Site icon CPI(M)

Ideology Series (Part IV): What Marx Discovered

Idology Series 4

প্রাককথন

প্রথমে ভেবেছিলেন ১৮৬৬-তেই পুঁজি প্রকাশনার কাজটি শেষ হবে। মার্কসের একান্ত ইচ্ছা ছিল পরিকল্পনামাফিক সমস্ত খণ্ডগুলিই একসাথে ছেপে বেরোক। লেখা সম্পর্কে তাঁর বিশেষ খুঁতখুঁতানির কথা জানতেন বলেই এঙ্গেলস শুরুর দিকে খুব একটা তাগাদা দেননি। হ্যমবুর্গের প্রকাশকও উল্লেখযোগ্য কোন হস্তক্ষেপ করতেন না। মার্কসের শরীর তখন প্রায়শই ভেঙ্গে পড়ছে, এইবার এঙ্গেলসের দুশ্চিন্তা শুরু হল। বইয়ের সমস্ত খণ্ডের কাজ শেষ হলে তবে ছাপতে দেওয়া হবে- এমন ভাবনায় তিনি আর নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। এঙ্গেলসই প্রথম মার্কস’কে পুঁজির প্রথম খন্ড আগে ছাপানোর প্রস্তাব দেন। শুরুর দিকে মার্কস সেকথায় খুব একটা আমল দেননি, পরে শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিলেন। ঐ পর্বের ইতিহাস দেখলে আজ ফ্রেডরিক এঙ্গেলসকেই পুঁজি প্রকাশের মূল কৃতিত্ব দিতে ইচ্ছা হয়। প্রাথমিক খসড়ায় মার্কস প্রায় ৫২টি নোটবুক জুড়ে নিজের লেখাটি সাজিয়েছিলেন। ঐ বছর অক্টোবর মাস নাগাদ এঙ্গেলসকে চিঠি লিখলেন- ‘শারীরিক ও মানসিক সবদিক থেকে অনন্ত বাধা পেরোতে হল। দুখণ্ডে পুরো লেখাটা শেষ করতে পারব বলে প্রথমে যেমনটা চেয়েছিলাম তা আর সম্ভব নয়। আমার পরিস্থিতি আমাকে মেনে নিতে বাধ্য করছে, পুঁজির প্রথম খণ্ডটিই প্রথমে ছেপে বেরোক। যা বুঝছি, বইটির চারটি অংশ মোট তিন খণ্ডে শেষ হবে। ১ম অংশ- পুঁজি গঠনের প্রক্রিয়া (দ্য প্রসেস অফ প্রোডাকশন অফ ক্যাপিটাল), ২য় অংশ- পুঁজি সঞ্চরণের প্রক্রিয়া (দ্য প্রসেস অফ সার্কুলেশন অফ ক্যাপিটাল), ৩য় অংশ- প্রক্রিয়ারূপে পুঁজিবাদী উৎপাদন কাঠামোর বিশ্লেষণ ( স্ট্রাকচার অফ দ্য প্রসেস অ্যাজ আ হোল) এবং ৪র্থ অংশটি হল- রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের ইতিহাস (অন দ্য হিস্ট্রি অফ দ্য থিওরি)। প্রথম দুটি অংশ থাকবে বইয়ের প্রথম খণ্ডে, ৩-য় অংশটি ২য় খণ্ডের অন্তর্গত হবে এবং ৪-র্থ অংশটি পুরোটাই যাবে ৩-য় খণ্ডে’।

