Modi Adani 1

আদানিঃ জালিয়াতি, তছরুপ ও সরকারী সমর্থন জুটিয়ে নেওয়ার এক অভূতপূর্ব কাহিনী (১ম পর্ব)

নীলোৎপল বসু

নরক গুলজার প্রতিষ্ঠা হয়েছে যেন। আদানি গোষ্ঠীর সমস্ত পাবলিক শেয়ারেই আপাতত রক্তক্ষরণ চলছে। ১২৯ পাতা জুড়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন। আমেরিকান সংস্থা হিন্ডেনবুর্গের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে দুনিয়ার তিন নম্বর বহুজাতিক সংস্থা আসলে দেনার দায়ে গলা অবধি ডুবে রয়েছে, অথচ নিজেদের সম্পত্তির বহর দেখাতে তারাই ছদ্মবেশে করহীন দেশ থেকে ভুয়ো বিনিয়োগের ছ্বটা দেখিয়ে চলেছে। হিন্ডেনবুর্গ বলছে ভারতীয় টাইকুন গৌতম আদানি কার্যত কর্পোরেট ব্যবসার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জালিয়াত। প্রতিবেদনটি দেখলেই বোঝা যায় তথ্য-প্রমাণ সহ বিষয়টি খাড়া করতে হিন্ডেনবুর্গ যথেষ্ট মেহনত করেছে, জনসমক্ষে প্রাপ্ত তথ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন গোপন ইমেইল অবধি তারা ব্যবহার করেছে। রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে আদানি গোষ্ঠীর সবমিলিয়ে ৭টি পাবলিক সংস্থা রয়েছে, এছাড়াও প্রায় ৫৭৮টি বিভিন্ন সাবসিডিয়ারি কোম্পানি তারা নানাভাবে নিজেদের দখলে রেখেছে। এই সমস্ত কোম্পানির মালিকানা কোথাও সরাসরি আদানি’দের হাতে রয়েছে আবার কোথাও নিজেদের পরিবারের সদস্যরাই সেগুলির মালিক হয়ে বসে রয়েছে। এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার আগে অবধি আদানি’দের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গোপন কথাটি ফাঁস হওয়ায় এখন সেই সম্পত্তির অনেকটাই স্রেফ উবে গেছে। হিন্ডেনবুর্গ বলেছে এহেন সম্পত্তির মূলে রয়েছে করহীন দেশসমূহ থেকে ঘুরপথে নিজেদেরই অর্থকে পুনঃবিনিয়োগ করিয়ে নেওয়া, আবার কখনো শেয়ারের দামে কারচুপি করা। আদানি’দের ৭টি সংস্থাই বিরাট দেনায় ডুবে রয়েছে। নিজেদের সম্পত্তিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখাতে এরা নিজেদের বহুজাতিক সংস্থার তকমাকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছে। সেই অসদুপায়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটাই – কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়িয়ে দেওয়া এবং সেই সুযোগে বাজার থেকে বিরাট পরিমাণ বিনিয়োগ টেনে নেওয়া। এই কায়দাটি কর্পোরেট বিনিয়োগের ভাষায় রাউন্ড ট্রিপিং বলে পরিচিত এবং আমাদের দেশে এমন কাজ গর্হিত অপরাধ। কি এই রাউন্ড ট্রিপিং? সহজ কথায় বিদেশে (যেখানে বিশেষভাবে করছাড় পাওয়া যায়) ভুয়ো সংস্থার সাহায্যে অর্থাৎ অন্য সংস্থার নামের আড়ালে নিজেদেরই হাতে থাকা অর্থকে বিনিয়োগের নামে পুনঃ পুনঃ ব্যবহার করে শেয়ারের মূল্যমান বাড়িয়ে নেওয়া। কোনও কোম্পানিতে মালিক গোষ্ঠীর হাতে থাকা মালিকানার অনুপাত নির্দিষ্ট, তার বেশি শেয়ার হাতে রাখা অন্যায়, আদানিরা সেটাই করেছে। সাইপ্রাস, মরিশাস ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে তারা এমন ভুয়ো সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। এদেরকে বাজারের ভাষায় শেল কোম্পানি বলে।

