Site icon CPI(M)

Who’s Mao Tse Tung?

Who is Mao Cover

সৌভিক ঘোষ

হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখায় খুঁজে পাওয়া যায় একসময় ভারতের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সাধারণ সম্পাদক পূরণ চাঁদ যোশী নাকি বলতেন মার্কস-এঙ্গেলসের রচনাগুলি মূলত লেনিনই উপলব্ধি করেছেন। লেনিনের শিক্ষাকে প্রকৃত অর্থে আত্মস্থ করেছেন জে ভি স্তালিন। আমরা যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে নিয়ে সমাজতন্ত্র নির্মাণে ব্রতী তাদের শিখতে হবে স্তালিনের থেকেই। মাও সে তুং প্রসঙ্গে যোশী এমন কিছু বলেন নি, ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে যে পর্যায়কে সহজ করে যোশী যুগ বলা হয় তার কিছু পরে চিনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হয়।

সেই বিপ্লবেরই অন্যতম নেতৃত্ব মাও সে তুং।

আধুনিক উচ্চারণে মাও জে দং।

চীনের লড়াই তার নিজস্ব বৈশিষ্টের কারনেই অনন্য। একদিকে বহুযুগের সামন্তশাসন আরেকদিকে চার চারটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চিন দেশটিকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। সেদেশে তখনও বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা হয়নি। পার্লামেন্ট বলে কোনোকিছু চিনের জনগণের জানা ছিল না।

মূলত দরিদ্র কৃষিজীবীদের দেশ। শাসক হিসাবে পশ্চাদপদ সামন্ত-জমিদার-রাজা আর সাম্রাজ্যবাদী লুটেরাদের সাঁড়াশি আক্রমণে জর্জরিত ছিল। এমনই এক দেশে সম্পন্ন মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন মাও সে তুং। পিতার নাম মাও শানশং। মা ওয়েন ছিমেই। তাদেরই পরিবারে ১৮৯৩ সালে মাও সে তুং’র জন্ম হয়।

ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মাও বলতেন, ‘আমাদের পরিবারে দুটি পার্টি ছিল। প্রথমটিতে ছিলেন বাবা- সেটি ছিল ক্ষমতাসীন পার্টি। আরেকটিতে ছিলাম মা, দুই ভাইয়ের সাথে আমি। এই দ্বিতীয় পার্টি ছিল বিরোধী। কখনো কখনো বাড়িতে কাজ করা মজুরেরাও দ্বিতীয় পার্টিতে সামিল হত।’ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, সংশ্লিষ্ট পারিবারিক কাঠামো এসব বুঝতে কথাগুলি খুবই কার্যকরী। মাও সে তুং’র চরিত্রের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক এটাই, অত্যন্ত জটিল সামাজিক তত্ত্বকে তিনি সকলের বোঝার মতো করে বলতে, লিখতে পারতেন। একটি নিবন্ধে মাও সে তুং’র সবটা তুলে ধরার মতো এলেম বর্তমান নিবন্ধকারের নেই।

আমরা মার্কসবাদ বা মার্কসীয় দর্শনে তার নির্দিষ্ট ভূমিকার কথাটুকুতেই কথার শুরু ও শেষ করতে চাইছি।

মার্কসকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল শোষণমুক্তির দর্শন। সেই কাজে জরুরী ছিল বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাসের সমস্ত ঐতিহাসিক শিক্ষার যথাযথ সার সংগ্রহ করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্বকে গড়ে তোলার। এই কাজে মার্কসের প্রতিপক্ষ কারা? মার্কসের আগে অবধি দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সাহিত্যে যাকিছু মানবসভ্যতার জন্য চিরায়ত সেইসব কিছুর বিরুদ্ধে লড়তে হয় মার্কস-এঙ্গেলসকে। তাদের আগে যেসমস্ত জ্ঞান মানুষ অর্জন করেছে তাকে নাকচ করতে নয়, বরং জ্ঞানের প্রকৃত প্রয়োগে মানবসমাজকে শ্রেণি শোষণের লজ্জা থেকে মুক্ত করতেই তারা জ্ঞানকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম শব্দগুলি স্বপ্নের জগত থেকে মুক্ত হয়েছিল, বোঝা গেল মুক্তি কিসে, কোথায়? কিভাবে, কোন রণকৌশলে সেই মুক্তি আসবে সেই নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েই গেল। একে বিতর্ক না বলে কেউ সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক কর্তব্যও বলতে পারেন। কমিউনিস্ট হতে চান যারা, তাদের প্রত্যেককেই সেই কাজ করতে হয় নিজেদের সময়ে, নিজেদের দেশের বাস্তব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে। লেনিন হলেন এই পৃথিবীতে সেই প্রথম মানুষ যিনি এ কাজে সফল হয়েছিলেন। মাও সে তুং হলেন দ্বিতীয়।

