Site icon CPI(M)

Lenin & Marx Memorial Library in London: An Experience

Marx Memorial Library Cover

ময়ূখ বিশ্বাস

এককালে ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ ওরফে লেনিনের ৩৫ ক্লার্কেনওয়েল স্ট্রিটের অফিস। মূলত ‘পেট্রিয়টিক ক্লাব’-এর ঠেক। পড়াশোনা করে ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে ফেরার পথে লেনিন সাহেব ইস্ক্রা-র কাজ করার জন্য থামতেন এখানে।

এখান থেকেই ‘ইস্ক্রা’ গোপন রাস্তা ধরে পৌঁছে যেত জার রাজত্বের নানা প্রান্তে। বাকু থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ, প্রশান্ত মহাসাগর থেকে আটলান্টিক- বিশাল জার সাম্রাজ্যের কোনায় কোনায় বিপ্লবী নিয়মশৃঙ্খলার সাথে গোপনে পৌঁছাতো বিপ্লবের ইস্তাহার। কিভাবে, কোনপথে এইগুলো পাচার হতো তা একটি ম্যাপের মাধ্যমে বর্ণনা করা আছে মার্ক্স মেমোরিয়াল লাইব্রেরীতে। গোপনে পত্রিকা পাঠানো, অসম্ভব অর্থ খরচ করে পত্রিকা পরিবহন করা সত্বেও ইস্ক্রা ছিল বলশেভিক পার্টির একমাত্র প্রচার মাধ্যম। সমাজ পরিবর্তনের সংগঠন হিসেবে পার্টি এবং পার্টির কথা, শ্রমিকদের কথা প্রচারের একমাত্র মাধ্যম হিসাবে ইস্ক্রা ছিল লেনিনের ধ্যান জ্ঞান। এই ইস্ক্রা হয়তো সফল হয়নি, কিন্তু এটা বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ ছড়ানোর কাজটা করেছিলো। তা পরবর্তীতে সারা পৃথিবীর লুঠেরাদের ত্রাস হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো। মুক্তির বাণী ছড়িয়ে পড়েছিলো বস্তি, কলোনিতে, শ্রমিক মহল্লা, কারখানার গেট, শ্রমিকের হাতুড়িতে, কৃষকের কাস্তেতে, ক্ষেতে, খামারে, স্কুলে, কলেজে, লাল পতাকায় এবং অবশ্যই খেটে খাওয়ার সাহিত্যে। ১৯০২ সালের এপ্রিল থেকে ১৯০৩-এর মে পর্যন্ত লন্ডনের এই বাড়ি থেকেই লেনিন ‘ইস্ত্রা’ সংবাদপত্রের ১৭টি সংখ্যা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছিলেন। এখানেই নির্বাসন কালে করেছেন বহু মিটিং।