১৮৬৭ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর পুঁজির প্রথম খণ্ড ছেপে বেরোয়। জার্মান ভাষায় হাজারখানেক কপি’ই ছাপা হয়েছিল। মার্কসের কথায় সেই বই ‘আজ অবধি বুর্জোয়াদের মাথা লক্ষ্য করে ছোঁড়া সবচাইতে বড় মিশাইল’। বইয়ের প্রতিটি পাতার প্রুফ দেখেছিলেন মার্কস নিজেই। সেকাজ শেষ হয়েছিল ১লা আগস্ট, রাত দুটোয়। শেষ করেই এঙ্গেলস’কে চিঠি লিখতে বসলেন- ‘শেষ পাতার প্রুফ দেখা এই সবে মিটল। অতএব, প্রথম খণ্ডটি ছাপা হচ্ছে… এ কাজ শেষ করার জন্য যদি সত্যিই কাউকে ধন্যবাদ দিতে হয় তবে তা একান্তই তোমার প্রাপ্য, আর কারোর না’।

যদিও মার্কসের পরিকল্পনা শেষ অবধি বাস্তবায়িত হয়নি। প্রথম প্রকাশের পরে মার্কস নিজেও বহু সংশোধন, সংযোজন করেছেন। পরের দুটি খণ্ড আর তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশ করা যায়নি।

‘মার্কস প্রসঙ্গে’ ১৮৭৭ সালের মে-জুন নাগাদ লেখা একটি প্রবন্ধ, ১৮৭৮ নাগাদ প্রকাশিত হয়। ইংরেজি শিরোনাম ‘অন মার্কস’। প্রবন্ধটি লিখেছিলেন এঙ্গেলস। তারই শেষ অংশ আজকের প্রতিবেদন। মতাদর্শ সিরিজের চতুর্থ পর্ব। দুটি বিশেষ কারণে প্রবন্ধটি গুরুত্বপূর্ণ। এক- এতে মার্কসের যাবতীয় কাজের এক অসাধারণ সারাংশ করেছেন তারই কমরেড ইন আর্মস ফ্রেডরিক এঙ্গেলস। দুই- এই প্রবন্ধ লেখার সময়ও এঙ্গেলস আশাবাদী মার্কসের শরীর সেরে উঠবে, তিনি ক্যপিটালের দ্বিতীয় খণ্ডের কাজটি দ্রুত শেষ করবেন এবং পাণ্ডুলিপিটি ছাপাখানায় পাঠানো যাবে। আমরা যেন মনে রাখি এঙ্গেলসের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।

এই লেখার সাত বছর বাদে ১৮৮৩ সালে কার্ল মার্কস মারা যান। ক্যাপিটালের দ্বিতীয় খন্ড তখনও ছাপাখানায় পৌঁছায়নি। মার্কসের নোটস, খাতাপত্র ইত্যাদি থেকে বইটি সাজানর কাজ এঙ্গেলসকেই করতে হয়েছিল, সেই লেখা যখন ছাপাখানার মেশিনে ঢুকছে ততদিনে ক্যালেন্ডার বলছে ১৮৮৫ সাল চলছে।

ফ্রেডরিক এঙ্গেলস

একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কারের সুবাদে মার্কস নিজের নামটি বিজ্ঞানের ইতিহাসে উৎকীর্ণ করে তুলেছেন। এই প্রবন্ধে আমরা কেবল দুটি আবিষ্কারের বিষয়ে আলোচনা করব।  

প্রথমটি হল সেই বিপ্লব যার দ্বারা তিনি ইতিহাসকে নতুনভাবে নির্মাণ করলেন। বিশ্বের ইতিহাস বলতে এতদিন অবধি আমরা শিখেছিলাম সমস্ত ঐতিহাসিক পরিবর্তনের প্রধান ভিত্তিটি আসলে মানুষের চেতনায় উল্লেখযোগ্য বদলের উপর নির্ভরশীল। এও শিখেছিলাম যাবতীয় ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মধ্যে সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন। বিশ্ব-ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি নাকি রাজনৈতিক ব্যবস্থার আধিপত্যে এগিয়ে চলে এমনটাই ছিল এতদিনকার ধারণা। কখনও জানতে চাওয়া হয়নি মানুষের চেতনার পরিবর্তন ঘটে কেন। রাজনৈতিক ব্যবস্থার বদল ঘটার পিছনেই বা কি কারণ রয়েছে সেই নিয়েও কোনও প্রশ্ন করা হত না। ফরাসী ঐতিহাসিকরাই সবার আগে এমন পরম্পরাগত অবস্থার কিছুটা বদল ঘটালেন, ইংরেজ’রাও কিছুদূর এগোলেন। সার্বিক না হলেও অন্তত ইতিহাসের মধ্যযুগ থেকে শুরু করে আধুনিক অবস্থার ব্যখ্যা করতে গিয়ে তারাই প্রথম ইতিহাসকে অতীতের সামন্ত-অভিজাতদের শাসনের বিরুদ্ধে ক্রমশ মাথা তুলতে থাকা বুর্জোয়াদের সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েমের সংগ্রাম হিসাবে উপস্থিত করলেন।  

