ভারতের অর্থনৈতিক বাস্তবতার তিনটি প্রধান দিক, বিপুল বেকারত্ব, খাদ্যসামগ্রীর চড়া দাম ও ক্রমবর্ধমান বৈষম্য। বেসরকারি পুঁজির বিনিয়োগ ক্রমাগত কমছে। এই পরিস্থিতিতে যাবতীয় আর্থিক কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটানোই কেন্দ্রীয় বাজেটের মূল অভিমুখ হওয়া উচিত ছিল। অথচ যা ঘোষণা করা হয়েছে তা এর বিপরীত। বাজেটের প্রস্তাবসমূহ সবই পশ্চাদগামী ও সংকোচনমুখী। এর প্রভাবে জনজীবনে দুর্দশা আরও বাড়তে চলেছে, পুঁজির বিনিয়োগ এবং কাজের সুযোগ দুটোই আরও কমবে।
বাজেট পরিসংখ্যানে স্পষ্ট, ১৪.৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেয়েছে অথচ সরকারের ব্যয়বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ৫.৯৪ শতাংশ। রাজস্ব খাতে বাড়তি আদায়কৃত অর্থকে ব্যবহার করেই দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আর্থিক কর্মকাণ্ডকে আরও বিস্তৃত করা উচিত ছিল। কিন্তু সেই পথে না হেঁটে, কেন্দ্রীয় সরকার আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির নির্দেশ অনুযায়ী ঐ অর্থে নিজেদের রাজকোষীয় ঘাটতি মিটিয়েছে। এই বাজেট পেশ হওয়ার আগের হিসাব অনুযায়ী সেই ঘাটতি ছিল জিডিপি’র ৫.৮ শতাংশ, এখন তা কমে হল ৪.৯ শতাংশ।
এই বাজেটে যে কায়দায় জিডিপি হিসাব করা হয়েছে তাতে বোঝা যায় সরকার পুনরায় প্রকৃত তথ্য গোপন রাখার কৌশল গ্রহণ করেছে। জিডিপি বৃদ্ধির সাধারণ হার’কে ১০.৫ শতাংশ ধরে নিয়ে বৃদ্ধির প্রকৃত হারকে (রিয়াল জিডিপি) ৬.৫ থেকে ৭ শতাংশের মাঝে বলে হিসাব দেওয়া হয়েছে। এটা বাস্তব অবস্থার সাথে মেলে না। আজকের অবস্থায় খাদ্যসামগ্রীতে মূল্যবৃদ্ধির হার ৯.৪ শতাংশে পৌঁছে গেছে অথচ বাজেট হিসাবের ভিত্তি হিসাবে সাধারণ মূল্যবৃদ্ধির (কোর) হার মাত্র ৩ শতাংশ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির প্রকৃত তথ্যকে এড়িয়ে মনগড়া হিসাবের ভিত্তিতে জিডিপি বৃদ্ধির প্রকৃত হারকে বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে।
এই বাজেটে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ আরও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা হয়েছে। সারে ভর্তুকি ছাঁটাই হয়েছে ২৪,৮৯৪ কোটি টাকা, খাদ্যে ভর্তুকি কমার পরিমাণ ৭০৮২ কোটি টাকা। জিডিপির শতাংশ হিসাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং গ্রামোন্নয়নে ব্যয় প্রায় অপরিবর্তিতই রয়েছে। এমজিএনআরইজিএস খাতে বরাদ্দকে আগের চাইতে আরও বেশি অবহেলা করা হয়েছে। ২০২৩ সালের বরাদ্দের চাইতে আরও কমিয়ে এবারের বাজেটে এবাবদ বরাদ্দ হয়েছে ৮৬,০০০ কোটি টাকা। চলতি আর্থিক বছরের প্রথম চার মাসে ইতিমধ্যেই ৪১,৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, বাকি আট মাসের জন্য মাত্র ৪৪,৫০০ কোটি টাকার বরাদ্দ পড়ে রইল৷ ভারতের গ্রামীণ এলাকায় বেকারত্বের গভীর সংকট মোকাবেলায় সেই বরাদ্দ একেবারেই অপর্যাপ্ত।