তাই রাশিয়ার পথ বনাম চিনের পথ ইত্যাদি বলে অহেতুক বিতর্কের নামে নিজেদের বোকা-পণ্ডিত প্রতিপন্ন করতে চান যারা, তাদের ব্যাতিরেকেই আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। রাশিয়া কিংবা চিন দুই বিপ্লবই আসলে এক নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে, একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে এবং একটি নির্দিষ্ট মানবগোষ্ঠীর সচেতন বিপ্লবী কর্মসূচি। এইসব পরিপ্রেক্ষিতকে এড়িয়ে গিয়ে নেহাতই টুকে-পাশ করতে চান যারা কিংবা ইতিহাসের শিক্ষার সবকিছুই জলাঞ্জলি দিতে চান যারা তাদের নিজেদের কমিউনিস্ট না ভাবাই উচিত। তিনি যে পক্ষেরই হন না কেন।

মার্কসের সময়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে মেধাজগতের পশ্চাদপদতাই ছিল মূল বাধা। লেনিন’কে জারের শাসন, সাম্রাজ্যবাদ এসবের সাথেই বিপ্লবী দর্শনের প্রসঙ্গে অভিজ্ঞতাবাদের মোকাবিলা করতে হয়েছিল। তবু নতুন সময়ে সমাজতন্ত্রের শত্রুরাও যে শুধু নতুন পোশাক পরে সামনে আসে তাই নয়, নতুন হাতিয়ারে সজ্জিত হয়েও রণাঙ্গনে উপস্থিত হয় তারা। মাও সে তুং ও চিনের কমিউনিস্ট পার্টিকে একদিকে ঐতিহাসিক প্রতিপক্ষের পাশাপাশি ভিতরে বাইরে নতুন শত্রুর সাথেও লড়াই চালাতে হয়েছিল।

মাও সে তুং’ নামটা আজকের পৃথিবীতে সামরিক লড়াই, লাল ফৌজ এসবের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে একটা বিরাট প্রজন্মই তাকে চিনতে ভুল করছে। একপক্ষে রয়েছে তারা যাদের মনে হয় মাও মানেই পিঠে রাইফেল বেঁধে যুদ্ধ, আরেকপক্ষ তাকে এশিয়া মহাদেশের ডিক্টেটর বানিয়েই ছাড়বে বলে পণ করেছে। এরা উভয়েই একে অন্যকে যুক্তি সরবরাহ করে চলে।

চিনে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে যুক্তফ্রন্টের রণকৌশল, শ্রেণিযুদ্ধের সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষিতে কৃষকসমাজকে গণমিলিশিয়ায় পরিণত করে দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধ এসব নিয়ে আজকের নিবন্ধ নয়। যদিও মনে রাখতে হবে এসবই হল চিনের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির বিবেচনায় মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগ। এরই সাথে গুরুত্বপূর্ণ চিনের বিপ্লবের ঐতিহাসিক শিক্ষা- যাকে মাও সে তুং চিন্তাধারা বলে চিহ্নিত করা হয়। মাওবাদ না, মাও সে তুং চিন্তাধারা, ইংরেজিতে বলে থটস্‌।

