সুকোমল সেন
স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষ থেকে ক্রমবর্ধমান আত্মবৈশিষ্ট্য নিয়ে দেশের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে অবতীর্ণ হওয়া যেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক তাৎপর্য, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলির নানান ধরনের রূপান্তর এবং নতুনভাবে গোষ্ঠীবদ্ধ হওয়ার রাজনৈতিক তাৎপর্য কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেকগুলি বিরোধী রাজনৈতিক দলেরই এই ধরনের রূপান্তর ঘটে, কিন্তু ১৯৬৬ সালে জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার ঘটনা সারা দেশের রাজনৈতিক জীবনে নিঃসন্দেহেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব বহন করে আনে। রাজনৈতিক দলগুলির এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছে বহুরকম কার্য-কারণ, কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যাওয়া যে, দেশের গভীরতম অর্থনৈতিক সঙ্কটেরই ফলশ্রুতি এই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
কিন্তু শ্রমিকশ্রেণী এবং অন্যান্য নিপীড়িত জনগণের ক্ষেত্রে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙন ছিল আরো সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যের বাহক। দেশের শাসকশ্রেণী সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি, মার্কসীয় দর্শনের বিপ্লবী নীতিগুলি সম্পর্কে মনোভাব এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঘটনাবলী সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি পার্টির মধ্যে অন্তর্বিরোধের সৃষ্টি করে এবং পরিশেষে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন সরাসরি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ল। পার্টির নেতৃত্বের একটা বৃহৎ অংশ শাসকশ্রেণীর দিকে ঝুঁকে পড়ায় এবং শ্রেণী-সংগ্রামের পথ পরিত্যাগ করে শ্রেণীসহযোগিতার পথ গ্রহণ করায় এই ভাঙন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। পার্টির নেতৃত্ব ও সদস্য সংখ্যার যে অংশ বুর্জোয়া জমিদার শাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের পক্ষপাতী ছিলেন এবং জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রশ্নে মার্কসীয় বিপ্লবী নীতিসমূহকে রক্ষা করে দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে আগ্রহী ছিলেন তাঁরা পরবর্তীকালে স্বতন্ত্র পথে অগ্রসর হলেন এবং ১৯৬৪ সালের ৩১শে অক্টোবর থেকে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত কলকাতায় পার্টির সপ্তম কংগ্রেস আহ্বান করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) সংগঠিত করলেন। অন্যান্য বিভিন্ন রাজ্যে আংশিক প্রভাব সহ এই পার্টি বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও ত্রিপুরায় গণভিত্তি সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। ১৯৫২, ১৯৫৭, ১৯৬২ ও ১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচন সমূহের মধ্য দিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান শক্তি প্রতীয়মান হয়ে উঠল এবং বিশেষ করে কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি শ্রমিকশ্রেণীর আকর্ষণ যে দ্রুত বৃদ্ধির পথে তাও সুস্পষ্ট হয়ে উঠল। ১৯৫৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে কেরালায় কমিউনিস্টরা সংখ্যাধিক্য অর্জন করলেন এবং মন্ত্রীসভা গঠন করলেন। কমিউনিস্ট পরিচালিত এই মন্ত্রীসভা শ্রমনীতির ক্ষেত্রে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন এবং ঐ রাজ্যে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ও ট্রেড ইউনিয়ন কার্যকলাপের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটল। কিন্তু এই প্রগতিতে আতঙ্কিত হয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ঐ সরকারকে ভাঙার জন্য একটা আন্দোলনের চক্রান্ত গড়ে তুলল। তাতে সরকার ভেঙে না পড়ায় কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করে ঐ সরকারকে বরখাস্ত করে দিল।
