ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৯)
কৃষ্ণপ্রসন্ন সেনের সঙ্গে শশধর তর্কচূড়ামণি সম্পর্কটি কৃষ্ণপ্রসন্নের সংগঠনের কিছু আভ্যন্তরীণ স্বার্থ ও তাঁর ব্যক্তিত্বের সংঘাত জনিত কারনে ক্রমশ তলানিতে এসে ঠেকে ।এই পর্বে ধীরে ধীরে শশধর তর্কচূড়ামণি সঙ্গে বর্ধমানের ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্রের সাথে পরিচয় হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে শশধর তর্কচূড়ামণি পরিচয় এবং শশধর চূড়ামণি র দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার-প্রসারের স্বার্থে প্রাথমিকভাবে বঙ্কিমচন্দ্র যে সমস্ত উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেগুলি যেমন একদিকে বাংলার সামাজিক ইতিহাস আলোচনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তেমনি ই গোটা ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে হিন্দু পুনরুত্থানবাদ কে আশ্রয় করে, রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রেও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ।
শশধর তর্কচূড়ামণি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বাংলায় ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের সাহায্য চেয়েছিলেন। এ বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের বাসভবনে শশধর তর্কচূড়ামণি সাথে বঙ্কিমের একটি অন্তরঙ্গ বৈঠক পর্যন্ত হয়েছিল সেই বৈঠকে, সেই সময়ের বাংলার সমাজ জীবনের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। সেই বৈঠক থেকেই অ্যালবার্ট হলে শশধরের একটি বক্তৃতার আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বক্তৃতার প্রথম দিনে বঙ্কিমচন্দ্র কেবল সেখানে উপস্থিত ই থাকেন নি। শশধরের বক্তৃতা মঞ্চে তিনি সভাপতির আসন অলংকৃত করেছিলেন। তারপরও দু-একদিন শশধরের বক্তৃতা শুনতে বঙ্কিম গিয়েছিলেন। বেশ কয়েকদিন পর পর শশধরের বক্তৃতা শোনার পর ,তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে নিজের চিন্তাভাবনার একটা মৌলিক পার্থক্য বঙ্কিম অনুভব করেন ।
এ প্রসঙ্গে ‘প্রচার’ পত্রিকায় ১২৯১ বঙ্গাব্দে’ হিন্দুধর্ম’ নামক একটি প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র স্পষ্টভাষায় লিখছেন ;
“পন্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণি মহাশয় যে হিন্দু ধর্ম প্রচার করিতে নিযুক্ত, তাহা আমাদের মতে কখনোই টিকিবে না, এবং তাহার যত্ন সফল হইবে না ।”
প্রাচীন ভারতের যাবতীয় বিষয়াবলীর ভিতরে হিন্দু ধর্মের একটা মহত্ব স্থাপন করে ,সবকিছুর একটি অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে ,ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে, শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের যে প্রবণতা শশধর তর্কচূড়ামণির ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছিল, যুক্তিবাদী বঙ্কিম হিন্দুধর্মের রীতিনীতি প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল হয়েও, প্রাচীনত্বের গায়ে হিন্দুধর্মের সার্বিক লেবেল সেঁটে দেওয়ার ব্যাপারটিকে কিন্তু কখনোই সমর্থন করতে পারেননি। বঙ্কিম নিজে শশধরের সঙ্গে খানিকটা দূরত্ব তৈরি করলেও, তাঁর অনুগামীরা এবং বঙ্কিম যেহেতু একদা শশধর কে সমাজে পরিচিত করে দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তার সূত্র ধরে তৎকালীন বঙ্গসমাজের বেশ কিছু উপরতলার মানুষের সাহচর্য ,সমর্থন শশধর তর্কচূড়ামণি পেয়ে যান ।
