হরকিষাণ সিং সুরজিৎ
কেন আমরা দেড়শ’ বছর পার হওয়ার পরও কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’কে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি? কেননা শত শত বছর ধরে মানুষের ওপর মানুষের যে শোষণ চলেছে, জাতি-সম্প্রদায়- গোষ্ঠীগত অত্যাচার, যুদ্ধ এবং মনুষ্যসৃষ্ট সঙ্কটে যেভাবে নিষ্পেষিত হয়েছে মানবজাতি তাকে প্রথম বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। এই ইস্তাহারে কেবলমাত্র এই সমস্ত ঘটনার সামাজিক কারণ ও অর্থনৈতিক ভিত্তিকে উন্মোচিত করা হয়েছে তাই নয়, এগুলিকে নির্মূল করার উপায়ও বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মার্কস যে সমস্ত উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার করেছেন তার মধ্যে প্রধানতম দু’টি বিষয় হলো : ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ও উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব। সামাজিক বিকাশের বস্তুগত নিয়মাবলী এবং সর্বহারার বিপ্লবী সংগ্রামকে বিকশিত করে পুঁজিবাদের মূলোচ্ছেদ করার যে বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি তা এই দুই মৌলিক ভাবনা থেকে পাওয়া যায়।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সামাজিক বিকাশের সূত্রগুলি চিহ্নিত করে, আর উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বের সাহায্যে বুর্জোয়াদের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির কারণ বোঝা সম্ভব হয়। এভাবেই পুঁজিবাদী শোষণের রহস্য এবং তাকে উৎখাত করবার যে ঐতিহাসিক অনিবার্যতা তা অনুধাবন করা সম্ভবপর। মার্কস মনে করতেন যে বিজ্ঞান ‘ইতিহাসের এক শক্তিশালী যন্ত্র, উচ্চতর অর্থে এক বৈপ্লবিক শক্তি। বৈজ্ঞানিক চিন্তার সাথে বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের মেলবন্ধনই মার্কসবাদের মহান রাজনৈতিক ভাবনার জন্ম দিয়েছে। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং তার বৈজ্ঞানিক প্রয়োগের মূর্ত রূপ যার গুরুত্ব কখনও নিঃশেষিত হবে না।
কমিউনিস্ট পার্টির ম্যানিফেস্টো সার্বিকভাবে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রথম তাত্ত্বিক নথি যা বৈপ্লবিক কর্মসূচিকে অসাধারণভাবে, নিখুঁত ও সুষমামণ্ডিতরূপে উপস্থাপিত করে। মার্কস ও এঙ্গেলস এই বইয়ে প্রথম সর্বহারার মতাদর্শকে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপনা করেন।
ম্যানিফেস্টো’র সবচেয়ে যুগান্তকারী অবদান হলো ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যাকে তুলে ধরা। বস্তুবাদী ধারণা অনুযায়ী ইতিহাস ব্যাখ্যার বিষয়বস্তু, এ কোনও ব্যক্তিত্ব ও ঘটনার ক্রমবিবরণমাত্র নয়। ইতিহাসের এই বস্তুবাদী ধারণাই ছিল সম্পূর্ণ এক নতুন ভাবনা। এর সাথে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের যে ধারণা মার্কস ও এঙ্গেলস প্রবর্তন করেন তার চারটি সুনির্দিষ্ট দিক আছে যা কিনা একে পূর্ববর্তী বৌদ্ধিক প্রচেষ্টাগুলির থেকে পৃথক করে।
প্রথমত, এই ধারণা অনুযায়ী ইতিহাসের এক অন্তর্নিহিত গতি রয়েছে যার উৎস নিহিত রয়েছে সামাজিক উৎপাদনের শক্তি ও উৎপাদনের সামাজিক সম্পর্কগুলির পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মধ্যে যার প্রধানতম হলো মালিকানা সংক্রান্ত সম্পর্ক।
দ্বিতীয়ত, এর মাধ্যমে দেখানো হয়েছে কিভাবে সামাজিক শ্রেণিসমূহ এবং শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।
তৃতীয়ত, এর মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত আকারে অথচ স্পষ্টভাবে মার্কস ও এঙ্গেলস দেখিয়েছেন যে, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারায় এই দ্বন্দ্ব কিভাবে পরিস্ফুট হয়েছে।
