সৌভিক ঘোষ
কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা
১৯২৪ সালের মার্চ মাস নাগাদ কানপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সমীপে কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলার সম্পূর্ণ চার্জশিট পেশ হয়। প্রথম শুনানি হয়েছিল ১৭ই মার্চ, আসামী হিসাবে আটজনের নাম ছিল। মানবেন্দ্রনাথ রায় বিদেশে থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। রামচরনলাল শর্মা ফরাসী উপনিবেশ পন্ডিচেরিতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন, তাকে আদালতে হাজির হতে হয়নি। সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার টাইফয়েড আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ থাকায় পুলিশের কাছে চিকিৎসকের সার্টিফিকেট জমা করেন, তার জামিন মঞ্জুর হয়।
ঐ বছরই ২০শে মে মামলার রায় ঘোষণা হয়। মুজফফর আহমদ, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, শওকত উসমানী ও নলিনীভূষণ দাশগুপ্তের প্রত্যেককে চার বছর সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হল। জেলে অল্প কিছুদিনের জন্য তাদের ‘ফার্স্ট ক্লাস মিসডিমিন্যান্ট’ (বিশেষ মর্যাদার বন্দী) হিসাবে রাখার পরে ব্রিটিশ সরকার নিজেদের মত বদল করে, চারজনই ‘বলশেভিক কয়েদী’ হিসাবে চিহ্নিত হন। এই চিহ্নিতকরণের সুবাদে তাদের প্রত্যেককে সেলের বাইরে এবং ভিতরে সর্বত্র গলায় লোহার হাঁসুলি, এক পায়ে লোহার কড়া পরিয়ে রাখা হয়।
এর আগে ঢাকা জেলে বন্দী থাকাকালীনই মুজফফর আহমদের শরীর ভেঙ্গে পড়েছিল। কানপুর বলশেভিক মামলার রায়ে জেলবন্দী অবস্থায় তার ‘ইন্সিপিয়েট টিউবারকিউলিসিস’ রোগ স্পষ্ট হল। তাঁর স্মৃতিকথায় রয়েছে- ‘১৯২৪ সালের জুলাই মাসের এক রাত্রিতে রায়-বেরেলি জেলে আমাকে একা একটি বাড়ীতে রাখা হয়েছিল। সঙ্গে ছিল শুধু একজন কয়েদী। নিকটে কোথাও একজন জেলের ওয়ার্ডার ছিল। আমার সামান্য কাশি হলো, তারপরে আমার মুখ দিয়ে অনেক রক্ত পড়ল। থুথু ফেলার কোনো পাত্র ছিল না, সব রক্ত আমি মেঝেয় ফেললাম। যুক্ত প্রদেশে (উত্তর প্রদেশ) জেলের মেঝে কাঁচা অর্থাৎ মাটির। সকালে জেলের ডাক্তার (সাব অ্যাসিস্টান্ট সার্জেন) এসে মাটি চেঁছে সব কিছু ফেলে দিলেন। বেলা হতে জেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট ডাক্তার ডি. কে. মুখার্জি এলেন। তিনি আবার রায়-বেরিলি জেলার সিবিল সার্জেন। পাইওরিয়ার জন্যে আমার মাঢ়ী খুব খারাব ছিল। তিনি বললেন, রক্ত মাঢ়ী থেকে এসেছে। আমার দিক থেকে আর কিছু করার ছিল না, তবে ডাক্তার মুখার্জি আমার খবর নিতেন ও মাঝে মাঝে আমায় পরীক্ষাও করতেন! এর মধ্যে তিনি কোথায় কি কি রিপোর্ট পাঠাতেন তা আমি জানতে পেতাম না। একদিন তিনি এসে আমায় বললেন যে আমায় আলমোড়া ডিস্ট্রিক্ট জেলে পাঠানো হবে। আরও বললেন লোকে আলমোড়ার মতো হিল স্টেশনে চেষ্টা করেও খরচের জন্যে যেতে পায় না, আর তুমি স্টেটের খরচে যাচ্ছ। যত পার খাওয়ার চেষ্টা করবে।’
এসবের মধ্যেই কানপুরে এক অপ্রত্যাশিত আয়োজনের ঘোষণা সামনে আসে!
১৯২৪’র জুলাই মাস নাগাদ একটি হিন্দি কাগজের পাতায় খবর! তারও আগে জুন মাস নাগাদ প্রকাশিত এক লিফলেটে একই ঘোষণা। ভারতের কমিউনিস্টরা আগামী ২৬-২৮ ডিসেম্বর তারিখে (১৯২৫) কানপুরে আয়োজিত এক সম্মেলনে মিলিত হতে চলেছেন। ঐ সম্মেলন থেকেই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করা হবে। কমিউনিস্ট আদর্শে আস্থাশীল সমস্ত পক্ষেকেই এ সম্মেলনে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
পাহাড়ের উপরে স্থাপিত আলমোড়া জেলে মুজফফর আহমদ’কে ঠিক এক দিন বন্দী থাকতে হয়েছিল। সরকারী নথী অনুসারে স্বাস্থ্যের অবনতির কারণেই নির্ধারিত শাস্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার অনেক আগেই (১৯২৫ সালের ১২ই ডিসেম্বর) ব্রিটিশ সরকার তাঁকে মুক্তি দিল। মুক্ত হওয়ার পরে মুজফফর আহমদ আরও কিছুদিন আলমোড়াতেই থেকে যান।
সেখানে থাকতেই তার হাতে চিঠি এল, সঙ্গে কিছু টাকাও রয়েছে!