১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রের প্রভূত পরিবর্তন ঘটে। বামপন্থী এবং দক্ষিণপন্থী সমস্ত বিরোধী দলগুলি পৃথক পৃথক ভাবে নির্বাচনী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেও কয়েকটি রাজ্যে মোট হিসাবে সংখ্যাধিক্য অর্জন করে। এই রকম কয়েকটি নির্বাচনের পর অকংগ্রেসী মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় বিশেষ সাফল্য অর্জন করে এবং ঐ দুইটি রাজ্যে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভায় যোগদান করে। এরপর মধ্যবর্তী নির্বাচনে ঐ পার্টি আরও সুফল লাভ করে এবং ১৯৭১ সালে পার্টি পশ্চিমবঙ্গের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ দল হিসাবে বিধানসভায় স্থান লাভ করে। ১৯৬৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে পুনরায় যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা গঠিত হলো কিন্তু অভ্যন্তরীণ চক্রান্তে অবিলম্বেই সেই মন্ত্রীসভার পতন ঘটল। তৎসত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় স্বল্পস্থায়ী হলেও এই দুইটি সরকার যে শ্রমনীতি অনুসরণ করে তা এযাবৎকাল অনুসৃত নীতি থেকে ছিল সম্পূর্ণ পৃথক এবং এই অনুকূল নীতির পরিবেশে এই দুই রাজ্যে শ্রমিকশ্রেণী তীব্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এবং মালিকশ্রেণীর হাত থেকে অনেক দাবিদাওয়া ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়।
আলোচ্য সময়ে এআইটিইউসি সর্বভারতীয় কংগ্রেসের-র চতুর্বিংশতিতম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায় ১৯৫৪ সালের ২৭শে থেকে ৩০শে মে পর্যন্ত। পূর্ববর্তী সম্মেলনের পাঁচ বৎসর পর এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
৮৩০ জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন, এবং এইচএমএস, আইএনটিইউসি এবং বিভিন্ন জাতীয় ফেডারেশনের পক্ষ থেকেও ৬৯ জন ভ্রাতৃত্বমূলক প্রতিনিধিও সম্মেলনে যোগদান করেন। সম্মেলনকালে এ আই টি ইউ সি-র অন্তর্ভুক্ত ছিল ১৩৭টি ইউনিয়ন এবং মোট সদস্যসংখ্যা ছিল ৬৫৫, ৯৪০। সম্মেলনে গৃহীত একটি প্রস্তাবে ‘শ্রমিক হিসাবে শুধু নয় মানুষ হিসাবেও নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য’ সমস্ত শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আহ্বান জানানো হয়। সম্মেলনে চক্করাই চেটিয়ার সভাপতি এবং এস এ ডাঙ্গে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
চতুর্বিংশতিতম ও পঞ্চ বিংশতিতম রজত জয়ন্তী সম্মেলনের মধ্যবর্তী সময়ে এআইটিইউ-র সাংগঠনিক ও সাধারণ প্রভাবের ক্ষেত্রে প্রচণ্ড অগ্রগতি ঘটে।
১৯৫৭ সালে এর্নাকুলামে এআইটিইউসি-র রজতজয়ন্তী সম্মেলন এক বিশাল ট্রেড ইউনিয়ন সমাবেশে পরিণত হয়েছিল। ভারতে এই ধরনের সম্মেলন ইতিপূর্বে সংঘটিত হয়নি। মোট ৯, ৪৭, ২৩১ জন সদস্যের পক্ষ থেকে ৩১ জন মহিলা সহ ১,২৮২ জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এআইটিইউসি-র মোট সদস্য সংখ্যা অবশ্য এই সময় ১৪ লক্ষ ছিল বলে দাবি করা হয়েছিল। ১৮২ জন ভ্রাতৃত্বমূলক প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। এই প্রথম সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ ট্রেড ইউনিয়স অফ ইউ এস এস আর, অল চায়না ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়নস্, রেভলিউশনারি ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্ট অফ চেকোশ্লোভাকিয়া, সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ ট্রেড ইউনিয়নস্ রোমানিয়া, জেনারেল কনফেডারেশন অফ লেবর অফ ফ্রান্স, জেনারেল ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়নস্ অফ কোরিয়া এবং ভিয়েতনাম কনফেডারেশন অফ লেবারের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিরা সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন। কেরালার তৎকালীন কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন। নয়াদিল্লিস্থিত আইএলও দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত ডাইরেক্টর ভি কে আর মেননও আমন্ত্রিত হয়ে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনের মঞ্চ থেকে গৃহীত সিদ্ধান্ত
সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক এস এ ডাঙ্গে যে রিপোর্ট পেশ করেন তাতে দেশের শিল্পায়ন, দ্বিতীয় পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনা এবং শ্রমিকশ্রেণীর দাবিদাওয়া সম্পর্কে এআইটিইউসি-র নীতি বিশ্লেষিত হয়। টু-পিলার বা দুই স্তম্ভ বলে অভিহিত এই নীতিতে একদিকে অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা অপরদিকে ঐ অর্থনীতিতে শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার বক্তব্য ঘোষিত হয়। সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে যে ১৭ দফা কর্মসূচীর কথা ঘোষণা করা হয় তার অন্যতম ছিল, ‘জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ এবং জাতীয় প্রগতির জন্য পরিকল্পনার মূল বৈশিষ্ট্যগুলির সফল রূপায়ণ’।
পরবর্তী বৎসরের জন্য ঐ সম্মেলনে এস এস মীরাজকর এবং এস এ ডাঙ্গে এআইটিইউসি-র যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। প্রকৃতপক্ষে রজতজয়ন্তী সম্মেলন এআইটিইউসি-র নীতির ক্ষেত্রে একটা তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা করে। এআইটিইউসি-র রজতজয়ন্তী সম্মেলন এমন একটা সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল যখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট আন্দোলনেও কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। ঐ পরিবর্তনগুলি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটা দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতির সূচনা করে। ঐ বিচ্যুতি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের একটা অংশকেও প্রভাবান্বিত করেছিল এবং এআইটিইউসি-র সম্মেলনে নীতি ও কৌশল সম্পর্কিত যে দলিল পেশ করা হয় তাতেও ঐ কমিউনিস্ট নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গির ঐ ধরনের পরিবর্তন যথেষ্ট প্রতিফলিত হয়েছিল। এস এ ডাঙ্গে কর্তৃক উদ্ভাবিত টু-পিলার তত্ত্ব বাস্তবে শাসক বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে সহযোগিতার নীতিকেই সুস্পষ্ট ভাবে উপস্থাপন করেছিল। কালক্রমে এই নীতি আরো খোলাখুলি রূপেই প্রচারিত হয়। ফলে কমিউনিস্ট আন্দোলনে সৃষ্টি করে গুরুতর ভাঙন।
যখন মার্কসবাদীরা কমিউনিস্ট আন্দোলনে দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতির বিরোধিতা করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) গঠন করলেন তখন এআইটিইউসি-র অভ্যন্তরীণ বিরোধ আরো তীব্রতর হলো। ঐ পার্টিতে সংগঠিত কমিউনিস্টরা ডাঙ্গে এবং তাঁর একনিষ্ঠ সমর্থকদের এই বলে অভিযুক্ত করলেন যে তাঁরা বুর্জোয়াদের যূপকাষ্ঠে শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থকে নির্লজ্জভাবে বিসর্জন দিয়েছেন। মার্কসবাদীরা সহকর্মীদের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ করলেন যে এআইটিইউসি ও তার অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়নগুলির পরিচালনার ব্যাপারে ডাঙ্গে প্রমুখরা আমলাতান্ত্রিক কায়দা-কানুন অনুসরণ করছেন, ইউনিয়ন পরিচালনায় শ্রেণী সহযোগিতার পথ গ্রহণ করছেন এবং বিভিন্ন সরকারী কমিশন ও কমিটিতে মনোনীত হয়ে শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থের ক্ষতিকারক ভূমিকা গ্রহণ করছেন। বিশেষ করে বোনাস কমিশনের সদস্য হিসাবে ডাঙ্গের ভূমিকা এবং ন্যাশনাল লেবর কমিশনের বিভিন্ন স্টাডি গ্রুপে তার মনোনীত প্রতিনিধিদের ভূমিকা তীব্রভাবে সমালোচিত হয়।
এই অবস্থায় যদিও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র অন্তর্ভুক্ত কমিউনিস্টরা ১৯৬৪ সালের পরেও আরও ছয় বৎসর এআইটিইউসি-র মধ্যে থেকে কাজ করেছেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত তাঁরা বিবেচনা করলেন যে ঐ সংগঠনের মধ্যে থেকে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাঁদের পক্ষে আর বিপ্লবী নীতি গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। তাই অবশেষে বিপ্লবী নীতির ভিত্তিতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সংগঠিত করবার জন্য একটা নতুন সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র স্থাপনের পথে অগ্রসর হলেন।
সেন্টার অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস্- সিআইটিইউ গঠন
