Site icon CPI(M)

Food Movement: A Legacy

Food Movement Cover

সৌভিক ঘোষ

পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কিছু বস্তুগত শর্ত রয়েছে। প্রাণ, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বিকশিত প্রাণীদেহ এমনকি উদ্ভিদ হলেও বিনা খাবারে বেঁচে থাকতে পারে না। তাই খাদ্যের দাবী মানুষের মৌলিক হক।

খাবারের দাবীতে আন্দোলন কেন? খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি ছিল? নাকি বিরাট মুনাফার গন্ধে মাতোয়ারা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষের বেঁচে থাকা নিয়েও ফাটকা খেলেছিল? দুটি সম্ভাবনার মধ্যে আসল কারণ যাই হোক না কেন –  প্রশাসনের দায় থেকেই যায়, সংকটের মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকা পালনের প্রশ্ন রয়েই যায়, যাবে। আমাদের আলোচনার প্রধান ক্ষেত্র হতে হবে সেটাই।

১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন আমাদের দেশে গণআন্দোলনের ইতিহাসে বিশেষ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার আগে এবং পরে দুইবার ভারতীয়রা খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হন। প্রথমবার ৪২ সাল নাগাদ। যদিও সেই ইতিহাস পাওয়া যাবে শুধুমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির কাগজেই। এমনটা কেন? কারণ তখনকার প্রায় সমস্ত মূলধারার সংবাদমাধ্যম শাসকের ইচ্ছামত প্রকৃত সত্য গোপন রাখে। কমিউনিস্ট পার্টির কাগজ, এবং ছোটখাটো কিছু স্থানীয় সংবাদ সংস্থা (যদিও তারাও প্রধানত বামপন্থী) ১৯৪২ সাল থেকেই বাস্তব সংকটের আসল চেহারা তুলে ধরতে শুরু করে। এইসব খবরের চাপে পরের বছর অর্থাৎ ৪৩ সালে টাইমস অফ ইন্ডিয়া ভারতে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম খবর প্রকাশ করে। পরাধীন ভারতে এই দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতির প্রধান কারণ ছিল ব্রিটিশদের নির্মম, বর্বর শাসনব্যবস্থা।

জ্যোতি বসু সেই পরিস্থিতি লন্ডন মজলিসের তরফে ইংরেজিতে ‘ ম্যান মেড ফ্যামিন ‘ শিরোনামে একটি লিফলেট রচনা করেন। রাজ্য ওয়েবসাইটেসম্প্রতি আমরা সেই লিফলেট সম্পর্কে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করি।

১৯৫৯ সাল। খাদ্য চাই, খাদ্য দাও – নইলে গদি ছেড়ে দাও স্লোগানকে সামনে রেখে সারা রাজ্যে ব্যাপক প্রচার করা হয়। যদিও এর ঠিক আগের বছর অর্থাৎ ৫৮ সালেও খাদ্য আন্দোলন হয়েছিল। সেই আন্দোলন মূলত গ্রামীণ বাংলায় সীমাবদ্ধ থাকে। শাসক সেই সুযোগে কার্যত নিজেদের দায় এড়িয়ে যায়। এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই পরের বছর গ্রাম এলাকার পাশাপাশি শহরাঞ্চলে ও আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ৩১ আগস্ট কলকাতায় বিরাট সমাবেশের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। নির্দিষ্ট দিনে ঘোষিত পথেই সমাবেশ আয়োজিত হয়। গ্রাম থেকে মানুষ যাতে কলকাতার বিক্ষোভে উপস্থিত না হতে পারে তাই অনেক ট্রেন বাতিল করে দেওয়া হল। যদিও বিরাট সমাবেশ আটকানো যায় নি। বিকালের দিকে রাজভবনের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলা মিছিলের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ। কোনরকম পূর্ব ঘোষনা ছাড়াই নির্মম কায়দায় আক্রমণ করা হয়। খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি রয়েছে এমন রাজ্যের তালিকাভুক্ত ছিল তখনকার পশ্চিমবঙ্গ। এর সাথেই দিন দিন বাড়তে থাকে চালের দাম। তাই মানুষ খাদ্যের দাবিতে আন্দোলনে নিজেদের একাত্ম করে নেন। জনগণের সেই দাবীকে সরাসরি অগ্রাহ্য করে বিধান চন্দ্র রায়ের সরকার। সরকার মানুষের সংকটের প্রশ্নে ধারাবাহিক ভাবে উদাসীন তা দেখায় বলেই গণআন্দোলনে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। আজও এই শিক্ষা মাথায় রেখেই আমাদের কাজ করতে হয়।

পুলিশের আক্রমণ ছিল সার্বিক। লাঠি পেটা, টিয়ার গ্যাসের শেল ছোঁড়া এমনকি সরাসরি গুলি চালিয়ে দেওয়া সবই হয়েছে। কমরেড বিমান বসু সেদিন মিছিলে ভলান্টিয়ার ছিলেন। তার সহযোদ্ধা হরিনারায়ন অধিকারীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ রাস্তায় যারা আহত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন খুঁজে খুঁজে সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে মাথায় লাঠি মেরে অনেককেই খুন করেছিল পুলিশ ‘।

৪৩ এর দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল সাম্রাজ্যবাদী শাসকের নির্লজ্জ লুটতরাজ। ৫৯ সালে দেশ স্বাধীন হলেও, ক্ষমতাসীন শাসক ছিল মুনাফা লুটে নিতে চাওয়া এক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষা কারী রাজনৈতিক শক্তি। তাই জনগণের ভয়াবহ সংকট দেখেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এই একটি কথা মাথায় রাখলেই শ্রেণী স্বার্থ, শ্রেণী শাসন এবং শ্রেণী শোষণ সবটা পরিষ্কার হয়ে যায়। কেন ওরা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায় তাও বুঝে নেওয়া যায়।

৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন আরো একটি ঐতিহাসিক শিক্ষা সামনে এনে দেয়। আজকের দিনে সেই শিক্ষাই সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অত্যাচারিত মানুষ, নিপীড়িত মানুষ যতই সংকটের মুখোমুখি হন না কেন, যদি সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তোলা যায়, শাসকের বিরুদ্ধে সঠিক দাবিতে যদি সংগঠিত লড়াই সংগ্রাম নির্মিত করা যায় তাহলে যত শক্তিশালীই হোক না কেন, অপশাসনের অবসান নিশ্চিত।

৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলনকে সেই উপলব্ধিতেই গণআন্দোলনের শহীদ দিবস হিসাবে পালন করা হয়।

আজকের প্রজন্মের কর্মীরা ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণ করেই আগামীর সংগ্রাম গড়ে তুলতে পার্টির কাজে সক্রিয় হবেন, এমন শপথেই পালন করবেন ৩১শে আগস্টের কর্মসূচি।

মেহনতি মানুষের লড়াইতে এই প্রতিজ্ঞাই আমাদের অঙ্গীকার।

Spread the word