লেনিনের ঘর
সেই বিখ্যাত ম্যুরাল

জারের রোষানলে পড়ে লেনিন ও তাঁর স্ত্রী নাদেজদা ক্রুপস্কায়া বিশ শতকের শুরু থেকেই দেশছাড়া ছিলেন। জারের পুলিশকে এড়াতে জেনেভা, মিউনিখে অজ্ঞাতবাসে থাকতে হয়েছে। এই বিপ্লবীদের খোঁজ চলেছিলো গোটা ইউরোপ জুড়ে। ব্যাভেরিয়া প্রদেশের পুলিশও পিছনে পড়ে লেনিনদের। ফলে ১৯০২-এর এপ্রিলে মিউনিখ থেকে লন্ডনে এসে পৌঁছন লেনিনরা। ছদ্মনামে। লেনিনের মূল উদ্দেশ্য তখন রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি-র মুখপত্র ‘ইসক্রা’-র প্রকাশ ও মুদ্রণ চালু রাখা। চেরিং ক্রস স্টেশনে এক বন্ধু— নিকোলাই আলেক্সিভ লেনিন-দম্পতির সঙ্গে দেখা করেন। ৩০ হলফোর্ড স্কোয়্যারে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হয়। এমা লুইস ইউ নামে এক ভদ্র মহিলার বাড়িতে ১ পাউন্ডের বিনিময়ে ভাড়ায় থাকতেন লেনিন, ক্রুপস্কায়া ও ক্রুপস্কায়ার মা। এই বাড়িতে থাকাকালীনই লেনিন ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরির বইপত্র ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছিলেন। ১৯০২-এর এপ্রিলে তিনি জেকব রিখটার নাম ব্যবহার করে একটি ‘রিডার্স টিকিট’-এর অনুমতি চান। জারের গুপ্তচরদের চোখ এড়াতেই এই নাম। আবেদনপত্রে লেখা ছিল, তিনি রাশিয়া থেকে এসেছেন ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ে পড়াশোনার জন্য। আবেদন গৃহীত হয়েছিল। ২৯ এপ্রিল তাঁকে একটি টিকিট দেওয়া হয়, নম্বর A72453। এখনো ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে হাতে-লেখা সেই আবেদনপত্রটি রাখা আছে। আবার মার্ক্স মেমোরিয়াল লাইব্রেরীতেও লেনিনের পড়ার ঘর আছে। সেই ঘর থেকেই ইস্ক্রার কাজ দেখভাল করতেন তিনি। ঘরটা ঢুকলেই গোটা শরীরে শিহরণ খেলে যায়। লেনিন পরবর্তীকালে ১৬ পিয়েরশি সার্কাসে ওঠেন। লেনিনের স্মৃতি বিজরিত বাড়িগুলোতে নীল ফলক বসিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। এরা শত্রু, মিত্র সব বিশিষ্টদের স্মৃতি বিজরিত স্থানেই এটা বসায়।

লন্ডনে টানাটানির সংসারে প্রত্যেকটা জিনিস নিয়ম করে গুছিয়ে চলতেন লেনিন দম্পতি। ছয় পেনি খরচ করে লেনিন ও ক্রুপস্কায়া বাসে করে প্রিমোর্স হিলে বা স্পিকার্স কর্ণারে যেতেন বক্তৃতা শুনতে এবং ইংরেজিতে নিজেদের সড়গড় করতে। ইস্ট এন্ডে যেতেন বিভিন্ন বিতর্ক সভায়। ইংরেজ পুঁজিপতিদের চরিত্র, তাদের ধনতান্ত্রিক সমাজের নির্মম রূপ ও ইংল্যান্ডের শ্রেণীবিভক্ত সমাজের প্রতি লেনিন ঘেন্না তীব্র পোষণ করেন। লেনিনরা সমাজের প্রতিটা অংশ পায়ে হেঁটে দেখতেন, সমাজের অংশের অংশ হতেন। সমাজকে বুঝতে। খারাপ গুলো ত্যাগ করে, ভালো কিছু গ্রহণ করতে। তাই তো নিয়ম করে লন্ডনের বিখ্যাত থিয়েটারে যেতেন। আবার পাবে বন্ধুদের সাথে মজা করাতেও খামতি ছিলো না। ১৯০৩ সালে আবার গোপনে আসেন লন্ডন লেনিন। এখানেই রাশিয়ান সোস্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস হয়। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে শুরু হলেও রাশিয়ান দূতাবাসের চাপে ধরপাকড় শুরু করে বেলজিয়ান পুলিশ। তাই প্রতিনিধিতা গোপনে লন্ডনে পালিয়ে আসেন। সেবারেই বিখ্যাত বলশেভিক ও মেনশেভিক বিভাজন হয়। কিন্তু মিটিংটি এতো গোপনীয়তার সাথে হয়েছিলো, এখনো সঠিক করে কোন স্থানে হয়েছিলো, বলা যায় না। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে মনে করা হয় সারলেট স্ট্রীট, টটেনহ্যাম রোড ও গ্রে ইন রোডের বিভিন্ন পাব ও ক্লাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পার্টি কংগ্রেস হয়!

