ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৩)
ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণ নিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা সমকালের যে নীরবতা পালন করেছিল , সেই নীরবতা তারা আজ পর্যন্ত কিন্তু ভঙ্গ করে নি। ইংরেজদের ভারতবর্ষ শাসন তথা শোষণের একটা বড় লক্ষ্য ছিল ;তাদের দেশের বাজারকে প্রসারিত করা।সেই উদ্দেশ্যেই ভারতবর্ষের হস্তশিল্পের গঙ্গাযাত্রা ঘটায় ব্রিটিশ।
ভারতীয় হস্তশিল্পের উপর এই মারাত্মক আক্রমণ আমাদের দেশের কৃষি ব্যবস্থার উপরে ও একটা ভয়ঙ্কর রকমের চাপের সৃষ্টি করেছিল। গোটা পর্যায়ক্রম টি দেশের দারিদ্র্যের হার কে ও ভয়াবহ আকারে বাড়িয়ে দিয়েছিল। এভাবেই ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ একটা খাদের কিনারে এসে দাঁড়ায়। সেই সময় দাদাভাই নওরোজি বিভিন্ন হিসেব-নিকেশের ভেতর দিয়ে দেখিয়েছিলেন যে ;তৎকালীন সময়ে ভারতবর্ষের একজন মানুষ মাথাপিছু আয় করছেন মাত্র ২০ টাকা ।উইলিয়াম ডিগভি এই হিসেবটি ১৮৯৯ সালের নিরিখে দেখিয়েছিলেন ;একজন ভারতীয় মাথাপিছু আয় মাত্র ১৮ টাকা উপার্জন করে ।
ব্রিটিশ সরকার কিন্তু কোন অবস্থাতেই দাদাভাই নওরোজি বা উইলিয়াম ডিগভির হিসেব মানেনি। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড রিপনের অর্থসচিব ১৮৮২ সালে হিসেব কষে দেখিয়েছিলেন; ভারতীয়দের মাথাপিছু আয় ২৭ টাকা ।১৯০১ লর্ড কার্জনের আমলে ,বঙ্গভঙ্গের ঠিক অব্যবহিত আগেই হিসেব কষে দেখানো হয়েছিল, ব্রিটিশের পক্ষ থেকে ভারতীয়দের আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে মাথাপিছু ৩০ টাকা। অথচ এই সময়কালে গোটা ভারতবর্ষের জুড়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ,মহামারী আমাদের দেশের সামাজিক- অর্থনৈতিক -সাংস্কৃতিক ,সার্বিক পরিবেশ কে একটা গভীর সংকটের মধ্যে এনে ফেলেছিল।
অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলা যায় যে ,মাথাপিছু আয় ঘিরে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ যে হিসেব ই দিন না কেন, বাস্তবের সঙ্গে সেই হিসেব কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সাদৃশ্য ছিলনা ।দাদাভাই নওরোজি খুব পরিষ্কার ভাবেই বলেছিলেন ;ব্রিটিশ শাসন ভারতবর্ষের মানুষদের বস্তুগত দিক থেকে একেবারে নিঃস্ব করে ফেলেছে। ব্রিটিশ শাসন কে দাদাভাই নওরোজি মিছরির ছুরির সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন; এই ছুরি কোনো কষ্ট দেয় না ।তার সবটাই মসৃণ আর মিষ্টি। কিন্তু তবুও তা ছুরি ।
এই যে গোটা পর্যায়ক্রম সমগ্র ভারতবর্ষের জুড়ে ধীরে ধীরে একটা ব্রিটিশবিরোধী মানসিকতা তৈরি হচ্ছে –এই গোটা ঘটনাক্রমে র সঙ্গে কিন্তু আরএসএসের প্রথম যুগের নেতৃত্বের কোন রকম সম্পর্ক ছিল না ।এমনকি আরএসএসের বস্তুগত উপাদান জমাট বাঁধার জন্য ,ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে যে সমস্ত শক্তি গুলি ,দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ,বিশেষ করে উত্তর ভারতে সমবেত হতে শুরু করেছিল ,তাদের চিন্তা-চেতনাতে , বিন্দুমাত্র ভারতের উপরে ইংরেজের অর্থনৈতিক শোষণ কোনো ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি ।
নরমপন্থী রাজনীতিকেরা ব্রিটিশের অর্থনৈতিক নীতির পরিবর্তনের জন্য সোচ্চার হয়েছিলেন। ব্রিটিশ কে তার অর্থনৈতিক নীতি বদলের জন্য তারা বেশ কিছু সুপারিশ করেছিলেন। সেই সুপারিশের অন্যতম বড় বিষয় হলো; সামরিক খরচ এবং করের যে ক্রমবর্ধমান বোঝা ভারতবর্ষের মানুষদের উপর ব্রিটিশ চাপিয়ে দিচ্ছে ,সেই বোঝা অবিলম্বে কমাতে হবে।
