Site icon CPI(M)

Colombia Election: A Report

Columbia Election

শান্তনু দে

খুব সম্ভবত, গুস্তাভো পেত্রো হতে চলেছেন ‘কলম্বিয়ার ইতিহাসে প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপতি।’

অন্য কেউ না, এই পূর্বাভাস শুনিয়েছে মার্কিন ওয়াশিংটন পোস্ট। ব্রিটিশ গার্ডিয়ান পত্রিকায় শিরোনাম ‘কলম্বিয়া নির্বাচিত করতে পারে তার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা উপরাষ্ট্রপতি’ ফ্রান্সিয়া মার্কেজকে। মার্কিন ফরেন পলিসি পত্রিকার সাপ্তাহিক ব্রিফ: কলম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি ও সংসদীয় নির্বাচন ঝুঁকে আছে বামপন্থার দিকে।

হিংসার আবহে আজ ভোটের লাইনে লাতিন আমেরিকায় ওয়াশিংটনের বহুদিনের বিশ্বস্ত দেশ কলম্বিয়া। এদিকে যে কোনও মুহূর্তে প্রাণনাশের আশঙ্কায় বামপন্থী প্রার্থী। চব্বিশ ঘণ্টা তাঁকে ঘিরে নিরাপত্তার ঘেরাটোপ। শুক্রবার সাও পাওলো শহরে এক বিরাট সমাবেশে একথা শুনিয়েছেন ব্রাজিলের নির্বাচনে বামপন্থী প্রার্থী লুলা দি সিলভা। লুলা বলেছেন, ‘আমরা, ব্রাজিলের শ্রমিক-কৃষক, ছাত্র-যুব, সামাজিক আন্দোলনের কর্মীরা, যাঁরা অক্টোবরে ফ্যাসিস্তদের পরাস্ত করে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছি— কলম্বিয়া মেহনতি মানুষের কাছে তাঁদের আহ্বান— রবিবার ভোট দিন বামপন্থী প্রার্থীকে। যাতে অক্টোবরে ব্রাজিল এবং কলম্বিয়া মিলে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য তৈরি করতে পারে। উষ্ণ আলিঙ্গন পেত্রোকে!’

শুধু লুলা নন, ‘মার্কিন বিবেক’ নোয়াম চমস্কি, নাওমি ক্লাইন-সহ দুনিয়ার ২৭ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী দাঁড়িয়েছেন পেত্রোর পাশে।

নোয়াম চমস্কি, নাওমি ক্লাইন

কলম্বিয়া রাষ্ট্রের সঙ্গে বামপন্থী গেরিলা বাহিনীর পাঁচদশকের বেশি যুদ্ধের পর এই নিয়ে দ্বিতীয়বার হতে চলেছে নির্বাচন। এর আগে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে সংসদীয় নির্বাচনের ফল দেখে পোস্ট বলেছে, ‘কলম্বিয়ার ইতিহাসে প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপতি হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে ভালো সম্ভাবনার মুখে দাঁড়িয়ে গেরিলা যোদ্ধা থেকে রাজনীতিবিদ গুস্তাভো পেত্রো।’

আটের দশকে ১৯ এপ্রিল আন্দোলন— এম-১৯ গেরিলা গোষ্ঠীর সদস্য, রাজধানী বোগোতা শহরের প্রাক্তন মেয়র (২০১২-১৪) পেত্রো গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ছিলেন দ্বিতীয় স্থানে। পেয়েছিলেন ৮০ লক্ষের বেশি ভোট, প্রায় ৪২ শতাংশ। ২০১৮ থেকে কলম্বিয়ার সংসদের উচ্চকক্ষ সেনেটের সদস্য ৬১-বছরের পেত্রো রাষ্ট্রপতির দৌড়ে সবার চেয়ে এগিয়ে। শনিবার রয়টার্সের খবর, জনমত সমীক্ষায় পেত্রোর পক্ষে সমর্থনের হার প্রায় ৪০ শতাংশ।

কলম্বিয়ার সংবিধান অনুযায়ী প্রথম রাউন্ডে কোনও প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে প্রথম দু’জনের মধ্য হবে চূড়ান্ত পর্বের ভোট। সমীক্ষার পূর্বাভাস, প্রথম রাউন্ডে না হলেও, ১৯ জুন চূড়ান্ত পর্বের ভোটে পেত্রোর জয় নিশ্চিত। এই মুহূর্তে পেত্রো তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী গুতেরেইজের পক্ষে ১৩ শতাংশ ভোটে এগিয়ে। তবে বরারবের মতো রয়েছে ভোট জালিয়াতির আশঙ্কা।

