Site icon CPI(M)

On Revolution: An Introspect

Amir Hayday Khan Cover

অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত

অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের ফসল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন মূল ধারার স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্ব কিছুমাত্র অস্বীকার না করেও একথা স্বীকার করে নিতে কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয়, এই ধারার বহির্ভূত অসংখ্য মানুষ দেশের মুক্তির জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন। এঁদের মধ্যে কিছু ব্যক্তিত্বকে এই দেশ স্মরণে রাখেনি কারণ তাঁদের রাজনৈতিক মত স্বাধীনতা উত্তর শাসকগোষ্ঠীর বিরোধী ছিল এবং সেই কারণেই তাঁদের নিয়ে চর্চার অভাব দেখা গেছে, অনেকে আবার বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছেন কারণ অখন্ড ভারতের পক্ষে সংগ্রাম করেও তাঁদের শেষ পর্যন্ত রয়ে যেতে হয়েছিল র‍্যাডক্লিফের টানা লাইনের অন্য পাড়ে। এর মধ্যে যে কোনো একটি কারণই একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর জনপ্রিয় ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। মর্মান্তিক ভাবে বিপ্লবী আমির হায়দার খানকে আমরা যে বিস্মৃত হয়েছি তার পশ্চাতে দুটি কারণই সক্রিয়। তিনি ছিলেন একজন বিপ্লবী কমিউনিস্ট এবং দেশভাগের পর তিনি থেকে যান পাকিস্তানে। তাঁর রাজনীতি ও স্বাধীনতার পর তাঁর পাকিস্তানে থেকে যাওয়া, দুইই এই মহান বিপ্লবীর স্মৃতি মুছে যাওয়ার জন্য দায়ী। এমনকি এই দেশের সাম্যবাদীদের মধ্যেও তাঁর নাম বিশেষ শোনা যায় না। এই সংক্ষিপ্ত রচনা যদি তাঁর সংগ্রাম কাহিনী থেকে যদি সামান্য হলেও ধুলো অপসারণ করে তাহলেই তা সার্থক হয়েছে বলে আমি মনে করব।  

বিপ্লবী আমির হায়দার খান জন্মগ্রহণ করেন ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায়। তাঁর প্রথমিক জীবন কেটেছিল কঠোর দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে। অল্প বয়সেই তিনি পিতাকে হারান। এরপর তাঁর পারিবারিক জীবন আর কখনো সুখী হয় নি। তাঁর মা পুনর্বিবাহ করেন। বিপিতার হাতে সব সময় লাঞ্ছিত হতেন হায়দার। উদয়াস্ত খাটুনি, দিন শেষে শক্ত রুটি আর লংকা দেওয়া ডাল আর পান থেকে চুন খসলে বিপিতার নির্মম প্রহার, হায়দারের কাছে এই জীবন অসহ্য ঠেকত। আরও বিরক্তিকর ছিল  কাঁহালিয়া-সাঁহালিয়া গ্রামের অলস কূপমণ্ডূক জীবন। গ্রামের লোকজনের কোনকিছুতেই আগ্রহ ছিল না, তাঁরা চাষাবাদ আর ধর্মকর্ম – এর বেশী কিছু বুঝতেন না। পড়াশোনায় হায়দারের ছিল প্রবল আগ্রহ, কিন্তু ইমাম আর হাফিজ-দের ধর্মশিক্ষা তাঁর পছন্দ হত না। সরকারী স্কুলে পড়াশোনা করবেন, তাঁর এইরকম স্বপ্নকে পরিবারের লোকেরা তো বটেই গ্রামের লোকেরাও হেসে উড়িয়ে দিত। গরিব চাষার ছেলে লেখাপড়া করে আর কি করবে, এই ছিল তাঁদের মনোভাব। বলাবাহুল্য, হায়দার এই পরিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ব্যাকুল ছিলেন। মাঝে মাঝেই পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু প্রত্যেকবারই অসফল হয়ে বাড়ি ফিরতে হত, কপালে জুটত প্রহার।

