১০০ বছরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সি পি সি)
সীতারাম ইয়েচুরি
কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতাবাদী সংস্কৃতি অনুসারে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সি পি সি) প্রতিষ্ঠার একশো বছর উপলক্ষ্যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-এর তরফে সৌভ্রাতৃত্বসূচক অভিবাদন জানানো হয়েছে।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সি পি সি) প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস আগেই অত্যাচারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ ভারতবর্ষে ১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে দেশের সীমানার বাইরে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে। বিগত একশো বছরে দুই পার্টি নিজেদের মধ্যে বহুবিধ টানাপোড়েন, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেও সৌভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
মার্কসবাদ – লেনিনবাদকে সিপিআই(এম) ‘সৃজনশীল বিজ্ঞান’ হিসাবেই চর্চা করে। এই মতাদর্শ যেকোনোরকম সংকীর্ণতা রহিত। গুটিকয়েক সুত্রে এই মতাদর্শের সরলীকরণ সম্ভব নয়। একদিকে বিপ্লববাদী নীতিসমূহ আরেকদিকে ক্রমান্বয়ী উন্নতিসাধনের সুযোগ সমৃদ্ধ এই মতবাদ যুগনিরপেক্ষভাবে যেকোন দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রয়োগযোগ্য। লেনিন সেই জন্যই উল্লেখ করেছিলেন “নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণই হল দ্বন্দ্বতত্ত্বের সজীব অন্তর্বস্তু”।
বিগত একশ বছরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস বস্তুত চীনের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মার্কসবাদ – লেনিনবাদের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগেরই সাক্ষ্য বহন করছে। রাশিয়ার বিপ্লবের সংগ্রামী ঐতিহ্য এবং শিক্ষা আত্মস্থ করেই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দেশের মুক্তিসংগ্রামের লড়াইতে নিজেকে নেতৃত্ব হিসাবে সাফল্যের সাথে প্রতিষ্ঠিত করে। এই প্রতিষ্ঠাই সমাজতান্ত্রিক চীনের ভিত গড়ে দেয় – তাকে পরিণত করে গণ সাধারণতন্ত্রী চীনে।
১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লব পরবর্তী পৃথিবীতে দুনিয়া বদলে দেবার কাজে উল্লেখযোগ্য অন্যতম তিনটি ঘটনা রয়েছে – ১৯৪৫ সালে হিটলার ও ফ্যাসিবাদের পরাজয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে উপনিবেশগুলির উচ্ছেদ এবং ১৯৪৯ সালে সমাজতান্ত্রিক চীনের প্রতিষ্ঠা। বিংশ শতাব্দীতে আধুনিক সভ্যতার বিকাশপথ নির্মাণে এই তিনটি ঘটনার গুরুত্ব অপরিসীম।
সংগ্রামের এক দীর্ঘ ইতিহাসের নানা বাঁক ও মোড়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে বহুবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হয়েছে, যুদ্ধের ন্যায়সঙ্গতা বিচার করতে হয়েছে। এই পর্বে অনেক ভ্রান্ত নীতিকেই চিহ্নিত করতে হয়েছে, ভ্রান্তি সংশোধন করতে হয়েছে সমাজতান্ত্রিক চীনের অখন্ডতা রক্ষা করতে হয়েছে। সেই লড়াইতে অনেক অবাঞ্ছিত যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছে, সেইসবের মধ্যে এমন কিছু ঘটনাও ঘটে যা সমাজে ভয়ানক অস্থিরতা তৈরি করে কিন্তু শেষ অবধি চীনের কমিউনিস্ট পার্টি উদ্ভুত সমস্ত বাধা পেরিয়ে অতীতের যুগের ভ্রান্তিসমুহের পুনরাবৃত্তি না করেই প্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অভিজ্ঞতা হল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণের প্রশ্নে এগিয়ে যেতে অতীতের ভ্রান্তিসমূহকে চিহ্নিতকরণ এবং সংশোধনই হল সাফল্যের চাবিকাঠি।
