ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
রাজ্য নির্বাচকের পদে আসীন হওয়ার শর্তই বোধহয় এরকম ছিল।
নির্বাচন প্রসঙ্গে জরুরী আয়োজনের অন্যতম হল সর্বদলীয় সভা। সেসব কিছুই হয়নি। নির্বাচন কমিশন হয়ত ভোট ব্যপারটাকে শাসকদলের নিজস্ব অ্যাজেন্ডা বলে মনে করে- তাই কথায় কথায় রাজ্য সরকারের সাথে ‘কথা বলে নেওয়ার’ কথা ছাড়া আর কিছুই বলে না।
নির্বাচন ঘোষণার ৬দিনের মধ্যে নির্ধারিত ৪০৩টি সরকারী কেন্দ্রে সমস্ত মনোনয়ন জমা করতে হবে, দুপুর তিনটের পরে মনোনয়ন কেন্দ্রগুলিতে আধিকারিক, কর্মচারীরা সাংবিধানিক রীতিনীতি ভুলে সব কাজ ছেড়ে উঠে চলে যাবেন।
মনোনয়ন কেন্দ্রের চারদিকে ১ কিলোমিটার অবধি নাকি ১৪৪ ধারা! কেন্দ্রের ভিতরে তো নয়! তাই তৃণমূলের গুণ্ডাবাহিনী ভিতরে ঢুকে বসে থাকলে কিছু বলার নেই। এদের কাজ কি? কোনরকমে বাইরের অশান্তি পেরিয়ে এসে প্রার্থীরা যদি ঢুকেও পড়েন তাহলে ভিতরের বাহিনী তাদের মারধর করবে, যেনতেন প্রকারেণ বাধা দেবে। অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে এমনই বন্দোবস্ত করেছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন।
আজই উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায় বাম-কংগ্রেস প্রার্থীদের সম্মিলিত মিছিলে আক্রমণ করা হয়েছে, গুলি চলেছে। মনোনয়ন জমা দিতে যাওয়া তিনজন প্রার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন. কুড়িজন আহত সহ দুজনের মৃত্যু হয়েছে। গত চারদিন ধরে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ভাঙড়ে বোমা-গুলির উৎসব চলছে, রাজ্য পুলিশকে গাছের ছায়ায় বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
গোটা মনোনয়ন পর্ব জুড়ে এমন পরিস্থিতি। আজ সেই পর্ব শেষ হবে। ১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের নামে প্রহসন, পুরসভার নির্বাচনে ভোট লুট (এমনকি সিসিটিভি’র ক্যামেরায় রুমাল চাপা দিয়ে ছাপ্পা দেওয়া)- ২১ সালের বিধানসভা ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস এসব পেরিয়েই স্লোগান উঠেছে এটা ২০১৮ নয়, ২০২৩। এবার নির্বাচন আর এতদিন যেভাবে চলেছে সেই কায়দায় হবে না। তৃণমূল কংগ্রেস সেই হুঁশিয়ারি বিলক্ষণ বুঝেছে। তাই আদালতের বিশেষ নির্দেশের পরেও আদালতে শুনানির সময় অপদার্থ রাজ্য নির্বাচন কমিশন জানাচ্ছে তারা জরুরী বন্দোবস্তের কিছুই করে উঠতে পারেনি।
আমলা পদে চাকরি এদেশের গরীব, মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এক বিশেষ গুরুত্ব পায়। শুধু স্থায়ী বেতনের নিশ্চয়তার কারনেই এমন মনোভাব তা কিন্তু না, যে ব্যবস্থা প্রতিদিন বেশিরভাগ মানুষকে যন্ত্রণা-নিপীড়নের জাঁতাকলে পিষে চলে, আমলা পদে নিয়োগ হয়ে সেই ব্যবস্থাকে শুধরে দেওয়ার স্বপ্নে মশগুল থাকে বলেই সাধারণ বুদ্ধিতে সরকারী অফিসার হওয়ার প্রতি বাড়তি এক আকর্ষণ কাজ করে। রাজীব সিনহা মহাশয় এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন- তাকে কিংবা তার কৃতকর্ম দেখে গরীব জনতার আমলা হওয়ার সাধ ঘুচে যাবে। শাসক দলের সামনে মাথা ঝোঁকানোর যদি কোনও মাপকাঠি থাকে তবে দেখা যাবে মানুষের চেহারাতেও অমেরুদন্ডী হওয়া যায়, অন্তত দায়িত্বরত অবস্থায় তো বটেই।
