রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে আলোচনা না করেই ভোটের নিয়মকানুন একতরফাভাবে বদলে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এমন স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে প্রথমেই মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার সুনীল অরোরাকে চিঠি দিয়েছিলেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। এবার সরাসরি সংসদেই নির্বাচনী নিয়ম বদলের বিষয়টি পেশের দাবি জানালেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক। তিনি মনে করেন, একতরফাভাবে এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। আরও অনেক বিষয় আছে যা আলোচনা ছাড়াই একতরফাভাবে ঘোষণা করার পাশাপাশি রূপায়ণ করা হয়েছে এই সময়কালে। একারণেই ইয়েচুরি বলেছেন, ‘‘সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় হলো সংবিধানের কেন্দ্রীকতা বজায় রাখা। সংসদের অধিবেশন বসার প্রয়োজনীয়তা এখানেই। সংসদ পঙ্গু হয়ে গেলে গোটা সাংবিধানিক রীতিনীতিই মুখ থুবড়ে পড়বে। এটা হতে পারে না। হতে দেওয়াও যায় না।’’ এক ওয়েবপোর্টালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইয়েচুরি ভোটের নিয়ম বদলে ৬৫বছরের বেশি বয়সি এবং করোনা আক্রান্তদের জন্য পোস্টাল ব্যালট চালুর বিরোধিতার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের গৃহীত জনবিরোধী নীতি এবং এর বিরুদ্ধে বামপন্থী দলগুলির সোচ্চার প্রতিবাদের কথা তিনি তুলে ধরেন। কীভাবে এমন অতিমারী পরিস্থিতিতে ভোট গ্রহণ করা সম্ভব সেই বিকল্প ব্যবস্থার কথাও উল্লেখ করেন। পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে কীভাবে সংসদের অধিবেশন বসা উচিত, সেই বিকল্প ব্যবস্থার কথাও জানান। কীভাবে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার একটার পর একটা নিজস্ব কর্মসূচি সুচারুভাবে রূপায়ণ করে চলেছে, তারও উল্লেখ করেছেন সাক্ষাৎকারে। উলটে তিনি বলেন, লড়াই-আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে রয়েছে বামপন্থীরা। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে, মুখে মাস্ক পরে এবং স্যানিটাইজেশন সহ প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে অনায়াসে সংসদের অধিবেশন ডাকা যায় বলে মনে করেন ইয়েচুরি। সেক্ষেত্রে সংসদের সেন্ট্রাল হলে লোকসভা এবং লোকসভার কক্ষে রাজ্যসভার অধিবেশন বসানোর প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে একই বুথের মধ্যে অনেকগুলি পোলিং স্টেশন খুলে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার সঙ্গে ভোটারদের জন্য স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করলে ভোটগ্রহণ অসম্ভব নয় বলেই মনে করেন ইয়েচুরি। আবার পোস্টাল ব্যালটের পাশাপশি তিনি বিরোধিতা করেন বৈদ্যুতিন যন্ত্রে ভোটগ্রহণেরও। তিনি বলেন, অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছি পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ব্যাপক কারচুপি করা যায়। তেমনই ইভিএম’রও ব্যাপক পর্যায়ে বেনিয়ম হতে পারে। একারণেই তিনি গত সাত দশক ধরে ভোটগ্রহণের যে ঐতিহ্য চলে আসছে তা বজায় রাখার ওপরেই গুরুত্ব দেন। এই অবস্থার মধ্যে বিহারে ভোটগ্রহণ করা যায় কীনা প্রশ্নের জবাবে ইয়েচুরি বলেন, বিহারের প্রতিটি বুথে ৭২হাজার এলইডি বসিয়ে ভার্চুয়াল ভাষণ দিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। ৭২হাজার ওয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপি। এসব তো বিহার নির্বাচনকে ঘিরেই প্রস্তুতি চলছে, এটা স্পষ্ট। কিন্তু আমাদের বক্তব্য, সমস্ত ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েই ভোটগ্রহণ করা উচিত। লকডাউন হাতিয়ার করে কেন্দ্রীয় সরকার একটার পর একটা নীতি গ্রহণ করলেও বিরোধী স্বর সেভাবে দানা বাঁধতে পারেনি। এপ্রসঙ্গে ইয়েচুরি বলেছেন, ১৪৪ধারা জারি থাকায় রাস্তায় নেমে বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ জানাতে পারেনি। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মোদী সরকার তাদের নিজস্ব কর্মসূচি প্রয়োগ করে গিয়েছে যথেচ্ছভাবে। অত্যন্ত অগ্রাসীভাবে অর্থনৈতিক সংস্কার, বেসরকারিকরণ, জাতীয় সম্পদ লুটের মতো নীতি প্রয়োগ হয়েছে এই সময়ে। এরই সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে সাম্প্রাদায়িক বিভাজনকে আরও ধারালো করা হয়েছে যা দেশের সামাজিক ঐক্যের ক্ষেত্রে গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। আর এই প্রক্রিয়া ধরেই সিএএ-এনআরসি-এনপিআর বিরোধী শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদেরই নিশানা করা হয়েছে। তার ওপর আন্দোলনকারীদের গায়ে দেশদ্রোহীতার তকমা সেঁটে ইউএপিএ’তে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় সমাজকর্মীদের দু’বছর ধরে জেলে পুরে রাখা হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও চার্জ গঠন পর্যন্ত করা হয়নি। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দেশের সার্বভৌমত্ব সম্পূর্ণভাবে বিকিয়ে দিয়েছে এই সরকার। এটা মোটেই দেশের স্বার্থে নয়। ইয়েচুরি বলেছেন, যখন একযোগে করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা তখন নিজেদের কর্মসূচি রূপায়ণকেই গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। অপরিকল্পতি লকডাউনের দায় বহন করতে হয়েছে দেশের খেটে খাওয়া গরিব মানুষকে। দু’মাস ধরে শ্রমিকরা রাস্তায় পড়ে থাকলেন। সরকার কোনোরকম ত্রাণের ব্যবস্থা না করে আরএসএস-বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি রূপায়ণেই ব্যস্ত থাকল সরকার। তিনি মনে করেন, বিরোধী স্বর আটকাতেই এমন ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার যাতে তাঁরা ছাড়া না পান। জেলে থাকার ফলে তাঁদের করোনায় আক্রান্তের ঝুঁকিও রয়েছে। দেশবাসী এক ভয়ানক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এই সময়ে কাজ হারিয়েছেন ১৪ থেকে ১৫কোটি মানুষ। ব্যাপক হারে বেতন ছাঁটাই হয়েছে। সবচেয়ে কঠিন অবস্থায় পড়েছেন দিনমজুর, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক এবং অস্থায়ী কর্মীরা। এটাই উদার অর্থনীতির প্রত্যক্ষ প্রভাব। বামপন্থীরা এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তিনদিনের সফল কয়লা ধর্মঘট হয়েছে দেশজুড়ে। শ্রম আইন বদলের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছে ট্রেড ইউনিয়নগুলি। ইয়েচুরি একথা জানিয়ে বলেছেন, একারণেই অর্থনৈতিক রোডম্যাপ তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে বামপন্থীরা। সেই প্রস্তাব সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়েছে। আমরা স্পষ্টতই বিপুল পরিমাণ সরকারি বিনিয়োগ চাইছি। এই অর্থে গড়ে তোলা হবে পরিকাঠামো, কাজও পাবেন বহু মানুষ। পরিশেষে ইয়েচুরি বলেছেন, আগামী দু’সপ্তাহে আরও বড় ধরনের আন্দোলনে নামতে চলেছে বামপন্থীরা। কিষাণসভা, সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন এবং খেতমজুর ইউনিয়নগুলি সারা দেশে যৌথ আন্দোলনে নামার ডাক দিয়েছে। এই লড়াই-আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়েই রয়েছে বামপন্থীরা।