এই চিন্তাধারা মার্কসীয় দর্শনের পরিসরকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পশ্চাদপদ রাশিয়ায় বিপ্লব সম্পন্ন করা, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে কি না সেই সমস্যার সমাধানে লেনিন লিখেছিলেন ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান?’ আর ‘এক পা আগে দুই পা পিছে’। মাও সে তুং’কেও কলম ধরতে হয়েছিল। বিশ্বসমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে তখন রাশিয়ার বিপ্লবের প্রভাব কর্তার ভুতের মতই সবার ঘাড়ে চেপে বসেছিল। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পরিস্থিতি, অথচ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের তরফে বড় ভাই গোছের আচরণ। তারা বলে দেবেন আর সবাই অনুসরণ করবে কিছুটা এমন অভ্যাস তৈরি হয়েছিল। সাধারণত এসবের জন্য স্তালিনকে কাঠগড়ায় তোলাই আজকের দুনিয়ায় দস্তুর, অনেকেই ভুলে যান একটা লম্বা সময় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দায়িত্বে ছিলেন লেনিনের সহযোগী জিনোভিয়েভ, স্তালিন নন। কর্তার সেই ভূত ঘাড় থেকে নামাতেই মাও দ্বন্দ্বতত্ত্ব প্রসঙ্গে নিজস্ব চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন।

ইয়েনানে ছিল চিনের কমিউনিস্ট পার্টির জাপ-বিরোধী সামরিক ও রাজনৈতিক কলেজ। সেখানেই শিক্ষার্থী কমরেডদের জন্য ভাষণ দিয়েছিলেন মাও সে তুং, বিষয় ছিল দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে। উদ্দেশ্য ছিল সেই সময় পার্টির মধ্যে বিভিন্ন মতান্ধতার মোকাবিলা করা। ১৯৩৭ সালে মাও ভাষণটি দিয়েছিলেন। পরে চিনের পার্টির সিদ্ধান্তে মাও সে তুং রচনাবলী প্রকাশের কাজ শুরু হলে তিনি নিজেই সেই ভাষণটিকে ভিত্তি করে কিছু সংশোধনসহ একটি বড় প্রবন্ধ লেখেন। 

সাধারনভাবে দ্বন্দ্বতত্ত্বের আলোচনায় ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস রচিত ‘ডায়ালেক্টিক্স অফ নেচার’কেই ভিত্তি করা হয়, বিস্তারিত ও তুলনামূলক জটিল বিষয়ে আলোচনায় উঠে আসে এঙ্গেলসেরই লেখা ‘অ্যান্টি ড্যুরিং’। তবু মাও’র লেখাটি জরুরী কেন? কারণ মাও ‘ডায়ালেক্টিক্স অফ নেচার’ বইতে বলা তিনটি মূল সুত্রকে আরও এগিয়ে দিয়েছেন।

মাও’র রচনায় উপসংহার সমেত মোট সাতটি অংশ রয়েছে।

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়োগ কিভাবে করতে হয়, কিভাবে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে সঠিক রাস্তায় এগোতে হয় সেই সম্পর্কে একটি সাধারণ বোঝাপড়াই এই প্রবন্ধের লক্ষ্য। অনেক পার্টি সদস্য-কর্মীরাই দ্বন্দ্বতত্ত্বকে কেবলমাত্র জ্ঞানচর্চার একটি বিষয় বলে ধরে নেন, একে প্রয়োগ করেই যে কমিউনিস্টদের এবং গোটা কমিউনিস্ট পার্টির কাজ পরিচালিত হয় এই উপলব্ধিতে কিছু ফাঁকি থেকে যায়। সেইসব ফাঁকফোকর গলে ঢুকে পড়ে ভুল চিন্তাভাবনা, ভ্রান্ত নীতি, প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গী। এমন হওয়া কিছুটা স্বাভাবিক, কেননা মার্কসীয় দর্শন অবশ্যই সচেতন হয়ে চর্চা করতে হয়, প্রয়োগ করতে হয় আর তাই তা শিখে নেওয়া জরুরী কাজ। দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গী মেনে স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন হয় না, তাই অনেকসময়ই দেখা যায় প্রথাগত শিক্ষায় বেশ কিছুটা শিক্ষিত এমন কমরেডদের চেতনাতেও ‘ফর্ম্যাল লজিক’ মেনে চলার প্রবণতা রয়েছে। ‘টেক দ্য ম্যাটার আজ ইট ইজ’- হল সেই দৃষ্টিভঙ্গির মূল কথা। এর বিপরীতে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন আমাদের দেখতে, চিনতে উপলব্ধি করতে শেখায় ‘টেক দ্য ম্যাটার ইন মোশন’।

এর মানে কি?