 অবশেষে একদিন চিরতরের মতো বাড়ির বাঁধন কাটালেন হায়দার। দরবেশদের সঙ্গে ভবঘুরে জীবন বেছে নিলেন কিছুদিন। কিন্তু তাতে মন টিকল না। তখনও সরকারী স্কুলে পড়ার স্বপ্ন পূর্ণ মাত্রাতেই তাঁর আছে। ঘুরতে ঘুরতে একদিন বেওয়াল শহরে এসে উপস্থিত হলেন তিনি। রাত্রে মসজিদে শুয়ে সকালে হাজির হলেন সরকারী স্কুলে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুনশি দেবীদত্ত হায়দারের পড়াশোনার আগ্রহ দেখে তাঁকে বিনা পয়সাতেই পড়ার অনুমতি দিলেন। মহা আনন্দে পড়াশোনা শুরু করলেন হায়দার। সকালে এসে ইস্কুল খোলেন, ঝাঁট দেন, কলসিতে জল ভরেন, ছাত্রদের সঙ্গে বসে পড়াশোনা করেন আবার ছুটির পর ইস্কুল বন্ধ করেন। মুনশিজির বারান্দার এককোনে তাঁর শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল, তাঁর ঘুড়ীটিকেও হায়দার দেখাশোনা করতেন। অল্পদিনের মধ্যে প্রধান শিক্ষক তাঁর এই মেধাবী ছাত্রটিকে ভীষণ পছন্দ করে ফেললেন। মুনশিজির স্ত্রী-ও হায়দারকে স্নেহ করতেন। কিন্তু এই সুখ বেশীদিন সইল না। হায়দারকে মুনশিজি বারণ করেছিলেন তাঁর ঘরে ঢুকতে। কিন্তু একদিন জ্বরে কাতর মুনশিজির জল দেওয়ার অনুরোধ হায়দার ফেলতে পারলেন না। জ্বরের ঘোর কাটতেই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে মুনশিজি হায়দারকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। ভীষণ আঘাত লাগল এই ঘটনায় কিশোর হায়দারের মনে। তিনি বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। জাতপাতের সংস্কারের লৌহ শৃঙ্খল হায়দারের কাছ থেকে কেড়ে নিল জীবনে প্রথম পাওয়া স্নেহের ছায়া।

হায়দার সারা ভারতকেই তাঁর ঘর বানিয়ে ফেললেন। ঘুরতে লাগলেন এই বিশাল উপমহাদেশের প্রদেশে প্রদেশে, সঞ্চয় করতে লাগলেন নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতা। কখনও কলকাতায় আফিম চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত দাদা শের আলির কল্যাণে পুলিশ, আইন ও অপরাধচক্র কি করে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তা দেখার সুযোগ হল তাঁর, কখনও বা স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য বোম্বের জাহাজের পুরোনো রঙ তোলার কাজের অভিজ্ঞতা হল। বিশেষ করে বোম্বে শহর হায়দারকে বদলে দিল। বারো ঘন্টা কাজ করে তিনি মজুরি পেতন ছয় আনা, ফুটপাতে শুয়ে রাত কাটাতে হত। এই ফুটপাতে থাকার সময় তার আলাপ হল আরও অনেক এই ধরণের ছেলের সঙ্গে যাদের আত্মীয়স্বজন নেই, বাড়িঘর নেই, নিজস্ব বলে কিছু নেই। তাদের রক্ষা করার কোনো মানবিক সমিতি নেই, কোনো শ্রম আইনের অস্তিত্ব নেই। শুধু দুটো স্বাধীনতা আছে – ক্ষুধার্ত থাকবার আর বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করার। হায়দার মনে মনে ভাবত – ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না, আর আমাদের জাহাজ সাফ করা ছেলেদের জীবনে সূর্য ওঠেই না।

এর কিছুদিন পর এমন একটি ঘটনা ঘটল, যার ফলে হায়দারের জীবন চিরকালের মতো গেল বদলে। একটি জাহাজের বালকভৃত্য হিসেবে কাজ পেয়ে যায় গেলেন তিনি। এই কজের সূত্রেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বাসরায় গিয়ে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হল হায়দারের। বাসরার পর আবার সাংহাই, তারপর কলম্বো, লন্ডন – ক্রমশ হায়দার পাকা নাবিক হয়ে উঠলেন। এখন তিনি আর বালকভৃত্য না, জাহাজের পাকা ফায়ারম্যান। এস. এস. সিটি অফ ম্যানিলা জাহাজে কাজ করার সময় হায়দারের প্রথম আন্দোলন পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা হল। যেহেতু তিনি দু-একটি ইংরেজি বাক্য বলতে পারতেন, তাই জাহাজের অত্যাচারী সারেং-কে অপসারণের আন্দোলনে নাবিকরা তাঁকেই এগিয়ে দিল। এই লড়াইয়ে হায়দারের নেতৃত্বে জয়যুক্ত হল নাবিকরা। ভালো সংগঠক হিসেবে তাঁর খ্যাতি এক ধাক্কায় অনেকটাই গেল বেড়ে।