রাজ্য নির্বাচন কমিশন আসলে কি চাইছে? যেভাবে হোক ভোটের সময়য়টুকু একবার পেরিয়ে যাক। তাহলেই বাকিটুকু বুঝে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বলেই এই কমিশনের এহেন নির্লজ্জ আচরণ।
তথ্য বলছে শাসকদল একদিনে চল্লিশ হাজারের বেশি মনোনয়ন জমা দিয়েছে, বুঝতে অসুবিধা হয় না মনোনয়ন কেন্দ্রগুলিতে আসলে কি চলেছে। একটা ভুল তারা করেছেন। রাজ্যের শাসকদলও করছে। ভোট আদৌ সরকারের কোনও বিষয়ই না। বরং ঠিক উল্টোটা- নির্বাচন হল সরকার যা কিছু পারেনি তার হিসাব বুঝে নেওয়া। রাজ্যের জনসাধারণ যেখানে যেভাবে পারছেন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। সারা বছর তৃণমূল-বিজেপি’র সাজানো বাইনারির গপ্পো ফেঁদে যাওয়া কর্পোরেট মিডিয়া অবধি গুন্ডাবাহিনীর অবরোধের ‘পাল্টা প্রতিরোধ’ দেখাতে বাধ্য হচ্ছে। আজ পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়ন জমা হওয়ার শেষ দিন।
এই নির্বাচনে মানুষ নিজের অধিকার প্রয়োগ করবেন নিজেদের হিম্মৎ সম্বল করে। ভোট লুটের বিরুদ্ধে সেই মেজাজ কেমন হতে পারে সেকথা দেশের ইতিহাসে রয়েছে। নাম কা ওয়াস্তে বিজেপি’কে যতই বিরোধী হিসাবে তুলে ধরতে চাওয়া হোক না কেন (রাজ্য বিজেপি নিজের জোরে বিরোধী হয়ে উঠতে পারে নি, পারবেও না- তাদের বিধায়ক তালিকার দিকে নজর দিলেই সেকথা বোঝা যায়) এই পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে তৃণমূল-বিজেপি উভয়েরই বিরুদ্ধে। বেশিরভাগ আসনে একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন জমা করিয়ে বিজেপি কেমনভাবে বিরোধিতার দায়িত্ব পালন করছে তা বুঝতে বাকি নেই।
তাই পক্ষ দুটোই। একদিকে তৃণমূল-বিজেপি’র কুশাসন, আরেকদিকে মানুষের অধিকারের লড়াই।
আজ চোপড়ায় গুলিবিদ্ধ বামপ্রার্থীর সাথেই হাসপাতালে উপস্থিত মানুষদের ‘আপনারা চলে যাননি কেন’ জিজ্ঞাসা করা হলে তারা উত্তর দিয়েছেন ‘আমরা লড়ব, আমরা সিপিএম’।
তৃণমূল কংগ্রেস ও তাদের ধামাধারা বাহিনী যেন মনে রাখে রাইফেল বা অন্য কিছু যাই ব্যবহৃত হোক না কেন, সমস্ত অস্ত্রেরই একটা সীমাবদ্ধতা থাকে। একটা নির্দিষ্ট দুরত্বের বাইরে যেমন তা অকেজো, তেমনই খুব কাছে চলে এলেও এসব আর কাজে দেয় না। নির্বিচারে চুরি,ডাকাতি এবং লাগাতার আক্রমণ, হুমকি, হামলা চালিয়ে তারা যা করছেন তাতে দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া মানুষ ক্রমশ লড়াইতে সামনে এগিয়ে আসছেন। আর কিছুদূর এগোলেই আক্রমণকারী ও আক্রান্তের মাঝে যে ব্যবধান তার গুণগত ফারাক ঘটে যাবে- তখন আর গুলি কেন কিছুই চালানো যাবে না।
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এখনও বাংলায় কার্যকর হচ্ছে না। আবহাওয়া দপ্তর বলছে বৃষ্টি নামতে আরও কিছুদিন দেরি হবে। তার আগেই গুলি-বোমার মুহুর্মুহু আঘাতে চারপাশ অন্ধকার করে দিতে চাইছে যারা তাদের মাথাদের তো ভুলে যাওয়া উচিত না –
‘…বর্ষার সিক্ত পশুর মত স্তব্ধ বসে
বক্রদেহে নায়কের দল
বিগলিত বিষণ্ণতায় ক্ষুরধার স্বপ্ন দেখে;
ময়দানে নষ্টনীড় মানুষের দল।
ফরাসী ছবির আমন্ত্রণে, ফিটনের ইঙ্গিতে আহ্বানে
খনির আগুনে রক্তমেঘে সূর্যাস্ত এল।’