‘‘সংগ্রামী অভিনন্দন দেওচা।’’ লিখেছিলেন আনিস খান।
আমতার যুবক আনিস পুলিশ-তৃণমূলের মিলিত সন্ত্রাসের শিকার। বাড়িতে ঢুকে, মাঝ রাতে ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে আমতার এই যুবককে। তার আগে, মাত্র ২৮ বছরের জীবনে আনিস খান জানিয়ে গেছেন — প্রতিবাদীর কোনও ধর্ম হয় না। যে যেখানে লড়ে যায়, সেই সব ময়দানে লড়াকুদের পাশে থাকে শুধু ঋজু শিরদাঁড়া।
আনিস খান, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রদের নেতা, নিজের গ্রামে তৃণমূলী সন্ত্রাসে দমবন্ধ জনজীবনে তিনি ছিলেন জেহাদ। তাঁকে খুন হতে হয়েছে মমতা-শাসনে, তৃণমূল-পুলিশের চক্রান্তে।
দেউচা পাঁচামীর লড়াই সেই আনিস খানের মননেও গভীর রেখাপাত করেছিল। ফেসবুকে পরপর পোষ্ট তাই বলছে। গত ৮ই জানুয়ারি আনিস লিখছেন, ‘‘বাংলার বিপ্লবীদের নতুন পথ দেখাবে দেওচা। সংগ্রামী অভিনন্দন দেওচা।’’ গত ২৯শে ডিসেম্বর আনিস খান আরও লিখেছিলেন,‘‘তৃণমূল-পুলিশের সন্ত্রাস, উচ্ছেদের ভয় উপেক্ষা করে দেওচা লড়ছে।’’ (আনিসের বানান অপরিরবর্তিত রাখা হল।)
নিহত আনিসের চেতনায় যে এলাকার মানুষের রুখে দাঁড়ানো ‘লড়াইয়ের নতুন পথ’, সেই এলাকায় জল-জমি-গ্রাম উজাড় করে বানানো খনির পথে নরেন্দ্র মোদীর জন্য রেড কার্পেট বিছিয়ে রেখে এসেছেন তথাকথিত ‘মা-মাটি-মানুষের’ নেত্রী মমতা ব্যানার্জি।
মোদীকে আমন্ত্রণ জানানোই আছে। মমতা ব্যানার্জি জানিয়েছেন। দু’বছর আগে। প্রতিবাদীদের জন্য তাঁর সিদ্ধান্ত — মারের। ভয় দেখানোর। সাক্ষী শুক্রবার, শনিবারের বোলপুর। প্রমাণ — বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই হুমকির মুখে লড়ে যাওয়া দেউচা পাঁচামীর গ্রামগুলি।
নয়াদিল্লিতে ২০১৯-র ১৮ সেপ্টেম্বর প্রায় চল্লিশ মিনিট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার আগে, লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপি ১৮টি আসনে জয়ী হয়েছিল। রাজ্যে তৃণমূল-বিজেপি দ্বিমেরু বিভাজন তুঙ্গে। তখন, সেই রুদ্ধদ্বার বৈঠক থেকে বেরিয়ে তৃণমূল নেত্রী বলেছিলেন,‘‘খুব ভালো আলোচনা হয়েছে।’’ সেই বৈঠকেই দেউচা পাঁচামী কয়লা খনি প্রকল্পের উদ্বোধনে নরেন্দ্র মোদীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছিলেন মমতা ব্যানার্জি।
সেই প্রকল্প প্রবল প্রতিবাদের মুখে। এখানে পাথর খাদানের ধুলো, পাংশু রুক্ষতা আর হলুদ ফসল যেন পিঠোপিঠি সহোদর। এই দু’য়েই জড়িয়ে আছে কেন্দাপাহাড়ি, হরিণশিঙা, পাথরচাল, তালবাঁধ, শালডাঙার মত গ্রামগুলি। সেই জনপদগুলিতে প্রতিবাদই এখন পরিচিতিপত্র। চাষ কোথাও দু’বার। বেশিরভাগ জায়গায় একবার। পাথর খাদান অনেক। সেখানে লক্ষাধিক মানুষের রুটি-রুজি নির্ভরশীল।
সেখানেই সব ধ্বংস করে খোলা মুখ কয়লা খনি তৈরিকে ‘শিল্প’ বলে দাবি করে গ্রামের পর গ্রাম উচ্ছেদের চক্রান্ত করেছে মমতা ব্যানার্জির সরকার।
রুখে দাঁড়িয়েছে দেউচা পাঁচামী। তৈরি হয়েছে ভূমিরক্ষা কমিটি। প্রতিবাদে আছেন সব অংশের মানুষ। তারা গ্রামে গ্রামে সভা করেছে। এখনও করছে। তারা হ্যান্ডবিল করেছে। ভূমিরক্ষা কমিটির নামে ছাপানো হ্যান্ডবিলে কী আছে? ‘‘দয়া নয়, অধিকার চাই, কয়লা খনি নয়, আদিবাসী সংস্কৃতি-জঙ্গল-জনজীবনের উন্নয়ন চাই।’’ হ্যান্ডবিলে আরও লেখা হয়েছে, ‘‘যেখানে যেখানে কয়লা খনি হয়েছে সেখানে মানুষ ধ্বংস ছাড়া আর কী পেয়েছে? এমন কোনও খনি-খাদান এলাকা আছে যেখানকার শিশুরা লেখাপড়া শিখেছে, স্বাস্থ্যবান শরীর পেয়েছে, সম্মানের সাথে কাজ পেয়েছে, চিকিৎসা পেয়েছে, মেয়েরা নিরাপত্তা পেয়েছে, ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষা পেয়েছে? বরং জুটেছে ২০০-৩০০ টাকার রোজে অনিশ্চিত কাজ আর সিলিকোসিস রোগ। তাই এই লড়াই শুধু আদিবাসীদের নয়। এ লড়াই আদিবাসী, গরিব হিন্দু-মুসলমান, দলিত সহ গতরে খাটা সব মানুষের।’’