মার্কস প্রমান করলেন মানুষের অতীত ইতিহাসের আগাগোড়াই হল শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়েই মূল কথা হল ঐ নির্দিষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোনও না কোনও শ্রেণী সামাজিক কাঠামোয় কর্তৃত্বের ভূমিকায় রয়েছে। ইতিহাসের গতি আসলে ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক শ্রেণীর কর্তৃত্বের সাথে উদীয়মান শ্রেণীর সংঘাতের উপরে নির্ভর করে সামনের দিকে এগোয়। এই সমস্ত শ্রেণী সমূহের উৎস কোথায়? কিভাবেই বা শ্রেণী হিসাবে তারা নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় সামাজিক কাঠামোর বস্তুগত ভিত্তিতে। নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক কাঠামোয় সামাজিক উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য জরুরি সামগ্রীসমূহ কোন শর্তে একে অন্যের সাথে বিনিময় হয় তার উপরেই নির্ভর করে কোন শ্রেণী সমাজের মাথায় বসবে। মধ্যযুগে ছিল সামন্তদের শাসন। এই পর্বটি মূলত স্বয়ং সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করেছিল। ছোট ছোট কৃষিজীবী গোষ্ঠীগুলি নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সমস্ত সামগ্রীই নিজেরাই উৎপাদন করত। বেচা কেনার মতো বিনিময় ব্যবস্থা প্রায় ছিল না বললেই চলে। এই সকল উৎপাদক গোষ্ঠিগুলিকে সুরক্ষিত রাখত অস্ত্রধারী বাহিনী যার মালিক ছিল অভিজাতরা। এহেন বন্দোবস্তের সুবাদে একদিকে গোষ্ঠিসমূহের সামাজিক জীবনযাপন নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য হত, আরেকদিকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকা সত্বেও এক একটি প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলগুলির মধ্যে অভিন্ন শাসকের মাধ্যমে একধরনের রাজনৈতিক সংহতিও বিরাজ করত। এর পরবর্তীকালে শহরগুলি গড়ে ওঠে। তখন গ্রামীণ উৎপাদক গোষ্ঠীর ( হস্তশিল্প নির্ভর কারিগর) সাথে ব্যবসায়ীদের যোগাযোগের বন্দোবস্তটি পাকা হল। এভাবেই বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে, প্রথমে একেকটি ভৌগোলিক অঞ্চলে পরে আন্তর্জাতিক স্তরে। এহেন পরিস্থিতিতেই শহুরে বুর্জোয়াদের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটে। ইতিপূর্বে তারা সামন্ত-অভিজাত শাসন ব্যবস্থার সাথে সংঘাতে জড়িয়েছিল। মধ্যযুগীয় সংগ্রামের সেই অভিজ্ঞতাই পরবর্তীকালে তাদের সামাজিক মর্যাদা এনে দেয়। এহেন মর্যাদার জোরেই তারা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও বিশেষ সুবিধাভোগী এক শ্রেণী হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ইউরোপের পরিসীমার বাইরে নতুন নতুন দেশ আবিষ্কারের সাথেই বুর্জোয়ারা নিজেদের শক্তিকে আগের তুলনায় অনেকগুণ প্রসারিত করতে থাকে। বাণিজ্যের প্রসার ঘটার সুবাদেই শিল্প কারখানার প্রতিষ্ঠা হওয়া শুরু হয়। জীবনধারণের জন্য জরুরী যে সকল সামগ্রী এতদিন অবধি হস্তশিল্পের মাধ্যমে উৎপাদন করা হতো সেসবই এবার থেকে ছোট ছোট কারখানায় তৈরি হতে শুরু করল। পরে সেইসকল ছোটখাটো কারখানাকে প্রতিস্থাপিত করল বিরাট আকারের কারখানা, শিল্প-প্রতিষ্ঠান। পূর্ববর্তী শতাব্দীতে বাষ্প-ইঞ্জিন আবিষ্কৃত হয়েছিল। সেই যন্ত্রই সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থার এই বিরাট পরিবর্তন সাধনে বিশেষ ভূমিকা পালন করল।