চিঠির লেখক সত্যভক্ত। কানপুর সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার আমন্ত্রণ এবং রাহাখরচ বাবদ তিরিশ টাকা।
মুজফফর আহমদ সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
কানপুর কমিউনিস্ট সম্মেলন
নিজের সম্পাদনায় প্রকাশিত কাগজে ঐ সম্মেলন ঘোষণা করেছিলেন ‘চিকন লাল’। অবশ্য ততদিনে তার আসল নাম অনেকটাই আড়ালে চলে গেছিল, তাকে সকলেই ‘সত্যভক্ত’ নামে চিনতেন। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করার সময় সশস্ত্র বিপ্লবপন্থায় আকৃষ্ট হন, পরে হয়ে ওঠেন গান্ধিবাদী রাজনীতির সক্রিয় কর্মী। পরবর্তীকালে সে পথেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিজিবি)-র নেত্রী সিলভিয়া প্যাংকহার্স্টের সাথে চিঠিপত্র মারফৎ যোগাযোগ ছিল। সিলভিয়াই তাকে কমিউনিস্ট সাহিত্য পড়তে উৎসাহ ও প্রাথমিক রসদ যোগান। শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গের সাথে পরিচিত হওয়ার সুবাদে সে উৎসাহ আরও বাড়ে।
দেশের মাটিতে সক্রিয় সমস্ত কমিউনিস্ট গোষ্ঠীগুলিকে একজায়গায় এনে একটি পার্টি গড়ে তোলা যে বিশেষ প্রয়োজন ততদিনে সে সত্য অনেকেই উপলব্ধি করছিলেন। কিন্তু কেউই সে কাজ খুব একটা এগোতে পারেননি।
কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালীন সত্যভক্ত ঐ ঘোষণা করে সকলকে প্রায় চমকে দেন। সম্মেলন উদ্বোধনের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কমিউনিস্ট সাংসদ সাপুরজি শাকলাতওয়ালা’কেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনিও সম্মতি জানান।
অনেক পরে ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স আর্কাইভ থেকে জানা যায় কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হওয়ার আগে গোয়েন্দাদের প্রাথমিক রিপোর্টে মোট ১৩জনকে গ্রেপ্তার করার আবেদন জানানো হয়েছিল। সে তালিকায় শেষ নাম ছিল সত্যভক্তের। সরকারী আইনজীবীরা কোনও ‘লুজ এন্ড’ রাখতে চাননি। তাই কয়েকজনের সাথে সত্যভক্তের নামটিও চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ যায়। এসব কথা সত্যভক্ত জানতেন না। মুজফফর আহমদ লিখে গেছেন ঐ খবর জানলে তিনি কিছুতেই কানপুর সম্মেলনের আয়োজন করতেন না।
জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি ঐ আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার বিবেচনায় রাশিয়ায় যেভাবে সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়েছে ভারতেও তেমনটাই প্রয়োজন। কমিউনিজম বলতে এর চাইতে বেশি কিছু ভাবতে তিনি কখনো রাজী ছিলেন না। সম্মেলনের আগেও না, পরেও না। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতাবোধ যে শুধু তার চেতনায় অনুপস্থিত ছিল না তাই নয়, তিনি সরাসরি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতার বিরোধী ছিলেন।
এমন একজন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা করবেন!
দেশজুড়ে কমিউনিস্টরা সিদ্ধান্ত নিলেন, সত্যভক্ত’কে এভাবে যা ইচ্ছা তাই করতে দেওয়া চলে না।
আলমোড়া থেকে ট্রেন ধরলেন মুজফফর আহমদ। লাহোর থেকে শামসুদ্দিন হাসান ও রামচন্দ্র, পাঞ্জাব থেকে সন্তোক সিং, ঝাঁসি থেকে অযোধ্যা প্রসাদ, বোম্বে থেকে এলেন আর এস নিম্বকর, জে পি বাগেরহাট্টা, কে এন যোগলেকর ও এস ভি ঘাটে। মাদ্রাজ থেকে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারের সাথে এসে উপস্থিত হলেন কামেশ্বর রাও ও কৃষ্ণস্বামী আয়েঙ্গার। কলকাতা থেকে পৌঁছলেন রাধামোহন গোকুলজি।
সবমিলিয়ে ৫০০ জন প্রতিনিধি। সাপুরজি শাকলাতওয়ালা শেষ অবধি এসে পৌঁছতে পারলেন না, একটি বিবৃতি পাঠিয়ে দিলেন। তার অনুপস্থিতিতে সভাপতি নির্বাচিত হলেন সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার। ৩০ জনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি নির্বাচন করা হল। ১৬জন সম্মেলন থেকে নির্বাচিত হলেন, বাকিরা পরে কো-অপ্ট হবেন। পার্টির কেন্দ্রীয় দপ্তর বোম্বে’তে স্থাপন হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ইংরেজিতে প্রকাশিত ‘লেবর কিষাণ গেজেট’ই হবে পার্টির মুখপত্র। সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার সভাপতি, আজাদ শোভানি সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক হিসাবে এস ভি ঘাটে ও জানকী প্রসাদ হলেন সাধারণ সম্পাদকদ্বয়, অফিস বেয়ারার্সরা নির্বাচিত হলেন। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির তরফে কলকাতার জন্য মুজফফর আহমদ, মাদ্রাজের জন্য কৃষ্ণস্বামী আয়েঙ্গার, কানপুরের জন্য সত্যভক্ত এবং লাহোরের জন্য এস ডি হাসান’কে দায়িত্ব দেওয়া হল। শাকলাতওয়ালার লিখিত বিবৃতি পাঠ করার পরে সভাপতি হিসাবে সিঙ্গারাভেলু এক দীর্ঘ ভাষণ দেন। চিত্তরঞ্জন দাস, বাল গঙ্গাধর তিলকের নামের সঙ্গে একসাথেই লেনিন, রোজা লুক্সেমবার্গ ও কার্ল লিবনেখটের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন তিনি। তার ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ দুটি-
১) ভারতীয় সমাজের সমস্যা হিসাবে জাতিভেদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে আগামিদিনের বিপদ হিসাব চিহ্নিত করলেন তিনি। অন্ত্যজ মানুষকে ‘অচ্ছুৎ’ বিবেচনা করার প্রথাকে জাতীয় কৃষিসমস্যার অন্যতম হিসাবে তুলে ধরেন। সিঙ্গারাভেলু’র বক্তব্য ছিল কৃষিবিপ্লবের মধ্যে দিয়েই এসকল সমস্যার সমাধান সম্ভব, জনসাধারণের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন ব্যতিরেকে সে কাজ হবে না।
২) দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, জমি, বনাঞ্চল, ফ্যাক্টরি, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন সহ রেলওয়ের মতো যাবতীয় কিছুর জাতীয়করণ করা দরকার বলে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।
গোলমাল বাধল পার্টির নাম চূড়ান্ত করার সময়।
সত্যভক্তের প্রস্তাব নাম হবে ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি’, কমিন্টার্ন ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিতে তিনি সরাসরি অস্বীকার করলেন।
সত্যভক্তের প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধির ভোটে পরাজিত হল। কমিউনিস্টরা যেমনটা চাইছিলেন সেটাই সিদ্ধান্ত হল। ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ অর্থাৎ গোটা দুনিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি একটাই।
নিজের ব্যাগে যাবতীয় কাগজপত্র ভরে তিনি সম্মেলনের মঞ্চ থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন।
পরে অতীতের মূল্যায়ন করার সময় পার্টি উল্লেখ করেছে ঐ সম্মেলন কমিউনিস্টদের এগিয়ে যেতে উৎসাহ বাড়িয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সম্মেলন থেকে নির্ধারিত অনেক কিছুই মার্কসবাদ সম্মত ছিল না। পার্টির কোনও সংবিধান কিংবা কর্মসূচি কিছুই ছিল না। এ সম্মেলনের আগেই ভারতে এআইটিইউসি প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছিল। কিন্তু দেশের শ্রমিক-কৃষক অংশের মানুষ, এমনকি জনসাধারণের এক বিরাট অংশই কমিউনিজম কিংবা কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে তখনও প্রায় কিছুই জানে না, পার্টি বা সংগঠনের চেহারা ছিল মূলত গোপন বিপ্লবী সংগঠনের মতো। এ উপলব্ধি মাথায় নিয়েই কমিউনিস্টরা আগামীদিনে সক্রিয় হতে চাইছিলেন।
ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টি গঠন
জনসাধারণের শ্রমজীবী অংশের উপরে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির লক্ষ্যেই কলকাতায় ফিরে এসে মুজফফর আহমদ’রা নতুন করে সক্রিয় হন। নজরুল ইসলামের সঙ্গে ‘লাঙ্গল’ পত্রিকা সম্পাদনার কাজে যুক্ত হলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল সরাসরি শ্রমজীবী মানুষের কাছে পৌঁছানো। লাঙ্গল শুধুমাত্র কৃষকদের প্রতীক ছিল না, তাও অনেকে ভুল বুঝেছিলেন। তাই ১৯২৬ সালে পত্রিকার নাম বদলে ‘গণবাণী’ হয়, কাগজের কভারে উল্লিখিত ছিল লাঙ্গল, গনবানি’তে মিশে গেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। তখন যুগ্ম সম্পাদক হিসাবে মুজফফর আহমদের সঙ্গে প্রথমে প্যারীমোহন দাশ, পরে কালীকুমার সেনের নাম যুক্ত করা হয়।
ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাতেই, ১৯২৫ সালে। ১৯২৭ সালে বোম্বে’তে ঐ পার্টি গড়ে ওঠে, মারাঠি ভাষায় প্রকাশিত ‘ক্রান্তি’ ছিল মুখপত্র। সে বছর পাঞ্জাবেও ‘কীরতি কিষাণ পার্টি’ গঠন হয়, উদ্যোক্তারা ছিলেন ভাগ সিং কানাডিয়ান ও সোহন সিং জোশ। উত্তরপ্রদেশের মিরাটে পার্টির গঠন হল ১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে। সিদ্ধান্ত হল ঐ বছরের শেষদিকে ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় সর্বভারতীয় সম্মেলন হবে, সংগঠনকে জাতীয় পার্টিতে রূপান্তরিত করা হবে।
জাতীয় কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে মুজফফর আহমদ উপস্থিত ছিলেন। অধিবেশন চলাকালীন ফিলিপ স্প্রাট’কে সঙ্গে নিয়ে তিনি ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টির সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করেন, দাবী জানানো হয় কন্সটিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির নির্বাচন করতে হবে। বাংলায় ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টির তৃতীয় সম্মেলন (১৯২৮, এপ্রিল) থেকে ‘আ কল টু অ্যাকশন’ শিরোনামে কর্মসূচি ধাঁচের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হল। ততদিনে দেশজুড়ে সাইমন কমিশন বিরোধী মেজাজ তুঙ্গে। ‘আ কল টু অ্যাকশন’ পড়লেই বোঝা যায় কমিউনিস্টরা নিজেদের কাজে আরও সংহত ও সাহসী হয়ে উঠছিলেন। এর সাথেই প্রচারিত হয়েছিল ‘থিসিস অন আওয়ার অ্যাটিচিউড টুয়ার্ডস দ্য কংগ্রেস অ্যান্ড প্রেজেন্ট লেবর লিডারশিপ’। সে থিসিসের সঙ্গেই পরিকল্পনা হল উদ্ভুত পরিস্থিতির মোকাবিলায় ‘স্বতন্ত্র্য যুব সংগঠন’ গড়ে তুলতে হবে। সেই অনুসারেই বাংলায় ‘ইয়ং কমরেডস লিগ’ গড়ে ওঠে।
১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টি’র সর্বভারতীয় সম্মেলন আয়োজিত হয়। এই সম্মেলনের অধিবেশনে ভগত সিং সশরীরে উপস্থিত ছিলেন, অবশ্য গোপনে।
সর্বভারতীয় সম্মেলন থেকে দাবী ওঠে-
১) সম্পূর্ণ স্বাধীনতা।
২) আধিয়ার/ বর্গা প্রথার সঙ্গেই জমিদারি ব্যবস্থার অবলুপ্তি।
৩) সর্বভারতীয় কৃষক সংগঠন চাই।
ভারতের জনগণের চেতনায় ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টি ছিল কমিউনিস্ট পার্টির’ই নামান্তর মাত্র। ব্রিটিশ সরকারও বিরাট বিপদ উপলব্ধি করেছিল। সর্বভারতীয় সম্মেলন শেষ হতেই পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী ব্যাপক আকারে গ্রেপ্তার করা শুরু হল।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা
ব্রিটিশ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রসারিত করার কাজে অন্যতম বাধা ছিল সরকারী নিষেধাজ্ঞা, আজীবন কারাবাসের শাস্তি অথবা পুলিশের গুলিতে প্রান হারানো। কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা নিজেদের প্রাণ বাজি রেখেই সেই কাজ করেছিলেন – সারা দেশে পার্টি সংগঠন প্রসারিত করতে বহু বাধার পাহাড় তাদের পেরোতে হয়েছে তবু সেই কাজ একদিনের জন্যেও থেমে থাকেনি। তাই প্রথম থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে অন্যতম বিপদ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল।
১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টি গড়ে ওঠে। অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসেও তখন কমিউনিস্টদের প্রভাব আগের থেকে অনেকটাই বেড়েছে। আসন্ন কমিউনিস্ট বিপ্লবের ভয়ে ব্রিটিশ সরকার প্রমাদ গুনল। এ বিপদ থেকে মুক্তি পেতে ১৯২৯ সালে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হল। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তো বটেই এমনকি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনেও এই মামলার রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।
ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে একেবারে ধ্বংস করতে চেয়েই এ মামলা দায়ের হয়, কিন্তু ফল হল একশো আশি ডিগ্রি বিপরীত। মামলায় অভিযুক্ত কমিউনিস্ট নেতৃত্ব আদালতের কাঠগড়াকেই পার্টির কাজের প্রচার এবং প্রসারের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন পার্টির পক্ষে কেউ নিজের বক্তব্য আলাদা করে না জানিয়ে সম্মিলিত একটি সাধারণ বক্তব্য তুলে ধরা হবে। ঐ বক্তব্যই হবে আদালতের সামনে তাদের জবাব, দেশবাসীর সামনে তাদের কর্মসূচী। গোটা দেশে কমিউনিস্টদের খবর ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রচারের কাজ, বিস্তারের কাজ সরকারী বিধিনিষেধের কারনেই বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল। আদালতের কাঠগড়াকেই সে উদ্দেশ্যে অসাধারণভাবে ব্যবহার করেন কমিউনিস্টরা। ফ্যাসিস্ত বাহিনীর হাতে বন্দী অবস্থায় জর্জি দিমিত্রভ এভাবেই নিজের বক্তব্য প্রচার করেছিলেন। বিচারাধীন বন্দী হিসাবে আদালতে দাঁড়িয়ে কিউবা বিপ্লবের নেতা ফিদেল কাস্ত্রোও সেই একই পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালীন কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা আদালতের সামনে যে সাধারণ বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন তাকেই ‘Communists Challange Imperialism From The Dock’ শিরোনামে একটি ইংরেজি বই প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ন্যাশনাল বুক এজেন্সি। বইতে মুখবন্ধ লেখেন মুজফফর আহমদ। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি ছিলেন অন্যতম অভিযুক্ত।
মুখবন্ধের রয়েছে- ‘কলকাতা হাইকোর্টের স্বনামধন্য ব্যারিস্টার মিঃ ল্যাংফোর্ড জেমস’কে ব্রিটিশ প্রশাসন মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় সরকারী উকিল হিসাবে নির্বাচিত করেছিল, কাজে সহায়তার জন্য ব্যারিস্টার ল্যংফোর্ড নিজের অধিনস্ত মিঃ জ্যোতিপ্রকাশ রায়কে জুনিয়র কাউন্সিল হিসাবে নিযুক্ত করেন। ব্রিটিশ সরকার মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা সংক্রান্ত কাজে ব্যারিস্টার মিঃ ল্যাংফোর্ড জেমস’কে দিন প্রতি ৮০ গিনি এবং মিঃ জ্যোতিপ্রকাশ রায়কে দিন প্রতি ৫ গিনি খরচ দেবার চুক্তি করেছিল, সেই সময়কার হিসাব অনুযায়ী ১ গিনি = ভারতীয় মুদ্রায় ১৭ টাকা। ঠিক কবে থেকে তারা এই কাজে নিযুক্ত হন এই তথ্য পাওয়া যায় নি।’
‘প্রাথমিকভাবে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় ৩১ জনের নামে অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয়। আমির হায়দার খান এবং হিউগ লেস্টার হাচিনসনের নাম কিছুদিন পরে সেই তালিকায় যুক্ত হয়। হিউগ লেস্টার হাচিনসন একজন ইংরেজ যিনি সাংবাদিক হিসাবে ভারতে কাজ করতে এসেছিলেন, পরে একটি ইংরাজি দৈনিক পত্রিকায় লেখার কাজ করতে গিয়ে বোম্বাইতে কমিউনিস্ট ট্রেড ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন – তাকে গ্রেফতার করে আদালতে পেশ করা হয়। ব্রিটিশ পুলিশ আমির হায়দার খানকে গ্রেফতার করতে পারেনি। তিনি আমেরিকায় নাবিক হিসাবে পৌঁছান, সেখানে একটি অটোমোবাইল কারখানায় কাজ করার ফাঁকেই ইংরেজি ভাষায় কথা বলা এবং লেখার কাজে নিপুণতা অর্জন করেন। বিমান চালনার লাইসেন্স অর্জন করে একটি পুরানো বিমান অবধি কিনেছিলেন। আমির হায়দার খান আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেছিলেন, সেই সুবাদেই তিনি প্রশিক্ষনের জন্য মস্কো চলে যান। মস্কোয় কমিউনিস্টদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষন অর্জন করার পরে দেশে ফিরে এসে জেনারেল মোটরস কোম্পানিতে চাকরি নেন এবং ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির কাজে যুক্ত হয়ে যান। এই সময় তার নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হয়, সেই খবর পাওয়া মাত্র সুকৌশলে গ্রেফতারী এড়িয়ে তিনি ইউরোপে চলে গেছিলেন। ইউরোপ থেকে ফিরে তিনি মাদ্রাজে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে নিজেকে সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে নিয়োজিত করেন, আজকের দিনে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতৃত্বই তার হাতে প্রশিক্ষিত হয়েছেন। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার একেবারে শেষ লগ্নে পুলিশ তার নাগাল পায়। তাকে মিরাটের আদালতে হাজির করা হলে সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়া আবার প্রথম থেকে চালু করতে হবে বলে ব্রিটিশ সরকার আমির হায়দার খানকে মাদ্রাজ জেলেই বন্দী রাখে, সেখানেই তার বিচার হয় এবং দুবছর ভয়ানক শ্রমযুক্ত বন্দী হিসাবে জেলে থাকার শাস্তি ঘোষিত হয়।’