 এরপর আরও কিছু দিন সমুদ্রে যাপন। আজ প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে হায়দারের স্বপ্নপুরণ হয়েছে। নিউ ইয়র্ক, ইয়াকোহামা, ভ্লাদিভোস্তক, ম্যানিলা, শাংহাই – আর তার কাছে শুধুই নাম নয়। কত ধরণের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে, কত লোকের কথা শোনার সুযোগ পাচ্ছেন তিনি। আর তার সঙ্গে সঙ্গে যখনই প্রয়োজন পড়ছে, সহ-নাবিকদের স্বার্থ রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন হায়দার। এই প্রতিবাদী স্বভাবের জন্যই জাহাজী দপ্তরে ক্রমে তাঁর কাজ পাওয়া মুশকিল হতে লাগল। কারণ ক্যাপ্টেনদের কাছে ততদিনে দাগী সংগঠক হিসেবে হায়দারের পরিচয় রটে গেছে। তবুও তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে, অভিজ্ঞ নাবিকদের চাহিদা চরমে। কোন না কোন জাহাজে কাজ জুটেই যেত। অবশেষে হায়দার নিউইয়র্কের নাবিকদের ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যপদ নিলেন। কাজের আর কমতি ছিল না। এই সময়ই তাঁর পরিচয় হল জোসেফ মিলকিন নামে এক আইরিশ অফিসারের সঙ্গে। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। হায়দার তাতে আনন্দ প্রকাশ করতেই মিলকিন ধরিয়ে দেন – ‘মহাযুদ্ধ শেষ হল বটে, তোমার যুদ্ধ কিন্তু চলতেই থাকল। স্বাধীনতা পাওয়া পর্যন্ত ক্রীতদাসের যুদ্ধ চলতেই থাকে।’ আইরিশ জাতীয়তাবাদী মিলকিন হায়দারকে প্রথম জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন, উৎসাহিত করলেন ইংরেজি শিখতে, বললেন ভারত কেন পরাধীন হয়েছে আর তার স্বাধীনতাই বা কিভাবে আসবে তার জন্য বই পড়তে হবে – ইংরেজি ছাড়া তা পড়বে কি করে ? জোসেফের কাছেই হায়দার প্রতিজ্ঞা করল মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তিনি শেষ রক্ত দিয়েও লড়াই করবেন।

সালটা ১৯১৯, হায়দার ইংরেজি শিখছেন আর মেরিন ইঙ্গিনিয়ারিং ডিগ্রির পাঠক্রমে ভর্তি হয়েছেন। এই সময়েই উইলকিন হায়দারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন আজম খান ও প্রেম সিং-এর। দুজনেই গদর দলের সদস্য। প্রেম সিং অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও বটে। কিছুদিনের মধ্যে হায়দারও তাঁদের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকতে লাগলেন। ১৯২০-তে গদর পার্টি ক্রমশ সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় পরিচালিত হতে শুরু করল। হায়দার প্রথম শুনলেন এক নতুন ধরণের সম্বোধন – ‘কমরেড’। গদর পার্টি তখন প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে তাদের মতাদর্শ প্রচারের চেষ্টা করছে। চীনের দায়িত্ব নিলেন হায়দার খান। শাংহাই ও হং কং-এ তাঁর কাজকর্ম অচিরেই ব্রিটিশ পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। যদিও বিনা প্রমাণে একদিন জেলে বন্দী করা ছাড়া হায়দারকে তারা হাতেনাতে কখনও ধরতে পারেনি। গদরের গুঞ্জন ক্রমশ স্থিমিত হয়ে এলে হায়দার খান আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানকার শ্রমিক আন্দোলনে যোগদান করলেন। যুদ্ধ ফেরত মার্কিন সৈনিকদের যথাযোগ্য সরকারী সহায়তার দাবীতে জঙ্গি আন্দোলন পরিচালনার অগ্রভাগে ছিলেন তিনি। রেলের ইঞ্জিন তৈরির কারখানায় একটা চাকরি নিলেন হায়দার। সেখানেই তিনি প্রথম কমিউনিস্ট মতবাদের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এলেন।

আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ। কাজ চলছে ওয়ার্কাস পার্টি নামে। কিছুদিন হায়দারকে পরখ করেই পার্টি নেতারা বুঝলেন, ইনি খাঁটি হীরে। ডেট্রয়েট আর নিউ ইয়র্কে পার্টির হয়ে কিছুদিন কাজ করার পর, হায়দার খবর পেলেন তাঁকে ‘Toilers of the East’-এর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হবে। সাতজন ছাত্র নির্বাচন করা হয়েছে। তিনি, কলকাতা থেকে আসা শামসুল হুদা ও গদর দলের আরও পাঁচজন সদস্য। আমেরিকার নাগরিকত্ব আর আরামের চাকরির মায়া ছেড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাড়ি দিলেন হায়দার। রাজনীতি, অর্থনীতি, ভুগোল, দর্শনের শিক্ষা দেওয়া হত তাঁদের। দেওয়া হয় অস্ত্র-প্রশিক্ষণও। ক্লাসে বক্তৃতা করতে আসতেন রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ – মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর কথা শুনতেন হায়দার। তাঁর মন ছটফট করত, কখন দেশে ফিরবেন, কখন এই অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগাবেন দেশমুক্তির উদ্দেশ্যে। অবশেষে ১৯২৮ নাগাদ সেই সুযোগ এল। আড়াই বছর মস্কোবাস শেষ করে হায়দার ও শামসুল হামবুর্গ হয়ে ভারতে পৌছলেন। হায়দার খান কার্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিলেন বোম্বে কে। তখন বোম্বের সুতোর মিল গুলোতে কমিউনিস্টদের সংগঠন ক্রমশ গড়ে উঠছে। হায়দার ব্র্যাডলে, ঘাটে, পূরণচাঁদ জোশীর মতো নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে নিলেন। একবার নিজের গ্রাম থেকে ঘুরে এসেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন কর্মসমুদ্রে।

