Site icon CPI(M)

What comes first through? Satyaki Roy

কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া ব্রিক্স এর অধিবেশন প্রধানমন্ত্রী এবং সম্প্রতি সিআইআই আয়োজিত একটি অধিবেশনে আমাদের দেশের অর্থমন্ত্রী যে গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তা হল ভারতবর্ষ অচিরেই ফাইভ ট্রিলিয়ন ডলার ইকোনমিতে পরিণত হবে এবং ২০৩০ এর মধ্যে ভারত পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। এ সম্পর্কে প্রচার মাধ্যমের বিপুল উৎসাহ আগামী ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপির দলীয় প্রচারে যথেষ্ট রসদ যোগালেও এ সম্পর্কে একটি বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন জরুরী।

 প্রথমত, অর্থনীতিতে ভবিষ্যৎবাণীর বিষয়টি প্রচার মাধ্যমে যথেষ্ট উৎসাহ তৈরি করলেও সাধারণত এই ধরণের প্রক্ষেপকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া  হয়না। এর প্রধান কারণ হল সমাজ ও অর্থনীতিতে কখন কি ঘটবে এবং তার সামগ্রিক অর্থনীতির গতি বৃদ্ধিকে কিভাবে প্রভাবিত করব সে ব্যাপারে কিছু পূর্ব প্রবণতার ভিত্তিতে সম্ভাবনার কথা বলা গেলেও এ ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কখনই সমীচীন নয়। রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার প্রয়োজনে কোন রাজনৈতিক নেতা কোনো বিশেষ সম্ভাবনার কথা তুলে ধরতেই পারেন  কিন্তু তা যদি বাস্তবে পরিণত করতে হয় তবে তা অনেকগুলো পূর্ব শর্ত রূপায়নের উপরে নির্ভর করে। এই পাঁচ ট্রিলিয়ন অর্থনীতি অথবা তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাটি নির্ভর করে যে বর্তমান অবস্থায় অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার এবং আগামী তিন বছর বা পাঁচ বছর ধরে কাঙ্খিত বৃদ্ধির হার কিভাবে রূপায়িত হচ্ছে তার উপরে। বিভিন্ন রেটিং এজেন্সিগুলি অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা এবং তার সম্ভাবনার হিসাবগুলো উপস্থিত করে থাকে এবং তাদের মতে ২০২৬-২৭ আর্থিক বছর থেকে যদি ভারতের অর্থনীতির বৃদ্ধির গড় হার ৭% বা তার চাইতে বেশি হয় তবে এই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হবে। আশা করায় কোন ক্ষতি নেই এবং এই সংখ্যা যে একেবারেই অবাস্তব তা নয়। কিন্তু পাশাপাশি  একথাও খেয়ালে রাখা দরকার যে আমাদের দেশে কর্পোরেট ব্যক্তিগত সংস্থাগুলির বিনিয়োগ বৃদ্ধির হার দীর্ঘকাল ধরে নিম্নগামী, মানুষের ভোগব্যয় বৃদ্ধির হারও এখনো পর্যন্ত যথেষ্ট আশা ব্যঞ্জক নয়। দেশে বেকারির হার এখনো যথেষ্ট বেশি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে আগামী দিনে মুদ্রাস্ফীতি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী। এই সমস্ত প্রবণতা গুলিই দেশের চাহিদা বৃদ্ধির গতিকে স্লথ করে দিতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে যে বৃদ্ধির হার আশা করা হচ্ছে এবং যা হলে এই তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির তকমা জুটবে তা একেবারেই নিশ্চিত এরকমটা নয়।