‘এ মামলায় আসামী হিসাবে আমাদের গ্রেফতার করে মিরাট জেলা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। প্রত্যেককেই আলাদা সেলে রাখা হয়, অনেকটা সেল্যুলার ব্যারাকের মতো জায়গায়। সকালে একবার এবং বিকালে একবার কিছুক্ষণের জন্য আমাদের সেল থেকে বাইরে আনা হতো, কেবলমাত্র তখনই আমরা একে অন্যের সাথে কথা বলার সুযোগ পেতাম। আমার ডানদিকের ব্যারাক দুটিতে শওকত উসমানী এবং ডঃ গঙ্গাধর অধিকারীকে রাখা হয়েছিল। এর আগে, ১৯২৪ সালে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় আমি এবং শওকত উসমানী আসামী হিসাবে জেলে ছিলাম, ডঃ গঙ্গাধর অধিকারীর এই প্রথম জেলে আসা। কানপুর ষড়যন্ত্র মামলাকে বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা বলে প্রচার করতে ব্রিটিশ সরকার খুবই চেষ্টা করেছিল। সকাল এবং বিকালে কথা বলার সুযোগটুকু কাজে লাগিয়েই আমরা মামলা সম্পর্কে আলোচনা করে নিতাম। এমন আলোচনাতেই আমি ডঃ গঙ্গাধর অধিকারীকে জানাই, সরকার যেভাবে মামলা সাজিয়েছে তাতে আমাদের শাস্তির মেয়াদ দীর্ঘ হবেই, তাই সেশন কোর্টকেই আমাদের রাজনৈতিক প্রচারের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করবো না কেন ? আমি তাকে বলি যে এর আগে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলার সময়েই অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল, সেই সুযোগ আমরা নষ্ট করেছি। ডঃ গঙ্গাধর অধিকারী আমার প্রস্তাবে রাজী হলেন।’
‘১৯২৯ সালের ১৪ই মার্চ ইন্ডিয়া ইন কাউন্সিলের গভর্নর জেনারেল কয়েকজন ভারতবাসীর (কমিউনিস্ট বিপ্লবী- অবশ্য যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন তাদের মধ্যে এমনও কেউ কেউ ছিলেন যারা কমিউনিস্ট নন) বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২১-এ ধারায় মামলা মুঞ্জর করেন। পরেরদিন, ১৫ই মার্চ মিরাটের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করেন। এই পরোয়ানার ভিত্তিতে ব্রিটিশ পুলিশ অত্যন্ত তৎপরতার সাথে সারা দেশে ধরপাকড় এবং তল্লাশি শুরু করে। তল্লাশি করার সময় বইপত্র, কাগজ, লিফলেট যা কিছু সম্ভব পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে। এমনকি কলকাতায় ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টির দপ্তরের কাঠের ফলকটিও তারা বাজেয়াপ্ত করে। অভিযুক্ত যারা, সবাইকেই গ্রেফতার করা হয় ঐদিনই। চার বছরেরও বেশি সময় ধরে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার বিচার চলে। সেই থেকে প্রতি বছর ২০শে মার্চ তারিখটিকে সারা দেশে শ্রমিক, কৃষক এবং মেহনতি মধ্যবিত্ত মানুষ মিরাট দিবস হিসাবে পালন করতে শুরু করে।’
‘এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি ডঃ স্যার শাহ সুলেমান এবং বিচারপতি জে ইয়ং-র রায়ের ভিত্তিতে ১৯৩৩ সালের ৩রা অগাস্ট ভারতের প্রধান বিচারপতি মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার রায় ঘোষণা করেন। এ মামলার রায়ে মুজফফর আহমদকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের শাস্তি ঘোষণা করা হয়। এস এ ডাঙ্গে, ফিলিপ স্প্রাট, এস ভি ঘাটে, কে এন যোগলেকর এবং আর এস নিম্বকরের ১২ বছরের জন্য দ্বীপান্তরের শাস্তি হয়। বি এফ ব্রাডলে, এস এস মিরজকর, শওকত উসমানীর ১০ বছরের জন্য দ্বীপান্তর, মির আবদুল মজিদ, সোহন সিংহ যশ, ধরনীকান্ত গোস্বামীর ৭ বছরের জন্য দ্বীপান্তর, অযোধ্যা প্রসাদ, গঙ্গাধর অধিকারী, পূরণ চাঁদ যোশী এবং এম জি দেশাইয়ের ৫ বছর দ্বীপান্তর ঘোষিত হয়। গোপেন্দ্র চক্রবর্তী, গোপাল চন্দ্র বসাক, এইচ এল হাচিন্সন, রাধা রমণ মিত্র, এস এইচ ঝাবওয়ালা এবং কেদার নাথ সেহগলকে ৪ বছরের জন্য সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়, শামসুল হুদা, এ এ আলভে, জি আর কাসলে, গৌরি শংকর এবং লক্ষণ রাও কদমকে ৩ বছরের জন্য সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়।’
‘এই মামলার পরে ৩৫ বছর কেটে গিয়েছে। আদালতে দাঁড়িয়ে কমিউনিস্টদের সেইদিনের বক্তব্য আজ বইয়ের চেহারায় পড়া যায়। ভারতীয়রা তো বটেই, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষজনও বইটি আগ্রহের সাথে পড়বেন বলেই আমার একান্ত বিশ্বাস। ভারতে আজকের প্রজন্মের কমিউনিস্টদের জন্য বইটি একটি প্রয়োজনীয় দলীল যা অধ্যয়ন করলে তারা বুঝবেন ৩৫ বছর আগে মিরাটে জেলে বন্দী থাকাকালীন কমিউনিস্টরা কি করেছিলেন, কি ভেবেছিলেন।’
এই মামলা ভারতে কমিউনিস্ট পার্টিকে জনসাধারণের সামনে পরিচিত করে তোলে। সংগঠনের বিস্তারে তার বিরাট প্রভাব পড়েছিল।
‘ড্রাফ্ট প্ল্যাটফর্ম অফ অ্যাকশন’