তখন পার্টি সম্পূর্ণ নিজের খরচে চলছে। আর্থিক সংগতির একান্ত অভাব, একমাত্র ব্র্যাডলের খরচ ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টি বহন করত। এমতাবস্থায় প্রাথমিক ভাবে নিজের খরচ চালানোর উদ্দেশ্যে হায়দার যোগ দিলেন হিন্দুস্থান জেনারেল মোটর্স-এর গাড়ি তৈরির কারখানায়। কারখানার কাজ ও গিরিনি কামগার ইউনিয়নের কাজ চলতে লাগল সমানতালে। আলি মর্দানের সহায়তায় কমিনটার্নের সঙ্গে যাতে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় থাকে, তার জন্যও সচেষ্ট হলেন তিনি। এদিকে গাড়ি তৈরির কারখানাতেও ধীরে ধীরে শ্রমিক সংগঠন গড়ে তুলেছেন হায়দার। কমিউনিস্ট শ্রমিক সংগঠনের এই বৃদ্ধি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ও কারখানার মালিক শ্রেণী স্বভাবতঃই ভালো চোখে দেখেনি। তারা শ্রমিকদের শ্রেণী ঐক্যকে দূর্বল করার জন্য, নানা প্রকার সাম্প্রদায়িক গুজব ছড়াতে লাগল। অনেক চেষ্টা করেও কমিউনিস্টরা তা আটকাতে পারলেন না। দাঙ্গা লাগল বোম্বাইতে, এর মধ্যে দাঙ্গা থামাবার চেষ্টায় নিহত হলেন বেশ কিছু কমিউনিস্ট সংগঠক। এক ধাক্কায় কমিউনিস্ট আন্দোলন অনেকটা পিছিয়ে গেল। গাড়ি কারখানায় কমিউনিস্ট প্রভাব হায়দার খানের প্রচেষ্টায় অনেকাংশে অটুট থাকলেও, সুতো-শ্রমিকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প প্রবেশ তাদের একতা অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু কমিউনিস্ট নেতারা দমলেন না, তারা চেষ্টা করতে লাগলেন কি করে তাঁদের সংগঠনের আরও বিস্তার ঘটানো যায়। ১৯শে মার্চ ১৯২৯-এ প্যারেলে ইউনিয়ন অফিসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে একটি কেন্দ্রীয় সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এই মিটিং-এই হায়দারের সঙ্গে এক ঝকঝকে তরুণের আলাপ করিয়ে দিলেন ডঃ গঙ্গাধর অধিকারী। তরুণ সদ্য বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এ পাশ করেছেন। তাঁর নাম বি.টি. রনদিভে।

 সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট সংগঠন গড়ার জন্য রিপোর্ট কমিটিতে ছিলেন ঘাটে, শওকত ওসমানি, ডঃ অধিকারী ও হায়দার। কাজকর্ম চলছিল, কিন্তু এরই মধ্যে ভীষণ বিপদ এসে উপস্থিত হল। সমগ্র ভারত জুড়ে পুলিশ কমিউনিস্টদের ধড়পাকড় করতে শুরু করল। হায়দার ছদ্মবেশে ফ্রান্সেসকো ফার্নান্ডেজ নামে আত্মগোপন করলেন গোয়াতে। ইতিমধ্যে শুরু হল মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে গেল, এমতাবস্থায় কমিন্টার্নের সঙ্গে একবার যোগাযোগ করা ভীষণ প্রয়োজন। হায়দার পাড়ি দিলেন হামবুর্গ হয়ে লেনিনগ্রাদের উদ্দেশ্যে। গোপনে পার্টি চালানোর কৌশল, সাইক্লোস্টাইল মেশিন চালানো, টেলিগ্রাফে খবর পাঠানোর মতো আরেক দফা সাংগঠনিক শিক্ষা শেষে তিনি আবার ভারতে ফিরে এলেন। এর পর থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিনটার্নের মধ্যে প্রধান সংযোগরক্ষাকারীর ভূমিকা পালন করতে লাগলেন তিনি।  এই নতুন দায়িত্বের জন্যই দেশে ফিরে কিছুকাল কর্মজগতে ডুবে থাকার পর আবার তিনি পাড়ি দিলেন মস্কোয়। এই সময়ে কমিন্টার্নের কাজকর্ম করতে করতে হায়দারের আলাপ হল এক তরুণ চৈনিক যুবকের সঙ্গে। গ্রামে গিয়ে মাটির মূলে থেকে কিভাবে কাজ করতে হয় তা নিয়ে দুজনে অনেক আলোচনা করতেন। দুজনেই এশিয়ার মানুষ। দুজনেই গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে পরিচিত। দুজনেই ঔপনিবেশিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার কবল থেকে নিজের নিজের দেশকে মুক্ত করার সংগ্রাম চালাচ্ছেন। অচিরেই দুই যুবকের মধ্যে হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠল। এই যুবক ছিলেন ভবিষ্যতের গণপ্রজাতন্তী চীনের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা লিও শাও চি।