শশধর তর্কচূড়ামণি উদ্যোগে ভূধর চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় একসময় ‘বেদব্যাস’ বলে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে ।এই পত্রিকাতে ১২৯৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবেই লেখা হয়;
” হিন্দুর চোক্ষে রাজনীতির ফলাফল বিচার হইবে।”
প্রচলিত হিন্দু ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির যোগসূত্র স্থাপনের ভেতর দিয়ে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের এই যে প্রবণতা উনিশ শতকককের বাংলায় শুরু হলো, সেটি কিন্তু পরবর্তীকালে বাংলা কে ছাপিয়ে, গোটা ভারতের প্রেক্ষিতে, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের আঙ্গিকের ভেতর দিয়ে, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত রাজনৈতিক চর্চার একটি ভিত্তিভূমির প্রতিষ্ঠা বলে উল্লেখ করতে হয়। এই প্রচেষ্টাকে পরবর্তীকালে নানা ধরনের ধর্মীয় গৌরবের লেবেল সেঁটে, আরএসএস তাদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে ।
শশধর তর্কচূড়ামণি যেভাবে উনিশ শতকের শেষ দিকে হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন তান্ত্রিকতা সর্বস্ব আচার বিচারের পেছনে, তাঁর স্বকোল্পিত দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিজ্ঞানের দোহাই দিতে শুরু করেন, সেটিকে কিন্তু পরবর্তীকালে আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা রা , পরবর্তীকালে যারা আরএসএস কে পরিচালনা করেছেন, আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিভিন্ন পর্যায়ে তৈরি করেছেন , আজ সেইসব কাজ গুলি করে চলেছেন, তারাই আরো নগ্নভাবে সমাজের বুকে শুরু করেছেন ধর্মের গায়ে বিজ্ঞানের লেবেল সাঁটার কাজটি।
কালিবর বেদান্তবাগীশ, চন্দ্রকান্ত ন্যায়ালঙ্কার , সত্যব্রত সামশ্রমী, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রজনীকান্ত গুপ্ত, চন্দ্রশেখর বসু ,বীরেশ্বর পাঁড়ে, নীলকন্ঠ মজুমদার প্রমূখ রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের প্রতিনিধিরা সেইসময় শশধর তর্কচূড়ামণি উগ্র সমর্থক হিসেবে হিন্দু পুনরুত্থানবাদের চিন্তাভাবনাকে প্রচারের লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করেছিলেন ,যেটি পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িকতা বিভিন্ন পর্যায় হিসেবে বাংলা তথা গোটা ভারতবর্ষে প্রচার লাভ করেছে।
যে সত্যব্রত সামশ্রমী , শশধর তর্কচূড়ামণি র সহযোগী ছিলেন, সেই ব্যক্তিটিই কিন্তু পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আচার্য শহীদুল্লাহকে বেদ পড়াতে অস্বীকার করেছিলেন। জন্মসূত্রে কোনো মুসলমানের বেদ পরবার অধিকার নেই– এই যুক্তি দিয়ে তিনি আচার্য শহীদুল্লাহকে বেদ পড়াতে অস্বীকার করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নিজে বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করে কোনোরকম সুষ্ঠু সমাধান সূত্র বের করতে পারেননি। সত্যব্রত কে তিনি শহীদুল্লাহকে বেদ পড়ানোর অনুরোধ জানালে ,উপাচার্যের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে সত্যব্রত চাকরি ছেড়ে