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের তরফে যৌথ বিবৃতি প্রকাশের আগেই পার্টির তরফে একটি কর্মসূচির ঘোষণা হয়েছিল। পরবর্তীকালে সে কর্মসূচি প্রসঙ্গে বহু বিতর্ক ও বিতন্ডা হলেও তৎকালীন পরিস্থিতির বিচারে এর বিশেষ গুরুত্ব ছিল। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের জন্য সেই বিবৃতির চর্চা আজও একান্ত জরুরী। নিছক ঐতিহাসিক তথ্য অনুসন্ধানের জন্য না, এমন বিশাল দেশে জনসাধারণের ব্যাপকতম অংশের মধ্যে পার্টির কাজকে বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে কিভাবে একটি সাধারণ বোঝাপড়া গড়ে তুলতে হয় তা উপলব্ধি করতে ঐ ড্রাফট প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন সত্যিই সহায়ক।
আজ আমাদের হাতে সময়োপযোগী পার্টি কর্মসূচি রয়েছে। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্তরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ ঘটনাবলীর প্রসঙ্গে পার্টির একাধিক লিটারেচর রয়েছে। সেদিন এসব কিছুই ছিল না। ঐ ড্রাফটই ছিল সে কাজের প্রাথমিক চেহারা।
১৯৩১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের করাচী অধিবেশনে এই কর্মসূচি তুলে ধরা হয়, উপস্থিত প্রতিনিধিদের মধ্যেও প্রচার করা হয়। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের নিজস্ব জার্নাল ইনপ্রেকরেও ঐ বিবৃতি ছেপে বেরোয়।
ঐ খসড়ায় উল্লেখ ছিল কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য:
১) ব্রিটিশ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কৃষিবিপ্লবের কাজ সম্পন্ন করা।
২) দেশের শ্রমিক ও কৃষকদের মুক্তি।
৩) ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন।
৪) সোভিয়েত সরকার প্রতিষ্ঠা।
৫) ব্রিটিশ মালিক, জমিদার, প্রাদেশিক রাজপরিবার ও সুদের কারবারিদের থেকে জমি, জঙ্গল সহ যাবতীয় সম্পত্তির অধিকার কেড়ে নেওয়া।
৬) শ্রমিকের কাজের সময়কে আট ঘণ্টা হিসাবে ঘোষণা।
এ লক্ষ্যে এগোনোর জন্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যে সকল দাবীর ভিত্তিতে সংগ্রাম করছে সেগুলি হল –
১) পুরুষ, মহিলা ও অপ্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকের প্রত্যেককে সমান কাজে সমান মজুরি চাই।
২) বাধ্যতামূলক শ্রমদান প্রথার অবসান, দাসখত ব্যবস্থার অবলুপ্তি চাই।
৩) প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকের ক্ষেত্রে বছরে চার সপ্তাহের সবেতন ছুটি, অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ছয় সপ্তাহ।
৪) বেকারদের জন্য রাষ্ট্রীয় বীমার বন্দোবস্ত। কর্মরত অবস্থায় রোগাক্রান্ত হলে, দুর্ঘটনা ঘটলে, পেশাগত কারণে অসুস্থ হলে এবং বার্ধক্য কিংবা শ্রমসাধ্য কাজে যুক্ত হওয়ার শক্তি হারালে সরকারী আর্থিক সহায়তা। শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষের জন্যও সরকারের তরফে উপযুক্ত আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা।
কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ দাবীসনদ ছিল এমন-
১) জাতিভেদ এবং সামাজিক রীতি অনুসারে উচ্চ ও নীচ পরিচিতির অবসান।
২) লিঙ্গ পরিচয়, ধর্মীয় আস্থা কিংবা জাতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকার।
৩) রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও ধর্মের মধ্যে কোনরকম সংযোগ না থাকা।
৪) ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে দেশের মাটি থেকে বিতাড়ন।
৫) বাকস্বাধীনতার অধিকার, প্রেস স্বাধীনতা আইন, নিজস্ব বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মাচরণের স্বাধীনতা, সভা-সমিতি, সংগঠন প্রতিষ্ঠার ও ধর্মঘটের অধিকার।
৬) জনস্বার্থবিরোধী ও শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী আইনসমূহ বাতিল ঘোষণা করা।
সাধারণভাবে পড়লেও এমন কর্মসূচিকে বিপ্লবী বলে চিহ্নিত করতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু এ পরিকল্পনায় সমাজ বদলের আন্তরিকতা থাকলেও পরিকল্পনা রুপায়নে বাস্তবসম্মত উপলব্ধির অভাব ছিল। সেই ভ্রান্তির কুপ্রভাব ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে দীর্ঘদিন ছিল। এমনকি বিধিসম্মত পার্টি কর্মসূচি গ্রহণের পরেও ছিল। অনেক পরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার সময় স্তালিন সে ভুল ধরিয়ে দেন।
‘বি টি রণদিভে উল্লেখ করেছিলেন- ‘Never before did India see such a revolutionary document directly addressing the problems of all sections of the Indian people and the immediate needs of the revolutionary struggle।’ এমন বৈপ্লবিক দলীল ভারতে আগে কেউ কখনো দেখেনি। দেশের জনসাধারণের সমস্ত অংশের আশু সমস্যা সমাধানের জন্য বিপ্লবী সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তাকে এই কর্মসূচি সরাসরি সামনে তুলে ধরেছিল।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, কমিন্টার্নের ষষ্ঠ ও সপ্তম কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত
দুনিয়া জুড়ে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত বদল ঘটছিল। পুঁজিবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্ব ছিলই, ঔপনিবেশিক দেশের মধ্যে চীনে কমিউনিস্টদের লড়াই নতুন মাত্রায় পৌঁছেছিল। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের তরফে অনেক আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল বিশ্ব পুঁজিবাদ সংকটগ্রস্থ হতে চলেছে। কমিউনিস্টদের বক্তব্যকে প্রমাণ করে দিল ৩০’র দশকের অর্থনৈতিক মহামন্দা। এর প্রভাব পড়ল দুনিয়ার সর্বত্র।
ব্রিটিশ শাসকেরা নিজেদের দেশের অর্থনৈতিক সংকটের বোঝা ভারতীয়দের ঘাড়ে চাপিয়ে বাঁচতে চাইল।