এই রকম একটা পরিস্থিতিতে এআইটিইউসি-র সাধারণ পরিষদ ও বিভিন্ন রাজ্য কমিটিগুলির যে সদস্যরা মূল নেতৃত্বের নীতি সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত সমূহের পক্ষে ছিলেন তাঁরা ১৯৭০ সালের ১-১০ এপ্রিল গোয়াতে এক কনভেনশনে মিলিত হলেন। ঐ কনভেনশনে ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের একটা নতুন সংগ্রামী কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কনফারেন্স সংগঠিত করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই অনুযায়ী জ্যোতি বসুকে সভাপতি এবং মনোরঞ্জন রায়কে সম্পাদক করে ঐ উদ্দেশ্যে একটি অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হয়। তার পর ১৯৭০ সালের ২৮-৩০শে মে কলকাতার লেনিননগর, রঞ্জি স্টেডিয়ামে সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো।
অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির অভিভাষণে জ্যোতি বসু ভারতের জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের একটা নতুন কেন্দ্র স্থাপনের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করলেন।
তাঁর অভিভাষণে তিনি বললেন –
‘ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমরা এখানে সমবেত হয়েছি এমন কতকগুলি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য, যেগুলি আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে হবে অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হবে নতুন সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র স্থাপন। ইতোমধ্যেই ভারতে একাধিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের অবস্থান থাকায় নতুন আরেকটি কেন্দ্র স্থাপন একটা বিভেদমূলক কাজ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ঠিক এর বিপরীত, ভারতের জঙ্গী শ্রমিকদের সমবেত করার কেন্দ্র হিসাবে এইরকম কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ঐতিহাসিকভাবেই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। যে এআইটিইউসি-কে আমরা সকলে কঠোর পরিশ্রম এবং সাধারণ কমরেডদের আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছি সেই সংগঠনকেই এখন সংশোধনবাদী নেতৃত্ব বুর্জোয়াদের নিকট আত্মসমর্পণের যন্ত্রে এবং জঙ্গী সংগ্রামের প্রতিবন্ধক হিসাবে রূপান্তরিত করেছে। অগণতান্ত্রিক কার্যকৌশলের মাধ্যমে এবং যে সমস্ত প্রতিনিধিত্বমূলক ইউনিয়নে তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই সেইগুলিকে বাইরে সরিয়ে রেখে তাঁরা এখন এআইটিইউ সি-কে তাঁদের আপন লীলাক্ষেত্রে পরিণত করেছে।
সংস্কারবাদী ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ এবং ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রগুলি সর্বদাই চেষ্টা করেছে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে অর্থনৈতিক সংগ্রামের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে। বর্তমানে সংশোধনবাদী এআইটিইউসি কেন্দ্রও ঐ একই পথ অনুসরণ করে চলেছে। এআইটিইউসি-র সংশোধনবাদী নেতৃত্ব শ্রমিক-শ্রেণীর নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করেছে এবং তারা শ্রমিকশ্রেণীকেও আর জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়ন সংগ্রাম অথবা শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে পারে না। কোনো ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব একবার এই দায়িত্ব বিসর্জন দিলে তার পক্ষে বুর্জোয়াদের লেজুড়ে পরিনত হওয়ার মতো অধঃপতিত হওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। এআইটিইউসি-র নেতৃত্বে দৈনিক শুধু নয়, প্রতি ঘণ্টায় শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে বুর্জোয়াদের সঙ্গে সহযোগিতা ও বুর্জোয়া নেতৃত্ব গ্রহণের নীতি অনুপ্রবেশ করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’