হিন্ডেনবুর্গ এসব জানল কি করে? অধিকাংশ তথ্য পাবলিক ডোমেইনেই ছিল। আর্থিক তছরুপ সংক্রান্ত একাধিক ভারতীয় নিয়ামক সংস্থা আদানিদের ব্যবসা সম্পর্কে নিজেদের অনুসন্ধান জনিত তথ্য প্রকাশ করেছিল। যদিও তারা প্রাথমিক অনুসন্ধান করেই থেমে যেতে বাধ্য হয়েছিল। এসব তথ্যই হিন্ডেনবুর্গের কাজে দিয়েছে।

হিন্ডেনবুর্গের প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরে কিছুদিন অবধি আদানিরা অবশ্য সবকিছুই অস্বীকার করেছিল। তাদের অভিযোগ ছিল এই প্রতিবেদনের কোনও সারবত্তা নেই, মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এসব কথা বলে হচ্ছে- এই ছিল তাদের বক্তব্য। যথেষ্ট তথ্যতালাশ না করেই এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করে কুৎসা করা হচ্ছে এমনটাও তারা বলতে চেয়েছে। আরও পরে তাদের বক্তব্য হয়েছে এমন প্রতিবেদন আসলে দেশের স্বার্থবিরোধী। আদানিদের ধামাধরা কেউ কেউ তো প্রায় এমন কথা বলে ফেলেছেন যেন আদানির স্বার্থই ভারতের স্বার্থ। অবশ্য ততদিনে আমজনতা আসল কথাটি বুঝে নিয়েছেন। তাই বিরাট বিরাট বুলি কপচেও আদানি’দের শেষরক্ষা হল না- বাজার থেকে টাকা তুলতে এফপিও (ফলো অন পাবলিক অফারিং) ঘোষণা করেও বাতিল করতে হল। এমন কাজের জন্য আদানিরা যদিও নৈতিক দায়িত্বের কথা তুলেছে কিন্তু প্রায় সবাই বুঝেছে বিনিয়োগকারীদের (ইনভেস্টর) স্বার্থে আদৌ এফপিও রিলিজ করা হয়নি, হয়েছিল আসলে নিজেদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে। কর্পোরেট জগতে কাকেরই নিয়ম চলে- এফপিও’র আড়ালে একজনকে বাঁচাতে অন্যরা নেমে পড়ত, হয়ত এই কায়দায় তারা নিজেদেরই আরও কিছু পয়সাকড়ি বিনিয়োগ করিয়ে নিত। এরাই একে অন্যকে উচ্চমর্যাদার সম্পত্তিবান (হাই নেটওয়ার্থ ইন্ডিভিজ্যুয়াল) বলে পিঠ চুলকাতে ব্যস্ত থাকে। এফপিও খারিজের পাশাপাশি ডলার ডিনোমিনেটেড বন্ড সংক্রান্ত অফারও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এমন ঘটনা নজিরবিহীন। এই পরিস্থিতিতে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দাবী করা হচ্ছে সেই কারনেই।

আদানি’দের সম্পত্তির উৎস সন্ধানে

ভারতে ব্যাক্তিমালিকানাধীন বন্দরের ক্ষেত্রে বৃহত্তম, বিদ্যুৎ উৎপাদনের বৃহত্তম কর্পোরেট সংস্থা – সবই আদানি’রা। আমাদের দেশে কয়লা খনি, জ্বালানী তেল ও গ্যাস উৎখনন, জ্বালানী গ্যাস সরবরাহের ব্যবসা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, সিভিল কনস্ট্রাকশন, পরিকাঠামো নির্মাণ, মাল্টি মডেল লজিস্টিকস, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, শিক্ষা, আবাসন শিল্প, ভোজ্য তেল উৎপাদন থেকে খাদ্যের মজুতকরণ অবধি এমনকি সম্প্রতি মালিকানাধীন বিমানবন্দরের ক্ষেত্রেও তারা প্রায় একচেটিয়া অধিকারী হয়ে বসেছিল। ৩০টিরও বেশি বিভিন্ন ধরণের পণ্য ব্যবসায় এরা প্রায় ২৮টিরও বেশি দেশে নিজেদের বাণিজ্য বিস্তার করেছে।

ফোর্বস পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালের (ঠিক যখন মোদী প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেছেন) সেপ্টেম্বর মাস অবধি আদানি’দের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৭.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

