ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
এলামকুলাম মনক্কল শংকরন নাম্বুদিরিপাদ – সংক্ষেপে ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ বা আরও ছোট হয়ে ভারতের ইতিহাসে তার নাম বিখ্যাত হয়ে রয়েছে কমরেড ই এম এস বলে।
যুবক হিসাবে জাতিভেদের অভিশাপের বিরুদ্ধে সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। অর্থনীতি এবং ইতিহাসের একনিষ্ঠ ছাত্র ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ কলেজের পড়া শেষ করে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং গ্রেফতার হয়ে জেলজীবন শুরু করেন। কেরালায় কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন ই এম এস – ১৯৩৪ সালে তিনি সিএসপি’র সারা ভারত যুগ্ম সম্পাদক হন।
কেরালায় প্রদেশ কংগ্রেস পার্টি র সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন – এই পর্বে তিনি একইসাথে কংগ্রেস রাজনীতির পাশাপাশি মার্কসবাদের সচেতন চর্চায় ব্রতী হন। ১৯৩৬ সালে যে পাঁচজন কেরালায় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন ই এম এস তাদেরও একজন। সেই রাজ্যে কমিউনিস্ট পার্টি শক্তিশালী হয়ে ওঠে মূলত দুই ধারার রাজনীতির জোরে – একটি সরাসরি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় আন্দোলন, আরেকটি সামন্তবাদ বিরোধী আন্দোলন। ভাষার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ কেরালার গঠনের তিনি অন্যতম একজন স্থপতি।
১৯৩৯ সালেই ইএম এস মাদ্রাজ প্রভিন্সিয়াল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে মোট দুই পর্বে তাকে আত্মগোপন করতে হয় – একবার ১৯৩৯ – ৪২ অবধি, আরেকবার ১৯৪৮ – ৫০ নাগাদ। ১৯৪১ঃ অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ১৯৫০ – পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য এবং ১৯৬২ সালে তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক।
১৯৫৭ সালে ভারতে প্রথমবার কমিউনিস্ট পার্টির নির্বাচিত সরকার রাজ্যের ক্ষমতায় আসে। যদিও ১৯৫৯ সালেই সেই সরকারকে কেন্দ্রীয় আইন ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে খারিজ করে দেওয়া হয়। কেন্দ্রে তখন কংগ্রেসের সরকার। কম সময়ের জন্য কাজ করার সুযোগ পেলেও সেই সরকার সারা দেশে প্রথম কৃষকদের জন্য কৃষিজমি সংস্কারের মধ্যে দিয়ে বণ্টন করে, মানুষ হাতে কলমে বুঝতে পারেন কমিউনিস্টরা সরকার পরিচালনা করলে কি কি হতে পারে। বুঝতে অসুবিধা হয় না কেন সেদিন কেন্দ্রীয় সরকার এই সরকারকে উচ্ছেদ করেছিল – তাদের কায়েমি স্বার্থে আঘাত হেনেছিল কমিউনিস্টদের পরিচালিত রাজ্য সরকার, চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল – শাসনের ভিত অবধি নড়ে উঠেছিল।
১৯৬৪ সালে পার্টির সপ্তম কংগ্রেস আয়োজিত হলে সিপিআই(এম) গড়ে ওঠে – সেই নবগঠিত পার্টির নবরত্নের (নয় জন পলিট ব্যুরো সদস্য) একজন ছিলেন ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার সময় তিনিই ছিলেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক।
সাংগঠনিক নেতৃত্বের সাথেই একজন মেধাবী মার্কসবাদী তাত্বিক হিসাবে তার পরিচিতি রয়েছে। ভারতের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট অনুযায়ী এদেশে বিপ্লবের নির্দিষ্ট কর্মসূচি রচনায় তার অবদান অনস্বীকার্য। মার্কসীয় দর্শন, সাহিত্য এবং ইতিহাস সম্পর্কে তার বিবিধ রচনাবলী এদেশে বিপ্লবপন্থীদের অবশ্যপাঠ্য তালিকায় থাকতেই হয়।
বহুযুগ ধরে চলে আসা উচ্চবর্ণের জমিদার পারিবারের রক্ষণশীল পরিবেশে বড় হয়েও সর্বহারা বিপ্লবের রাজনীতিতে নিজেকে নেতৃত্ব হিসাব প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে এদেশে ইএম এস নাম্বুদিরপাদ একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর আগে অবধি নিয়মিত লেখার এবং পার্টির নানা কাজে পরামর্শ দেবার কাজে তিনি অবিচল ছিলেন – এও এক মনে রাখার মতো বিষয়।
একজন অবিসংবাদি কমিউনিস্ট নেতা হিসাবে ইএমএসকে প্রায়ই বিভিন্ন সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে হত, এমনই এক সাংবাদিক তাকে কথা বলায় জড়তা সম্পর্কে প্রশ্ন করেন তিনি কি সবসময়ই এমন কথা বলার সমস্যায় ভোগেন? তার উত্তরটি ছিল অসাধারণ – “না সবসময় নয়, কেবলমাত্র যখন কথা বলি তখনই এমন হয়”!!
১৯৪০ সালে মালাবারে বিপ্লবী যতীন দাসের একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হলে ব্রিটিশ সরকার সেই বইটির ভূমিকা লেখকের নামে ১০০০টাকা মূল্যের পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। না লেখকের সাহিত্য কীর্তির পুরস্কার না, তখন কমিউনিস্ট পার্টি ভারতবর্ষে নিষিদ্ধ ছিল। পুরস্কার ঘোষিত হয়েছিল লেখকের খোঁজ পেতে, গ্রেফতারি পরোয়ানা সমেত – সেই ভূমিকা লিখেছিলেন ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ।
নিউমনিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, ১৯৯৮ সালের ১৯শে মার্চ ৮৯ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
সৌভিক ঘোষ