১৯০৫ এর ব্যর্থ বিপ্লবের পর প্রচুর রুশ ভীড় করে আসে বিলেতে। মূলত সবাই রাজনৈতিক কারণে আসেন। তাই রাশিয়ান সোস্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসও হয় লন্ডনে। সেবারেও আসেন লেনিন। জার রাজত্বে লন্ডনে গোপনে এসেছিলেন স্ট্যালিনও। এখন যা মার্ক্স মেমোরিয়াল লাইব্রেরী, সে বাড়িতে এসেছেন ডিমিট্রিভ ও। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ ও ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের বহু ইতিহাস এখানে সংরক্ষিত আছে। এখানকার প্রাচীন পোস্টার, প্লেটগুলো বহু ইতিহাসের সাক্ষী।

১৮৮৩-র ১৪ মার্চ লন্ডনে মার্ক্সের মৃত্যুর ৫০ বছর স্মরণে ১৯৩৩ সালে এখানে মার্ক্স মেমোরিয়াল লাইব্রেরী ও ওয়ার্কার্স স্কুল তৈরী হয় মার্ক্সবাদ চর্চার উদ্দেশ্যে। এর আগে ওয়েলস চ্যারিটি স্কুল হিসাবে চলত ১৭৩৭ সাল থেকে। ১৮৭২ সালে র‍্যাডিকাল লন্ডন প্যাট্রিয়টিক সোসাইটি নামে ও পরবর্তীতে ১৮৯৩ থেকে টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি প্রেস ছিলো। এই প্রেস থেকেই ছাপতো ইস্ক্রা।

ইস্ক্রা

সেই ম্যাপ

বর্তমানে এই মার্ক্স মেমোরিয়াল লাইব্রেরীটি কমিউনিস্ট, অন্যান্য ধারার নানা বাম আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনের ওপর গবেষণা করার জন্যে বিখ্যাত। এর প্রতিটা কোনায় ইতিহাস। এখানে আছে মার্ক্সের ব্যবহৃত সামগ্রী। লেনিন-সম্পাদিত ইসক্রার নানা কপি। আছে ‘দাস ক্যাপিটাল’-এর প্রথম সংস্করণ, মার্ক্সের অন্যান্য বই, অন্য হাজার হাজার বই। যে ঘরটিতে বসে লেনিন ইসক্রা সম্পাদনা করতেন, সেটি রাখা আছে অতীতের মতোই। আছে ডিমিট্রিভের ব্যবহৃত নানা জিনিস। জওহরলাল নেহেরুর সই করা ক্যাপিটাল।

এখানে ১৯৩৫ সালের একটি বিখ্যাত ম্যুরাল রাখা আছে লাইব্রেরিতে। তাতে দেখা যাচ্ছে খালি গায়ের এক শ্রমজীবী মানুষকে, তাঁকে ঘিরে আছেন লেনিন, মার্ক্স, এঙ্গেলস। শ্রমিক মানুষটি শেকল ভাঙছেন, কাঁপিয়ে দিচ্ছেন সমগ্র পৃথিবী, আর ভেঙে পড়া শোষণের প্রতিষ্ঠানগুলোর তলায় চাপা পড়ে মরছে পুঁজিবাদীরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই বাড়িতে নাৎসি বোমা পড়লেও এই ম্যুরালটি রক্ষা পায়। লাইব্রেরিটিতে এখন লেনিনের বেশ কতকগুলি আবক্ষ মূর্তি রাখা আছে। এখানে বক্তৃতা করে গেছেন জ্যোতি বসু। কয়েকদিন আগেও এখানে এসে বক্তৃতা দিয়েছেন সীতারাম ইয়েচুরি। উত্তর লন্ডনের হাইগেট কবরস্থানে কার্ল মার্ক্সের মূর্তি ও সমাধির রক্ষণাবেক্ষণের ভারও এই মার্কস মেমোরিয়াল লাইব্রেরির উপরেই। প্রতি বছর তা দেখতে ভিড় জমান হাজার হাজার মানুষ।

নিঃসন্দেহে জায়গাটা ‘বিপ্লবের মিউজিয়াম’।

Spread the word