বিরাট আকারের শিল্প-কারখানা আসলে কি করল? এতদিন সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থাটি হস্তশিল্প-কারিগরদের কায়িক শ্রমের উপর নির্ভরশীল ছিল। শিল্প-কারখানার প্রতিষ্ঠান সেই ব্যবস্থার অবসান ঘটাল, সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার ভরকেন্দ্রটি কায়িক শ্রম থেকে সরে এল। যত দিন গেল ইউরোপের ভূখণ্ডের বাইরে থাকা নতুন নতুন দেশে বাণিজ্যের প্রসার হল। ঐ সকল দেশের হস্তশিল্প নির্ভর পশ্চাদপদ উৎপাদন ব্যবস্থাকে উৎখাত করল বুর্জোয়ারাই, এভাবেই তারা বিপুল পরিমাণ সামাজিক সম্পদের মালিক হয়ে ওঠে। সামাজিক সম্পদের সাথে তাদের সামাজিক কর্তৃত্বও বাড়তে থাকে। এক দীর্ঘ যুগ ধরে সামন্ত-অভিজাতরাই সামাজিক ক্ষমতার অধিকারি ছিল, তাদেরই সমর্থনে রাজতন্ত্র নিজেকে টিকিয়ে রেখেছিল। এইবার সামাজিক ক্ষমতার প্রসঙ্গে সামন্ত-অভিজাতদের সাথে বুর্জোয়াদের সংঘাত চরম আকার নিতে শুরু করল। সেই সংঘাতের ধারাই ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা করে- তাকেই আমরা ফরাসী বিপ্লব বলে চিহ্নিত করি। ফরাসী বিপ্লব পরবর্তী নতুন সমাজব্যবস্থায় ক্ষুদ্র চাষি ও সর্বহারা জনসাধারণের উপরে বুর্জোয়াদের সামাজিক কর্তৃত্ব কায়েম হল, সেই কাঠামোই আধুনিক বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামোর উপরে ভিত্তি করে কোনও নির্দিষ্ট যুগের ইতিহাসকে বিচার-বিশ্লেষণের এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের ইতিহাসের প্রত্যেক পর্বকে সঠিকভাবে ব্যখ্যা করতে সক্ষম। এতদিন অবধি কোনও ঐতিহাসিক এই কাজে সক্ষম হননি, মার্কসই এর আবিস্কর্তা। সমাজব্যবস্থার নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে উৎপাদন সম্পর্কের সুনির্দিষ্ট কাঠামোকে ভিত্তি করে যেমন সেই যুগের ব্যবস্থাকে ব্যখ্যা করা যায় তেমনই ঐ একই কায়দায় সংশ্লিষ্ট যুগে মানুষের চেতনার মূল প্রবণতাগুলিকেও ব্যখ্যা করা যেতে পারে। কারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনা-চেতনা মূলত নিজের সমসাময়িক যুগের উৎপাদন সম্পর্কের উপরেই নির্ভর করে বিকশিত হয়। মার্কসের আবিষ্কারের সুবাদেই ইতিহাস প্রথমবার নিজের বাস্তব ভিত্তির উপরে এসে দাঁড়াল। তখনই প্রমাণ হল মানুষকে প্রথমে নিজেদের পেটের খিদে ও পানীয় জল সংক্রান্ত সমস্যাগুলির সমাধান করতে হয়, তারপরে আসে জামাকাপড়, বাসস্থানের প্রসঙ্গ। এসব মিটলে পরে সামাজিক জীবনে স্বার্থের বিভিন্ন সংঘাত দেখা দেয়। ধর্ম, দর্শন ও রাজনীতি সহ অন্যের উপরে কর্তৃত্ব কায়েম করার যাবতীয় কিছু তারও পরবর্তীতে আলোচ্য। এতদিন অবধি সমাজবিকাশের ঐ সকল পরবর্তী ধাপগুলিকেই ইতিহাষের প্রধান উপাদান হিসাবে বিবেচিত হত। ইতিহাসে কোনটা আগে আর কোনটা পরে বিবেচিত হওয়া উচিত সেই সত্যকে মার্কসই তুলে ধরলেন। 

সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গীর নিরিখে ইতিহাসের এহেন বিবেচনাবোধের গুরুত্ব সর্বাধিক। এই দৃষ্টিভঙ্গীর সুবাদেই উপলব্ধি করা যায় অতীত ইতিহাসের যাবতীয় গতিই আসলে বিকাশমান শ্রেণী সংঘাতের উপরে নির্ভরশীল। ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে শাসক ও শাসিতের, শোষক ও শোষিত শ্রেণীর সংঘর্ষের ইতিহাস। এই সঞ্চারপথে বেশিরভাগ মানুষই হাড়ভাঙ্গা খাটুনির বাধ্যবাধকতা ও অল্পস্বল্প আরামের সুযোগ পেয়েছে। কেন এমন ঘটল? কারন পুঁজিবাদ পূর্ববর্তী অতীত ইতিহাসের সমস্ত পর্বেই সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়া অল্পই বিকশিত হয়েছিল। তাই বিকাশের ঐতিহাসিক ফলশ্রুতিতে মানবজীবনের যে উৎকর্ষ তার সুফল জনসাধারণের কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে, এরাই সমাজের সুবিধাভোগী অংশ। আর তাই বিরাট অংশের মানুষ নিজেদের শ্রমশক্তিকে উদয়াস্ত খাটুনির কাজে ব্যয় করতে বাধ্য হয়েছে। সেই পরিশ্রমে তাদের নিজেদের প্রয়োজন মিটেছে সামান্যই, বেশিরভাগ সুফলই সুবিধাভোগী অংশ ভোগ করে এসেছে।