অবশেষে মস্কোয় কাজ শেষ হয়ে এল হায়দারের। তিনি নিজের দেশে আবার ফিরে গেলেন। পার্টি তাঁকে মাদ্রাজে সংগঠন নির্মাণে প্রেরণ করল। অজানা জায়গা, ভাষাও জানেন না, তাও হায়দার পূর্ণ উদ্যমে কাজ শুরু করলেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল দাদিভালু মুদালিয়র, জয়রাম-এর মতো কর্মীর। ব্রিটিশ বিরোধী পত্রিকা ছাপানো, পার্টির প্রচার, পাঠ চক্র আয়োজন সবেরই দায়িত্ব হায়দার খানের উপর।  শঙ্কর ছদ্মনামে, ব্রাহ্মণ সেজে পুলিশের চোখ এড়িয়ে গোপনে সংগঠন নির্মাণ করতে লাগলেন হায়দার। এমন নিপুণ ছিল তাঁর ছদ্মবেশ, পুলিশের দুঁদে গোয়েন্দারাও তাঁকে ধরতে অক্ষম হন। এই ছদ্মবেশের জন্য হায়দারকে তামিল ব্রাহ্মণের ছোঁয়াছুঁয়ি, আচার সব রপ্ত করতে হয়েছিল। এই সূত্রেই তিনি প্রথম বুঝতে পারলেন, শুধু শ্রেণী নয়, জাতিগত একটি সংঘাত – নিম্ন জাতির সঙ্গে উচ্চজাতির – দক্ষিণ ভারতে বর্তমান। তাঁর ধারণা তৈরি হল এই কাস্ট-এর প্রশ্নকে এড়িয়ে পার্টি সংগঠন হয় না। নিম্নবর্ণের মানুষদের তিনি আলদাভাবে সংগঠিত করতে লাগলেন। তার পাশাপাশি চলল মাদ্রাজের ট্রেড ইউনিয়নের কাজ।

এই সময়েই হায়দার এক গান্ধীবাদী নেতার কথা শুনলেন। তাঁর নাম পি. সুন্দরাইয়া। লবণ সত্যাগ্রহের সময় তিনি জেল খেটেছিলেন। তাঁর মতো বিদগ্ধ মানুষ খুব কমই আছেন। কমিউনিস্ট পার্টিতে তাঁকে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে সুন্দরাইয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন হায়দার এবং জয়রাম। সুন্দরাইয়া তখন কট্টর গান্ধীবাদী। তিনি তাঁদের কথা তাই খুব মন দিয়ে শুনলেন না। একটি পার্কে তিনি দুপুরে খেতে যেতেন, ওই খাওয়ার সময়টুকুই তিনি হায়দারকে কথা বলার জন্য দিয়েছিলেন। হায়দারই বলে যেতেন, সুন্দরাইয়া দুই একটা নিয়মরক্ষার মতো প্রতি প্রশ্ন ছাড়া কিছু বলতেন না। হায়দার উপলব্ধি করলেন অন্ততঃ বর্তমানে সুন্দরাইয়ার যে কট্টর গান্ধীবাদী মনোভাব এবং কমিউনিস্টদের তিনি যেরকম অবিশ্বাস করেন সেই পরিস্থিতিতে তাঁকে বেশি জোর করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তিনি  কিছুদিন প্রচেষ্টা করেই বিদায় নিলেন, যদিও তখনও সুন্দরাইয়ার মতো যুবককে একদিন দলে নিয়ে আসবেন এই আশা তিনি ত্যাগ করেননি।  

ইতিমধ্যে দেশে বিপ্লবী আন্দোলন এগিয়ে চলেছে। ১৯৩১ সালের ৩১শে মার্চ ভগৎ সিং, রাজগুরু আর সুকদেবের ফাঁসি হল। হায়দারের নেতৃত্বে মাদ্রাজের কমিউনিস্ট শ্রমিক সঙ্ঘ ঠিক করল তিনজন শহীদকে স্মরণ করে আর Trade-Dispute Act নিয়ে মূল আপত্তিগুলো তুলে ধরে তারা একটি পুস্তিকা প্রকাশ করবে। কিন্তু এই ইস্তাহার প্রকাশ করে বিলি করার সময় হায়দার ব্রিটিশ পুলিশের নজরে পড়লেন। ইতিমধ্যে হায়দারের শিষ্য কারখানার কর্মী পালান-এর পুলিশের অত্যাচারে মৃত্যু হল। পালান প্রাণ থাকতে পার্টির কোনো কথা ফাঁস করেননি। কিন্তু তল্লাসি চালিয়ে পুলিশের হাতে কিছু গোপন নথি আসে। তাতে মাদ্রাজে হায়দার খানের উপস্থিতি তারা জানতে পারে। সুহাসিনী চট্টোপাধ্যায় হায়দার খানের বোম্বের দিনগুলির বন্ধু ছিলেন। তিনি এই খবর জানতে পেরে হায়দারকে অর্থ পাঠিয়ে গা ঢাকা দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। মাদ্রাজের পার্টির প্রায় সবাই ধরা পড়লেন – বি কে নরসিংহম, পুরুষোত্তম, জয়রাম, নারায়ণ – আর হায়দার স্বয়ং। ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগে কারারুদ্ধ করা হল তাঁকে।