চতুর্থত, এইখানে ব্যাখ্যা সহকারে বোঝানো হয়েছে পুঁজিবাদ উৎপাদনের শেষ বৈরিতামূলক রূপটিকে যা বিশেষ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় সর্বহারার জন্ম দিয়েছে যারা কেবল পুঁজিবাদের নয় সমস্ত শ্রেণিশোষণের অবসান ঘটিয়ে মানুষকে তার ‘প্রাক্- ঐতিহাসিক’ থেকে ‘ঐতিহাসিক’ অবস্থায় নিয়ে যাবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি কেবল এর সামঞ্জস্য, বিস্তৃতি এবং আপসহীন বিপ্লবী চরিত্রের জন্য শক্তিশালী হয়নি, সর্বোপরি এর সত্যতা একে শক্তিশালী করে তুলেছে। ম্যানিফেস্টো যে বিশদ ব্যাখ্যা হাজির করেছিল তা তার মূল উদ্দেশ্য সিদ্ধ করেছে, কিন্তু বর্তমানে যখন ইউরোপের বাইরে আমাদের নজর কেন্দ্রীভূত হচ্ছে এবং পুঁজিবাদ ম্যানিফেস্টোয় বর্ণিত পূর্বাভাস অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে তখন কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর আরো বিস্তৃতি ঘটার অবকাশ রয়েছে। তবে ম্যানিফেস্টো’তে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের যে মৌলিক ভাবনা হাজির করা হয়েছে। তার বস্তুনিষ্ঠ প্রয়োগই আমরা পরবর্তীকালের সমস্ত তাত্ত্বিক ভাবনার মধ্যে লক্ষ করি যা ম্যানিফেস্টোর যে অনুসন্ধান তাকেই এগিয়ে নিয়ে গেছে, তার মৌলিক ধারণাগুলিকে নস্যাৎ করেনি। এ ঘটনা এই সমস্ত ভাবনার প্রতি অনায্য বিশ্বস্ততার জন্য হয়েছে তা নয়, বরং এই ভাবনাগুলি সত্য হওয়ায় তা সম্ভবপর হয়েছে। লেনিন যেমন বলেছিলেন ‘মার্কসবাদ শক্তিশালী কেননা তা সত্য।’ ঐতিহাসিক বস্তুবাদের বৈধতার একটি নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। মার্কস ও এঙ্গেলসের মতে এর কারণ তারা ‘বাস্তব ভিত্তি’কে অনুসরণ করেছিলেন : “আমরা কোনো মনগড়া বিষয়ের ওপর কিংবা কোনো আপ্তবাক্যের ওপর ভিত্তি করে অগ্রসর হইনি, আমরা বাস্তব ভিত্তির ওপর… বাস্তব জগতের মানুষ, তাদের ক্রিয়াকলাপ, তাদের জীবনের বস্তুগত উপাদান যা আগে থেকেই ছিল এবং যা তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে সে সব কিছুর ওপর নির্ভর করেছি।” কোনো আপ্তবাক্য নয়, বাস্তবতার প্রতি মার্কসীয় চিন্তাধারার এই বিশ্বস্ততার কারণ এই মতবাদের আপসহীন বৈপ্লবিক চরিত্র। কোনো কায়েমি স্বার্থসিদ্ধ করবার উদ্দেশ্য মার্কসবাদের দৃষ্টিকে অস্বচ্ছ করে না, কোনো বিশেষ সামাজিক শ্রেণি বা গোষ্ঠীর নিজস্ব স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য মার্কসবাদীরা কোনো বাস্তবতাকে সুন্দরতর করে কিংবা বিকৃতভাবে উপস্থাপিত করে না। মার্কসবাদী বিশ্ববীক্ষা যে বৈপ্লবিক সমাজবাদের কথা বলে তার সম্পূর্ণরূপে সত্যকে প্রয়োজন আর সেজন্যই দেড়শ’ বছর আগে ম্যানিফেস্টো যে দৃষ্টিভঙ্গিকে উপস্থাপনা করেছিল তাকে কেউ অস্বীকার করতে পারেনি বরং তা পরবর্তীকালের সমস্ত তাত্ত্বিক অগ্রগতিকে প্রেরণা জুগিয়েছে।
বর্তমানে পুঁজিবাদের গতিপ্রকৃতি যথাযথভাবে বুঝতে হলে মার্কসের লেখা বিশেষত তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘পুঁজি’ অবশ্যই প্রয়োজন। সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে লেনিনের শিক্ষা মার্কসের অর্থনৈতিক তত্ত্বেরই সৃজনশীল প্রয়োগ। লেনিন প্রমাণ করেছেন। যে পুঁজিবাদের এই শেষ স্তরে সমাজবাদে উত্তরণের বস্তুগত ভিত্তি তৈরি হয়ে যায় এবং মানুষ মৌলিক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের খুব কাছাকাছি এসে পড়ে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বৈপ্লবিক অগ্রগতির যুগে উৎপাদিকা শক্তির ব্যাপক বিকাশ আজকের দিনের পুঁজিবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে সমাজবাদের বিরোধীরা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো ও মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে অচল বলে আখ্যায়িত করছেন। একথা ঠিক যে বিংশ শতাব্দীর অস্তিম লগ্নে পুঁজিবাদ নানা বিষয়ে পৃথক চরিত্র অর্জন করেছে। পুঁজিবাদের বিবর্তনের এই পর্যায়ে উৎপাদিকা শক্তির বিপুল বিকাশ, নামের সামাজিকীকরণ, উপনিবেশের অবলুপ্তি, লগ্নিপুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ যেমন লক্ষ করা গিয়েছে তেমনি শ্রমিকশ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ নানাবিধ দাবি আদায়ে সক্ষম হয়েছে এবং দেশে দেশে গণতান্ত্রিক ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলন বিকশিত হয়েছে। নয়ের দশকের প্রথমদিকে সমাজতন্ত্রের যে বিপর্যয় ঘটে তার পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যবাদ পৃথিবীজুড়ে আধিপত্য কায়েম করে একমেরু বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলবার ক্ষেত্রে কার্যত বাধাহীনভাবে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু পুঁজিবাদের অলঙ্ঘনীয় সঙ্কট এবং জনগণ ও সমাজের মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে এর মজ্জাগত অক্ষমতা যা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’য় বলা হয়েছে তা সর্বৈব সত্য। মহান অক্টোবর বিপ্লবের বার্তা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পর পুঁজিবাদ মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করবার একমাত্র শক্তি হিসেবে তার অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তবে একথা ঠিক যে, পুঁজিবাদ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং তাকে দীর্ঘায়িত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু মানুষকে এর জন্য নিদারুণ মূল্য দিতে হয়েছে। সর্বোপরি পুঁজিবাদ মানবজাতির এক বিপদ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।
অবশ্য পুঁজিবাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এর অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকায় এবং এই ব্যবস্থার ফলে সৃষ্ট সামাজিক অশুভ শক্তিগুলির বিকাশ ঘটতে থাকায় বিপ্লবের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি এই ব্যবস্থার অভ্যন্তরে চলমান থাকে যাকে মার্কস রূপকার্থে ‘ইতিহাসের প্রাচীন চর’ নামে অভিহিত করেছেন। সমৃদ্ধ, বিকাশমান ও “সঙ্কটমুক্ত’ পুঁজিবাদের সম্পর্কে মোহ আজ জীবনের অভিজ্ঞতায় ভেঙে গিয়েছে। কয়েক শতাব্দী ধরে পুঁজিবাদ প্রসারিত হওয়ার পর পৃথিবীর ৬০% জনগণ বিশ্বের মোট উৎপাদন ও আয়ের মাত্র ৫.৩% ভোগ করে। আর বিশ্বের ৮০% উৎপাদন ও আয় কেন্দ্রীভূত রয়েছে ৮৩% মানুষের হাতে। এক্ষেত্রে মার্কসের ভবিষ্যদ্বাণী সম্পূর্ণ মিলে গিয়েছে। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোয় বলা হয়েছে – “আধিপত্যের এক শতাব্দী পূর্ণ হতে না হতে, বুর্জোয়া শ্রেণি যে উৎপাদন শক্তির সৃষ্টি করেছে তা অতীতের সকল যুগের সমষ্টিগত উৎপাদন শক্তির চেয়েও বিশাল ও অতিকায়।” তবে আজকের প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাদের বিপুল সম্পদ লাগা। রাষ্ট্রসংঘের সাম্প্রতিকতম মানব উন্নয়ন রিপোর্ট অনুযায়ী পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিরাপদ পানীয় জল ও খাবার থেকে বঞ্চিত।
