Site icon CPI(M)

The New Being, The Craftwork: The History (Part I)

Lenin and Soviet Education 1

অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত

রুশ বিপ্লব ও আনাতোলি লুনাচার্‌স্কির শিক্ষাচিন্তা

প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও ঐতিহাসিক ভিক্টর শুলগিন একবার লেনিনের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এইরকম আড্ডা দুজনের মধ্যে হত মাঝে মধ্যেই। দুজনেরই পছন্দের লেখক ছিলেন চের্নেশেভস্কি (যাঁর উপন্যাস ‘What is to be done ?’ থেকে লেনিন তাঁর পৃথিবী বিখ্যাত রচনার শিরোনামটি গ্রহণ করেছিলেন), তাঁকে নিয়ে নানা রকম আলোচনা হত নিজেদের মধ্যে। রুশ বিপ্লবের কিছু পরে, এইরকমই একদিন আলোচনা হচ্ছে দুজনের মধ্যে। কিন্তু শুলগিন আনমনা। লেনিন লক্ষ্য করেই জিজ্ঞেস করলেন ব্যাপারখানা কি। খুলেই বললেন শুলগিন। বিপ্লবের ঠিক পর পরই কাউন্সিল অফ পিপলস কমিশারস (সোভনারকম)-এ দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রথম যে তিনজন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন লেনিন, অপরজন ট্রটস্কি আর তৃতীয়জন হলেন আনাতলি ভাসিলিয়েভিচ লুনাচার্‌স্কি। ‘বলশেভিকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মেধাজীবী’ এবং ‘মেধাজীবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলশেভিক’ হিসেবে বিখ্যাত লুনাচার্‌স্কি দায়িত্ব নিয়েছিলেন কমিশারেট অফ এনলাইটেনমেন্ট-এর। লুনাচার্‌স্কি নারোদনয়ি কমিশারিয়েত প্রোসভেস্চচেনিয়া (সংক্ষেপে ‘নারকমপ্রোস’)-এর দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুলগিনের মতো বহু বলশেভিক বুদ্ধিজীবীই ভেবেছিলেন যে বৌদ্ধিক লড়াই তাঁরা এতকাল লড়ে এসেছেন, তাতে এবার তাঁরা রাষ্ট্রের সহযোগিতা লাভ করবেন। কিন্তু তাঁদের এই আশায় ছাই দিয়েছেন লুনাচার্‌স্কি। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক মত নির্বিশেষে জ্ঞানীর কদর করা আলোকপ্রাপ্তির একটি অপরিহার্য অংশ। আর সর্বশ্রেষ্ঠ আলোকপ্রাপ্ত রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত রাশিয়া এই কাজ করতে পারে না। তাই তিনি কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন বুদ্ধিজীবীদেরই শুধু ‘নারকমপ্রোস’ পৃষ্ঠপোষকতা করবে, এমন দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছেন। মায়াকভস্কি বা মেয়রহোল্ডের মতো কমিউনিস্ট শিল্পীরা তাঁর উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ। শুলগিন নিজেও মনে করেন, লুনাচার্‌স্কি বড্ড বেশি উদার। তিনিও বেশ বিরক্ত। পুরো সমস্যার কথা বলে তিনি লেনিনকে বলে অনুযোগ করলেন তিনি, লেনিনকে অনুযোগের সুরে বলেছিলেন, ‘আপনি তা-ও লুনাচার্‌স্কিকে এতো পছন্দ করেন।’ লেনিন মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমার পরামর্শ, আপনিও ওনাকে পছন্দ করুন। আসলে ওনার সমগ্র সত্তা ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত। সেই কারণেই ওনার মধ্যে এত আনন্দ আর উদারতা, যা তিনি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে সদা প্রস্তুত।’

