Site icon CPI(M)

Uniform Civil Code: Let It Be One

বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য

১ অগাস্ট ২০২৩ ম মঙ্গলবার বার)

কর্ণাটকের নির্বাচনে বজরঙ্গবলিকে ভোট দেবার আহ্বান জানালেন নরেন্দ্র মোদি। কর্ণাটকের সাধারণ মানুষ সচেতন ভাবেই ধর্মীয় বিভাজনের ঐ ডাককে বাতিল করে দিল।
ব্যর্থ মনোরথ বিজেপির নেতা মোদি আরও আক্রমণাত্মক হয়ে মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনী জনসভায় বলে বসলেন, এক পরিবারের যেমন ভিন্ন আইন চলে না, তেমনই এক দেশে এক ও অভিন্ন আইন চালু করতে হবে। আওয়াজ উঠল অবিলম্বে বিবাহ, উত্তরাধিকার, দত্তক সংক্রান্ত (সিভিল) আইন অভিন্ন হতে হবে। ভুলে গেলেন ভারতবর্ষ তথা ইন্ডিয়া বিভিন্ন রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্র (Union of State) | Unity of State নয় অর্থাৎ বৈচিত্রের মধ্যেই ঐক্য Unity of diversity|
ফৌজদারী আইন (Criminal Code) যদি সবার জন্য এক হয়, তবে পারিবারিক আইন (সিভিল) কোড সবার জন্য এক নয় কেন? এই প্রশ্ন সহজেই মন কেড়ে নেয় আমরা ভুলে যায় ফৌজদারি অপরাধ (ক্রিমিনাল) সমাজের বিরুদ্ধে অপরাধ। সেই অপরাধে সমাজের সবাই অপ্রত্যক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই একই আইনে সবাইকে বেঁধে ফেলা যায়।
বিবাহ, উত্তরাধিকার, দত্তক ইত্যাদি বিষয়গুলি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক। বিভিন্নতার সঙ্গেই সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ তাদের প্রথাগত বিশ্বাস ও ভাবনা থেকেই ঐ সব ক্রিয়াকলাপ পালন করে।


‘Unifrom Civil Code’ ভারতবর্ষের মত বৈচিত্র্যময় দেশে কিভাবে লাগু করা যাবে তা ব্রিটিশ আমল থেকেই আলোচিত হয়েছে। ১৮৪০ ‘আইন কমিশন’ এর রিপোর্টে তার বিস্তারিত আলোচনার পর ফৌজদারী আইন সকলের জন্য প্রযোজ্য হলেও পারিবারিক বিষয় সংক্রান্ত আইন সমভাবে কার্যকরি করার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। তার মূল কারণ হ’ল পারিবারিক সম্পর্কিত ক্ষেত্রে মানুষ সাধারণভাবে ব্যাক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশাসনকেই মেনে চলে।
সংবিধানসভায় এ বিষয়ে বহু বিতর্ক হয়। সংবিধান প্রনেতারা সংবিধানের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অধ্যায়ে ধর্মীয় আচরণের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সম অধিকার যাতে রক্ষিত ও কার্যকরি হয় তার জন্য সাংবিধানিক আদালত গঠন করেছে। অন্য একটি অধ্যায়ে দেশ পরিচালন ও গঠনের একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে ‘Directive Principle of State Policy’ নামক অধ্যায়ে।
সুপ্রীম কোর্ট বিভিন্ন রায়ে বলেছে যে মৌলিক অধিকার কার্যকর করতে গেলে নীতি নির্দ্ধারক (Directive Principles) বিষয়গুলিকেও কার্যকর করতে হবে। ৪৪নং ধারায় বলা হয়েছে, Unifrom Civil Code for the citizens. The State Shall endeavour to secure for the citizens a uniform Civil Code throughout the territory of India.
লক্ষ্যনীয় এখানে বলা হয়েছে রাষ্ট্র চেষ্টা করবে – সম আইন চালু করতে। চাপিয়ে দেওয়া নয়। চেষ্টা করা অর্থাৎ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সহমত তৈরীর চেষ্টা করে তবেই আইন চালু করা।
হঠাৎ নির্বাচনের সময় ধর্মীয় আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে আইন কমিশনকে বাধ্য করে এর পক্ষে মতামত অর্জন করা নয়।
২০১৮ সালেই বহু চর্চার পর আইন কমিশন জানিয়েছে, এখনই সম আইন তৈরীর সময় আসেনি। বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় ভাবধারার গোষ্ঠী তারা কেউই এই সম আইনের পক্ষে নয়। তারা ধর্মীয় আচরণ বা গোষ্ঠীগত প্রচলিত প্রথাকে তাদের মৌলিক অধিকার বলেই মনে করে।


এসব কথা মনে রেখেই সংবিধান সভার বিতর্কে আম্বেদকার বলেছিলেন, It is perfectly possible that future parliament may make a provision by way of making a beginning that the code shall apply only to those who make a declaration that they are prepared to be bound by it, so that in the initial stage the application of the code may be purely voluntary .
দীর্ঘ আলোচনা না করেও বলা যায়, সংবিধান প্রনেতারা কখনই মনে করেননি যে যেনতেন প্রকারে এক সম পারিবারিক আইন লাগু করা যেতে পারে বা করা উচিৎ।
রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায় অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনা। সে কাজে চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্ন পথে পরিচালনার কুকৌশল হল অভিন্ন ধারার কথা বলা। মনে রাখতে হবে এই বিজেপি ও আরএসএস হিন্দু কোড বিলের তীব্র বিরোধীতা করেছিল।
১৯৫১ সালে হিন্দু কোড বিল সংসদে আলোচনা হয় কিন্তু সহমত না হবার জন্য বিল বাতিল হয়। পরবর্তী কালে ১৯৫২ সালে আবার সংসদে তোলা হয়। অবশেষে ‘Hindu Marrige Act 1965’, ‘Hindu sucecassion. Act 1956’, ‘Hindu Minority and gurdiaonship Act, 1956’ Ges ‘Hindu Adoption and Maintenance Act, 1956’ গৃহীত হয়।
১৯৫৪ সালে ‘Special Marriage Act’ লাগু হয়। এর ফলে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ পরস্পরের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারল। এখনতো হিন্দু মৌলবাদীরা ‘লাভ জিহাদ’ – আওয়াজ তুলে বিভিন্ন ধর্মীয় মানুষের বিবাহের বিরোধ করছে। হিন্দুদের মধ্যে নারী পুরুষের মধ্যে যে অসমতা ও বিপুল ফারাক ছিল সেই সমস্যা সমাধানেই হিন্দু কোড আইন কার্যকরী করা হয়, বিজেপি আরএসএস-এর বিরোধীতা সত্তে¡ও।