নতুনের খোঁজ, আত্মমূল্যায়ন এবং জরুরী সংশোধন এসবই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি নিজের অভ্যাসে পরিণত করেছে যার ফলে ১৯৭৮ সালে তারা পার্টিতে কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়। সেই সংস্কার পদক্ষেপেরই ফলাফল হিসাবে চীন আজ সারা পৃথিবীর সামনে দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে।
১৯৮৭ সালে আমাদের পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ চীনে গেলে আমিও তার সাথে যাওয়ার সুযোগ পাই। তখন দেং জিয়াও পিং তখন পার্টির পদাধিকারসমূহ পরিত্যাগ করেছেন এবং বিদেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ বন্ধ রেখেছেন। সেবার যেহেতু ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ চীনে গেছেন তাই নিজস্ব নিয়ম ভেঙ্গে তিনি মধ্যাহ্ন ভোজনের একটি আয়োজন করেন। কমরেড দেং জিয়াও পিং অবিরত ধূমপান করতেন। কমরেড ই এম এসের সাথে তার গভীর সখ্যতা ছিল। একটি সিগারেট ধরিয়েই কমরেড দেং ই এম এস’কে বললেন “তুমি আমার মতো দীর্ঘজীবী হবে না”। এই কথা বলে তিনি জোরে হেসে উঠলেন এবং বললেন “তুমি ধূমপানও করোনা, মদ্যপানেরও অভ্যাস তোমার নেই সুতরাং তুমি কিছুতেই আমার মতো দীর্ঘজীবী হতে পারবেনা”।
সেইসময় চীনের পার্টিতে যেসব সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে আমরা সেগুলি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি তার এক সহযোগী কমরেডকে চীনের একটি মানচিত্র আনতে বললেন। একটি বড় টেবিলের উপরে সেই মানচিত্র খুলে তিনি চীনের গুয়াংদৌ (ভারতে এই অঞ্চলে ক্যান্টন নামেই বেশি পরিচিত) প্রদেশের দিকে নির্দেশ করলেন এবং জানালেন এই অঞ্চল থেকেই সারা দেশে সংস্কার কর্মসূচী শুরু হবে। ১৯৮০’র দশকে দক্ষিণ চীন, ১৯৯০’র দশকে পূর্ব চীন, ২০০০ থেকে ২০১০ অবধি মধ্য চীন প্রদেশে, ২০১০ থেক ২০২০ অবধি চীনের পসছিমাঞ্ছল এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে সেই কর্মসূচী পূর্ণতা পাবে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে আগামী ২০ বছরের মধ্যে ২০৫০ সাল নাগাদ চীন একটি সমৃদ্ধশালী সমাজতান্ত্রিক দেশে পরিণত হবে। পিছনের দিকে ফিরে দেখলে বলতেই হয় দেং জিয়াও পিং’য়ের সেই পরিকল্পনাকে আজকের চীন গড়ে তোলার কাজে অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়েছে।
আমরা বিশ্বাস করি যে এইসব সংস্কারমূলক কর্মসূচী এবং উন্মুক্তকরণের নীতিসমূহ সবটাই মার্কসবাদ – লেনিনবাদের বিপ্লবী মতাদর্শের আলোকেই পরিচালিত হবে এবং এই কাজ সমাধা করতে গিয়ে যারা উঠতে – বসতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণকে ভুল বার্তা দিতে কিংবা সেই সম্পর্কে কুৎসা করতে এতটুকুও সুযোগ হারাতে চায় না, সমাজতন্ত্রের সেইসব শত্রুদের হাতে কোনভাবেই আক্রমনের হাতিয়ার তুলে দেওয়া হবে না। দশকের পরে দশক জূড়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি অত্যন্ত সাফল্যের সাথে সমগ্র বিশ্বের সামনে নিজেদের আরও বেশি প্রকাশিত করার নীতি এবং একইসাথে সংকারমূলক কর্মসূচী পালন করে আসছে। একইসময়ে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থবাহী সেইসব শক্তিগুলির সাথেও তারা নিরন্তর লড়াই জারী রেখেছে