শুলগিনের অভিযোগ ভুল ছিল না। অনেকেই ভেবে কূল পেতেন না, যে লেনিন প্রতিবিপ্লবের শক্তির সঙ্গে সংগ্রামে এত অনমনীয় সেই একই লেনিন লুনাচার্‌স্কির ‘নারকমপ্রোস’-এর উদারপন্থী মানসিকতাকে কেন বরদাস্ত করেন ? কেন লুনাচার্‌স্কি স্বয়ং বারংবার প্রত্যেক বিতর্কে লাভ করে যান লেনিনের রাজনৈতিক সমর্থন ? আদতে, শুলগিন বা মায়াকভস্কির আশঙ্কা, যে লুনাচার্‌স্কির উদারতার সুযোগ নিয়ে বিপ্লবের অনেক শত্রুও যে নতুন সোভিয়েত রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা ও বিদ্যায়তনিক পরিসরে জায়গা করে নেবে, তা লেনিন বিলক্ষণ জানতেন। কিন্তু তার পাশাপশি তিনি একথাও জানতেন যে উচ্চ আদর্শবাদের জায়গা থেকে লুনাচার্‌স্কির উদারতা জন্ম নিয়েছে, সেই একই আদর্শবাদ সোভিয়েত দেশে প্রতিকূল শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য   তাও যে রুশ বিপ্লবের ঠিক পরপরই শ্বেত বাহিনী সাইবেরিয়া থেকে ইউক্রেনে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিশ্বের তাবড় তাবড় শক্তিগুলি শুধু অর্থ আর অস্ত্র দিয়েই নয়, সরাসরি সেনা পাঠিয়ে উদ্যত হয়েছে শিশু সোভিয়েতকে তার সূতিকাগৃহেই হত্যা করার। সোভিয়েত রাষ্ট্র লড়ছে তার নিজের অস্তিত্বের জন্য। এইরকম পরিস্থিতিতে কোনও দেশে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার দায়িত্ব একমাত্র এমন মানুষকেই প্রদান করা যায়, যার মধ্যে রয়েছে অনন্ত আশাবাদ। যার দৃষ্টি রক্তস্নাত বর্তমানে নয়, বরং ভবিষ্যতের অনাগত সমাজতান্ত্রিক সমাজের উপযোগী মানুষ নির্মাণে নিবদ্ধ। লুনাচার্‌স্কি ছিলেন সেইরকমই একজন মানুষ। এই উচ্চ আদর্শবাদী মানসিকতা বাস্তব রাজনীতির মারপ্যাঁচ সবসময় বুঝতে সক্ষম হবে না, তা লেনিন বিলক্ষণ জানতেন। তা সত্ত্বেও যতদিন জীবিত ছিলেন, তিনি লুনাচার্‌স্কি সবসময় সাহায্য করে গেছেন আর নারকমপ্রোস বহু কঠিন সংগ্রামে বারে বারে লাভ করেছে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা।