যেকোনো কিছুকেই গতির মধ্যে বিচার করতে হবে। বস্তুগত অস্তিত্ব আছে এমন সবকিছুই বিচার করা হবে এক গতিময় অস্তিত্বের নিরিখে যার পর্যাবৃত্ত চলনের প্রকৃতিটি হল –

উদ্ভব – পরিবর্তন – বিকাশ ও সবশেষে রূপান্তর

এমন দার্শনিক অভিব্যাক্তির জোরেই মার্কস ঘোষণা করেছিলেন পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিনাশ ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা দুইই অবশ্যম্ভাবী। রাষ্ট্রকাঠামোকে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করেই অমন প্রত্যয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। ঐ কথা কেবল একটি রাজনৈতিক স্লোগানমাত্র নয়।

এই গতিময়তাকেই মাও ব্যখ্যা করলেন ছয়টি সুত্রের সাহায্যে (‘ডায়ালেক্টিক্স অফ নেচার’ বইতে তিনটি প্রাথমিক সুত্র রয়েছে)।

১) দুটি বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি – জাগতিক সত্যের ব্যখ্যায় দুটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। একটি ফর্ম্যাল, আধিবিদ্যক। এই দৃষ্টিভঙ্গি পুঁজিবাদের হাতিয়ার। আরেকটি দ্বান্দ্বিক, বস্তুবাদী। একেই মার্কসীয় বিশ্ববিক্ষা (ওয়ার্ল্ড আউটলুক) বলে। এতে মূল কথাটি হল বস্তুর বিকাশ ঘটে মূলত তার অভ্যন্তরীণ গুণের জন্য। এই অভ্যন্তরীণ গুণ সেই বস্তুর নিজস্ব বৈশিষ্ট। বাইরে থেকে প্রযুক্ত শর্তের কোনও ভূমিকাই নেই এমনটা না, কিন্তু সেই বাইরের শর্ত কতদুর সফল হবে তা নির্ভর করে অভ্যন্তরীণ শর্তের উপরেই।

এই ব্যখ্যা গুরুত্বপূর্ণ কেন? সামগ্রিকভাবে গোটা পৃথিবীতেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কমিউনিস্টদের লক্ষ্য। কিন্তু বিভিন্ন ভূখণ্ডের ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা রয়েছে। তাই এক জায়গার রণকৌশল যত নিখুঁতই হোক না কেন, সোজাসুজি অন্যজায়গায় প্রয়োগ করা চলে না। এখানেই কমিউনিস্ট পার্টির স্বতন্ত্র ভূমিকার, সৃজনশীলতার প্রসঙ্গ। আরএসএসের মতো আমরাও সবই মার্কস লিখে গেছেন বলে চোখ বন্ধ করে এগোতে পারি না, নিজেদের দেশে বিপ্লবের কাজ নিজেদেরকেই খুঁজে বের করতে হয়।

আগেই উল্লিখিত হয়েছে মাও’র বিশেষ গুণ হল তত্ত্ব ব্যখ্যায় অসাধারণ উদাহরণ নির্বাচন। বিকাশের পথে অভ্যন্তরীণ শর্ত ও বাইরের শর্তের গুরুত্ব ব্যখায় তিনি উদাহরণ টেনেছেন ডিম ফুটে পাখির বাচ্ছা হওয়ার ঘটনাকে। ডিমে তা দেওয়ার ব্যাপারটা হল বাইরের শর্ত, ওটা জরুরীও। কিন্তু শুধু তা দেওয়াই যথেষ্ট নয়, ডিমের মতো একই আকার ও ওজন বিশিষ্ট পাথরে যতই তা দেওয়া হোক না কেন কোনোদিনই বাচ্ছা বের হয়ে আসবে না। এখানেই অভ্যন্তরীণ শর্তের অনন্য ভূমিকা। ডিম ফুটতে তা লাগবেই, কিন্তু ডিমটুকু হতে হবে, পাথর হলে হবে না।