যারা চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিশানা করে আসলে সমাজতন্ত্রকে খাটো করে দেখাতে চায়। শ্রেণীসংঘর্ষের এই লড়াই কোভিড পরবর্তী পৃথিবীতে আরও বৃদ্ধি পাবে কারন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়াজূড়ে নিজেদের প্রতিপত্তি বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। সেই লক্ষ্যেই তারা নিজেদের সামরিক পরিকল্পনার নাম রেখেছে ‘চীনকে ঘেরাও করো’। এই সমস্ত বাধাকেই শেষ অবধি চীনের কমিউনিস্ট পার্টি মোকাবিলা করতে সফল হবে সিপিআই(এম) এই প্রত্যাশা রাখে।
পুঁজিবাদ যা মূলগতভাবে একটি অমানবিক ব্যবস্থা, তার দ্বারা যে মানুষের উপরে শোষণের অবসানে কিংবা এই ব্যবস্থার কাঠামোগত সংকটমোচনে কোন সুরাহাই সম্ভব নয় তার যাবতীয় সাক্ষ্য-প্রমান আজকের পৃথিবী নিজেই। ২১ শতাব্দীর প্রথম দুই দশক দেখিয়ে দিয়েছে ২০০৮ সাল থেকে শুরু হওয়া সারা বিশ্বে পুঁজি বিনিয়োগের সংকট থেকে নিষ্কৃতি পেতে পুঁজিবাদ সম্পূর্ণরুপে ব্যার্থ।
বিশ্ব অর্থনীতির ক্রমশ শক্তিক্ষয় হচ্ছে, তা এগিয়ে চলেছে এক গভীর মন্দার দিকে। কোভিড মহামারী ইতিমধ্যেই দুনিয়াজূড়ে অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছে। সাম্রাজ্যবাদী নয়া উদারনৈতিক বিশ্বায়নের নীতিকে শক্তি যোগায় যে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি তার আপাদমস্তক দেউলিয়াপনা প্রমান করে দিচ্ছে সমস্যার যে কোনোরকম সমাধানেই এই ব্যবস্থা অক্ষম।
কোভিড মহামারী নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং তার মোকাবিলা করে জনজীবনসহ দেশের অর্থনীতিকে পুনরায় উজ্জীবিত করতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যে দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য অর্জন করেছে তা গোটা পৃথিবীর কাছে শিক্ষণীয় বিষয়, একইসাথে এই সাফল্য পুঁজিবাদের তুলনায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্বই তুলে ধরেছে।
এতগুলো বছর ধরে সংস্কারমূলক কর্মসূচী পালনের ২০২০ সাল নাগাদ চীন নিজের দেশ হতে চরম দারিদ্র দূর করেছে, প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থানের দ্বারা দেশজূড়ে কর্মহীনতার হার নীচে নামিয়েছে, সরকারী স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতিসাধনে সফল হয়েছে এবং একইসাথে বিশ্বমানের পরিকাঠামো এবং শিক্ষাঙ্গন গড়ে তুলেছে। গবেষণা এবং উন্নয়ন খাতে যথোপযুক্ত বিনিয়োগের ফলে আজকের চীনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতির যথার্থ লভ্যাংশ প্রাপ্তি ঘটছে। অসমতা ও দুর্নীতিরোধে বহুবিধ বন্দোবস্ত করে, জনগণের জীবনযাত্রার উন্নতিসাধনের সাফল্য চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিজেদের একশো বছরের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৪৯ সালের ভিতরে “ সমৃদ্ধশালী, দৃঢ়, গণতান্ত্রিক এবং সাংস্কৃতিক গুনাবলির সমন্বয়পূর্ণ একটি আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশ” হিসাবে চীনকে গড়ে তোলার সামর্থ্য অর্জন করেছে।
শান্তিপূর্ণ বৈদেশিক নীতি, প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং দক্ষিণ এশিয়াসহ গোটা পৃথিবীতে শান্তি ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গণসাধারণতন্ত্রী চীনের সাফল্য সম্পর্কে দুনিয়াজূড়ে মানুষজন প্রত্যাশায় বুক বেঁধেছেন।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদ – সৌভিক ঘোষ