মাদ্রাজ জেলে রাজনৈতিক বন্দীর অধিকার পাওয়ার জন্য অনশন শুরু করলেন হায়দার। জবরদস্তি, নল লাগিয়ে দুধ খায়ানো সবই চলতে লাগল, কিন্তু অনশন হায়দাররা ছাড়লেন না। তারা অনেকসময় প্রচুর জল খেয়ে থাকতেন, যাতে জোর করে দুধ খাওয়ালেও তা বমি হয়ে বেরিয়ে যায়। কি অমানুষিক ছিল এই সংগ্রাম তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অবশেষে তাঁরা জয়যুক্ত হলেন, তাঁদের রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদা আর সকল সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হল। এই অনশনের সূত্র ধরেই হায়দারের প্রথম আলাপ হল আরেক প্রথম শ্রেণীর রাজবন্দীর সঙ্গে। তিনিও মাদ্রাজ জেলে বন্দী। তাঁর নাম সুভাষচন্দ্র বসু। কিছুদিনের মধ্যেই দুজনের পরিচয় সখ্যতায় পরিণত হল। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে হায়দার ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতেন। দেশ নিয়ে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে, স্বাধীনতা নিয়ে, সাম্যবাদ নিয়ে। আবার বিতর্কও হত। সুভাষ সাম্যবাদী ভাবনায় বিশ্বাস করলেও, কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি সব সময় সদয় থাকতেন না। অন্যদিকে হায়দার খানও সুভাষের ভাবনা বা নীতির সর্বদা সমর্থন করতেন না। কিন্তু একে অপরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ছিল।

এরই মধ্যে হায়দারকে সালেম সেন্ট্রাল জেলে বদলি করা হল। অবশেষে ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে হায়দার খান মুক্তি পেলেন। তাঁর জন্য একটি চমক অপেক্ষা করছিল। তাঁকে জেল থেকে মুক্তির পর যারা অভ্যর্থনা করতে এলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন সুন্দরাইয়াও। তরুণ প্রাক্তন গান্ধীবাদী নেতা হাত ঝাঁকিয়ে জানালেন, তিনিও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছেন।  আবার কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপ দিলেন হায়দার। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আবার গ্রেপ্তার হলেন C.I.D-এর হাতে। তাঁকে রাখা হল মাদ্রাজ সেন্ট্রাল জেলে। কিছুদিন পরেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন হায়দার। জেলের ডাক্তার মেজর ম্যাক্রাবিট তাঁর পূর্বপরিচিত। তিনি হায়দারকে পরীক্ষা করার সময় বললেন – ‘স্বাস্থ্য যদি পুনরুদ্ধার করতে হয়, আপনি জেল থেকে বেরিয়ে এইসব রাজনীতি ছেড়ে একটা বিয়ে করুন।’ হায়দার হেসে জবাব দিলেন – ‘বিবাহ তো আমার হয়ে গেছে ডাক্তারবাবু। আমার দেশই আমার স্ত্রী।’