ম্যানিফেস্টোয় মার্কস ও এঙ্গেলস বুর্জোয়া শ্রেণিকে এমন একটি সমাজ সৃষ্টি করবার জন্য দায়ী করেন যেখানে জনসংখ্যার এক-দশমাংশের ব্যক্তিগত মালিকানা রয়েছে। এবং “এর অস্তিত্ব এ কারণেই টিকে রয়েছে কেন না নয়- দশমাংশের হাতে এই মালিকানা নেই।” তারা এই সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক বোঝাপড়ায় উপনীত হন যে, পুঁজিবাদের পরবর্তী পর্যায়ের বিকাশ এই প্রবণতার পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে যা কিনা এই বই প্রকাশের দেড়শ বছর পরে যথার্থ বলে প্রমাণিত হচ্ছে। অবিশ্বাস্য বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত বিকাশের পর এবং সমাজতন্ত্রের পক্ষ থেকে কোনো বিপদ না থাকা সত্ত্বেও পুঁজিবাদের মৌলিক চরিত্র একইরকম রয়েছে।
এত দীর্ঘসময় পেরনোর পরেও ম্যানিফেস্টো রচয়িতাদের ভাবনার সত্যতা অটুট। ১৮৭২ সালে ম্যানিফেস্টোর জার্মান সংস্করণের মুখবন্ধে লেখা হয় – গত ২৫ বছরে বাস্তবিক অবস্থার যত পরিবর্তনই হোক না কেন, ম্যানিফেস্টোয় যে সাধারণ নিময়গুলির কথা উল্লেখিত হয়েছে তা এখনও সমানভাবে যথার্থ। এই একই মুখবন্ধে তারা একথা জোরের সাথে উল্লেখ করেন যে ম্যানিফেস্টোয় বর্ণিত নীতিসমূহের রূপায়ণ নির্ভর করবে সেই সময়ের বস্তুগত অবস্থার উপর। সমসাময়িক পৃথিবীর অর্থনীতি ও আন্তঃপুঁজিবাদী দ্বন্দ্বকে মার্কসীয় দ্বান্দ্বিকতার সৃজনশীল প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে লেনিন দেখালেন যে, সাম্রাজ্যবাদের যুগে যখন পুঁজিবাদের পতন ও ক্ষয় হচ্ছে তখন পুঁজিবাদী দেশগুলির শৃঙ্খলের দুর্বলতম গ্রন্থিতে আঘাত হেনে তাকে ভেঙে ফেলা সম্ভব। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির পারস্পরিক দ্বন্দ্ব রাশিয়ায় সর্বহারার বিপ্লবের বিজয়ের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে ওঠে যা – লেনিনের মতে- সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে। মহান অক্টোবর বিপ্লব লেনিনের অসামান্য বিশ্লেষণ ও পূর্বানুমানকে সার্থক প্রতিপন্ন করে।
ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতের পরিবর্তন এবং দেশে দেশে সর্বহারার শ্রেণিসংগ্রামের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হওয়ার পরুন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচিগত প্রথম নথির আরো ব্যাখ্যা ও বিস্তার ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু এর যে মৌলিক ধ্যানধারণা যা বিশ্বের বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে তা অপরিবর্তিত রয়েছে।
ম্যানিফেস্টোর মার্কসবাদের যে বৈজ্ঞানিক ভাবনা তার প্রতিফলন ঘটেছে প্যারি কমিউনের পরবর্তীকালে অক্টোবর বিপ্লব, চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা ও কোরিয়ার বিপ্লবে। আজও এই অসামান্য মার্কসবাদী বইটির প্রতি মানুষের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে। পৃথিবীর সবক’টি ভাষায় অনুদিত এই বই সর্বত্র চর্চা হয়ে চলেছে। এই আগ্রহ কেবল ঐতিহাসিক কারণে নয়। শ্রমিকশ্রেণি এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণ থেকে মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ এই বই-এ লিপিবদ্ধ ভাবনার সম্পর্কে জানতে চান, কেননা সংগ্রাম চলাকালীন যে সমস্ত জটিল ও জরুরী প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তার উত্তর পেতে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের জটিল বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণের দিশা খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে এবং সংগ্রামী মানুষের আশাপদকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করবার প্রশ্নে এই বই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমস্ত ঐতিহাসিক নথির মতো এই ম্যানিফেস্টোও নিজের যুগের বৈশিষ্ট্যগুলি বহন করে এবং একে যথাযথভাবে বুঝতে হলে সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বিশ্লেষণ করতে হবে যখন তার জন্ম হয়েছিল। মার্কস মূলত তার সময়কালের অতিকায় পুঁজিবাদী বিকাশের চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকশ্রেণি ও কৃষক সমাজের মধ্যে মৈত্রীর প্রসঙ্গটি বিশদে আলোচিত হয়নি। প্যারি কমিউনের সময় এ সম্পর্কিত দুর্বলতা নজরে আসে। প্রথম আন্তর্জাতিকের সাধারণ সভায় যে বৈঠক ১৮৭১ সালের ২৩শে মে অনুষ্ঠিত হয় তাতে মার্কস প্যারি কমিউনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য প্রসঙ্গে বলেন: “কমিউনের শাশ্বত আদর্শকে কেউ মুছে ফেলতে পারবে না, যতদিন না শ্রমিকশ্রেণি মুক্তি পায় ততদিন বারে বারে এই প্রয়াস চলবে।” প্যারি কমিউন পৃথিবীর প্রথম শ্রমিকশ্রেণির সরকার গঠন করে যা ছিল প্রকৃত অর্থে জনগণের সরকার। এখানেই কমিউনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য। এই সময় ফ্রান্সের শ্রমিকশ্রেণি প্রমাণ করেছিল যে তারা সমাজের সমস্ত প্রগতিশীল অংশের নেতৃত্বদান করতে সক্ষম। মার্কস একথা উল্লেখ করেন যে, প্যারি কমিউনের প্রাদেশিক সমর্থন এবং কৃষকদের সহায়তা পাওয়া প্রয়োজন। এর মাধ্যমে তিনি কমিউনের সংগঠকদের সামনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে সর্বহারার মিত্রদের চিহ্নিত করার প্রশ্ন উত্থাপন করেন। কিন্তু যখন একাজ করা শুরু হয় তখন তারা নানাবিধ বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং মূলত প্রুধোপন্থী মানসিকতার দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হন। যদিও প্রথম সর্বহারার বিপ্লব এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে সংগঠিত হয়েছে, তবু কমিউনের সাথে যুক্ত ঘটনাবলী পৃথিবীর সর্বত্র উৎসাহের সাথে আলোচিত হয়েছে। ঊনবিংশ শতকে ফরাসি সর্বহারার বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের পর শ্রমিকশ্রেণির বৈপ্লবিক সংগ্রাম তীব্রতর হয়ে ওঠে কমিউনের ঐতিহ্যকে সামনে রেখে। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র তাৎপর্যের প্রথম ঐতিহাসিক পরীক্ষা ছিল প্যারি কমিউন।
বীরত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পৃথিবীতে শ্রমিকশ্রেণির প্রথম বিপ্লব পরাস্ত হওয়ার কারণ হিসেবে লেনিন বলেন যে, সামাজিক বিপ্লব জয়যুক্ত হওয়ার জন্য অন্তত দু’টি শর্ত প্রয়োজন একটি, অত্যন্ত উন্নত উৎপাদিকা শক্তি, দুই সর্বহারার প্রস্তুতি। কিন্তু ১৮৭১ সালে এই দু’টো শর্ত-র কোনোটাই ফ্রান্সে ছিল না। ফরাসি পুঁজিবাদ তখনও অনুন্নত পর্যায়ে রয়েছে এবং ফ্রান্স সে সময় মূলত পেটিবুর্জোয়া অর্থাৎ দোকানদার, চাষী, কারিগর ইত্যাদিদের দেশ।
অন্যদিকে সে সময় ফ্রান্সে ছিল না কোনো শ্রমিকশ্রেণির পার্টি। শ্রমিকশ্রেণি কোনো দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি। অনেকটাই প্রস্তুতির অভাবে ভুগছিল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা নিজেদের ইতিকর্তব্য স্পষ্টভাবে স্থির করতে পারেনি ও তাকে পূরণ করবার পরিকল্পনাও গ্রহণ করতে অক্ষম হয়েছিল।
কমিউনের ইতিহাস একথা প্রমাণ করে যে একদিকে শ্রমিকশ্রেণি অন্যদিকে কৃষক, ছোট শহরে উৎপাদক, কারিগর এবং কর্মরত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মৈত্রী সর্বহারার বিপ্লবের বিজয় সুনিশ্চিত করবার জন্য প্রয়োজন। এজন্য শ্রমিকশ্রেণিকে সমাজের এই সমস্ত অংশকে নেতৃত্ব দিতে হবে। যেহেতু কমিউন ছিল বিভিন্নরকম আন্দোলনের মেলবন্ধনের ফলশ্রুতি সেহেতু আজ যখন একচেটিয়া পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সর্বহারার বিভিন্ন অংশের মধ্যে জোট তৈরি করে সংগ্রাম সংগঠিত হচ্ছে তখন কমিউনের গুরুত্ব বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে।
