কর্মসংস্থান সহ রাজ্যের মানুষের দুর্দশা কাটানোর কোনো দিশা নেই রাজ্য বাজেটে, আছে কেবল বুজরুকি। বুধবার তৃণমূল সরকারের পেশ করা বাজেট প্রস্তাব সম্পর্কে একথা বলেছেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের ঋণের পরিমান চারগুণ বাড়িয়েছেন, কিন্তু তাই দিয়ে কোনো স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি করেননি, বেকারদের কাজের ব্যবস্থা করেননি। ঋণের টাকা গেল কোথায়? বুজরুকি দিয়ে উনি খালি তৃণমূলের শখ আহ্লাদ মেটাতে খরচ করছেন।
রাজ্যের উন্নয়নে, স্থায়ী সম্পদ তৈরিতে, কিংবা রাজ্যবাসীর দারিদ্রদূরীকরণে, কোনো ক্ষেত্রেই তৃণমূল সরকারের একের পর এক বাজেট কার্যকরী হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন সেলিম। তিনি বলেছেন, আবাস প্রকল্পে কেবল দুর্নীতিই হয়েছে, ঘর পায়নি গরিব মানুষ। কেন রাজ্যে আবাস যোজনা ব্যর্থ তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। শিক্ষা স্বাস্থ্যের অব্যবস্থা দূর করার কোনো কথা নেই। স্কুলে ড্রপ আউট হচ্ছে, স্কুল বন্ধ হচ্ছে। এগুলির সমাধানে কোনো পদক্ষেপের কথা বলা নেই। রাজ্যে গণপরিবহন বিপর্যস্ত, কিন্তু তা নিয়ে কোনো কথা নেই। কলকাতার ট্রামকে বাঁচাতে কোনো কথা নেই। বন্যারোধে পরিকল্পনা নেই। কেবল মাস্টার প্ল্যানের গল্প বলে মুখ্যমন্ত্রী মিডিয়াতে মাস্টার স্ট্রোক প্রচার করতে চাইছেন হয়তো।
সেলিম আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাজেটের নদীবন্ধন প্রকল্প নিয়ে। তিনি বলেছেন, নদী বন্ধনে দুশো কোটি টাকা বরাদ্দ কেন? এই প্রকল্পের ডিপিআর কই? মমতা ব্যানার্জি বাজপেয়ীর কেন্দ্রীয় সরকারে ছিলেন, তখন থেকে নদী সংযোগের পরিকল্পনা। কিন্তু পরিবেশে তার মারাত্মক খারাপ প্রভাব পড়বে। কাজের কাজ না করে মুখ্যমন্ত্রী এখন নদী নিয়ে খেলতে চাইছেন? নদী লুট কিন্তু ভোট লুটের থেকেও মারাত্মক। নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালি পাথর তুলতে চাইছেন? আমাদের নদীমাতৃক সভ্যতা। নদীতে যারা মাছ ধরেন, নদীতে জলপরিবহনে কিংবা নদীর জলের ওপরে যারা নির্ভর করেন তাঁদের ওপর কী প্রভাব পড়বে তার বিবেচনা করা হয়েছে? পরিবেশবিদ বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়ার দরকার আছে। ভয়ের কথা হলো, মুখ্যমন্ত্রী যেদিকে দৃষ্টি দেন সেখানেই বিপদ, তাই সাবধান হতে হবে।
কর্মসংস্থানে দিশাহীন বাজেট সম্পর্কে সেলিম বলেন, বিজনেস সামিটে কটা কারখানা হলো, কত কর্মসংস্থান হলো? এবারের বাজেটে কোনো ঘোষণা নেই। শিল্পায়ন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বাইরে আজগুবি দাবি করতে পারেন, কিন্তু বিধানসভায় বাজেট ভাষণে সরকারি বিবৃতি নথীভূক্ত হয়, সেই সময় আজগুবি দাবিগুলো এড়িয়ে গেলেন কেন?