দেওয়ার হুমকি পর্যন্ত স্যার আশুতোষের মুখের উপরে দিয়েছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্র যেমন ‘কমলাকান্ত’ চরিত্রের ভেতর দিয়ে সামাজিক সমস্যাবলী র বিভিন্ন দিক নানা রকম বিদূষণের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপিত করেছিলেন, তেমনি ই শশধর তর্কচূড়ামণি ‘ভোলা পাগলা’ নামক একটি চরিত্র তৈরি করে ,দেবতাদের সঙ্গে কাল্পনিক কথোপকথনেল ভেতর দিয়ে, তান্ত্রিক আচার সর্বস্ব হিন্দু ধর্মের রীতিনীতি, যেগুলি পরবর্তীকালে হিন্দু সমাজের রীতি নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে, সে সব গুলির পেছনে ,তার সকল দৃষ্টি ভঙ্গি অনুযায়ী নানা ধরণের কল্পিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করেছিলেন।
‘ প্রচার ‘ পত্রিকায় ১২৯১ বঙ্গাব্দ ১৪ ই শ্রাবণ সংখ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র লিখছেন;
সম্প্রতি সুশিক্ষিত বাঙ্গালীদিগের মধ্যে হিন্দু ধর্মের আলোচনা দেখা যাইতেছে ।অনেকে ই মনে করেন যে, আমরা হিন্দু ধর্মের প্রতি ভক্তিমান হইতেছি। যদি একথা সত্য হয় ,তবে আহ্লাদের বিষয় বটে ।জাতীয় ধর্মের পুনর্জীবন ব্যতীত ভারতবর্ষের মঙ্গল নাই। ইহা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।”
এর বেশ কিছুকাল আগে ১২৮৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যা ,’ বঙ্গদর্শনে’ বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন;
” অতএব মনোবৃত্তি যে অবস্থায় পরিণত হইলে পূণ্যকর্ম তাহার স্বাভাবিক ফলস্বরূপ স্বতঃ নিষ্পাদিত হইতে পারে ,পরলোক থাকিলে, তাহাই পরলোকে শুভদায়ক বলিলে কথা গ্রাহ্য করা যাইতে পারে। পরলোক থাকুক বা না থাকুক ,ইহলোক তাহাই মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য বটে ।কিন্তু কেবল তাহাই মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য হইতে পারে না। যেমন কতকগুলি মানসিক বৃত্তির চেষ্টা কর্ম, এবং যেমন সে সকলগুলি সম্যক মার্জিত ও উন্নত হইলে ,স্বভাবত পূণ্যকর্মের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্তি জন্মে ,তেমনি আর কতকগুলি বৃত্তি আছে ,তাহাদের উদ্দেশ্য কোন প্রকার কার্য নহে –জ্ঞান ই তাহাদিগের প্রিয়া। কার্যকারীনি বৃত্তি গুলির অনুশীলন যেমন মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য ,জ্ঞানার্জনী বৃত্তিগুলিরও সেইরূপ অনুশীলন জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। বস্তুতঃ সকল প্রকার মানসিক বৃত্তির সম্যক অনুশীলন ,সম্পূর্ণ স্ফূর্তি ও যথোচিত উন্নতি ও বিশুদ্ধিই মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য ।”
এই বঙ্কিম ই ১২৯১ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে লিখচ্ছেন;
” এই চতুর্বিধ বৃত্তিগুলির উপযুক্ত স্ফূর্তি ,পরিণতিও সামঞ্জস্যই মনুষ্যত্ব ।”
তবে ১২৯১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে তাঁর লেখা ;
” হিন্দুধর্ম ই সর্বশ্রেষ্ঠ। ইহাই অবলম্বন কর।”
এবং সে বছরই ভাদ্র মাসে তাঁর লেখা ;
” যিনি একাধারে শাক্যসিংহ, যীশুখ্রীষ্ট ,মহম্মদ ও রামচন্দ্র ; যিনি সর্ববলাকার, সর্বগুণাধার, সর্বধর্মবেত্তা, সর্বোত্র প্রেমময় ,তিনি ঈশ্বর হউন বা না হউন , আমি তাঁহাকে নমস্কার করি। তুমিও বল , নমো ভগবতে বাসুদেবায়।”