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মার্কস ও এঙ্গেলস প্রথম শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রীর সম্ভাবনা ও প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। তারা একথা জোরের সাথে উল্লেখ করেন যে, শ্রমিকশ্রেণিকে কেবল কৃষকদের মিত্র হলে চলবে না, তাদের নেতৃত্ব দিতে হবে কেননা নতুন সমাজ তৈরি করবার ঐতিহাসিক দায়িত্ব তাদের পালন করতে হবে। মার্কস ও এঙ্গেলস-এর ভাবনার ওপর ভিত্তি করে লেনিন তাঁর বই ‘জনগণের বন্ধু কারা এবং তারা কিভাবে সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের প্রতিহত করে’ (১৮৯৪)-তে একথা প্রমাণ সহকারে উল্লেখ করেন যে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী সামাজিক মুক্তির জন্য শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামকে সফল করবার অন্যতম শর্ত।
১৮৪৮ সাল পর্যন্ত মার্কসবাদী চিন্তাধারার যে বিবর্তন তারই সংক্ষিপ্ত রূপ রয়েছে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’য়। এখন সেই তত্ত্ব কার্যত পূর্ণাঙ্গ চেহারা পেয়েছে এবং পৃথিবীকে বিশ্লেষণ ও পরিবর্তন করবার এক সুসংবদ্ধ দর্শনে রূপান্তরিত হয়েছে। এই নতুন ধারণাই ছিল বিপ্লবী সর্বহারার প্রথম আন্তর্জাতিক দল কমিউনিস্ট লিগের ভিত্তি। এই দলের মূল নীতি ও শিক্ষা যা এখনও বিপ্লবী সংগ্রামের মতাদর্শ ভিত্তি তার একটি হলো তত্ত্ব ও প্রয়োগের সমন্বয়।
ম্যানিফেস্টো’র প্রথম দু’টি অধ্যায়ে বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের তাত্ত্বিক নীতিসমূহ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তারই যৌক্তিক অনুসরণ করে তৃতীয় অধ্যায়ে সমাজবাদের অন্যান্য ধারণার সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে যা সর্বহারার সমাজতন্ত্রের থেকে আলাদা। চতুর্থ ও শেষ অধ্যায়ে বিভিন্ন দেশে সর্বহারার বিভিন্ন কৌশলের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র আত্মপ্রকাশের দেড়শ’ বছর পরেও এর অদম্য শক্তি সর্বত্র অনুভূত হচ্ছে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিচ্যুতি, বিকৃতি ও পরাজয় সত্ত্বেও ম্যানিফেস্টোর শিক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারণার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। শ্রমিকশ্রেণির রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে। মুক্তির সংগ্রামে জনগণের বিজয় সম্পর্কে মানুষের দৃঢ় আস্থা, বিপুল আত্মবিসর্জনের বিনিময়ে স্বাধীনতা ও প্রগতির অর্জনকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দিয়েছিল ম্যানিফেস্টো। আজ এই প্রেক্ষাপটে স্মরণ করতে হয় মার্কসের সেই বক্তব্যকে যা তার জীবদ্দশায় যেমন যথার্থ ছিল আজও তাই : “অত্যন্ত অনুকূল পরিস্থিতির মধ্যেও শ্রমিকশ্রেণির যে কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য নির্ভর করে সাংগঠনিক পরিপক্কতার ওপর যার ওপর ভিত্তি করে শ্রেণির শক্তিসমূহকে শিক্ষিত ও সংহত করা যায়।” ভারতীয় কমিউনিস্টরা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র মতো ঐতিহাসিক দলিল থেকে বিরাট অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন।
ভাষান্তর: অর্ণব ভট্টাচার্য
১৯৯৮ সালের ৮ই অক্টোবর, সি পি আই (এম)- র ১৬ -তম কংগ্রেসে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর দেড়শো বছর উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ অধিবেশনে প্রদত্ত বক্তব্য। উল্লেখযোগ্য এ বছর ইশতেহার প্রকাশের ১৭৫ বছর। লেখাটি দেশহিতৈষী সুত্রে সংগৃহীত।