Site icon CPI(M)

Abdullah Rasool, the communist leader in the struggle for human liberation

অরিন্দম কোঙার

১৯২১ সালে ১৮ বছর বয়সে অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের উপনিবেশবাদ-বিরোধী সংগ্রামে যুক্ত হন মহম্মদ আবদুল্লাহ্‌ রসুল। মানবমুক্তির বিভিন্ন পর্যায়ের সংগ্রামে আমৃত্যু তিনি ছিলেন অবিচল। অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হন ১৯৩৮সালে। সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র আত্মপ্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। আমৃত্যু পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য ছিলেন। এই সময়ে রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্যও ছিলেন। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য (১৯৮২-৮৮) ছিলেন। কিন্তু বয়সের ভারে ও শারীরিক অসুস্থতার জন্য সদস্যপদ থেকে নিজেই অব্যাহতি নেন।

মহম্মদ আবদুল্লাহ্‌ রসুলের জন্ম ১৯০৩ সালের ১২ জুন বর্ধমান জেলার মেমারী থানার শলদা গ্রামে (শলদা মামার বাড়ি, নিজেদের বাড়ি মেমারী থানার কেজা গ্রামে) এবং মৃত্যু ১৯৯১ সালের ২১ নভেম্বর কলকাতায়। সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী আদর্শ কমিউনিস্ট অকৃতদার আবদুল্লাহ্‌ রসুল ভারতের কৃষক আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব, কমিউনিস্ট আন্দোলনের সামনের সারির একজন নেতা। কলকাতায় থাকতেন পার্টি কমিউনে। অশক্ত শারীরিক অবস্থার জন্য তিনি নিজেই স্বেচ্ছায় নেতৃত্বের পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক শৈলেন দাশগুপ্তকে ১৯৯১ সালের ২ নভেম্বর জীবনের শেষ চিঠিতে লেখেন, ‘‘এই সঙ্গে বলে রাখি যখন নতুন সম্পাদকমন্ডলী হবে তার প্যানেলে আমার নাম যেন না থাকে। তবে কমরেডদের আপত্তি না থাকলে আমি পিসি-তে থাকতে চাই। তা না থাকলে আমাকে পার্টি থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে।। দু’তিন মাস অন্তর একবার পিসি মিটিং হলেও তখন অন্তত কমরেডদের সঙ্গে দেখাটা হবে।’’রাজ্য সম্মেলন (সপ্তদশ) অনুষ্ঠিত হয় মৃত্যুর কয়েক দিন পর (১১-১৫ ডিসেম্বর,১৯৯১)।

বিশ্ববিপ্লবের পথিকৃৎ মহান বিপ্লবী কার্ল মার্কস, ভূমি ও কৃষি সমস্যা: লেনিনবাদের আলোকে, প্রলেতারীয় সংস্কৃতি: লেনিনবাদের আলোকে, দুটি জটিল সামাজিক সমস্যা ইত্যাদি প্রবন্ধে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আবদুল্লাহ্‌ রসুল দেখিয়েছেন মার্কসবাদের উদ্ভব ও তার বিকাশ কেমনভাবে হয়েছে, মার্কসবাদের প্রয়োগ ঘটিয়ে সমাজের পরিবর্তন ও বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধান কীভাবে হয়েছে। রসুলের ভাষায়, ‘‘মার্কসবাদ সমগ্র মানবজাতির সবচেয়ে অগ্রণী ও বৈজ্ঞানিক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি, এ যুগের প্রধান বিপ্লবী শ্রেণী প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী দার্শনিক মতবাদ। এই মতবাদকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণী পৃথিবীকে পরিবর্তন করছে ও করবে।’’ (বিশ্ববিপ্লবের পথিকৃৎ) প্রচারবিমুখ, আত্মম্ভরিতামুক্ত আবদুল্লাহ্‌ রসুল সহজ ভাষায় সাম্যবাদ সম্পর্কে আলোচনা করে লিখেছেন ‘কমিউনিজম কাহাকে বলে’।

মহম্মদ আবদুল্লাহ্‌ রসুল ছিলেন অবিসংবাদী কৃষক নেতা। সারা ভারত কৃষক সভার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভার সভাপতি ছিলেন,সম্পাদক ছিলেন। আবদুল্লাহ্‌ রসুল অবিভক্ত ভারত, বিশেষ করে বাংলার গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেছেন, মানুষকে সংগঠিত করেছেন, কষ্টের মধ্যে থেকেছেন, আনন্দ পেয়েছেন, অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘এমনি একদিন হাঁটতে হাঁটতে খিদেয় প্রাণ যায়।কোথাও কিছু পাওয়া যায় না। এক জায়গায় পথে দেখা গেল একজন কৃষক মাথায় এক ঝুড়ি কাঁঠাল নিয়ে হাটে যাচ্ছে। পাকা কাঁঠালও ছিল। একটা কিনে জলের ধারে বসে তাকে অতি সন্তর্পণে ভেঙে (যাতে হাতে বেশি আঠা না লাগে) তিনজনে খেয়ে শেষ করলাম। এই ধরনের অভিজ্ঞতা সেকালে কৃষক কর্মীদের হতো। মাঠের আল বা কাঁচা রাস্তা ছাড়া পাকা রাস্তা ও যানবাহন ছিল অত্যন্ত বিরল।’’ (গ্রামে গ্রামান্তরে) কিন্তু এই কষ্টের মধ্যেও পেয়েছেন কত আনন্দ।