এবার যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া হয় কাঙ্খিত বৃদ্ধির হার অর্জন করা সম্ভব হবে ফলে ভারতের অর্থনীতি অচিরেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। মনে রাখা দরকার যে ২০১৪ সালে ভারতের অর্থনীতি চলতি মূল্যের হিসাবে পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি ছিল এবং ২০২২ সালেও ভারতবর্ষ পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। আমাদের আগে রয়েছে আমেরিকা, চীন, জাপান ও জার্মানি। বর্তমানে চলতি মূল্যে ভারতের জিডিপি হল ৩.৩৯ ট্রিলিয়ন ইউ এস ডলার। চলতি মূল্যে জিডিপির হিসাবের সমস্যাটি হল যে কোন দেশের মূল্য সংযোজন যদি একই থাকে কিন্তু জিনিসের দাম যদি বেড়ে যায় তাহলে কোন নতুন জিনিস তৈরি না হলেও জিডিপির মূল্য বেড়ে যাবে। পঞ্চম থেকে তৃতীয়তে পৌঁছানোর যে আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে তা আসলে চলতি মূল্যে জিডিপির হিসাবে এবং সে কারণে তা যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য নয়। তুলনার ক্ষেত্রে আরও বড় সমস্যা হলো দুটি দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার যদি দুরকম হয় তবে ওই দুটি দেশের মূল্য সংযোজন এর তুলনা চলতি দামের ভিত্তিতে করার কোনো মানেই দাঁড়ায় না। এবার আসা যাক প্রকৃত মূল্যের প্রশ্নে। ২০১৫ সালের স্থির ডলার মূল্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জিডিপির পরিমাণ পাওয়া যায়। এই হিসেবে আমাদের জিডিপির পরিমাণ হলো ২.৯৫ ট্রিলিয়ন ডলার। এবং স্থির মূল্যের জিডিপির পরিমাণে আমরা পৃথিবীর ষষ্ঠ স্থানে। এছাড়াও ক্রয় ক্ষমতার সামঞ্জস্যের ভিত্তিতে বা পারচেসিং পাওয়ার প্যারিটি অনুসারেও জিডিপির পরিমাপ করা যেতে পারে। এবং সে ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক ডলারের চলতি মূল্যে ভারতের জিডিপির পরিমাণ ১১.৯ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ২০১৭ র আন্তর্জাতিক ডলারের ভিত্তিতে স্থির মূল্যে ভারতের জিডিপির পরিমাপ ১০.১ ট্রিলিয়ন ডলার।

এবারে প্রশ্ন হল যদি আমরা পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি থেকে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হই সেটা আনন্দের খবর হলেও বিশেষ কিছু বিস্ময়কর নয়। ভারতবর্ষের জনসংখ্যা এখন পৃথিবীর বৃহত্তম। বড় দেশের মোট আয় অন্য ছোট দেশের তুলনায় বেশি হবে এতে বিশাল গৌরবের খুব একটা কিছু নেই। বিশেষত উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলি পরিণত পর্যায়ে উপনীত হওয়ার কারণে তাদের বৃদ্ধির হার স্লথ হয়ে এসেছে। অথচ চিন বা ভারতবর্ষে বা সাধারণভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বৃদ্ধির হার যথেষ্ট বেশি। বর্তমানে ভারতের বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি অতএব এই পরিপ্রেক্ষিতে জার্মানি এবং জাপানকে অতিক্রম করে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়াটা খুব বিস্ময়কর কিছু নয়। প্রশ্ন হল সংখ্যার হিসেবে এই তথ্যটি যথেষ্ট পুলকের কারণ হলেও সাধারণ মানুষের জীবনে এই সংখ্যার বিশেষ কোন মানে নেই।

বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির আরেকটি তুলনামূলক বিচারের মাপকাঠি হল মাথাপিছু আয়। অর্থাৎ সহজ হিসাব হল, মোট জিডিপি কে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে কোন দেশের মাথাপিছু আয় বা গড় আয় বার করা যায়। এর থেকে বোঝা যায় এদেশের একেক জন মানুষের অধীনে গড়ে কত আয় পড়ছে। এই পরিমাপ নিয়েও সমস্যা আছে। ধরুন কোন দেশে দুটি লোক বসবাস করে যাদের একজনের আয় ১০ টাকা এবং অপরজনের আয় ১০০ টাকা। অতএব মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ৫৫ টাকা। কিন্তু এটা সত্যকে প্রতিফলিত করে না। আর্থিক বৈষম্যের কারণে বড়লোক বেশি আয় করে এবং গরিব লোক কম আয়ের অধিকারী হলেও গড় আয়ের পরিমাপে  তা ধরা পড়বে না। অতএব মাথাপিছু আয় কখনোই বৈষম্যের পরিমাপকে প্রতিফলিত করে না। কিন্তু এ কথা ঠিক যে দুটি দেশের মোট আয়ের তুলনা করার চেয়ে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে তুলনা করা বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এবার দেখা যাক সে ক্ষেত্রে ভারতের স্থান কোথায? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু আয়  ভারতের মাথাপিছু আয়ের ৩০ গুণেরও বেশি। ফ্রান্স জার্মানি এবং জাপানের মাথাপিছু আয় ভারতবর্ষের চেয়ে যথাক্রমে ১৯ গুন ২১ গুন এবং ১৭ গুণ বেশি।