কিন্তু এইবার ঐ বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীই ইতিহাসের নতুন সমস্যার স্বাভাবিক সমাধানকে সামনে নিয়ে আসে। ইতিহাসের ধারা বেয়ে আজকের সমাজেও শ্রেণী সংঘাত একইরকমের প্রাসঙ্গিক। বুর্জোয়ারা আগেকার ব্যবস্থায় প্রগতির পক্ষে ভূমিকা পালন করেছিল। তারাই এখন সমাজ বিকাশের পরবর্তী পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ এমন এক অভূতপূর্ব মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে যখন আর পুরানো কায়দায় অর্থাৎ শাসক ও শাসিত, শোষক ও শোষিতের শ্রেণী সংঘাতের উপরে নির্ভর করে সমাজ সামনের দিকে চলতে পারছে না। চলতি সমাজের শাসক শ্রেণী হিসাবে বৃহৎ বুর্জোয়াদের ঐতিহাসিক ভূমিকা ইতিপূর্বে সম্পন্ন হয়ে গেছে, পরবর্তী সমাজ বিকাশের নেতৃত্ব দিতে তারা আর সক্ষম নয়। এখন তারাই উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের পথে বাধাস্বরূপ। বাণিজ্য সংকট (ট্রেড ক্রাইসিস) সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়। দেশে দেশে শিল্প-উৎপাদনের রুগ্ন চেহারা স্পষ্ট করে দিয়েছে সমাজকে পরবর্তী ধাপে এগিয়ে নিয়ে যেতে নেতৃত্বের প্রশ্নটি ঐতিহাসিকভাবেই সর্বহারা শ্রেণীর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। গোটা সমাজকে পুঁজিবাদের অভিশাপ থেকে মুক্ত না করে সর্বহারা শ্রেণীর নিজেদের মুক্তি আসবে না। সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে যাবতীয় শ্রেণী শাসন, দাসত্ব ও শোষণের অবসান না ঘটা অবধি এদের মুক্তি অর্জিত হবে না। সামাজিক উৎপাদিকা শক্তির বিকশিত চেহারাটি আর কিছুতেই বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না, সংকট তৈরি হচ্ছে সেকারণেই। সর্বহারা শ্রেণীকেই সেই রাশ নিজেদের হাতে তুলে নিতে হবে। সমাজবিকাশের ধারায় আমরা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি যখন পরবর্তী সমাজব্যবস্থায় প্রত্যেকটি মানুষ আর কেবলমাত্র উৎপাদনের কাজে মেহনত করবে না, উপাদিত সম্পদের বণ্টন ও রক্ষণাবেক্ষণেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। সমাজের প্রতিটি অংশের মানুষের চাহিদা মেটাতে সক্ষম এমন এক নিরন্তর বিকাশশীল উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে উপযুক্ত ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার স্বার্থক রুপায়ন ঘটবে।

মার্কসের দ্বিতীয় আবিষ্কারটি পুঁজি ও শ্রমশক্তির আন্তঃসম্পর্ক প্রসঙ্গে। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার অধীনে পুঁজিবাদীদের হাতে শ্রমিকরা কিভাবে শোষিত হয় মার্কস সেই রহস্য উন্মোচিত করেন। যখন থেকে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র ঘোষণা করেছে যে যাবতীয় সম্পদের গোড়ায় রয়েছে মানবিক শ্রম তখন থেকেই একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হয়েছিল। নিজের শ্রমের বিনিময়ে একজন শ্রমিক যে মূল্য উৎপাদন করে তার ছোট একটি অংশই সে মজুরি হিসাবে পায়, বেশিরভাগটাই চলে যায় মালিকের দখলে- কিভাবে এমনটা ঘটে এই ছিল সেই প্রশ্নের মূল কথা। এক্ষেত্রে শ্রমিকের মজুরি তার শ্রমের বিনিময় মূল্যের সমান হলেও উৎপাদিত মূল্যের সমান হচ্ছে না। তবে মানবিক শ্রমকেই সমস্ত সম্পদ সৃষ্টির মূল বলে কিভাবে চিহ্নিত করা যায়? বুর্জোয়া অর্থনীতির পণ্ডিত এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদ উভয়েই এই প্রশ্নটিকে ঘিরে অনেক কসরত করেছেন, সবশেষে মার্কস তার সমাধান খুঁজে বের করলেন।