জীবন সায়াহ্নে এসে যে হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বঙ্কিম ঘোষণা করলেন , তা কিন্তু প্রচলিত হিন্দু ধর্ম নয় ।আর ‘কৃষ্ণ চরিত্রে’ র ভেতর দিয়ে কৃষ্ণের যে মাহাত্ম্য কীর্তন বঙ্কিম করেছেন ,সেটিও মহাভারত- ভাগবতের কৃষ্ণ নয় ।বঙ্কিমের কৃষ্ণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন;
তিনি যে কৃষ্ণের অন্বেষণে নিযুক্ত ছিলেন সে কৃষ্ণ তাঁহার নিজের মনে আকাঙ্ক্ষাজাত ।সমস্ত চিত্তবৃত্তির সম্যক অনুশীলনে সম্পূর্ণতাপ্রাপ্ত একটি আদর্শ তিনি ব্যাকুলচিত্তে সন্ধান করিতেছিলেন, তাঁহার ধর্মতত্ত্বে যাহাণকে তত্ত্বভাবে পাইয়াছিলেন ,ইতিহাসে তাহাকেই সজীব শরীরীভাবে প্রত্যক্ষ করিবার জন্য নিঃসন্দেহে তাঁহার নিরতিশয় আগ্রহ ছিল।
একথা ভুলে গেলে চলবে না যে ,বঙ্কিমকে রাজনৈতিক হিন্দুরা তাদের অন্যতম মেন্টর হিসেবে দেখানোর যতই চেষ্টা করুন না কেন ,বঙ্কিম কিন্তু হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যা বা প্রচারের ভিতর কখনো, কোনো অবস্থাতেই অপর ধর্ম সম্বন্ধে কোনো রকম অসহিষ্ণুতার কথা বলেননি ।
১২৯১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে তাঁর লেখা ,’নবজীবন’ প্রবন্ধে তিনি বলছেন;
“আমি এমন কথা বলি না যে জেলখানায় যেমন একটি মাত্র ফটক, স্বর্গের তেমনি একটি মাত্র দ্বার ।যে ব্যক্তি বলে ,আমার গৃহীত ধর্ম ভিন্ন আর সকল ধর্মই মিথ্যা ,কেবল আমি আর আমার সহধর্মীরাই স্বর্গে যাইবে, আর সকলেই নরকে পচিয়া মরিবে , তিনি আর্য ঋষি হউন, পান্ডিত্যাভিমানী ইংরেজ ই হউন বা সর্বশাস্ত্রবেত্তা জর্মান ই হউন, আমি তাঁহাকে ঘোরতর মূর্খ মনে করি। আমি ঈশ্বরকে কখনো এমন পক্ষপাতী এবং খলস্বভাব মনে করিতে পারি না ,যে, তিনি কেবল জাতিবিশেষকে স্বর্গে যাইবার উপায় বলিয়া দিয়া ,পৃথিবীর আর সকল জাতিকে নরকের পাঠাইবার বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছেন।”
বঙ্কিমের মতে;
” যে ধর্মে সত্যের ভাগ অধিক ,অর্থাৎ যে ধর্মের তত্ত্বজ্ঞানে অধিক সত্য, উপাসনা যে ধর্মের চিত্তশুদ্ধিকর এবং মনোবৃত্তি সকলের স্ফূর্তিদায়ক, যে ধর্মের নীতি সর্বাপেক্ষা ব্যক্তিগত এবং জাতিগত উন্নতির উপযোগী, সেই ধর্মই অবলম্বন করিব ।সেই ধর্ম সর্বশ্রেষ্ঠ।”( নবজীবন।শ্রাবণ।১২৯১)
মুক্তকণ্ঠে বঙ্কিম বলেছিলেন;
” এই পরিশ্রম ,এই কষ্টভোগের ফলে এইটুকু শিখিয়াছি যে, সকল বৃত্তির ঈশ্বরানুবর্তিতাই ভক্তি, এবং সেই ভক্তি ব্যতীত মনুষ্যত্ব নাই ।”
বঙ্কিমের জীবনে একসময় সাংখ্য দর্শন একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। অথচ জীবন সায়ান্নে সেই বঙ্কিম ই বলেন ;
” সাংখ্যদর্শনকে তোমাকে ধর্ম বলিয়া গ্রহণ করিতে বলিতেছি না।”
আবার পুরান ভিত্তিক হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে বঙ্কিমের যে বিরক্তি, ‘বঙ্গে দেবপূজা : প্রতিবাদ “- প্রবন্ধে ,যেটি’ ভ্রমর’ মাসিক পত্রে ,১২৮১ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল, তি মুক্তকণ্ঠে সেখানে বঙ্কিম লিখছেন;
” যদি বল, ঈশ্বর সাকার, তিনি শিল্পকারের মত হাতে করিয়া জগৎ গড়িয়াছেন, তাহা হইলেও তোমার সঙ্গে বিচার ফুরাইল। কৃমি- কীট- সঙ্কুল অবর্ণনীয় হ্রদরুগ নরক বা অস্পরোকন্ঠ- নিনাদ-মধুরিত,উর্বশী- মেনকা-রম্ভাদির নৃত্যসমাকুলিত ,নন্দন- কুসুম- সুবাস- সমুল্লাসিত স্বর্গ মানি না। হিন্দু ধর্ম মানি, হিন্দু ধর্মের’ বখামি ‘ গুলা মানি না। আমি শীর্ষদিগের ও নিষেধ করি ।”