এখন যেমন সুপ্রীম কোর্ট মুসলীমদের মধ্যে প্রচলিত তিন তালাক প্রথাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে সরকারকে বাধ্য করেছে ঐ প্রথাকে বেআইনী ঘোষণা করে। আইন তৈরী করতে।
এভাবেই প্রতিটি পার্সোনাল ‘ল’ যেখানে যেমন অসমতা দেখা যাবে তাকে আইনি সংশোধন করেই নারী পুরুষের অধিকারে সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবেই। ব্যাপক আলোচনার মাধ্যমেই প্রচলিত কুপ্রথা কে বাতিল করতে হবে। চাপিয়ে দিলে ভাঙবে, জুড়বে না। Unifrom Civil Code অপেক্ষা করুক। আর্থিক সমতা দ্রুত আনতে হবে – সংবিধানের ৩৯নং ধারা কার্যকর করতে হবে।
সুপ্রীম কোর্টের ব্যাখ্যানুযায়ী ডাইরেকটিভ প্রিন্সিপালস অব স্টেট পলিসি, অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি কার্যকর করতে হবে সংবিধানের মূল লক্ষ্য কে বাস্তবায়িত করার জন্য। মূল লক্ষ্য হ’ল সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ডাইরেকটিভ প্রিন্সিপেলের প্রথম ধারাটিই সংবিধানের ৩৯নং ধারা।
Article 39” Certain principle of policy to be followed by state –
The State shall, in particular, direct its policy towards securing –
a) That the citizens, men and women equally, have the right to an adequate means to livelihood;
b) That the ownership and control of the material resources of the community are so distributed as best to subserve the common good;
c) That the operation of the economic system does not result in the concentration of wealth and means of production to the common detriment
d) That there is equal pay for equal work for both men and women;
e) That the health and strength of the workers, men and women, and the tender age of children are not abused and that citizens are not forced by economic necessity to enter avocations unsuited to their age and strength;
f) That children are given oppurtunitie and facilities to develop in a healthy manner and in conditions of freedom and dignity and that childhood and youth Protected against exploitation and against moral and material abandonment.

(আনুবাদ – সংবিধানের ৩৯ নং ধারায় রাজ্যগুলির জন্য অবশ্যপালনীয় নীতি হিসাবে উল্লেখ রয়েছে- বিবিধ প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট অধিকারসমূহকে সুরক্ষিত রাখতে রাজ্যগুলীকে যে সকল নীতি প্রণয়ন করতে হবে-

ক) জীবন-জীবিকার উপযুক্ত উপায়সমূহে নর-নারী নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার সমান।

খ) সামাজিক সম্প্রদায়ের যৌথ সম্পত্তির অধিকারটি সকলের জন্য এমনভাবেই সুষমবণ্টিত হবে যাতে সার্বিক উন্নয়ন সুনিশ্চিত হয়।

গ) সর্বসাধারণের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে কতিপয়ের হাতে সম্পদ ও উৎপাদনের উপকরনসমূহকে কেন্দ্রিভুতকরণের উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে না।

ঘ) সম পরিমান কাজে নর-নারীর বেতন সমান হবে।

ঙ) অর্থনৈতিক দূরবস্থার তাগিদে গুরুতর স্বাস্থ্যহানী হতে পারে এমন কাজে নর-নারী, কম বয়সী শিশুদের নিযুক্ত হতে বাধ্য করা যাবে না।

চ) শিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কাজটি সুচারুভাবে লভ্য হতে হবে। তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও স্বাধীনতা খর্ব হলে চলবে না। অপ্রাপ্তবয়স্ক ও যুববয়সী সকল নাগরিককে শোষণের থেকে সুরক্ষিত রেখেই তাদের নৈতিক ও বৈষয়িক প্রাপ্যসমুহকে নিশ্চিত করতে হবে।)


Unifrom Civil Code স্থান পেয়েছে সংবিধানের ৪৪নং ধারায়। ৩৯নং ধারায় যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে সে সব কার্যকরী না করে হঠাৎ ৪৪নং ধারার প্রতি মোদির নজর খুবই উদ্দেশ্যমূলক। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে এক উদ্বেগ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে মানুষকে ব্যস্ত রাখা। যাতে ৩৯নং ধারা কে কার্যকরি করার জন্য মানুষ সংগঠিত হতে না পারে।
৩৯নং ধারায় উল্লেখিত বিষয়গুলি নির্দিষ্টভাবে কার্যকরী হলেই সব অংশের মানুষই ক্ষুদ্র পারিবারিক ও ধর্মীয় গন্ডি থেকে বেড়িয়ে আসতে পারবে। মেলামেশা বাড়বে ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গন্ডি ছিন্ন হবে।

Spread the word