সমাধানটি এরকম-  

আজকের যুগে সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়াটি পুঁজিবাদী নিয়মে চলে। এই ব্যবস্থায় মোটের উপরে দুটি শ্রেণী কর্তব্যরত রয়েছে। একদিকে বুর্জোয়ারা, যারা উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদিত সম্পদের মালিক আরেকদিকে সর্বহারা মজুরি শ্রমিক যাদের একমাত্র সম্পদ হল নিজের শ্রমশক্তি। বুর্জোয়া ব্যবস্থায় সর্বহারা শ্রমিক সেই শ্রমশক্তি বিক্রি করে নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদনের বন্দোবস্ত করে। নিজেদের শ্রমশক্তির বিনিময়ে তারা জীবন টিকিয়ে রাখতে জরুরী উপকরণ-সামগ্রী (মিনস অফ সাবস্টিনেন্স) ইত্যাদি সংগ্রহ (খরিদ) করে। যেকোনো পন্যের মূল্য নির্ধারিত হয় তাকে উৎপাদনের জন্য সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় পরিমাণ শ্রমের নিরিখে। এর ভিত্তিতেই পন্যের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন চলতে থাকে। মানবিক শ্রমশক্তির গড় মূল্যমান নির্ধারিত হয় সাধারণত দিন, মাস বা বছরের হিসাবে। সুতরাং ঐ এক দিন, এক মাস কিংবা এক বছর ব্যাপি সময়কালে একজন মজুরি শ্রমিকের বেঁচে থাকার জন্য জরুরী উপকরণ সামগ্রীর মুল্যও একই নিক্তিতে হিসাব করতে হয়- অর্থাৎ সেইসব সামগ্রীর উৎপাদনে ব্যয় হওয়া শ্রমশক্তির নিরিখে।

এবার ধরা যাক একজন মজুরি শ্রমিকের একদিনের জন্য প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ যতটা লাগে তার উৎপাদনে ছয় ঘন্টার শ্রমশক্তি দরকার হয়। তাহলে সেই পরিমাণ সামগ্রীর মুল্য হবে ছয় ঘণ্টার মজুরীর সমান অথবা এভাবেও বলা যায় সেই পরিমাণ সামগ্রী উৎপাদনে সামাজিকভাবে নির্ধারিত ছয়ঘন্টার গড় শ্রমশক্তি খরচ হয়েছে। এবারে ধরা গেল যে পুঁজির মালিক (মজুরি শ্রমিকের নিয়োগকর্তা) সেই পরিমাণ অর্থ দৈনিক মজুরি হিসাবে দিয়ে দিল, তাহলেই তো বলে দেওয়া যায় শ্রমিকের উৎপাদন তার উৎপাদিত মূল্যের সমান। কিন্তু এমনটি ঘটলে তো পুঁজির মালিকের জন্য কিছুই পড়ে থাকবে না। বাস্তবে যা ঘটে তা হল মজুরি দেওয়া হয় ছয়ঘণ্টার হিসাবে কিন্তু শ্রমিককে কাজ করতে হয় আট, দশ, বারো এমনকি চোদ্দ ঘন্টাও। কিছু ক্ষেত্রে তার চাইতেও বেশিক্ষণ কাজ করার ঘটনাও দেখতে পাওয়া যায়। মালিক বলে আমি শ্রমিককে নিয়োগ করেছি ছয় ঘন্টার জন্য নয়, গোটা দিনের জন্যই। এমন অবস্থায় বাড়তি সময়টুকু জুড়ে শ্রমিক যে বাড়তি মূল্য উৎপাদন করে তার সবটাই মালিকের অধিকারে চলে যায়। অর্থাৎ ছয়ঘণ্টার পরবর্তী সময়ে শ্রমিকের শ্রমশক্তির পুরোটাই ব্যয় হয় মালিকের জন্য, তার নিজের জন্য না। সুতরাং শ্রমিক তার কাজের খানিকটা অংশে ব্যয় হওয়া শ্রমশক্তির বিনিময়ে মজুরি পায় ঠিকই, কিন্তু বাকি অংশে বিনা মজুরিতে খাটে। সারাদিনের শেষে সে যে মজুরি পায় তা তার ব্যয় করা শ্রমশক্তির একটি অংশমাত্র। সারাদিনের কাজে সে শুধু নিজের মজুরির সমান মূল্যই তৈরি করে না, মালিকের জন্য উদ্বৃত্ত মূল্যও তৈরি করে। এই উদ্বৃত্ত মুল্যই পরবর্তীকালে সুনির্দিষ্ট আর্থিক নিয়মবিধি অনুসারে কয়েকটি খাতে বিন্যস্ত হয়, বন্টিত হয়। সেই বন্টনের প্রক্রিয়ায় জমির খাজনা (গ্রাউন্ড রেন্ট), মুনাফা ও পুঁজি সঞ্চয় (অ্যাকুম্যুলেশন অফ ক্যাপিটাল) ইত্যাদি সবই পুঁজিপতি শ্রেণীর একেকটি অংশের মালিকানায় জমা হয়। অর্থাৎ উদ্বৃত্ত যা কিছু উৎপাদিত হয় তার সবটাতেই সেই শ্রেণীর অধিকার কায়েম হয় যারা শ্রমসাধ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আদৌ অংশগ্রহণ করে না। এভাবেই পুঁজিপতি শ্রেণীর হাতে ক্রমাগত উদ্বৃত্ত সম্পদের পাহাড় জমতে থাকে যা আসলে শ্রমজীবী শ্রেণীকে বিনে পয়সায় খাটিয়ে নেওয়া শ্রমের ফসল।