২) দ্বন্দ্বের সর্বজনীনতা – আগেই বলা হল, একেক দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করতে একেক রণকৌশল প্রয়োজন হয়। কিন্তু রণকৌশলের সাথে রণনীতিও লাগে। এতে প্রধান শ্রত্রু, প্রধান মিত্র; দোদুল্যমান মিত্র ইত্যাদি নির্ধারিত হয়। শেষে পৌঁছে যে দেশই হোক না কেন, পুঁজিপতি শ্রেণির শাসন উচ্ছেদ করতেই হয়। বুর্জোয়া শ্রেণির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্তৃত্বকে উপড়ে ফেলতেই হয়। সুতরাং চিরায়ত সত্যেরও কিছু গুরুত্ব আছে, সবশেষে যে সর্বহারার শ্রেণিকে ক্ষমতা দখল করতেই হবে এবং বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে চুরমার করে দিতে হবে একথা ভুললে চলে না। প্যারি কমিউন থেকে মার্কস-এঙ্গেলস সেই শিক্ষাই নিয়েছিলেন। শ্রমের সাথে পুঁজির যে দ্বন্দ্ব তাই সর্বজনীন, দুনিয়ার যেকোনো পুঁজিবাদী দেশেই একথা সত্য।

৩) দ্বন্দ্বের বিশিষ্টতা – এটি মুলত বস্তুগত সত্যেরই আরেকটি দিক। অনেকটা কয়েনের উল্টোপিঠের মতো। বিশ্বজনীন দ্বন্দ্বের অস্তিত্ব যেমন আছে তেমনই রয়েছে প্রতিটি দেশের ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট। এগুলিকে অগ্রাহ্য করে শুধু এক সাধারণ রণনীতির ভিত্তিতে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত হতে পারে না। সহজ কোথায় অন্য দেশের শ্রেণিসংগ্রামের শিক্ষাকে ‘মেড ইজি’ বা সহায়িকা ধরে উত্তর খুঁজলে চলবে না, নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেদের মতো করেই নির্ধারণ করতে হবে।

৪) প্রধান দ্বন্দ্ব ও দ্বন্দ্বের প্রধান দিক – এমন না যে বস্তু বা কোনও পরিস্থিতি জনিত বিকাশের পর্যায়গুলি সরাসরি সরলরেখায় চলবে। বিকাশের পথে অনেক ছোট বড় দ্বন্দ্ব চলে। কিন্তু সমস্ত দ্বন্দ্বের মূলে যা সক্রিয় থাকে তাই হল প্রধান দ্বন্দ্ব বা কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব। এই কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্বকে আবর্ত করেই নানা সময়ে একেকটি সাময়িক দ্বন্দ্ব সামনে চলে আসে, আবার পিছনে চলে যায়। বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়জূড়ে এই চলন বিদ্যমান থাকে। কমিউনিস্ট পার্টির কর্তব্য নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করে কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্বকে চিহ্নিত করার সাথেই বিভিন সাময়িক বা অপ্রধান দ্বন্দ্বগুলিকেও চিহ্নিত করা, সেগুলির সমাধানে ব্রতী হওয়া। বলা চলে কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব নির্ধারণ করে প্রধান শত্রু ও শ্রেণিভিত্তি। অপ্রধান দ্বন্দ্বগুলি বিভিন্ন সময়ে অনুশীলিত রণকৌশল নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে। মাও এই প্রসঙ্গে বলছেন– ‘ধনতান্ত্রিক সমাজে যুদ্ধরত দুই শক্তি, সর্বহারাশ্রেণী এবং বুর্জোয়া- শ্ৰেণী প্ৰধান দ্বন্দ্ব গঠন করে। অন্যান্য স্বল্প, যেমন, অবশিষ্ট সামন্তশ্রেণী ও বুর্জোয়াশ্রেণীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব, কৃষক পাতি বুর্জোয়া ও বুর্জোয়াদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, সর্বহারা ও কৃষক পাতি বুর্জোয়াদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, অ-একচেটিয়া পুঁজিপতি ও একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, বুর্জোয়া-গণতন্ত্র ও বুর্জোয়া-ফ্যাসিবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, ধনতান্ত্রিক দেশগুলির নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব, সবই নির্ধারিত বা প্রভাবিত হয় ঐ প্রধান দ্বন্দ্ব দ্বারা’।