লড়াইয়ের চরিত্র স্পষ্ট — সম্মিলিত ইচ্ছার প্রকাশ দেখছে মহম্মদবাজার ব্লক এলাকার এই গ্রামগুলি। পরিসর বাড়িয়ে আন্দোলনের গন চরিত্র কী ভাবে গড়ে ওঠে – – তার এক গবেষণাগার হয়ে উঠছে দেউচা পাঁচামী। ভূমিরক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে সুনীল মুর্মু বলেছেন, ‘‘আমরা গ্রামে গ্রামে বসে কয়লা খনি নিয়ে মানুষের মতামত নিয়েছি। কেউ কয়লা খনি চায় না। মানুষের সেই মত জানানোর জন্যই এদিন আমরা এলাকার গ্রামে গ্রামে হ্যান্ডবিল দিয়েছি।’’
ইতিমধ্যে সভা হয়েছে। একাধিক — প্রতিবাদের, প্রতিরোধের। সিপিআই(এম)-র সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য এবং বিভিন্ন সংগঠন পাঁচামীতে গেছেন। লড়াইয়ের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন। গেছে সিপিআই(এম)-র প্রতিনিধি দলও। ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী। কী শুনেছেন তিনি? চাঁদপুর, হরিণশিঙাগ্রাম ঘুরে দেওয়ানগঞ্জের আদিবাসী পাড়ায় প্রতিনিধিদল পৌছাতেই ঝাঁঝিয়ে ওঠেন বৃদ্ধা মতিয়া সরেন। চিৎকার জুড়ে বলেন, ‘‘আদিবাসীদের গাঁয়ে কি সোনা আছে? সব নজর আদিবাসীদের দিকেই কেন? যে পাথরটো চলছে সেটোই ভাল করে চালাক। তাহলেই আমাদের চলে যাবে। আমরা কুটি টাকা চাই না।’’
ইতিমধ্যেই দেউচা পাঁচামীর এই প্রতিবাদ-বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যে। ‘বিদ্বেষের রাজনীতি বিরোধী জনমঞ্চ’ আয়োজন করেছিল পদযাত্রা। পাঁচামীর লড়াইয়ের প্রতি সংহতির অংশ এই পদযাত্রার অংশগ্রহণকারীদের লক্ষ্য ছিল আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি পাঁচামীর দেওয়ানগঞ্জে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালন — মাতৃভূমি রক্ষার শপথে অঙ্গাঙ্গী হত মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা। পদযাত্রা শুরু হয়েছিল কলকাতা থেকে, গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি। গত ১৭ই ফেব্রুয়ারি তা পা রেখেছে বোলপুরে। তারপর থেকে শুরু আক্রমন। শুক্রবার মঞ্চের সভা ভন্ডুল করেছিল পুলিশ। মাইক, চেয়ার বাজেয়াপ্ত করেছে। মঞ্চের প্রতি সংহতি জানাতে সভায় উপস্থিত সিপিআই(এম) নেতা গৌতম ঘোষসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করেছিল বোলপুর থানার পুলিশ।
শনিবার হয়েছে হামলা — এবার পুলিশ দর্শক। ময়দানে তৃণমূল — সরাসরি। যে লজে পদযাত্রীরা ছিলেন, রতনপল্লীর সেই লজে ঢুকে ছাত্র, যুব, কলাকুশলীদের বেধড়ক মেরেছে মুখ্যমন্ত্রীর দলের লোকরা। ভাঙচুর করা হয়েছে শিল্পীদের সরঞ্জাম।
মোদীর আমন্ত্রণ মিলেছে। প্রতিবাদীদের জন্য রইলো আক্রমন।
দেউচা পাঁচামী — ছিল জল, জমি, প্রকৃতি রক্ষার সংগ্রাম। হয়ে উঠেছে একইসঙ্গে গনতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম, স্বৈরাচার-বিরোধী লড়াই।
অত্যাচার অনেকদিন থেকেই সহ্য করতে হচ্ছে দেউচা পাঁচামীর গ্রামবাসীদের। সংবাদপত্র লিখবে না সেই সব কথা। সংবাদমাধ্যম দেখাবে না রুখে দাঁড়ানোর ফুটেজ। আজকের পশ্চিমবঙ্গে এটি প্রবল, অসহ্য এক সত্য। কিন্তু তবু দেওয়ানগঞ্জসহ সেখানকার গ্রামবাসীদের উপর জমি, জঙ্গল দখলে মরীয়া তৃণমূলের অত্যাচারের কথা উঠে এসেছে নানা ভাবে।