এই আবিষ্কারের সুবাদেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মুখোশটি খুলে পড়ে। যে ব্যবস্থা নিজেকে সমানাধিকার, ন্যায়বিচার, প্রকৃত মজুরি ইত্যাদি কথার আড়ালে রেখে আসলে অন্যের শ্রমজাত ফল আত্মসাৎ করেই টিকিয়ে রেখেছে তার শোষণের স্বরুপটি উদ্ঘাটিত হয়ে যায়। পূর্বতন সমাজব্যবস্থাগুলিতে (দাস ব্যবস্থা, সামন্ত শাসন ইত্যাদি) শোষণ ছিল সরাসরি, চোখের সামনে। দাস মালিক কিংবা সামন্তশাসনের জোয়ালে পিষতে থাকা মানুষের উপরে চাপিয়ে দেওয়া শোষণকে প্রত্যক্ষরূপে উপলব্ধি করা যেত। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সেই শোষণকে আড়ালে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আগেকার শাসন ব্যবস্থার মতোই শোষক ও শোষিতের বন্দোবস্তটি পুঁজিবাদেও টিকে রয়েছে, মজুরির কৌশলে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এই যা। ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে শোষণের মুল কথাটি একই রয়েছে, বিনা মজুরিতে খাটিয়ে নেওয়া, অন্যের শ্রমজাত ফসল আত্মসাৎ করা। এই সকল সমাজব্যবস্থায় ফারাক শুধুমাত্র এটুকুই যে সেই আত্মসাৎকরণ বা খাটিয়ে নেওয়ার কৌশলটি একেক যুগে একেকরকম। মার্কস তাকেই সামনে নিয়ে এলেন। স্পষ্ট হয়ে গেল পূর্বতন ব্যবস্থাগুলির মতো পুঁজিবাদী ব্যবস্থাও অনেকের উপরে কতিপয়ের শোষণ চালানোর বন্দোবস্ত কায়েম করেছে। সেই কতিপয় অংশটিও ক্রমশ ছোট হতে থাকে, পুঁজির সঞ্চয় ক্রমাগত অল্প কিছুজনের হাতেই আটকে থাকে।

এই দুটি সত্যকে ভিত্তি করেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারণা নির্মিত হয়েছে। মার্কসের আবিষ্কার এখানেই থেমে থাকেনি, ক্যাপিটালের দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হলেই আমরা দেখতে পাবো পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের এমন কিছু বৈশিষ্ট সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেছেন যেগুলি প্রথম খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। মার্কস শুধু আলোচনা করেননি, তার সমালোচনা কার্যত এই প্রসঙ্গে বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গীকে তুলে ধরেছে। আশা করা যায় দ্বিতীয় খণ্ডের পান্ডুলিপিটি দ্রুত ছাপাখানায় পোঁছাবে, কেননা কাজটি শেষ করতে মার্কস নিজেই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।   

প্রাককথন ও অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ

Spread the word