৫) দ্বন্দ্বের দিকগুলির অভেদ ও সংগ্রাম – লেনিন বলেছিলেন বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রামের নিয়মটিই হল দ্বন্দ্বতত্ত্বের শাঁস। প্রায়োগিক রাজনীতিতে মাও লেনিনের সেই বক্তব্যকেই আরও প্রসারিত করেছেন। তিনি বলছেন- ‘আমরা যে ভূমিবিপ্লব কার্যকরী করেছি তা এমন একটি প্রক্রিয়া ছিল এবং আবারও হবে যার ফলে জমির মালিক জমিদারশ্রেণী জমিহারা শ্রেণীতে রূপান্তরিত হয়, আর যারা একদা তাদের জমি হারিয়েছিল সেই কৃষকরা জনি দখল ক’রে রূপান্তরিত হয় ক্ষুদে মানিকে। নির্দিষ্ট অবস্থায়, থাকা এবং না থাকা, অর্জন করা এবং হারানো, পরস্পর সংযুক্ত; উভয় দিকের রয়েছে অভেদ। সমাজতন্ত্রের অধীনে, কৃষকদের ব্যক্তিগত মালিকানা রূপান্তরিত হয় সমাজতান্ত্রিক কৃষির গণ-মালিকানায়, সোভিয়েত ইউনিয়নে ইতিমধ্যে এটা ঘটেছে, এবং ঘটবে সারা বিশ্বেও। ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে সাধারণ সম্পত্তিতে পৌঁছানোর জন্য রয়েছে একটা সেতু, যাকে দর্শনশাস্ত্রে বলা হয় অভেদ, বা পরস্পরে রূপান্তর, বা আন্ত:অনুপ্রবেশ।

সর্বহারাশ্রেণীর একনায়কত্ব বা জনগণের একনায়কত্বকে সংহত করা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে ঐ একনায়কত্বের অবসানের জন্য এবং যখন সকল রাষ্ট্রব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যাবে সেই উচ্চতর স্তরে অগ্রগমনের জন্য শর্ত প্রস্তুত করা। কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ সাধন করা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে কমিউনিস্ট পার্টি ও সমস্ত পার্টি ব্যবস্থাই বিলুপ্ত করার জন্য শর্ত প্রস্তুত করা’। অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ সময়ে দ্বন্দ্বগুলি স্তিমিত হয়ে আসে, আবার সময়ের দাবী মেনেই তাদের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই কাজে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে, আবার প্রতিটি ছোটখাটো, অন্তরবর্তী লড়াইও জেতার চেষ্টা করতে হবে। একইসাথে ক্ষুদ্র লক্ষ্যে জয়ের মাধ্যমে মূল লক্ষ্যের প্রতিও যত্নশীল হতে হবে। আমাদের পার্টির তরফে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্র গনশক্তির পাতায় উপরের দিকে কমরেডরা প্রতিদিন একটি কথা ছাপা হিসাবে দেখেন। ঐ কথাটি শুধুই পত্রিকার শোভাবর্ধনের জন্য লেখা হয় এমনটা না।