এর প্রভাবে ভারতের জনসাধারণকে ব্যপক দুর্দশার সম্মুখীন হতে হয়। খাদ্য সংকটের পরিস্থিতি তৈরি হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শ্রমিক অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তৎকালীন পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কল-কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়নগুলি অভূতপূর্ব সংগ্রামের ইতিহাস তৈরি করে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কলকাতা ও বোম্বাইয়ের লড়াই।
বোম্বে’তে মিল মালিকেরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবল প্রতিযোগিতার অজুহাতে এক নতুন স্কিমের প্রস্তাব আনে। মূল কথা ছিল মাথা পিছু কাজের বোঝা বাড়িয়ে দাও, স্থায়ী মজুরির বিধি বাতিল করো, অস্থায়ী ঠিকা মজুরির পরিমাণ আরও কমাও। এর নাম দেওয়া হয় ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন’- বাংলায় সময়োপযোগীকরণ বা আধুনিকিকরণ। কারখানায় শ্রমিক-মজদুরদের কাজের সময় না বাড়ালেই নয়। কারখানা চালানোর স্বার্থে মজুরিতে কাটছাঁট না করলেই নয়। যারা কর্মরত তাদের কিছুটা বাড়তি কাজের বোঝা মেনে নিতে হবে। বদলি’র নামে ঠিকা কাজের যেটুকু বন্দোবস্ত রয়েছে সেসব বাতিল করে দিতে হবে। অন্তত পনেরো হাজার মানুষ কাজ হারাবেন।
সব মিলিয়ে বিয়াল্লিশটি মিল ইউনিট। একসাথে প্রায় দেড় লক্ষ শ্রমিক-মজদুর। প্রত্যেকেই স্ট্রাইকের সিদ্ধান্তে ঐক্যবদ্ধ। এতদিন বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন কারখানায় কর্মরত শ্রমিকেরা নিজেদের মতো করে পিকেটিং ইত্যাদি চালিয়েছেন। এবার তারা এক হলেন, ৪২টি মিলেই কাজ বন্ধ হল। ব্রিটিশ পুলিশ আগে থেকেই তৈরি ছিল, মালিকদের হয়ে তারাই স্ট্রাইক ব্রেকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হল। হুমকি, নোটিশ জারী, গ্রেফতার, লাঠিচার্জ এসব শ্রমিকদের গা-সওয়া হয়েই গেছিল, তাই এবারের আক্রমণ শুরুই হল সরাসরি আক্রমণ দিয়ে।
শিল্পকারখানায় এমন ব্যাপার অন্তত বোম্বে’তে এর আগে কখনো ঘটেনি। প্রতিদিন নতুন নতুন লোক আসে, সারাদিনের শেষেও কেউই ফিরে যেতে চায় না। মজদুর ইউনিয়নের সে জোর কথায় যে এত মানুষের জন্য দুমুঠো খাবার জোটে? কিন্তু খাবার জুটেছিল, সহায়তা এসেছিল। একদিকে ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার লিগ অফ ইন্ডিয়া, আরেকদিকে রাশিয়া বা বলা ভালো সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই জোরেই পুরো এলাকায় চোদ্দটি ‘সেন্টার’ খোলা হল। এতদিন যখন শ্রমিকেরা, তাদের পরিবার কি খেয়ে বাঁচবে তার ঠিক ঠিকানা ছিল না, দেশীয় সংবাদমাধ্যমের বিরাট মাতব্বরেরা মুখে রা’টুকু কাড়েননি। এবার তারাও ময়দানে নামলেন। স্ট্রাইকের শেষদিন অবধি সেই সহায়তা জারী ছিল। কাগজওয়ালারা কি প্রচার করলেন? প্রথমে বলা হল এসব জঘন্য হাঙ্গামায় মস্কোর এজেন্ট এসে ঢুকছে। এতে চিঁড়ে ভিজছে না দেখে সেই একই লোককে ল্যাঙ্কাশায়ারের এজেন্ট বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল। উদ্দেশ্য এই যে ল্যাঙ্কাশায়ারের এজেন্ট যখন সে তো চাইবেই দেশীয় বস্ত্রশিল্প ধ্বংস হয়ে যাক।
দেশে নিষেধাজ্ঞার পরিস্থিতি, কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে কাজ করতে পারছে না। ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টির নামে কমিউনিস্টরা সেই বাধা পেরোতে লড়াই করে গেছেন। স্ট্রাইক শেষ হয়েছিল। ছয় মাসের জীবনপণ লড়াই’র পরে বম্বে’র স্টেট গভর্নমেন্ট হস্তক্ষেপ করে। মালিকদের সাথে ট্রেড ইউনিয়নের আলোচনার শেষে এবং ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন স্কিম’ স্থগিত রাখার ঘোষণা হল। সরকার একটি কমিটি করে দেয় যারা শ্রমিকদের দাবিদাওয়া সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে পর্যালোচনা করবে। এই অবধি পড়েই থেমে যাবেন না, ঠিক যেমন সেদিন শ্রমিক-মুজদুরেরা স্ট্রাইক তুলে নিতে রাজি হলেও ওখানে থেমে থাকেননি। তারা উপলব্ধি করেছিলেন এহেন সরকারী কমিটি আসলে মালিকদের বাড়তি সময় যোগাবে, নতুন অজুহাতে আবার তারা একই কাজ করবে। তবে আগের চাইতে এবারের লড়াই হবে অন্যরকম। কারণ এতদিন তারা আশংকায় থাকতেন কবে মালিকরা নতুন কায়দায় নিপীড়ন বাড়িয়ে দেয়। এইবার সে লড়াইয়ের জন্য তারা মানসিকভাবে তৈরি রইলেন। উপলব্ধি করলেন পুঁজি বনাম শ্রমের দ্বন্দ্ব। এই উপলব্ধির জোরেই শ্রমিক আন্দোলন নতুন মাত্রায় পৌঁছে যায়, গেলও তাই। তাই ‘বোম্বে মিল স্ট্রাইক’ ঘটনামাত্র নয়, এক ঐতিহাসিক শিক্ষা।
এই গোটা পর্বের ইতিহাসকে নিজের চোখ, কান, হাত এমনকি দুপায়ের ভরসায় সাক্ষ্য করেছেন যারা, বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্র্যাডলে ছিলেন তাদেরই অন্যতম। ব্রিটেনের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পক্ষ থেকে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ব্র্যাডলে’কে। প্রথমে মস্কোর পরে ল্যাঙ্কাশায়ারের এজেন্ট বলে অপদস্থ করার চেষ্টা হয়েছিল ব্র্যাডলেই ছিলেন সেই লোক। রিপোর্টাজের ধাঁচে তার ধারাবাহিক লেখা থেকেই আমরা স্ট্রাইকের ঐতিহাসিক উপাদানগুলি সংগ্রহ করেছি।