আনাতলি ভাসিলিয়েভিচ লুনাচার্‌স্কি জন্মগ্রহণ করেন রুশ সাম্রাজ্যের উদারনৈতিক এক সরকারী কর্মচারী পরিবারে, ১৮৭৫ সালের ১১-ই নভেম্বর। কিয়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীনই বিপ্লবী আন্দোলনে তিনি যোগদান করেন। ১৮৯৫ সালে সদস্য হন রাশিয়ার সোশ্যাল-ডেমোক্রাটিক দলের। রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য তিনি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। উচ্চশিক্ষার জন্য লুনাচার্‌স্কি পাড়ি দিয়েছিলেন বিদেশে। ১৮৯৫-৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দর্শন ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। উচ্চশিক্ষা অবসানে ১৮৯৭ সালে রাশিয়ায় ফিরে আসেন। অবিভক্ত রুশ সোশ্যাল ডেমক্র্যাটিক লেবার পার্টির মস্কো কমিটির তিনি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন্য ১৮৯৯ সালে লুনাচার্‌স্কি গ্রেপ্তার হন ও তাঁকে আবার নির্বাসিত করা হয়। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের লেনিনের আমন্ত্রণে জেনেভা থেকে প্রকাশিত ‘ভপেরিওদ’ (অগ্রগামী) ও ‘প্রলেতারি’ (সর্বহারা) পত্রিকার সংগঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। আলেকজান্ডার বোগদানভা আর ম্যাক্সিম গোর্কির বন্ধু ছিলেন লুনাচার্‌স্কি। তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে লেনিনের অতি উচ্চ ধারণা ছিল। ‘ভপেরিওদ’ পত্রিকাকে ঘিরে যে লেনিন বিরোধী একটি বলশেভিক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে লুনাচার্‌স্কি তার অংশ ছিলেন। অথচ মতবিরোধের সেই চুড়ান্ত পর্যায়েও লেনিন তাঁকে একজন ‘অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ’ বলে প্রশংসা করতে কুন্ঠা করেননি। ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লব লুনাচার্‌স্কির স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। তিনি দেশে ফিরে পিটার্সবার্গে ‘নোভায়া ঝিজন’ (নবজীবন) সংবাদপত্র প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৯০৫-১৯০৭-এর রুশ বিপ্লবের ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে লেনিনের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ আরও তীব্র হয়। প্রবল বিতর্কে লিপ্ত হন দুজনেই। যদিও তাতে ব্যক্তিগত সম্পর্কে চিড় ধরেনি। লুনাচার্‌স্কি লেনিনের বাস্তব রাজনৈতিক বোধকে শ্রদ্ধা করতেন, আর লেনিন লুনাচার্‌স্কির উচ্চ-আদর্শবাদের অনুরাগী ছিলেন। ১৯০৫-এর বিপ্লবের ব্যর্থতার পর লুনাচার্‌স্কি পুনরায় বাধ্য হন দেশত্যাগ করতে। আবার স্বদেশে ফেরার সুযোগ আসে এক দশক পরে। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের অব্যবহতি পরে ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে লুনাচার্‌স্কি আবার স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। অচিরেই বিপ্লবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। লুনাচার্‌স্কি বক্তৃতা দেবেন, একথা প্রচারিত হলেই কম করে হাজার চার-পাঁচেক মানুষ হামেশাই জড়ো হয়ে যেত পেট্রোগ্রাদের রাস্তায়। বিপ্লবের পর যখন প্রভিশানাল সরকারের শিক্ষামন্ত্রকের দায়িত্ব কে গ্রহণ করবেন, এই প্রশ্ন উত্থাপিত হল, তখন এগারোটি ভাষায় পারদর্শী, প্রায় বিশ্বকোষ সুলভ জ্ঞানের অধিকারী লুনাচার্‌স্কির নাম কমিশার অফ এনলাইটেনমেন্ট হিসেবে প্রস্তাবিত হওয়াতে অবাক কেউই হয়নি। কিন্তু আদৌ এই গুরুভার তাঁর মতো ‘বুদ্ধিজীবী’ সামলাতে পারবে কিনা, তা নিয়ে আশঙ্কা ছিল অনেকেরই। দায়িত্ব হাতে পেয়েই লুনাচার্‌স্কি সচেষ্ট হয়েছিলেন নিজের মতো করে একটি দল গড়ে তুলতে। তিনি এই কাজে পেয়ে গেলেন দুজন যোগ্য সহযোগী। একজন নাদেজদা ক্রুপস্কায়া, যাঁকে পরবর্তী সময়ে লুনাচার্‌স্কি অভিহিত করেছিলেন ‘নারকমপ্রোস’-এর প্রাণ হিসেবে আর আরেকজন হলেন এম. এন. পক্রোভস্কি, অসম্ভব মেধাবী ঐতিহাসিক এবং কট্টর বলশেভিক । খুব দ্রুত একটি কর্মী গোষ্ঠী তৈরি হয়ে গেল এঁদের সহায়তায়। এঁরাই ছিলেন নতুন শিক্ষা কমিশারেটের আকর – ন. ক্রুপস্কায়া, ভেরা ও লুডমিলা মেনঝিনস্কায়া, ভ. ম. পোজনার, ডোরা লাজুকিনা,  ড.ই. লেশচেঙ্কো, ফ. ই. কালিনিন ও লেবেদেভ-পলিয়ান্সকি, ভেরা বঞ্চ-ব্রুয়েভিচ এবং ই. ব. রোগালস্কি।          