ব্রিটিশ ভারতবর্ষের মানুষদের ওপর দিয়ে তাদের সামরিক খরচাপাতি যেভাবে ক্রমশ বাড়াচ্ছে, সেই বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি নরমপন্থী রাজনীতিকেরা করেছিলেন। তারা ভারতবর্ষের শিল্পকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরির দাবি জানিয়েছিলেন ।ব্রিটিশের ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত যে মূল্যায়ন, তা পুনর্বিবেচনার দাবি নরমপন্থী নেতারা জানান।
মহলওয়ারি এবং রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের ফলে এলাকায় যে সংকট তৈরি হচ্ছে ,সেই সংকটের সঙ্গে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা কে বিচার-বিবেচনাতে আনবার দাবিও নরমপন্থী রাজনীতিকেরা করেছিলেন। এছাড়া তাঁরা বিশেষভাবে ভারতবর্ষের কুটির শিল্প এবং হস্তশিল্পের উৎসাহ দেওয়ার প্রসঙ্গটি ব্রিটিশের সামনে তুলে ধরেছিলেন ।
একথা বলতে কোনো সংকোচ নেই যে , নরমপন্থী রাজনীতিকদের তোলা এইসব অর্থনৈতিক দাবিগুলির প্রতি ব্রিটিশ সরকার কোনো অবস্থাতে কোনোরূপ কর্ণপাত করেনি। ১৮৭০ সালে আয়কর উঠে গিয়েছিল ।কিন্তু জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ঠিক অব্যবহিত পরেই ১৮৮৬ সালে আয়কর আবার বসানো হয় ।লবণ কর যেখানে ছিল ২ টাকা ছিল, ব্রিটিশ সেটা বাড়িয়ে করে ২ টাকা ৫০ পয়সা করে। আমদানি শুল্ক বসানো হয়।
একথা ঠিকই , আমদানি শুল্কের পাল্টা হিসেবে ভারতবর্ষে তৈরি সুতির সুতোর উপর ১৮৯৪ সালে একটা বড় আকারে অন্তশূল্ক কৌশল হিশেবে ব্রিটিশ সরকার বসায়।এই শুল্ক ঘিরে ভয়ংকর রকমের সামাজিক প্রতিক্রিয়া হওয়াতে ১৮৯৬ সালে এই শুল্ক তারা, সাড়ে তিন শতাংশ ধার্য করে খানিকটা আগের পরিমাণ থেকে কমিয়ে ।ব্রিটিশের তৈরীর ফাউলার কমিশন ,অর্থনীতির ধারা-উপধারা কে একটা কৃত্রিম ছকে বেঁধে ,ভারতবর্ষের টাকার মূল্য ব্রিটিশ মুদ্রায় বেঁধে দেয় ১ সিলিং ৪ পেন্সে।
নরমপন্থী নেতারা দাবি জানানো স্বত্ত্বেও ব্রিটিশ কৃষিক্ষেত্রে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটায় না ।এ প্রসঙ্গে আলফ্রেড লায়াল মন্তব্য করেছিলেন ; ভারতবর্ষের কৃষি ব্যবস্থা তার একটা স্থবির , জঙ্গম অবস্থা থেকে উত্তরণের ভিতর দিয়ি উন্নয়নের আধুনিক পর্যায় পৌঁছে গেছে ।সেই কারণেই ভারতবর্ষের কৃষিতে পেছনের দিকে ফেরা অপেক্ষা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা খুব ইতিবাচক ভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ।
এই সমস্ত কুযুক্তিকে, যুক্তি হিসেবে খাড়া করে ,নরমপন্থী রাজনীতিকরা প্রশাসনিক এবং সাংবিধানিক প্রশ্নের যে সমস্ত অদল বদল দাবি করেন এবং তার সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রশ্নে নতুন চিন্তাভাবনা প্রবর্তনের দাবি করেন ।তাঁদের সেইসব দাবিকে ব্রিটিশ কোনো অবস্থাতে কোনোরকম মূল্য দেয়নি ।নরমপন্থী রাজনীতিকদের এই পর্যায়ক্রমে খুব সাফল্য না পেলেও, জাতীয় আন্দোলনের পরিবেশ-পরিস্থিতি, গোটা ভারতবর্ষের সর্বস্তরের মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার একটা প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে তাদের এই ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণের প্রসঙ্গটি উত্থাপনের অত্যন্ত গুরুত্ব আমাদের জাতীয় জীবনে পড়েছিল।