 সুস্থ হয়ে উঠলেন হায়দার। কিন্তু প্রচুর চাপ স্বত্তেও আর রাজনীতি করবেন না এই কড়ারে মুক্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। দীর্ঘ ছয় বছর পর অবশেষে জেল থেকে মুক্তি পেলেন তিনি। ততদিনে রাজনৈতিক পট অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সারা দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির ফলে মুসলিম লীগের শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে, যদিও কংগ্রেসই তখনও দেশের সব থেকে জনপ্রিয় সংগঠন, ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইন অনুসারে হওয়া প্রাদেশিক নির্বাচনেই তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। বদল এসেছে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মপদ্ধতিরও। পি.সি. জোশীর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি তখন যুক্তফ্রন্টের নীতি নিয়ে, কংগ্রেসের মধ্যে থেকে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে এর সমর্থক না হলেও পার্টির সব শৃঙ্খলা মানা কর্মীর মতোই হায়দার তা মেনে নিলেন। ১৯৩৯ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের বোম্বাই রাজ্য কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি নির্বাচিত হলেন তিনি। কিন্তু এই ন্যাশনাল ফ্রন্টের রাজনীতি বেশীদিন চলল না। জনযুদ্ধ নীতিকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস-কমিউনিস্ট বিভাজন স্পষ্ট হয়ে গেল। একাধারে জনযুদ্ধ নীতি নিয়ে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সামিল না হওয়া, অন্যদিকে লীগের উস্কানি আর সাম্প্রদায়িক বিভাজন – হায়দারের চোখের সামনে বোম্বাইয়ের কমিউনিস্ট সংগঠন দূর্বল হয়ে যাতে লাগল। কংগ্রেস আর লীগ – দুই পক্ষই কমিউনিস্টদের পিষে দিতে উদ্যত হল – পার্টি অফিসে হামলা শুরু হল – নেতারা আক্রান্ত হলেন। তাও হায়দাররা লড়ে যেতে লাগলেন। যুদ্ধ শেষে ফিরে আসা সৈনিকদের হায়দার, মিরদাদ ও সুহাসিনী চট্টোপাধ্যায়ের মতো কমিউনিস্ট সদস্যরা সংগঠিত করতে উদ্যোগী হলেন। তাঁরা আরও জঙ্গী আন্দোলনের পথে যেতে পার্টিকে চাপ দিলেও, কমিউনিস্ট পার্টি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথেই গেল। হায়দার হতাশ হলেও পার্টির সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন। কিন্তু বেশীদিন তাঁর হতাশা থাকল না। ১৯৪৬ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারী বোম্বাই-এ নৌবিদ্রোহের দামামা বেজে উঠল। বোম্বাই-এ বিদ্রহের সমর্থনে শ্রমিকদের  সংগঠিত করায় ভূমিকা নিলেন হায়দার। পার্টিকে বারবার আহ্বান করলেন আরও বৈপ্লবিক অবস্থানের জন্য। কিন্তু পার্টি রাজি হল না। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি মেনে হায়দার পার্টির সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হলেন। হায়দার ক্রমশ উপলব্ধি করলেন, শহর কেন্দ্রিক রাজনীতি দিয়ে মূলগত পরিবর্তন আনা যাবে না। গ্রামে ফিরতে হবে। নিজের গ্রাম দিয়েই শুরু করলেন হায়দার।

বোম্বের কমরেডদের থেকে অশ্রুসজল বিদায় নিয়ে গ্রামে এসে একটা স্কুল খুললেন। পাঞ্জাবের পার্টির সঙ্গে নতুন উদ্যোমে কাজ করতে লাগলেন। কিন্তু বেশিদিন এই অবস্থা রইল না। মুসলিম লীগের প্ররোচনায় সাম্প্রদায়িক সংঘাত ক্রমে বাড়তে লাগল। কমরেডদের সঙ্গে আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন হায়দার, সংখ্যালঘু হিন্দু ও শিখদের রক্ষা করতে। কিন্তু এই নারকীয় পরিস্থিতি, যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের শবের উপর দিয়ে ক্ষমতার জন্য এক দেশ ভেঙে দুই হল – তাকে এড়াতে পারলেন না হায়দার। ১৯৪৭-এর জুন মাসে ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের দাবি মেনে নিল। রাওয়ালপিন্ডিতে কমরেড ভি ডি চোপরার কাছ থেকে পার্টি অফিসের দায়িত্ব বুঝে নিলেন হায়দার। অ-মুসলিম কমরেডদের সকলকে যখন ট্রেনে তুলে দিতে স্টেশনে এলেন দুই তরফের চোখেই জল। এই বিভাজন তাঁরা কেউ চাননি। বিষণ্ণ মনে পার্টি অফিসে ফিরে এলেন হায়দার। উড়তে থাকা লাল পতাকার দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন। এই পতাকার জন্যই তিনি ট্রেন না ধরে রয়ে গেছেন এদেশে। তাঁকে অনেকেই বলেছিল ভারতে চলে যেতে। তিনি লীগের চোখে দাগী লোক। পাকিস্তানে থাকলে তাঁর কপালে প্রচুর দুর্ভোগ আছে তা তিনি জানেন। কিন্তু সবাই যদি চলে যায়, এই পতাকা খাড়া রাখবে কে ? মির্জা ইব্রাহিম আর ফিরোজউদ্দিন মনসুরের সঙ্গে এই কঠিন কাজেই হাত দিলেন আমীর হায়দার খান। রেলশ্রমিকদের মধ্যে, ছাত্রদের মধ্যে, আগত শরণার্থীদের মধ্যে ক্রমশ বৈপ্লবিক চেতনা বোনার কঠিন কাজে মনোনিবেশ করে তাঁরা।