এই সংগঠন তৈরি হয়ে যাওয়ার পর ৮-ই নভেম্বর লুনাচার্‌স্কি কংগ্রেস অফ সোভিয়েত-এর কেন্দ্রীয় কমিটি-কে জানালেন যে শিক্ষামন্ত্রক-এর শাসনভার গ্রহণ করা এখনও সম্ভব হয়নি। কর্মীরা চুড়ান্ত অসহযোগিতা করছে। কাদেত-পন্থী শিক্ষক সংগঠন সর্ব-রাশিয়া শিক্ষক ইউনিয়ন (V.U.S) ধর্মঘটে গেছে। তাঁরা সংকল্প করেছেন এই ‘অশিক্ষিত’ শ্রমিক সরকারের সঙ্গে কোনও রকম সহযোগিতা শিক্ষকরা করবে না। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, যে লুনাচার্‌স্কি বলেন, এই মন্ত্রককে কমিশারেটের অধীনে আনার প্রচেষ্টা করার থেকে আনকোরা নতুন একটি শিক্ষা মন্ত্রক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করা সম্ভবতঃ সহজতর। পরিস্থিতি কঠিন জেনেও অবশ্য হাল ছেড়ে দেননি ‘নারকমপ্রোস’-এর কর্মীরা। ১৮-ই নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রকের বাড়িটিতে তাঁরা প্রথম কাজ করা শুরু করেন। পঞ্চাশজন টেকনিক্যাল স্টাফ তাঁদের আমন্ত্রণ জানান। সাধারণ কর্মীরা অনেকেই বিপ্লবের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করতেন। কিন্তু উচ্চ আমলারা প্রায় সকলেই ছিলেন বিপ্লবের বিরুদ্ধে। তাঁরা কেউই আসেননি। জরুরি নথিপত্র, টাকা পয়সা আর চাবি নিয়ে তাঁরা চম্পট দিয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিতে লুনাচার্‌স্কিকে প্রস্তাব দেওয়া হয় সেনাবাহিনী ব্যবহার করার। তিনি এই প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখ্যান করে। শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয় রাইফেল দিয়ে হয় বলে তাঁর বিশ্বাস ছিল না।

দপ্তরের আর্থিক পরিস্থিতি ছিল খুবই সংকটজনক। দক্ষ কর্মীর একান্ত অভাব ছিল। যাঁরা মন্ত্রকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সেই সকল বলশেভিক বিপ্লবীদের অনেকেরই শিক্ষা সংক্রান্ত অগাধ পড়াশোনা ছিল। কিরকম শিক্ষানীতি তাঁরা নতুন রাশিয়ায় চালাতে চান, সেই সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা ছিল। কিন্তু তাঁদের কোনও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ছিল না। ‘সোভনারকম’ শ্ল্যাপনিকোভ-এর নেতৃত্বে একটি কমিশন তৈরি করে যার সামনে ‘নারকমপ্রোস’-কে প্রথম বাজেট পেশ করতে বলা হয়। শুরু হয় বাজেট নিয়ে দড়ি টানাটানি, যা কখনও কখনও রীতিমত ঝগড়ার পর্যায়ে চলে যায়। ঘন্টা দুই এইরকম টানাটানির পর শেষে ৫১ কোটি রুবল শিক্ষাখাতে ‘সোভনারকম’ বরাদ্দ করতে রাজি হয়। লক্ষণীয় বিষয় ছিল এই, অত্যন্ত গুরুতর পরিস্থিতিতে, জাতীয় সংকটের সময়েও যে পরিমাণ অর্থ নতুন সোভিয়েত সরকার শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করে, তা ইতিপূর্বে আর কোনও রুশ সরকার বরাদ্দ করেনি।