৬) দ্বন্দ্বে বৈরিতার স্থান – এমন কিছু দ্বন্দ্ব থাকে যেখানে দুই প্রতিপক্ষের মাঝে সম্পর্কের বুনিয়াদ বৈরিতামূলক। আবার এমনও হয় যে দুই পক্ষের মাঝের বিরোধ বাস্তব, কিন্তু আন্তঃসম্পর্কটি বৈরিতামূলক নয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে বৈরিতামূলক সম্পর্ক অবৈরিতামূলক সম্পর্কে পর্যবসিত হতে পারে, আবার উল্টোটাও ঘটতে পারে। সামাজিক শ্রেণীস্বার্থের যে সংঘাত তাতে এমনসব বাঁক ও মোড়ের প্রতি কমিউনিস্ট পার্টিকে বিশেষ মনোযোগ বজায় রাখতে হয়। সঠিক সময়ে সঠিক কর্তব্য নির্ধারণে এই বিবেচনাবোধ কার্যকরী হয়। মাও বলেছেন- ‘যতদিন শ্রেণীর অস্তিত্ব আছে ততদিন কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে নির্ভুল ও ভুল চিন্তাধারার দ্বন্দ্ব পার্টির ভেতরে শ্রেণী-দ্বন্দ্বের প্রতিফলন। গোড়ার দিকে, বা কতকগুলি প্রশ্নে, এই ধরনের দ্বন্দ্ব সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের বৈরী রূপে প্রকাশ নাও করতে পারে। কিন্তু শ্রেণীসংগ্রামের বিকাশের সাথে সাথে সেগুলি বৃদ্ধি পেতে পারে এবং বৈরী হয়ে দাঁড়াতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়ন নের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস আমাদের দেখিয়ে দেয় যে, লেনিন ও স্তালিনের সঠিক চিন্তাধারা এবং ট্রটস্কী ও বুখারিন প্রমুখের ভুল চিন্তাধারার দ্বন্দ্ব গোড়ার দিকে বৈরী রূপে আত্মপ্রকাশ করেনি, কিন্তু পরে ঐ দ্বন্দ্ব বৈরী হয়ে দাঁড়ায়। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসেও অনুরূপ ঘটনা আছে। আমাদের পার্টির অনেক কমরেডদের সঠিক চিন্তাধারা এবং ছেন তু-সিউ ও চাং কুও-থাও প্রমুখ ব্যক্তিদের ভুল চিন্তাধারার দ্বন্দ্ব গোড়ার দিকেও বৈরী রূপে আত্মপ্রকাশ করেনি, কিন্তু পরে তা বৈরী হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে আমাদের পার্টির মধ্যে সঠিক ও চিন্তাধারার দ্বন্দ্ব বৈরী রূপে আত্মপ্রকাশ করে নি এবং যে কমরেডরা ভুল করেছেন তাঁরা যদি ভুল সংশোধন করতে পারেন, তাহলে ঐ দ্বন্দ্ব বৈরিতায় পরিণত হবে না। এজন্য, পার্টিকে অবশ্যই একদিকে ভুল চিন্তাধারার বিরুদ্ধে কঠিন সংগ্রাম করতে হবে, এবং অন্যদিকে যে কমরেডরা ভুল করেছেন তাঁদেরকে জেগে ওঠার জন্য যথেষ্ট সুযোগ দিতে হবে। এমতাবস্থায়, অতিরিক্ত সংগ্রাম স্পষ্টতঃই যথাযথ নয়। কিন্তু যাঁরা ভুল করেছেন তাঁরা যদি ভুলগুলো আঁকড়ে থাকেন এবং বাড়িয়ে তোলেন, তাহলে ঐ দ্বন্দ্বের বৈরিতায় পরিণত হবার সম্ভাবনা রয়েছে’।

এই প্রবন্ধটি পাঠ করলে মার্কসীয় দর্শনে পাণ্ডিত্য লাভ করবেন বলে কমরেডদের এটি অধ্যয়ন করা উচিত এমনটা না। লেনিনের মতোই মাও সে তুং’ও নিশানা করেছেন পার্টিতে সঠিক চিন্তাভাবনা গড়ে তোলার কাজকে, তাই প্রবন্ধের পাতায় পাতায় রয়েছে অজস্র ঐতিহাসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ঘটনার উদাহরণ, যাতে কমরেডরা নিজেদের বিচার-বিবেচনা বোধ উন্নত করতে উৎসাহিত হন। লেনিনের মতোই মাও কখনো কমরেডদের উপরে সমস্ত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেননি, হুকুম তামিলের শৃঙ্খলা চাপিয়ে দেননি। প্রায় সমস্ত জরুরী বিষয়েই স্পষ্ট ভাষায় কারণসহ আলোচনা করেছেন, বলেছেন লিখেছেন।

মাও সে তুং চিন্তাধারা সেই দার্শনিক অভীক্ষা ও অবস্থানেরই ফসল।

সেই ফসল কিভাবে আমাদের দেশের পরিস্থিতিতে উপযোগী ও কার্যকরী রূপে ফলতে পারে এই পথ খুঁজে দেখার দায় ও দায়িত্ব আমাদের।

আমরা মানে যারা মাও সে তুং চিন্তাধারার কথা তুলে ধরি।

আমাদের দেশে মাওবাদের নামে নিপীড়িত জনগণের এক বিরাট অংশকেই সন্ত্রস্ত করে দেওয়া হয়েছে। তারা মাও সে তুং ও এহেন মাওবাদকে এক রেখায় বিচার করতে বাধ্য হয়েছেন, হচ্ছেন।

আজকের প্রজন্মের পার্টি সদস্য, কর্মী, সমর্থকদের মনে রাখা উচিত, সমাজতন্ত্র নির্মাণের লক্ষ্যে বিভিন্ন মতামতের মধ্যে বিতর্ককে ‘শত পুস্প বিকশিত হোক’ বলে ভিন্নমত পোষণের অধিকারকে যিনি মর্যাদা দিয়েছিলেন তিনিই মাও সে তুং।

আজ তারই জন্মদিন।                                                                                                                              

Spread the word