ঔপনিবেশিক চিন্তাভাবনার সঙ্গে আমাদের দেশের পর্বত প্রমাণ দারিদ্র্যকে মিলিয়ে দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নৈতিক অধিকারের বিষয়টি কে নস্যাৎ করে দেওয়া চেষ্টার ভেতর দিয়ে , ব্রিটিশশের তথাকথিত হিতৈষী মানসিকতা, ব্রিটিশের এক ধরনের ,’দাদাগিরি’, তাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখবার যে মানসিকতা ছিল ,সেই মানসিকতাকে অভিজাত সম্প্রদায় কেই ভেতরেই একটা প্রশ্ন চিহ্নের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেয়।
এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আমাদের সামাজিক জনজীবনে যে প্রতিক্রিয়া সেই সময় শুরু হলো ,তা পরবর্তীকালে আমাদের জাতীয় আন্দোলনের সার্বিক প্রেক্ষিতে, সমাজের উচ্চবর্ণ থেকে একেবারে অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে ,পিছিয়ে পড়া অংশেকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। নরমপন্থী রাজনীতিকরা এই পদ্ধতির ভেতর দিয়ে গোটা ভারতবর্ষের অভিজাত সমাজের ভেতরে মূলত ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যে একটা ক্রোধের মানসিকতা তৈরি করতে পেরেছিলেন, সেটি পরবর্তীকালে সমাজের সর্বস্তরে ব্যপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল ।
নরমপন্থী রাজনীতিকদের চিন্তাচেতনার ভেতরে কিছু শৈথিল্য ছিল ।সেইসব শৈথিল্যের বশবর্তী হয়ে এইসব রাজনীতিকরা ব্রিটিশদের ভারতবর্ষ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ভাবনাকে সেভাবে নিয়ে আসেন নি, একথা সত্যি ।কিন্তু তাঁরা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিতৃষ্ণাকে একটা গণ আন্দোলনে পরিণত না করতে পারলেও, সেই আন্দোলনের সলতে পাকানোর কাজটি কিন্তু অত্যন্ত সফলভাবে করতে পেরেছিলেন ।
নরমপন্থী রাজনীতিকরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উদার রাজনৈতিক ঐতিহ্যের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। ব্রিটিশের গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা প্রতিও আস্থাশীল ছিলেন ।এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই হয়তো তাঁদের ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনে যাওয়ার পথটি সেই সময় অবলম্বন করা সম্ভব হয়নি ।বিশেষ করে ইংল্যান্ডের একটা অংশের মানুষদের যে উদার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, সেই দৃষ্টিভঙ্গি ,অভিমতেরষ প্রতি নরমপন্থী রাজনীতিকদের একটা গভীর শ্রদ্ধা, সম্ভ্রমের মানসিকতা ছিল ।
তাই আবেদন-নিবেদনের ভেতর দিয়ে, বক্তৃতার ভেতর দিয়ে, প্রবন্ধ ছাপানোর ভেতর দিয়েই ,নরমপন্থী রাজনীতিকরা তাঁদের রাজনীতির কর্মপদ্ধতিকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতবর্ষের আধুনিক জনজীবন কে এইসব পদ্ধতির ভেতর দিয়ে একটা পরিবর্তনের জায়গায় উপনীত করবে– এই প্রসঙ্গ টিকে নরমপন্থী রাজনীতিকেরা একটি উল্লেখযোগ্য যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেছিলেন ।তাঁদের ধারণা ছিল; আবেদন-নিবেদন, বক্তৃতা ,প্রবন্ধ ছাপানো– ইত্যাদি একটা শাসনতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতির ভেতর দিয়ে ,ইংল্যান্ডের জনমতের একটা বড় অংশ, যাঁরা উদারনৈতিক চিন্তা চেতনায় বিশ্বাস করে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করে, তাঁরা ভারতবর্ষের মানুষদের এসব অর্থনৈতিক দাবিগুলি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবেন।