কিন্তু সংগঠনের উল্কাবেগে বৃদ্ধি লীগ বরদাস্ত করতে রাজি ছিল না। তারা কারাগারে বন্দী করে হায়দারকে। মুক্তির শর্ত দেওয়া হয়, তাঁকে ভারতে ফিরে যেতে হবে। হায়দার রাজি হলেন না। জেল থেকে কিছুদিন পরে মুক্ত হলেন। কিন্তু লীগ তার এই চরম শত্রুকে বেশীদিন বাইরে রাখতে রাজি ছিল না। আবার গ্রেপ্তার হলেন হায়দার। ১৯৫১ সালে শুরু হল বিখ্যাত রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা। কাঠগোড়ায় দাঁড়ালেন সাজ্জাদ জাহির, ফয়েজ আহমেদ, আইয়ুব মির্জা এবং আমির হায়দার খান। পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করা হল – হায়দার খানকে তাঁর নিজের গ্রামেই গৃহবন্দী করা হল। এরপরেও হায়দার খান হাল ছাড়েননি। যখনই সুযোগ পেয়েছেন, সংগঠন বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। আয়ুব খানের সামরিক শাসনে তাঁকে আবারও কারাবাস করতে হয়েছে। আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির সমর্থনেও তাঁকে দেখা গেছে। কিন্তু পাকিস্তানে জিয়াউল হকের সেনাশাসন কায়েম হওয়ার পর হায়দারের মন ভেঙে গেল। দেশে সমাজতান্ত্রিক ভাবনার শেষ চিহ্নও মুছে ফেলতে উদ্যোগী হলেন জিয়া। চৌরাস্তার মড়ে গজিয়ে উঠল ফাঁসিকাঠ। ধর্মান্ধতার হাওয়া বইতে লাগল সারা দেশে। হায়দার তাঁর ইস্কুলের উন্নতির জন্য সমস্ত মনপ্রাণ সমর্পণ করলেন এই আশায় প্রশ্ন করতে পারে এমন মন যদি তিনি নির্মান করতে পারেন। ইস্কুল তাঁর মন মতো চললেও দেশ আর কোনোদিন তাঁর মনের মতো চলবে না, এ তিনি বুঝে গিয়েছিলেন। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের জন্যও একটা স্কুল বানালেন তিনি। হাতে কলমে বিজ্ঞান শেখানোর জন্য গড়ে তুললেন একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার।

১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে একদিন চলতি বাসে উঠতে গিয়ে মাথায় চোট লাগল হায়দারের। অবস্থা ক্রমে খারাপ হতে লাগল। ২৬শে ডিসেম্বর সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমির হায়দার খানের বর্ণময় বিপ্লবী জীবনের সূর্যও অস্ত গেল। মানুষের ভিড় উপচে পড়ল শেষ যাত্রায় সবার প্রিয় ‘দাদা’-কে দেখার জন্য। আমির হায়দার খান চলে গেলেন বটে, কিন্তু রেখে গেলেন এক বিজ্ঞানমনস্ক সমাজের স্বপ্নের, ধর্মান্ধতা মুক্ত সাম্যের উপমহাদেশ গড়ার স্বপ্নের উত্তরাধিকার। পাকিস্তানে আমির হায়দার খানকে স্বভাবতঃই কেউ স্মরণে রাখেনি। খান আবদুল গফফর খানের মতো তিনিও পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই গণ্য হয়েছেন দেশদ্রোহী হিসেবে। ‘ভারতের চর’ এই তকমা বারে বারে তাঁর গায়ে সেঁটে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছে। আজকের ভারতও সেভাবে আর মনে রাখেনি তাকে, যে দেশের সঙ্গে বিবাহ হয়ে গেছে বলে হায়দার স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। সেই সময়ে তাঁর যথেষ্ট আর্থিক স্বচ্ছলতাও হয়েছিল। আরামের জীবন ত্যাগ করে প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রশিক্ষণ নিয়ে সেখান থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন কেন ? কারণ সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল মুক্ত করে সাম্যের স্বদেশ গড়ার স্বপ্ন ছিল দুই চোখে। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য ব্যক্তিজীবনে একের পর এক আত্মত্যাগ করে গেছেন। স্বপ্নকে হৃদয়ে লালন করেই ব্রিটিশ কারাগারের নির্মম অত্যাচার হাসিমুখে সহ্য করেছিলেন। এর কোনো প্রতিদান যদিও চাননি, তবুও এ অত্যন্ত লজ্জার বিষয় যে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে আরাকান এবং কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত বিস্তৃত যে অবিভক্ত উপমহাদেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য তাঁর এই প্রচেষ্টা ছিল, তার একটি দেশও এই মহান বিপ্লবীকে কোনো প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। পাকিস্তানে আয়ুব মির্জা হায়দারের একটি জীবনী লেখেন, পরে ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের নেতা মহম্মদ আমীন বাংলায় একটি বই লিখে জনগণকে এই মহান বিপ্লবীর জীবন ও কর্মকাণ্ডের খবর দেন। স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে কমিউনিস্ট হিসেবে এবং ভারতীয় হিসেবেও আমাদেরই দায়িত্ব কমরেড আমির হায়দার খান ও তাঁর বিপ্লবী জীবনকে যথাযথ শ্রদ্ধায় স্মরণ করা। তাঁর কাছে আমাদের যে বিপুল ঋণ, তারই থেকে সামান্য হলেও মুক্ত হতে সচেষ্ট থাকা।

ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া এবং পিপলস ডেমোক্রেসি সুত্রে

Spread the word