বেকারত্ব নিরসনের নাম করে এই বাজেটে কার্যত প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগযুক্ত ইনসেন্টিভ (এমপ্লয়মেন্ট লিঙ্কড ইনসেন্টিভ) নামের নতুন প্রকল্পের ঘোষণা করা হয়েছে। এই প্রকল্প অনুসারে ফরম্যাল সেক্টরে বার্ষিক আয় এক লক্ষ টাকার কম বেতনে যারা নতুন কাজের সুযোগ পাবেন তাদের এক মাসের মজুরি ইনসেন্টিভ হিসাবে দেওয়া হবে। এদের মধ্যে কোম্পানি দ্বারা চিহ্নিত যোগ্য কর্মীরাই সর্বোচ্চ ইনসেন্টিভ হিসাবে পাঁচ হাজার টাকা পাবেন, তাও আবার তিনটি মাসিক কিস্তিতে। একই প্রকল্পের সুবাদে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী যাদের বার্ষিক মজুরি এক লক্ষ টাকার কম, তাদের প্রত্যেকের জন্য ২৪ টি মাসিক কিস্তিতে (অর্থাৎ দু’বছর) কোম্পানিগুলি পাবে ৭২,০০০ টাকা। বোঝাই যায়, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির নামে এই প্রকল্প আসলে কর্পোরেটদের ভর্তুকি দেওয়ার আরেকটি উপায় মাত্র। এমন প্রতারণা কোনোদিনই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে না। বিগত বছরগুলিতে কর্পোরেট সেক্টর বিপুল পরিমাণ মুনাফা করলেও, তারা সেই অর্থ যন্ত্রপাতি এবং উৎপাদনের কাজে বিনিয়োগ করেনি। এই কারণ দেশের বাজারে সাধারণ চাহিদা কমেছে। জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়াই বাজারে চাহিদা কমার কারণ।
কাজের জন্য জরুরী দক্ষতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে যুবসম্প্রদায়ের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও তার কোনোটিতেই বেকার সমস্যার সমাধান হবে না। ২০১৬ থেকে ২০২২ অবধি সারা দেশে মাত্র ১৮ শতাংশ যুবক-যুবতী দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগকে ব্যবহার করে কাজ খুঁজে পেয়েছে। তাই বারবার মনে রাখতে হয়, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিস্তৃত না হলে কাজের সুযোগ তৈরি হয় না।
সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার নামে অনেক বড় বড় কথা বলা স্বত্বেও এই বাজেটে অন্ধ্রপ্রদেশ ও বিহার ব্যতীত অন্যান্য রাজ্যের সরকারের জন্য কিছুই নেই। তেলুগু দেশম পার্টি ও জনতা দল ইউনাইটেড’কে সাথে নিয়ে এনডিএ জোট সরকার টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাই যে এমন বৈষম্যমূলক আচরণের কারণ, বুঝতে অসুবিধা হয় না। কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে কর বাবদ আদায়ের অর্থের বিষয়টি ছাড়া সাধারণভাবে ফিনান্স কমিশনের তরফে রাজ্যগুলিকে যে অর্থ দেওয়া হয় তার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২২-২৩ সালে সেই বরাদ্দ ছিল ১,৭২,৭৬০ কোটি টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে প্রকৃত খরচ হয়েছিল ১,৪০,৪২৯ কোটি টাকা – এই বাজেটে সেই পরিমাণ আরও কমে হল ১,৩২,৩৭৮ কোটি টাকা।
সামগ্রিক বিচারে বলা যায় এই বাজেট আসলে গরীব মানুষের ওপরে বাড়তি বোঝা চাপিয়ে ধনীদের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বন্দোবস্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। অতি-বিত্তশালী ভারতীয়দের থেকে সম্পত্তি কর আদায় করে সেই অর্থে দেশের আর্থিক বিকাশের যাবতীয় প্রস্তাবকেই অগ্রাহ্য করা হয়েছে। জনসাধারণের উপরে অপ্রত্যক্ষ করের বোঝা কম করার প্রস্তাবও একই কায়দায় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
দেশের আর্থিক পরিস্থিতি ও জনজীবনের সমস্যা দুয়েরই সমাধানে ব্যর্থ এমন বাজেটের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে পার্টির সমস্ত ইউনিটকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে পলিট ব্যুরো।
সিপিআই(এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যালয়ের তরফে
মুরলিধরন দ্বারা প্রকাশিত বিবৃতি