বামপন্থী নির্বাচনী জোট প্যাক্টো হিস্টোরিকা (হিস্টোরিকাল প্যাক্ট)-র প্রার্থী পেত্রো। তাঁর কথায়, ‘সামাজিক আন্দোলন, আদি জনগোষ্ঠীর আন্দোলন, নারীবাদী ও পরিবেশবাদীদের নিয়ে এই জোট।’ এই জোটে অতি বামপন্থী, কমিউনস (একসময়ের দাপুটে মার্কসবাদী গেরিলা সংগঠন ফার্কের রাজনৈতিক দল), মধ্য-বাম থেকে রয়েছে কলম্বিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মতো ২০টি রাজনৈতিক দল।  

বর্তমান রাষ্ট্রপতি ইভান দুকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। কারন ২০১৫’র আইনি বিধি অনুযায়ী একজন রাষ্ট্রপতি কেবল চার-বছরের মেয়াদই পূরণ করতে পারবেন। তার বেশি নয়। অবশ্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জিততে পারতেন না। দুকের বিরুদ্ধে অসন্তোষের হার ৭৫ শতাংশ। গতবছরের মে মাসে কলম্বিয়া দেখেছে কয়েকদশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় গণসমাবেশকে। প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। দুকের নয়া উদারনীতি, পরিবেশের ধ্বংসযজ্ঞ, পুলিশি বর্বরতা এবং বেপরোয়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সরকারের দমনপীড়নের শিকার হন ৪৪ জন। আহতের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার। একতরফাভাবে আটক করা হয় প্রায় দেড় হাজার জনকে। ইপসসের সাম্প্রতিকতম জনমত সমীক্ষায় ৮৪ শতাংশ মানুষই জানিয়েছেন ‘দেশ চলছে ভুল দিকে’। শেষ জনমত সমীক্ষায় নিও লিবারেল আলভারো উরিবে, দুকের দল ডেমোক্রেটিক সেন্টারের প্রার্থী অস্কার জুলুয়াগার পক্ষে সমর্থনের হার ছিল ৫ শতাংশেরও কম। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তিনি তাই নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। সমর্থন জানিয়েছেন দক্ষিণপন্থী ফেদরিকো গুতেরেইজকে।

অবশেষে বামপন্থীদের উত্থান দেখছে কলম্বিয়া।

১৩ মার্চ সংসদীয় নির্বাচনে ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো ফল করেছেন বামপন্থীরা। একইসঙ্গে ছিল সংসদের উচ্চকক্ষ সেনেট এবং নিম্নকক্ষ প্রতিনিধিসভার মোট ২৯৫টি আসনের নির্বাচন। দুই কক্ষ মিলিয়ে পেত্রোর হিস্টোরিকাল প্যাক্ট পেয়েছে ৪৬টি আসন, গতবাবের তুলনায় ২১টি অতিরিক্ত আসনে! সেনেটে জোট জিতেছে ১৯টি আসনে। যেখানে দক্ষিণপন্থী দল: কনজারভেটিভ পার্টি ১৬, দুকের ডেমোক্রেটিক সেন্টার ১৪, রাডিকাল চেঞ্জ ১১, ইউনিয়ন পার্টি ফর দি পিপল ১০ এবং মিরা পার্টি পেয়েছে ৪টি আসন। হিস্টোরিকাল প্যাক্টের সঙ্গে রয়েছে ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড সোশ্যাল অলটারনেটিভ মুভমেন্ট (এমএআইএস) এবং মুভমেন্ট অব ইন্ডিজেনাস অথরিটিস অব কলম্বিয়া (এআইসিও)-র একটি করে আসন। জরুরি সামাজিক সংস্কারের জন্য তাকে চাইতে হবে মধ্য-বাম গ্রিন অ্যালায়েন্স অ্যান্ড দি হোপ সেন্টার কোয়ালিশন (১৪ আসন) এবং লিবারেল পার্টি (১৫ আসন)-র সমর্থন।

প্রাণনাশের আশঙ্কা, শেষ সমাবেশে এভাবেই নিরাপত্তার ঘেরাটোপে পেত্রো

কলম্বিয়া মানে লাতিন আমেরিকায় দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শক্ত ঘাঁটি। লাতিন আমেরিকায় ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপের জন্য সবচেয়ে বিশ্বস্ত হলো কলম্বিয়ার সেনাবাহিনী। এর স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অপরিসীম। এক কলম্বিয়াতে রয়েছে সাত-সাতটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। এর সঙ্গেই পেন্টাগন নিয়মিত অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করে কলম্বিয়ার সেনাবাহিনীকে। প্রতিবেশী দেশ ভেনেজুয়েলায় সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য নির্ভর করে কলম্বিয়ার সেনাবাহিনীর ওপর। ২০১৯, ভেনেজুয়েলার নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করতে মার্কিন পদক্ষেপে সক্রিয়ভাবে যোগ দেয় কলম্বিয়ার সেনাবাহিনী। সামরিক খাতে বরাদ্দের পরিমাণ জিডিপি’র ১২ শতাংশ। রয়েছে ২ লক্ষ ৯৫ হাজারের শক্তিশালী সেনাবাহিনী। লাতিন আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম।