দেশজুড়ে এমন অসন্তোষের পরিস্থিতিকে কমিউনিস্ট পার্টি যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারেনি, এই মূল্যায়ন পার্টি নিজেই করেছে। অবশ্য এর একটি কারণ ছিল মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার সুবাদে তখন পারড়তির উপরে ব্যপক আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছিল। ভবিষ্যতে দেশজুড়ে কমিউনিস্ট পার্টির কাজ সংহত করতে সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়। সেই উদ্দেশ্যেই ১৯৩৩ সালে কলকাতায় এক জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন হয়। ঐ সম্মেলন একটি অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কমিটিকে দায়িত্ব দেয় এবং আগামী রাজনৈতিক কর্মসূচির একটি খসড়া প্রকাশ করে।
ততদিনে বলশেভিক পার্টি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে লিওঁ ত্রতস্কি’কে বহিস্কার করা হয়েছে।
কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ষষ্ঠ কংগ্রেস থেকে ঔপনিবেশিক শাসনাধীন দেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ও কমিউনিস্ট পার্টিগুলির কর্তব্য প্রসঙ্গে নিজেদের আন্তর্জাতিকের এতদিনকার অবস্থানে বদল ঘটল।
আন্তর্জাতিকের সিদ্ধান্ত ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের অন্তভূর্ক্ত দেশে বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে চলা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে কমিউনিস্টরাও যুক্ত হবে। এর পাশাপশি তারা দেশের শ্রমজীবী জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন সংগঠন, পার্টি ( যেমন আমাদের দেশে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজ্যান্টস পার্টি গড়ে উঠেছিল) গড়ে তুলে বিপ্লবী সংগ্রামের পথেও এগোনোর চেস্টা করবে। ষষ্ঠ কংগ্রেস থেকে বলা হল ঐ ধরনের পার্টি শেষ অবধি পাতি বুর্জোয়াদের দখলে চলে যাবে, তাদেরই স্বার্থরক্ষা করবে। এমন অবস্থান বদলের প্রভাবে ভারতের মতো দেশে কমিউনিস্ট পার্টির কাজে এতদিনকার বোঝাপড়ায় ধাক্কা লাগল। ষষ্ঠ কংগ্রেস নির্দেশ দিল –
১) সমাজে বিদ্যমান সামন্ত জমিদার শাসনের যাবতীয় চিহ্নই মুছে দিতে হবে।
২) কৃষিবিপ্লব সম্পন্ন করার মাধ্যমে সোভিয়েত সাধারনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আন্তর্জাতিকের ষষ্ঠ কংগ্রেস ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকা দেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রসঙ্গে কৃষি বিপ্লবের গুরুত্ব ও শ্রমিক শ্রেণীর চরিত্র সম্পর্কে মার্কসবাদ সম্মত সঠিক অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে ইউনাইটেড ফ্রন্ট গড়ে আন্দোলন-সংগ্রাম চালানোর অবস্থান থেকে সরে এসে গৃহীত নয়া কলোনিয়াল থিসিসে জাতীয় মুক্ত সংগ্রামে কমিউনিস্টদের রণকৌশল ও জাতীয় বুর্জোয়াদের ভূমিকা সম্পর্কে নানা পরস্পর বিরোধী বোঝাপড়া দেখা গেল। ষষ্ঠ কংগ্রেসে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইতে কমিউনিস্ট পার্টির একক সক্ষমতাকে বড় করে বিবেচনা করার ভ্রান্তি ঘটেছিল বলা যায়। অধিবেশনে উপস্থিত ভারতের কমিউনিস্ট প্রতিনিধিরা নয়া কলোনিয়াল থিসিসকে সমর্থন করলেও সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্পষ্টভাবেই ভারতের মতো দেশে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টির উপযোগিতার কথা তুলে ধরেছিলেন। ষষ্ঠ কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি ‘প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন’ নামে আরেকটি দলীল গ্রহণ করে। যদিও কয়েকবছরের মধ্যে সেটিও অকার্যকর উপলব্ধি হওয়ায় নতুন করে অচলাবস্থা দেখা দেয়।
১৯৩৫ সালে আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেস আয়োজিত হয়। ততদিনে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদের বিপদ সবার সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে। ঔপনিবেশিক ও আধা ঔপনিবেশিক দেশ সমূহে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রশ্নে ফ্যাসী বিরোধী ও বিশ্বযুদ্ধ বিরোধী অবস্থান গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। এই কংগ্রেস নিজের আগেকার সংকীর্ণ রাজনৈতিক লাইন পরিহার করে। এর পিছনে জর্জি দিমিত্রভের বিশেষ ভূমিকা ছিল। নিজের বক্তব্য পেশ করার সময় তিনি কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে শ্রমিকশ্রেণীর ব্যাপক জোট গড়ে তুলে নিজেদের দেশে ফ্যাসিবাদের বিপদ রুখে দেওয়ার কর্তব্যকে অত্যন্ত সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছিলেন।
নতুন পরিস্থিতিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক লাইনকে সময়োপযোগী করার জন্য রজনী পাম দত্ত এবং বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্র্যাডলে একযোগে দলীল পেশ করলেন। সেই দলীলই ‘দত্ত-ব্র্যাডলে থিসিস’ নামে প্রখ্যাত।
ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ঐ দলীল কার্যত নতুনভাবে এক শক্তসমর্থ ভিতের উপরে দাঁড় করিয়ে দিল।
তথ্যসুত্রঃ
১) Documents of The Communist Movement in India,
National Book Agency, Volume I- XXVII
২) আমার জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি,
মুজফফর আহমদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি
৩) Galvanising Impact of the October Revolution on India’s National-Liberation Movement
Gangadhar Adhikary, Soviet Land, August 1977
৪) Reminiscences of Lenin: Nadezhda Krupskaya
৫) Communists Challange Impearialism From The Dock, Muzaffar Ahmad
National Book Agency