নরমপন্থীদের এই সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গি গুলি সাফল্য লাভ কোনো অবস্থাতে করতে পারেনি– একথা ইতিহাসগত ভাবে সত্য হলেও ,এটা অত্যন্ত জোরের সঙ্গেই বলতে হয় যে ,ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণের স্বরূপকে কে ভারতবর্ষের মানুষদের সামনে উপস্থাপিত করে ,জাতীয় আন্দোলনকে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে ,তাঁরা যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন ,তেমন ভূমিকা কিন্তু হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিক, যারা হিন্দু মহাসভা সহ নানা ধরনের রাজনৈতিক হিন্দু সংগঠন তৈরি করে ,বিভাজনের রাজনীতিতে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছিলেন, যারা পরবর্তীকালে আরএসএসের প্রতিষ্ঠার সমস্ত ধরনের কর্মপদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ,তারা কিন্তু নরমপন্থী রাজনীতিকদের তৈরি করা এই সমস্ত সামাজিক প্রেক্ষিতে ভগ্নাংশের সঙ্গে যুক্ত হওয়া তো দূরের কথা, এই মানসিকতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোন রকম ভূমিকা পালন করতে পারেননি।
নরমপন্থী রাজনীতিকদের গোটা আন্দোলনের যে কৌশলটি ,তাকে পরবর্তীকালে ভিক্ষাবৃত্তি বলে বর্ণনা করে গোটা কার্যক্রমটি সমালোচনা করেছিলেন চরমপন্থী রাজনীতিকেরা ।কংগ্রেসের ভিতরকার নানা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের নিরিখে ,চরমপন্থী নরমপন্থীদের যে বিবাদ-বিসংবাদ -বিতর্ক, সেসব জায়গাগুলোকে মনে রেখেই এ কথা জোর দিয়ে বলা উচিত যে, নরমপন্থী রাজনীতিকদের চিন্তা-চেতনায় অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও ,ভারতবর্ষের মানুষদের ভেতরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী চিন্তা চেতনার উন্মেষের ক্ষেত্রে তাঁদের এই আবেদন নিবেদন নীতি- অনেক সীমাবদ্ধ পরিসরেও কিন্তু একটা বিশেষ রকম ভূমিকা পালন করেছিল।
বিশেষ করে নরমপন্থী রাজনীতিকদের যে প্রভাব টি অভিজাত সমাজের উপরে পড়েছিল ,সেই প্রভাবের ফলশ্রুতি ,পরবর্তীকালে অভিজাত সমাজ থেকে প্রবাহিত হয়েছিল সমাজের মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন বৃত্তের পিছিয়ে পড়া মানুষদের ভেতরেও। আক্ষরিক অর্থে হয়তো এটা খুব সত্যি কথা যে ,পিছিয়ে পড়া মানুষদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট চিন্তা-ভাবনার কথা নরমপন্থী রাজনীতিকেরা সেভাবে বলেননি। তবে অভিজাত সম্প্রদায়ের সমস্যাগুলিকে তুলে ধরার ভেতর দিয়েও, ব্রিটিশের শাসনের নামে শোষণের যে প্রেক্ষাপট তাঁরা ভারতবর্ষের মানুষদের সামনে মেলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন ,তা কিন্তু পরবর্তীকালে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষদের ভেতরে ব্রিটিশবিরোধী মানসিকতা কে প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে অনেকখানি বড় ভূমিকা পালন করেছিল।
উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে নরমপন্থী রাজনীতিকদের চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে সাফল্য না আনতে পারা জনিত যে সমস্যা গুলি, তাতে একদিকে এই নরমপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের একটা বিপন্নতা যেমন খুব পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছিল ।তেমনি ই ব্রিটেনের রাজনীতির ক্ষেত্রে টোরি রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতাসীন হলো, তখন তাদের ভিতর ভারতবর্ষের মানুষদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে কোনো রকম সহানুভূতি না থাকলেও, নরমপন্থী রাজনীতিকরা যে ভাবনার ভিতর দিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন, সেই ভাবনার ক্ষেত্রটি তে কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয় থাকলেও এ কথা খুব স্পষ্টভাবে বলতে হয়; রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি করবার বিষয়ে নরমপন্থী রাজনীতিকেরা একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা কিন্তু সেই পর্যায়ে পালন করেছিলেন ।
উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে শুরু করে বিশশতকের একদম প্রথমার্ধ পর্যন্ত তাঁদের কার্যাবলী আমাদের দেশে ব্রিটিশ বিরোধী মানসিকতার উন্মেষের ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করেছিল ,সেই ভূমিকাকে নস্যাৎ করবার লক্ষ্যে কিন্তু বিএস মুজ্ঞের মত আরএসএসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সে বালগঙ্গাধর তিলকের কার্যক্রমের সঙ্গে ১৯০৬ সালে সুরাট কংগ্রেস ,যেখানে নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে ওঠে ,সেখানে সংযুক্ত হয়ে তিলকের সমস্ত সামাজিক কর্মকান্ড কে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের মোড়কে আরো বেশি ভাবে প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করেছিলেন ।
উনিশ শেষ পর্বে চাপেকর ভাইদের কর্মকান্ড ইত্যাদি সঙ্গে সম্পৃক্ত তিলকের ভেতর হিন্দু পুনরুত্থাণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট পরিমাণে থাকলেও, সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে পরবর্তীকালে মুসলিমবিদ্বেষে পর্যবসিত করবার লক্ষ্যেই আরএসএসের প্রতিষ্ঠা পর্বের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিত্বরা, বিশ শতকের প্রথম ভাগে খুব সামান্য হলেও তিলকের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হয়ে, জাতীয় আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের চরমপন্থী নেতৃত্বদের ভেতরে একটি সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার পরিমণ্ডলকে আরো প্রসারিত করতে শুরু করেন ।
এই দৃষ্টিভঙ্গি উন্মেষের ক্ষেত্রে অবিভক্ত পাঞ্জাবের হিন্দু সাম্প্রদায়িক অংশটি ,বিশেষ করে যারা নানা ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল ,সেই ‘লালা ‘সম্প্রদায় নানা ধরনের অনুঘটক তৈরি করে ,গোটা পরিবেশ-পরিস্থিতি কে একটা জটিল থেকে জটিলতর পর্যবেক্ষণের দিকে ঠেলে দিয়ে ,ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ক্রমশ ভারতবর্ষের মানুষের ভেতরে যে ঘৃণার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে ,তাকে সরাসরি রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক অভিধায় প্রবাহিত করবার ক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করে।
ধারাবাহিক লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুনঃ www.cpimwb.org.in
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১২)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১১)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১০)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব- ৯)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (অষ্টম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (সপ্তম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (ষষ্ঠ পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পঞ্চম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (চতুর্থ পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (তৃতীয় পর্ব)