তিনি বলেন, বাজেটের বিবৃতিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের ঋণ বাড়ছে। এমনকি একবছরে যা ঋণ নেওয়ার কথা ছিল, তার থেকেও বেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে। এই অর্থ বর্ষের শেষে ঋণের পরিমান দাঁড়াবে ২০১১ সালে রাজ্যের ঋণভারের চারগুন। বাজার থেকেই বেশি সুদে ঋণ নেওয়া হচ্ছে শখ আহ্লাদ মেটাতে। বেকারদের কাজের সংস্থান করতে নয়। সরকার কোনো নতুন প্রকল্প ঘোষণা করেনি, নতুন কোনো সম্পদ সৃষ্টি করতে পারেনি, তাহলে এত ঋণ কেন? মুখ্যমন্ত্রী সেই ব্যাখ্যা না দিয়ে যথারীতি বামফ্রন্টকে দায়ী করে গালি দিচ্ছেন। স্বাধীনতার পর থেকে বামফ্রন্ট সরকারের শেষদিনে পুঞ্জীভূত মোট ঋণভারের পরিমান ছিল ১.৯২ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ ছিল, এখন তার চারগুণ। ঋণ লাঘবের বদলে রাজ্যকে ক্রমাগত ঋণ নির্ভর করে তুলেছেন মমতা ব্যানার্জি।
শুধু একটি বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে সেলিম বলেছেন, দিনের পর দিন সরকারি কর্মচারীদের ডিএ নিয়ে আন্দোলন হলো, মামলা হলো। মোকদ্দমায় সরকার অঢেল খরচ করেছে। কিন্তু ডিএ’র বকেয়ার পরিমান কমছে না। তবু মন্দের ভালো, এবারের বাজেটে ৪ শতাংশ ডিএ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মেনে নিয়েছেন যে ডিএ বকেয়া আছে। এতদিন তো বলতেন মহার্ঘ ভাতায় কোনো বকেয়াই নেই।
রাজ্যে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কোনো নতুন প্রকল্পের ঘোষণা ছাড়াই ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের বাজেট প্রস্তাব পেশ করল তৃণমূল সরকার। বুধবার বিধানসভায় অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের পেশ করা বাজেটে আইসিডিএস এবং আশা কর্মীদের স্মার্ট ফোন দেওয়া, সরকারি কর্মীদের ৪ শতাংশ ডিএ দেওয়ার মতো যৎসামান্য কিছু ঘোষণা ছাড়া সাধারণভাবে রাজ্যবাসীর প্রাপ্তি বলতে কিছুই নেই। রাজ্যে দারিদ্র এবং বেকারীর সমস্যা মেটাতে যে সরকারি পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল সেদিকেও তৃণমূল সরকার বিন্দুমাত্র ঝোঁকেনি।
এসত্ত্বেও বাজার থেকে নতুন করে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে বাজেটে। ফলে বছর শেষে রাজ্যের মোট ঋণভারের পরিমান দাঁড়াবে ৭লক্ষ ৭১হাজার কোটি টাকা।
মোট ৩ লক্ষ ৮৯ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে বিধানসভায়। এর মধ্যে রাজ্য সরকার নিজে ১লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করবে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ১ লক্ষ ৭ হাজার কোটি টাকা রাজস্বের ভাগ আদায় করবে এবং ৩৭ হাজার কোটি টাকা অনুদান নেবে এবং প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নেবে। শুধুমাত্র বাজার থেকেই চড়া সুদে ঋণ নেওয়া হবে প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকার। আর রাজ্য সরকার নিজস্ব রাজস্ব সংগ্রহের মধ্যে ২২ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করবে কেবলমাত্র মদ বিক্রির ওপর করবাবদ।
গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে রাজ্য সরকার এভাবে ঋণনির্ভর পথেই এগোচ্ছে, এবং তার ফলে রাজ্যের মোট ঋণভার চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি, কর্মসংস্থান, দারিদ্র দূরীকরণে এতটুকুও অগ্রসর হতে পারেনি। এবারের বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে বেকারত্বের হার দেশের বেকারত্বের হারের অর্ধেক। আরও বলা হয়েছে, ‘লাগাতার সামাজিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং আর্থিক উন্নয়ন সহ ২০২১ সাল পর্যন্ত ৯২ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র থেকে মুক্ত করা গেছে। বর্তমানে ১.৭২ কোটি মানুষ দারিদ্র থেকে মুক্তি লাভ করেছে।’