তারপর এআইটিইউসি নেতৃত্বের বিভিন্ন ভূমিকা— বিভিন্ন শিল্পে ‘শ্রমিক বিরোধী চুক্তি’ স্বাক্ষর করা, ‘সরকার নিযুক্ত ত্রিপাক্ষিক ও অন্যান্য কমিটিতে তার যে বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।’ উদাহরণস্বরূপ, ‘বোনাস কমিশনে ডাঙ্গের নিজস্ব ভূমিকা থেকে ন্যাশনাল লেবর কমিশনের স্টাডি গ্রুপ সমূহে ঐ গোষ্ঠীর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের কাজকর্ম এবং আন্তর্জাতিক চেতনা থেকে ভারতের শ্রমিকশ্রেণীকে দূরে রাখবার জন্য, এই নেতৃত্বের চেষ্টা ইত্যাদি উল্লেখ করে জ্যোতি বসু তাঁর অভিভাষণে সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ‘এই ধরনের পরিস্থিতিই একটা প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী ইউনিয়ন কেন্দ্র স্থাপন অপরিহার্য করে তুলেছে যে কেন্দ্র শ্রমিকদের জঙ্গী অর্থনৈতিক সংগ্রামে পরিচালিত করবে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদের রাজনৈতিকীকরণ ও ক্ষমতা দখল জন্য প্রস্তুত করবে এবং দেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে তাঁদের শামিল করবে।
সম্মেলনে মূল রিপোর্ট পেশ করেন পি রামমূর্তি। তিনি তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে ঐক্যের সংগ্রাম পরিচালনার জন্যই এইরকম একটি নতুন সারা ভারত কেন্দ্র স্থাপন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এবং আহ্বান দেন যে ‘ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে নিচের তলায় ঐক্য সৃষ্টির সংগ্রাম তীব্রতার সঙ্গে পরিচালিত করতে হবে।’ রামমূর্তি তাঁর রিপোর্ট আরো ঘোষণা করেন যে, ‘আমরা’ একটা শিল্পে বা একটা কারখানায় একটা ইউনিয়নই চাই। আমরা রাজনৈতিক মতামতের ভিত্তিতে ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে বিভক্ত করতে চাই না। আমরা শ্রমিকদের একটা সাধারণ ট্রেড ইউনিয়নে ঐক্যবদ্ধ করতে চাই কারণ মালিকদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের স্বার্থ অভিন্ন এবং তাই তাদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে সংগ্রাম পরিচালিত করতে হবে।’
সম্মেলনটি একটা বিরাট শ্রমিক সমাবেশে পরিণত হয়েছিল। এম কে পান্ধে কর্তৃক ক্রেডেন্সিয়াল কমিটির যে রিপোর্ট পেশ করা হয় তা থেকে প্রকাশ পায় যে মোট ৮, ০৪,৬৩৭ সদস্য সমন্বিত ১৯৫১টি ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ৪,২৬৪ জন প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগদান করেন। এছাড়া ভ্রাতৃত্বমূলক ইউনিয়নগুলি থেকে যে ১১৬ জন প্রতিনিধি যোগ দেন তাঁদের সহ মোট অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধির সংখ্যা ৫,৫১৪।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রশ্নে একাধিক প্রস্তাব ঐ সম্মেলনে গৃহীত হয়।
সম্মেলনের সমস্ত আলোচনা গুটিয়ে আনেন বি টি রণদিভে। তিনি তাঁর ভাষণে বলেন যে জাতীয় ও গণতান্ত্রিক পরিস্থিতিতে এই ধরনের একটা জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র স্থাপন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে, তার আনুপূর্বিক বিশ্লেষণ উপস্থিত করেন। উপসংহারে বলেন, ‘ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে একথা ভুললে চলবে না যে সমাজতন্ত্র এবং শোষণ থেকে মুক্তি কথার কথা হয়ে থাকবে যদি শ্রমিকশ্রেণী সচেতনভাবে ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম না করে এবং এই দিকে প্রথম পদক্ষেপ হবে বর্তমান বুর্জোয়া জমিদার সরকারকে হটিয়ে প্রকৃত জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা। বর্তমান সরকারকে পরিবর্তনের জন্য নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া, কৃষক সমাজের সঙ্গে মৈত্রীবদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম গড়ে তোলা ও তাতে অংশগ্রহণ করা, ভূমি বিপ্লব সম্পন্ন করার সংগ্রাম সমর্থন করা,… এবং এই লক্ষ্য নিয়ে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তির একটা ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করা এইগুলিই হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের জরুরী দায়িত্ব।
৩১শে মে ১৯৭০ কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডে অনুষ্ঠিত প্রকাশ্য সমাবেশ অনুষ্ঠানের পর সম্মেলনের সমাপ্তি হয়। প্রায় দশ লক্ষ শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এই মহতী সভায় সভাপতিত্ব করেন বি টি রণদিতে। এই নবজাত সংগঠন সেন্টার অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস্-এর সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হলেন যথাক্রমে বি টি রণদিভে ও পি রামমূর্তি।
সূত্রঃ ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস (১৮৩০-২০১০), প্রকাশক – ন্যাশনাল বুক এজেন্সি