ছোট-বড় দাবি নিয়ে কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে, কিন্তু সেই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে বারে বারে সচেতন করেছেন আবদুল্লাহ্‌ রসুল। তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কৃষক সভা, তার আন্দোলন ও সংগ্রাম জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটা প্রধান অংশ। অন্যান্য অংশগুলির মধ্যে আছে শ্রমিক, ছাত্র, যুব, শিক্ষক, নারী প্রভৃতি সমাজের বিভিন্ন অংশের ও স্তরের জনগণ এবং সাধারণভাবে আছে সমস্ত শ্রমজীবী জনগণ আর তাদের সকলের নেতৃত্বে আছে সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণী। কৃষকসভার কর্মীদের এই সত্যটি সব সময়ে মনে রাখা দরকার, যাতে গণতান্ত্রিক বিপ্লবে কৃষক সভার আন্দোলনকে সার্বিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।’’

ইতিহাস— চতুর্থ সংস্করণের ভূমিকা। কৃষক আন্দোলনের তাগিদে সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায় তিনি দিনের পর দিন প্রচার চালিয়েছেন, তুলে ধরেছেন সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাস এবং শেষ পর্যন্ত লিখে ফেলেছেন ‘সাঁওতাল বিদ্রোহের অমর কাহিনী’ নামে পুস্তিকা যা সাঁওতালী ভাষায় অনুদিত হয়ে হয়েছে ‘হড় হপন কোআ বিরাদ কাহিনী’।

শুধু তত্ত্বগতভাবে নয়, জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা মুহম্মদ আবদুল্লাহ্‌ রসুল দেখিয়েছেন যে, সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে শ্রেণী সংগ্রাম কী রকম কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতায় বীভৎসতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়, দুদিনে প্রায় ৫০০০ মানুষের প্রাণ যায়। অক্টোবর মাসে দাঙ্গা বাধে নোয়াখালিতে এবং তারপর দাঙ্গা বাংলার বাইরে বিহারের মজফ্‌ফরপুর, যুক্ত প্রদেশের গড়মুক্তেশ্বর এবং পাঞ্জাব, বোম্বাই, ত্রিপুরায় ছড়িয়ে পড়ে। এই পটভূমিকায় ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভা তেভাগা আন্দোলন (বর্গাদারদের জন্য ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ ভাগের দাবি)-এর ডাক দেয়। দিনাজপুর জেলার আটোয়ারি থানা এলাকায় এই আন্দোলন শুরু হয় নভেম্বর মাসে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বাংলা প্রদেশের বিভিন্ন জেলায়। অধিকার প্রতিষ্ঠায় গড়ে ওঠে সাম্প্রদায়িক বিরোধের মোকাবিলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। আবদুল্লাহ্‌ রসুল তাই লিখেছেন, ‘‘সমাজের ইতিহাসের এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, সাধারণ শ্রমজীবী জনগণকে সন্প্রদায়গত চিন্তা ও মানসিকতার দুর্বলতা থেকে রক্ষা করবার একমাত্র নিশ্চিত উপায় তাদের শ্রেণীস্বার্থ সম্বন্ধে তাদের সচেতন ও সংগঠিত করে শ্রেণী-সংগ্রামের মধ্যে নিয়ে আসা, শ্রেণী শোষণ থেকে স্থায়ী মুক্তির জন্য শ্রেণীগত বিপ্লবের পথে পরিচালিত করা।’’ (সাম্প্রদায়িকতা বনাম শ্রেণী-সংগ্রাম)

সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা মুহম্মদ আবদুল্লাহ্‌ রসুল মনে করতেন, ‘‘ভূমি-বিপ্লব ও কৃষক-মুক্তির বিপ্লবকে সফল করে তুলতে হলে একদিকে যেমন কৃষকের রাজনৈতিক সংগ্রামে তার বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমাজবাদী চেতনার স্তরে তোলা দরকার, তেমনি কৃষক স্বার্থে রচিত শিল্পকর্মগুলির মধ্যেও সমাজবাদী চিন্তাধারার সুস্পষ্ট প্রতিফলন একান্ত প্রয়োজন। এই দুইয়ের সমন্বয়ের ভিতর দিয়েই কৃষকের শিল্প-সংস্কৃতি সার্থকতা লাভ করবে।’’ ( কৃষকের শিল্প-সংস্কৃতি)। কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি দেখিয়েছেন যে, কেমনভাবে বিশ শতকের চারের দশকে বাংলায় কৃষক সভার সঙ্গে গণনাট্য সঙ্ঘের নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। তিনি আরও দেখিয়েছেন যে ছৌ, গম্ভীরা, জারি, ভাটিয়ালি,আখড়ার কীর্তন, সত্যপীরের পালা, লেটো, মনসার ভাসান, বাউলের গান, কবিয়ালি ইত্যাদি বিভিন্ন রূপের শিল্পের স্রষ্টা গ্রামের কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষ। সুতরাং উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সাধারণ মানুষের শিল্পবোধ আছে, শিল্প রুচি আছে, শিল্পের চাহিদা আছে আর এই শিল্প হচ্ছে তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভুত। তিনি নিজে কৃষক জীবন, কৃষক আন্দোলনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখেছেন ‘আবাদ’ (১৯৬৫ সালে দমদম সেন্ট্রাল জেলে বন্দী অবস্থায়), ‘শহর থেকে গ্রামে’, ছিটেফোঁটা (মৃত্যুর পর প্রকাশিত)-র মতো উপন্যাস। ‘আবাদ’ উপন্যাস আবার মালায়ালাম ও জাপানী ভাষায় অনুদিত হয়েছে যদিও তিনি এগুলিকে উপন্যাস না বলে, কাহিনী বলেছেন আর নিজেকে সাহিত্যিক বলে মনে করতেন না।

মৃদুভাষী আবদুল্লাহ্‌ রসুল তাই সাহিত্যিকদের পরামর্শ দিয়েছেন মৃদু ভাষায়। তাঁর পরামর্শ হচ্ছে ‘‘কৃষক জীবন সন্বন্ধে সাহিত্য রচনা করতে হলে প্রথমেই দেখতে হবে সে লেখার ভাষা যেন হয় সহজ ও সরল, যা সাধারণ কৃষক পড়ে বা শুনে বুঝতে পারে; যেন হয় সজীব ও সরস এবং রাজনীতিক চিন্তা প্রেরণায় সমৃদ্ধ, যেন তার মধ্যে প্রতিফলিত হয় চলতি মামুলি জীবনের তুলনায় আরো উন্নত জীবন ও চরিত্র বাস্তব অবস্থা ও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন গুণের সমাবেশে আদর্শ ধরনের কিন্তু বাস্তবসম্মত সতেজ, তীক্ষ্ণ, আত্মত্যাগী ও জনপ্রিয় চরিত্র। চরিত্র অবশ্যই এক রকমের হবে না। তার মধ্যে ভালো ও মন্দের পার্থক্য ও বিরোধকে তুলে ধরতে হবে।’’ ( জনগণের বিপ্লবী শিল্প-সাহিত্য)। শিল্পী-সাহিত্যিকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ্‌ রসুল ছিলেন এক উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক। ১৯৭২ সালে পশ্চিমবঙ্গে আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের সময়ে গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী কলাকুশলী সম্মেলন প্রতিষ্ঠায় (বর্তমান নাম গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘ) ও পরবর্তীকালে সংগঠন পরিচলনায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

আন্দোলনের জন্য চাই সচেতনতা। আর চেতনা বিকাশে সাক্ষরতার গুরুত্ব তুলে ধরে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের পরিবহন মন্ত্রী (১৯৭০ সালে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত) আবদুল্লাহ্‌ রসুল লিখেছেন ‘‘নিরক্ষতা দূর করবার মতো অত্যন্ত গুরুত্নপূর্ণ ও জরুরী কাজে সাহায্য করাকে বর্তমান যুক্তফ্রন্ট সরকারের উচিত সামগ্রিক দায়িত্ব বলে গ্রহণ করা, তাকে একটা বিশেষ দপ্তরের বিষয় বলে উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে বিচার না করা জনগণের মৌলিক।

সাংস্কৃতিক স্বার্থেরই পরিপন্থী। বেসরকারীভাবেও নিরক্ষরতা দূর করার কাজে সাহায্য করা, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, কৃষক সভার এবং ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলির নিকট একটা বিশেষ দায়িত্ব বলে গণ্য ও স্বীকৃত হওয়া উচিত।’’ (প্রলেতারীয় সংস্কৃতি : লেনিনবাদের আলোকে)। সাক্ষরতার সঙ্গে ও সক্ষমতাকে যুক্ত করতে সাক্ষরোত্তর অভিযানে ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞান বিষয়ক কর্মসূচী যুক্ত হচ্ছে। আবদুল্লাহ্‌ রসুলের উপন্যাসে (‘ছিটেফোঁটা’) ঠিক এই কথাই বলা হয়েছে।

মানবমুক্তির সংগ্রাম এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, নানা আগে-পিছের মধ্য দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পরিচালিত হয়। সেখানে মহম্মদ আবদুল্লাহ্‌ রসুলের মতো কমিউনিস্ট নেতারা প্রেরণার উৎস হিসাবে অমর থেকে যান।

শেয়ার করুন