বাস্তবতায় পশ্চিমবঙ্গে বেকারী বৃদ্ধি, ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে চলে যাওয়া, শিল্প ও কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার যে চিত্র খোলা চোখেই দেখা যাচ্ছে, বাজেটে তার সম্পূর্ণ বিপরীত দাবি করা হয়েছে। এমনকি বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটের বিপুল সাফল্যের দাবি করা হয়েছে, এমএন রেগা প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ বকেয়া থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার নিজস্ব ‘কর্মশ্রী’ প্রকল্পে ৬১ কোটি কর্মদিবস সৃষ্টি করেছে বলে দাবি করা হয়েছে। পথশ্রী প্রকল্পে ৩৭ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তা নির্মাণের সাফল্য দাবি করা হয়েছে। বাংলার বাড়ি প্রকল্পেও ১৪ হাজার কোটি টাকা খরচের দাবি করা হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতিরোধ করে কেন্দ্রীয় আবাস বা গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পে টাকা আদায়ের কথা বলা হয়নি। শিল্পায়নের সাফল্য দাবি করে বিজিবিএস’এ ২১২টি মৌ এবং শিল্প স্থাপনের ইচ্ছাপত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে, ৪লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাবের কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু বিগত বছরগুলিতে কত টাকার বিনিয়োগ হয়েছে এবং তাতে কতজনের কর্মসংস্থান হয়েছে তা বাজেট বিবৃতিতে বিস্ময়করভাবে অনুল্লেখিত রাখা হয়েছে।
এই মূহূর্তে রাজ্যের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে, কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রের উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ রাজ্য বাজেটে বলা হয়নি। একবছর আগেও মুখ্যমন্ত্রী গঙ্গাসাগরে যাতায়াতের জন্য যে সেতু নির্মাণের কথা বলেছিলেন, এবারের বাজেটেও সেটাই ফের উল্লেখ করে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। নদী বন্ধন প্রকল্পে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা করেছেন, নদী ভাঙন রোধে মাস্টার প্ল্যানের জন্য বরাদ্দের কথা বলেছেন। রাজ্যে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির ভঙ্গুর অবস্থা। অর্থমন্ত্রী অবশ্য সেগুলির বাজার সংযুক্তিকরণ সম্ভব হয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন এবং প্রতিটি জেলা সদরে একটি করে শপিংমলের জন্য জমি দিয়ে তাতে দুটি তলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে দেওয়ার কথা বলেছেন। বাকি শপিং মল অবশ্য বেসরকারি সংস্থার হাতেই চলে যাবে। আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের স্মার্ট ফোন দেওয়া এবং রাজ্য সরকারি কর্মীদের ৪ শতাংশ ডিএ দেওয়ার ঘোষণাও বাজেটে করা হয়েছে। কিন্তু সামাজিক দিক থেকে তফসিলি জাতি ও আদিবাসী মানুষদের এবং মহিলাদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও আর্থ সামাজিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কোনো নজর দেওয়া হয়নি।
সবশেষে বলা যায় নির্মলা সীতারামণ দেশের সংসদে দাঁড়িয়ে যে ‘আচ্ছে দিনের’ ফানুস উড়িয়ে ছিলেন আমাদের রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের বাজেট ও সেই একই পথের পথিক হয়েছে। স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি, মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বৃদ্ধি,কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য কোন ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্ট উত্তরণের দিশাহীন এই রাজ্য বাজেট।
তথ্যসুত্রঃ গণশক্তি পত্রিকা