স্পষ্টভাষায় বঙ্কিম বলছেন ;
” যে ব্রাহ্মণের গুণ আছে, অর্থাৎ যিনি ধার্মিক ,বিদ্বান, নিষ্কাম, লোকের শিক্ষক, তাঁহাকে ভক্তি করিবে; যিনি তাহা নহেন ,তাঁহাকে ভক্তি করিবে না। তৎপরিবর্তে যে শূদ্র ব্রাহ্মণের গুণযুক্ত অর্থাৎ যিনি ধার্মিক ,বিদ্বান, নিষ্কাম ,লোকের শিক্ষক ,তাঁহাকেও ব্রাহ্মণের মত ভক্তি করিবে ।”
‘প্রচার ‘ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় বঙ্কিম সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন;
” হিন্দুয়ানী তে অনেক রকম দেখিতে পাই ।হিন্দু হাঁচি পড়িলে পা বাড়ায় না ,টিকটিকি ডাকলে’ সত্য সত্য’ বলে ,হাই উঠলে তুড়ি দিয়ে , এ সকল কি হিন্দুধর্ম ?অমুক শিয়রে শুইতে নাই, অমুক আস্যে খাইতে নাই ,শূন্য কলসি দেখিলে যাত্রা করিতে নাই ,অমুক বারে ক্ষৌরি হইতে নাই ,অমুক বারে অমুক কাজ করিতে নাই ।এ সকল কি হিন্দু ধর্ম? অনেকে স্বীকার করবেন যে,এ সকল হিন্দু ধর্ম নহে ।মূর্খের আচার মাত্র ।যদি ইহা হিন্দু ধর্ম হয়, তবে আমরা মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি যে ,আমরা হিন্দু ধর্মের পুনর্জীবন চাহি না ।”
অন্যত্র তিনি বলছেন ;
” এক্ষুণে শুনিতে পাইতেছি যে হিন্দু ধর্মের নিয়ম গুলি পালন করিলে শরীর ভালো থাকে যথা একাদশী ব্রত স্বাস্থ্য রক্ষার একটি উত্তম উপায়। তবে শরীর রক্ষার ব্রত ই কি হিন্দু ধর্ম?”
‘ গৌড়দাস বাবাজির ভিক্ষার ঝুলি ‘ এটি ‘প্রচার ‘ পত্রিকায় ১২৯১ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল ,সেখানে মুক্তকণ্ঠে বঙ্কিম লিখছেন;
এই সমদর্শিতা থাকিলেই মনুষ্য,বিষ্ণু নাম জানুক না জানুক ,যথার্থ বৈষ্ণব হইল। যে খ্রীষ্টিয়ান, কি মুসলমান মানুষ মাত্র কে আপনার মত দেখিতে শিখিয়াছে ,সে যীশুর পূজা করুক আর পীরপ্যাগম্বরের ই পূজা করুক, সেই পরম বৈষ্ণব ।আর তোমরা কন্ঠী কুঁড়োজালির নিরামিষের দলে, যারা যাহারা তাহা শিখে নাই ,তাহারা কেহই বৈষ্ণব নহে। সর্বত্র সমান জ্ঞান ,সকলকে আত্মবৎ জ্ঞান ই বৈষ্ণব ধর্ম ,তখন হিন্দু ও মুসলমান, এ ছোট জাতি ও বড় জাতি, এরূপ ভেদজ্ঞান করিতে নাই ।যে এরূপ ভেদজ্ঞান করে সে বৈষ্ণব নহে।”
ধারাবাহিক লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুনঃ www.cpimwb.org.in
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৮)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৭)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৬)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৫)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৪)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৩)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১২)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১১)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১০)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব- ৯)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (অষ্টম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (সপ্তম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (ষষ্ঠ পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পঞ্চম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (চতুর্থ পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (তৃতীয় পর্ব)