গৌতম আদানি কলেজের পড়াশোনা শেষ করেননি। হিরের ব্যবসায় চমকপ্রদ সাফল্যের পরে তিনি ১৯৮১ সাল নাগাদ আমেদাবাদের বাসিন্দা হন। তার এক ভাইপো তখন পিভিসি’র ব্যবসা করতেন, গৌতম সেই ব্যবসাতেই পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ শুরু করেন। ১৯৮৮ নাগাদ শুরু হয় আদানি স্পোর্টস। এই ব্যবসাই তাকে গুজরাটে পরিচিতি দেয়। যদিও তখন থেকেই তার ব্যবসা প্রসঙ্গে বহুবিধ সংশয়, বিতর্কের সুত্রপাত ঘটে তাহলেও যে অবিশ্বাস্য গতিতে তিনি বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়ে বসেন এবং দুনিয়ার দুনম্বর ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন তার ধাক্কায় সব বিতর্কই চাপা পড়ে যায়।

ধনী হয়ে ওঠার পথে অভূতপূর্ব গতি এবং মোদীর সাথে নজরকাড়া সম্পর্ক  

মোদীর সাথে আদানির যোগাযোগ কিভাবে শুরু হল? ২০০২ সালে গুজরাটে দাঙ্গা হয়েছিল। সেই সময় মোদী ছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। দাঙ্গার সেই ঘটনা মোদীকে ভারতের রাজনীতিতে প্রায় একঘরে করে দেয়। নানা দিক থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর আসন থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার দাবী উঠতে থাকে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী অবধি তার সমালোচনা করেছিলেন। মোদীর বিরুদ্ধে চলে যায় সিআইআই-এর মতো সংস্থাও। এই অবস্থায় অনেক শিল্পপতিরাই মোদীকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন, ঠিক এই অবস্থাতেই আদানি আসরে নামেন। তারই ইচ্ছায় গুজরাটে সিআইআই- বিরোধী আরেকটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। সেই বিরোধী গোষ্ঠীই ভাইব্র্যান্ট গুজরাট স্লোগান তুলেছিল। ২০১৪ সালে মোদীকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত করতে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিল এরাই।

গুজরাটে জাতিদাঙ্গার ঘটনার পরেও আদানি সেই রাজ্যে উৎসাহের সাথে বিনিয়োগ করে গেছেন। যখন মোদী প্রায় অচ্ছুতে পরিণত হয়েছেন ঠিক সেই সময়েই আদানি তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রসাশক হিসাবে মোদীর ভাবমূর্তি শোধরাতে আদানিই বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। একে অন্যের সুবিধার প্রতি বিশেষ নজর দিয়ে নিজেদের কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে চলার শুরু হয় সেই থেকেই।

মোদীও ততদিনে আদানির বন্ধুত্বের ঋণস্বীকার করতে শুরু করেছেন। ২০০২ থেকে ২০১৪ অবধি সময়কালে সেই পারস্পরিক বন্ধুত্বের এমন বহু নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। মুন্দ্রা বন্দরের আশেপাশের জমি হস্তান্তরের মধ্যে দিয়ে ব্যাপারটি শুরু হয়। সেইবার প্রতি বর্গমিটার জমি মাত্র এক সেন্ট (ভারতীয় মুদ্রায় ৫০ পয়সা) দরে  প্রায় ৭৩৫০ একর জমি আদানির হাতে চলে আসে। বড় কারখানা স্থাপনে পুঁজিপতিদের বিশেষ সুবিধা দেওয়াই রেওয়াজ, এক্ষেত্রে সমস্ত রেওয়াজেরই রেকর্ড ভেঙ্গে যায়। শুধু যে জমির দাম কম নেওয়া হল তাই নয়, অধিগৃহীত জমিতে এসইজেড গড়ে তুলতে যাবতীয় ষ্ট্যাম্প শুল্কই মাফ করে দেওয়া হয়। সেই জমিতে এসইজেড নির্মাণের সময় পরিবেশগত বিধিনিষেধের নানা বাধ্যবাধকতা ছিল, জমিতে বসবাসকারী আদিবাসীদের পুনর্বাসন প্রসঙ্গেও অনেক কথাই ওঠে। সব বাধা পেরিয়েই আদানি জমির মালিকানা হাতে পান। পরে সেই জমিকেই প্রতি বর্গমিটারে ১১ মার্কিন ডলার ( ভারতীয় মুদ্রায় ৯০৭.৫০ টাকা) দরে আদানিরা বিক্রি করে দেয়! কিভাবে গুজরাট স্টেট পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে দখল করতে আদানিকে নানারকম সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে সেইসবই ক্যাগের রিপোর্টে রয়েছে। সেই সুবিধার তৎকালীন মূল্যমান ৭০ কোটি টাকা। 


শেয়ার করুন

উত্তর দিন