 উন্নয়নশীল দেশগুলির সাপেক্ষে আমাদের অবস্থান তুলনা করাটা বোধহয় এক্ষেত্রে সমীচীন হবে। ১৯৭০ সালে চীনের মাথাপিছু আয় ভারতবর্ষের চেয়ে কম ছিল। ২০২২ সালে চীনের মাথাপিছু আয় ভারতের ৫.৫ গুন। ১৯৭০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু আয় ছিল ভারতের নয় গুণ বর্তমানে তা ১৭.৬ গুনেরও বেশি। বড় দেশ ব্রাজিলের অথবা দক্ষিণ আফ্রিকার মাথা পিছু আয়  ভারতের যথাক্রমে ৪.২ ও ২.৯ গুন। এমনকি ভিয়েতনাম অথবা শ্রীলংকার মাথাপিছু আয়ও ২০২২ সালে ভারতের তুলনায় বেশি। শুধু তাই নয় আর্থিক অগ্রগতির তুলনায় বিভিন্ন দেশের  উৎপাদনশীলতা কিভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তাও বিবেচনার মধ্যে রাখা দরকার।১৯৯১ থেকে ২০১৯ এই সময়কালে ভারতের শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২.২ গুন আর একই সময়কালে চিনে শিল্পে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে ১১ গুণের চেয়েও বেশি। বর্তমানে চীনের শ্রমের উৎপাদনশীলতা ভারতের শ্রমের উৎপাদনশীলতার চেয়ে ৪.৭ গুন বেশি এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে চীনের শ্রমের উৎপাদনশীলতা ভারতের তুলনায় ২.৪ গুন। অতএব জিডিপির মোট পরিমানের সাপেক্ষে তৃতীয় বা চতুর্থ হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বিশেষ পুলকিত হওয়ার কিছু নেই বরং তা ভারতের আর্থিক অবস্থার গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা গুলিকে আড়াল করার বৃথা প্রচেষ্টা মাত্র।

 একথা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে মোট আয় বা মাথাপিছু আয়ের তুলনামূলক বিচারে ভারতের অবস্থান একটি সংখ্যামাত্র। তা কি সত্যিই দেশের মানুষের জীবনে বিরাট গুরুত্ব বহন করে? দেশে বেকারির হার ৭.৫% যা গত ছয় বছরের বেকারি হারের মধ্যে সর্বোচ্চ। শিক্ষিত ও অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে বেকারির হার আকাশচুম্বি। দেশে মহিলাদের শ্রমবাজারের অংশগ্রহণের হার ক্রমাগত কমেছে। ভারতবর্ষকে আয় বৈষম্যের বিচারে প্রথম কয়েকটি দেশের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। অনেকের মতে আমাদের দেশের আয় বৈষম্য প্রাক-স্বাধীনতা আমলের বৈষম্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ক্ষুধার সূচকে ভারতের স্থান ১২৫ টি দেশের মধ্যে ১১১ তম। উপর্যুপরি মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে অথচ কর্পোরেট সংস্থাগুলি মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে এই সময়কালে  ব্যাপক মুনাফা করেছে। এই সমস্ত সূচকগুলি যা মানুষের জীবনের সঙ্গে যুক্ত তা যদি সত্য হয়ে থাকে এবং যদি এই প্রবণতা চলতে থাকে তবে জাতীয় আয়ের মোট পরিমানের নিরিখে আমরা যদি প্রথমও হয়ে যাই তাতে সাধারণ মানুষের কি যায় আসে?

 উল্লেখযোগ্য বিষয হল জিডিপির নিরিখে তৃতীয় বৃহত্তম দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে উৎসাহ দেখাচ্ছে সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী যে দেশের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন যে আয় বৃদ্ধি মানুষের কল্যাণকে সুনিশ্চিত করে না। মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উপর তার সক্ষমতা ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতা আসলে তার কল্যাণকে সুনিশ্চিত করে। এ কারণেই তার স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এইগুলি সুনিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরী। এই তাত্ত্বিক প্রতিপাদ্যের উপর ভিত্তি করেই আন্তর্জাতিক স্তরে মানব উন্নয়ন সূচকের ধারণাটি উন্নয়নের পরিমাপের গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হিসেবে উপস্থিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য  যে ২০২৩ সালে মানব উন্নয়ন সূচক অনুযায়ী ভারতের স্থান ১৯১টি দেশের মধ্যে ১৩২ তম এবং গত তিন দশকে এই প্রথম দুটি পরপর বছরে আমাদের মানব উন্নয়ন সূচকের মান কমেছে।

এর পরেও আর্থিক অগ্রগতির বিপুল সম্ভাবনা ও সাফল্য দেখতে পাওয়ার জন্য দেশের সরকার ও প্রচার মাধ্যমকে ধন্যবাদ

১ জানুয়ারি ২০২৪ গণশক্তি পাত্রিকায় প্রাকাশিত

Spread the word