প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা দেশগৌরব বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী নোবেল বঞ্চিত ,ছোটজাতের মানুষ এই তকমা লাগিয়ে অপমানিত মেঘনাথ সাহা | ১৮৯৩ সালের ৬ ই অক্টোবর পূর্ব বঙ্গের কালিকাকেয়ার উপজেলায় তিনি জন্ম গ্রহন করেন |
অত্যন্ত গরীব ঘরের জন্ম হয়েছিল এই বিজ্ঞানীর। ঢাকা থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে শেওড়াতলি গ্রামে। এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ ছিলেন প্রচণ্ড দরিদ্র ও তথাকথিত নিম্নবর্ণের | রক্ষণশীল সমাজের চোখে নিচুজাতে জন্ম। নমঃশূদ্র। এজন্য প্রতিমুহূর্তে মেঘনাদ সাহার পরিবারকে সমাজে অনেক অপমান সহ্য করতে হত। তার সঙ্গে সংসারে ছিল প্রচন্ড দারিদ্র্য। ঝড় জলের রাতে জন্ম হয়েছিল বলে দেবরাজ ইন্দ্রের নাম অনুসারে ঠাকুমা ও বাবা মা ভালবেসে ছেলের নাম রেখেছিল ” মেঘনাথ ” | আট ভাই বোনের মধ্যে উনি ছিলেন পঞ্চম |
ছোট থেকে লেখাপড়ায় অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন মেঘনাথ।
কিন্তু দারিদ্র্য ছিল প্রতিবন্ধকতা।
ডাক্তার অনন্ত দাসের বাড়িতে বাসন মেজেছেন।
গোয়ালঘরে কাজ করেছেন। গ্রামের স্কুলে ৬ বছর বয়েসে ভর্তি করার সময় থেকে ই বাবা জগন্নাথ দোকানের কাজ ও শেখাতে শুরু করেন ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে | মেঘনাথ সমস্ত কাজ ই সময় বের করে করতেন , শুধু যাতে পড়াশোনাটা ভালভাবে করতে পারেন।
স্কুলের পরীক্ষা সাফল্যের সঙ্গে শেষ করে পড়তে এলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে।
তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর।
তাঁর সহপাঠী ছিলেন আর এক বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। আর তাঁদের শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ,আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু প্রমুখ |কখনও তিনি প্রথম আবার কখনও সত্যেন বসু প্রথম।এই বিষয় একটা ঘটনা খুবই উল্লেখযোগ্য |
মেঘনাদ সাহার বাড়ি, এক যুবককে দেখা গেলো দরজার সামনে । এক মুরুব্বি গোছের লোক দাঁড়িয়ে ছিলেন।
যুবকটি জিজ্ঞেস করলো – মেঘনাথ আছে ?
ভদ্রলোক বললেন – কে তুমি ?
ছেলেটি – আজ্ঞে আমি সত্যেন |
মেঘনাথ বলুন না আমি এসেছি |
মেঘনাদ অতীতে স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। এই ছেলেটি সেরকম স্বদেশী করা কেউ নয় তো?
মুরুব্বি পথ আটকালেন – “এই যে বাপু, কোথায় যাচ্ছো?
ছেলেটি – “দয়া করে একটু মেঘনাদকে ডেকে দেবেন, দরকার ছিল।”
মুরুব্বি তাচ্ছিল্য সহকারে বললেন,
“অসময়ে এসে বিরক্ত না করলেই নয়? ইউনিভার্সিটিতে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী ছেলে যখন-তখন যার-তার সাথে দেখা করেনা।”
যুবকটি বিনীত ভাবেই উত্তর দিলো,
“বলুন ইউনিভার্সিটিতে প্রথম স্থানাধিকারী ছেলে দেখা করতে এসেছে। “
তারপরে কি হলো সেটা নিশ্চই বুঝতে পারছেন !
সেদিনের যুবকটি পরবর্তীতে বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহার সহপাঠী এবং একান্ত সুহৃদ। এবার আসি সেই লজ্জা জনক অধ্যায়ে |
কলকাতায় পড়তে এসেও জাতপাতের অত্যাচার থেকে মেঘনাথ নিস্কৃতি পেলেন না। প্রেসিডেন্সির হস্টেলে তার পাশে বসে উচ্চবর্ণের ছাত্ররা খেতে বসতো না।
এবার ঘটে গেল সেই ঘটনা।
সরস্বতী পুজোর দিন মেঘনাথ ফুল হাতে নিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দিতে যাবেন ঠিক এমন সময় উচ্চবর্ণের কিছু ছাত্র বলে উঠল, মেঘনাথ! তুমি লেখাপড়ায় যতই ভাল হও, ভুলে যেও না তুমি নীচুজাতের। তোমার পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া হবে না। এই কথা শুনে মেঘনাথ রাগে, দুঃখে, অপমানে চলে গেলেন।
সেইরাতে মেঘনাথ নিজের নাম পাল্টে ফেললেন।
নিজের নাম দিলেন ” মেঘনাদ” কারণ উচ্চবর্ণের ক্ষত্রিয়রা রাক্ষস রাজ ইন্দ্রজিৎ অর্থাৎ মেঘনাদকে অন্যায় ভাবে বধ করেছিল। তাই নিজের নাম পাল্টে মেঘনাথ থেকে হয়ে গেলেন মেঘনাদ সাহা। সারাজীবন বঞ্চনা তাঁর পিছু ছাড়েনি।
মেঘনাদ সাহা ১৯২০ সালেই নোবেল সম্মানে ভূষিত হতেন তাপীয় আয়নীতত্বের জন্য।
১৯২৫ সালে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী আর্থার কম্পটন নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম সুপারিশ করেন।
এরপরেও তাঁর নাম আরো কয়েকবার প্রস্তাব হয়েছিল।
মোট পাঁচবার তাঁর নাম প্রস্তাব হয়েছিল নোবেল পুরস্কারের জন্য কিন্তু রহস্য জনক ভাবে তাঁকে বঞ্চিত করা হয়েছিল | এটা একটা বিরল ঘটনা। প্রতিবারই তাঁর নাম নানা অজুহাতে বাতিল করে দেওয়া হয়।
দেশের লোক বলল নীচু জাত আর বিদেশিরা বলল কালা আদমি। নানা অজুহাতে বিদেশিরা তাঁকে নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করল।
সারাজীবনে জাতপাত আর বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়ে চলে গেলেন এক বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী।
১৯৫৬ সালের ১৬ ই ফেব্রুয়ারী দিল্লি তে তিনি প্রয়াত হন |
তথ্যসূত্রঃ
দেশ পত্রিকা, ৯ অক্টোবর, ১৯৯৩/ বিখ্যাত জ্যোতির্বিঞ্জানী ডেভিড ডিভরকনের সাক্ষাতকার, নোবেল পুরস্কার সংক্রান্ত বিষয়ে।