কলম্বিয়ার রপ্তানির অর্ধেকের বেশি আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। শুধু পেট্রোলিয়াম থেকেই আসে ৫৭ শতাংশ। লাতিন আমেরিকার চতুর্থ বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। কলম্বিয়ার প্রায় ৯২ শতাংশ কয়লাই রপ্তানি করা হয়। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম কয়লা উৎপাদনকারী দেশ। গত বছরের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ১৫ লক্ষ টন। রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস, পান্না, নিকেলের অফুরন্ত ভাণ্ডার। উর্বর কফিখেত। বিপুল এলাকাজুড়ে আমাজনের গহীন জঙ্গল। এই অপার প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর রয়েছে কানাডা ও মার্কিন সংস্থাগুলির আধিপত্য। ড্রাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে ওয়াশিংটনের ‘প্ল্যান কলম্বিয়া’ তাই ছিল ছুতো, লক্ষ্য আসলে তেল আর প্রাকৃতিক সম্পদ। তাছাড়া, কলম্বিয়াতে রয়েছে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম-সহ একশটির বেশি ব্রিটিশ বহুজাতিক সংস্থা। নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ নিরাপদ রাখতে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কলম্বিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রকের সঙ্গে ১ কোটি ১০ লক্ষ ডলারের চুক্তি করেছে।

এই নির্বাচন নিয়ে তাই তৎপর ওয়াশিংটন। ফেব্রুয়ারির গোড়ায় তাই কলম্বিয়া সফরে গিয়েছিলেন মার্কিন বিদেশদপ্তরের রাজনৈতিক বিষয়ের আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুলান্ড। কে এই নুলান্ড? ২০১৪, ইউক্রেনে মার্কিন মদতে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে উৎখাত করার অন্যতম মস্তিষ্ক। অভ্যুত্থানের ঘটনায় সরাসরি মার্কিন মদত বেআব্রু হয়ে যায় সেসময় মার্কিন সহকারী বিদেশসচিব নুলান্ড এবং ইউক্রেনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জিওফ্রে পিয়াটের আলোচনার অডিও-রেকর্ড ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর। ইউক্রেনে সরকার পালটে কাদের বসানো হবে তা-ও তিনি ঠিক করেছিলেন। ‘মাইদান’ অভ্যুত্থানে অতি দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদীদের মার্কিন ঋণ দেবার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটায় নুলান্ড সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বাইরের লোকেরা যাতে (নির্বাচনকে) প্রভাবিত করতে না পারে, তা আমাদের সুনিশ্চিত করতে হবে।’ ব্লুরেডিও-কে নুলান্ড বলেছেন, ‘ভেনেজুয়েলা সীমান্তে রুশদের ক্রমবর্ধমান তৎপরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।’

ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী এবং সমাজকর্মীদের জন্য সবচেয়ে বিপদজনক দেশ কলম্বিয়া। চলতি বছরে ইতিমধ্যেই খুন হয়েছেন ৩৩ জন। আর ২০১৬-তে হাভানায় শান্তি চুক্তি হওয়ার পর থেকে ১,৩১৯ জন। খুন হয়েছেন ফার্কের ৬ জন প্রাক্তন গেরিলা, এমনকি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরকারী পর্যন্ত।

সম্পদের অসাম্যে অর্গানাইজেশন অব ইকনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-র সদস্য দেশগুলির মধ্যে শীর্ষে কলম্বিয়া। রাষ্ট্রসঙ্ঘের তথ্যে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দারিদ্র কলম্বিয়াতে। ইকনমিক কমিশন ফর লাতিন আমেরিকা অ্যান্ড ক্যারিবিয়ান জানাচ্ছে, ২০২০-তে দারিদ্রসীমার নিচে থাকা মানুষের হার ছিল ৩৭.৫ শতাংশ। যখন দারিদ্র বেড়েছে, তখন দেশের তিনজন মানুষের সম্পদের পরিমাণ জিডিপি’র ১০ শতাংশের বেশি। এক শতাংশের হাতে ৮০ শতাংশের বেশি জমি। জমির মালিকানায় অসাম্যের মাপকাঠিতে লাতিন আমেরিকার শীর্ষে কলম্বিয়া।

নির্বাচনী প্রচারে পেত্রো বলেছেন, ১৯৪৮ থেকে হিংসায় আক্রান্ত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কিছু বড় পরিবর্তন জরুরি। তাঁর সরকার কৃষি সংস্কার করবে, শক্তিশালী করবে শ্রম আইনকে, কলম্বিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ ও আদি জনগোষ্ঠী মানুষের সমানাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

Spread the word