কমিশার হিসেবে লুনাচার্‌স্কি-র প্রথম ঘোষণা প্রকাশিত হয় ২৯-শে অক্টোবর ১৯১৭ সালে। ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘সরকার জনতাকে শিক্ষা দিতে পারে না, বুদ্ধিজীবীরাও না, আদতে তাঁদের নিজেদের বাইরে কোনও শক্তিই এই কাজ করতে পারে না। বিদ্যালয়, বই, রঙ্গমঞ্চ, সংগ্রহশালা ইত্যাদি সহায়ক হতে পারে মাত্র। কিন্তু জনতাকে নিজেদেরকেই সচেতন ভাবে নিজেদের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।’ তিনি আরও বলেন কমিশারেট কোনও কেন্দ্রীভূত শিক্ষামন্ত্রক না, যা উপর থেকে নিচে সবকিছু চাপিয়ে দেবে। একদম তৃণমূল স্তরে গড়ে তুলতে হবে শিক্ষক, ছাত্র ও অভিভাবকদের সমন্বয়ে ‘শিক্ষা সোভিয়েত’। এই সোভিয়েতের সমন্বয়ের কাজ কমিশারেট করবে, এর মধ্যেই তার ভূমিকা সীমাবদ্ধ। কমিশারেট কোনও একক মডেল চাইছে না। রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পরিস্থিতি আলাদা, চাহিদাও আলাদা। যত ভিন্ন ভিন্ন ধরণের স্কুল হয়, ততই ভালো। কোনও একক মডেলের প্রয়োজন নেই। প্রদেশ থেকে জেলা স্তর পর্যন্ত যে শিক্ষা সোভিয়েতগুলো গড়ে উঠবে তারাই পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে কি প্রকার শিক্ষানীতি প্রয়োজন। প্রথম সর্ব-রাশিয়া শিক্ষা কংগ্রেসে প্রদত্ত ভাষণে লুনাচার্‌স্কি জোর দিয়ে বলেন, ‘উৎপাদন-উপায়ের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানের মালিকানা আয়ত্ত করলেই জনগণের সর্বক্ষমতার অধিকারী হিসাবে মানুষ নিজেকে জয়ী ভাবতে পারে।’ গণমুক্তির আদতে তিনটি ধারা রয়েছে – ১) সরকারী ক্ষমতা, ২) অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং ৩) সংস্কৃতি ও জ্ঞানের ক্ষমতা। সর্বহারাকে এই তিনটি-ই অধিকার করতে হবে মুক্তি অর্জনের জন্য। রাজনৈতিক ক্ষমতা নভেম্বর বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণি অধিকার করেছে। অর্থনৈতিক ক্ষমতা এখনও পরিপূর্ণ অধিকার করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু প্রচেষ্টা চলছে পূর্ণ উদ্যমে। অবশিষ্ট রয়ে গেছে সর্বহারা শ্রেণির সংস্কৃতি ও জ্ঞানকে নিজেদের আয়ত্তে আনার প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টা সফল করতে পারবে শিক্ষা সোভিয়েতের মতো সংগঠনগুলিই, যারা সমাজতান্ত্রিক জ্ঞানদীপ্তির আদর্শ ছড়িয়ে দেবে সোভিয়েত রাশিয়ার গ্রামে গ্রামে।

কিন্তু অচিরেই এটা স্পষ্ট হয়ে গেছিল, রুশ বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধের বিশৃঙ্খলার পরিস্থিতিতে এই আদর্শবাদী শিক্ষার মডেল কার্যকর করা অতিব কঠিন। ভাবা হয়েছিল, তৃণমূল স্তর থেকে উঠে আসা শিক্ষা সোভিয়েত ঊর্ধ্বতন কোনও কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়াই পরিচালিত হবে এবং এলাকা ভিত্তিক চাহিদা অনুসারে শিক্ষা নীতি গড়ে তুলবে। দুঃখের বিষয় ভোলগা অঞ্চল পরিদর্শন করার সময় নাদেজদা ক্রুপস্কায়া নারকমপ্রোস-এর সহকর্মীদের যে চিঠিপত্র পাঠান, তার থেকেই স্পষ্ট এই আদর্শবাদী ভাবনার কোনও বাস্তব প্রতিফলন দেখা যাচ্ছিল না। স্থানীয় সোভিয়েতগুলি শিক্ষা সোভিয়েত গড়ে তুলতে একেবারেই আগ্রহী নয়। স্থানীয় বলশেভিক পার্টি নেতারাও গৃহযুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত। শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে কোনও রাজনৈতিক সহায়তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা করছেন না। স্কুলগুলির শিক্ষকরা হয় সোভিয়েত শিক্ষানীতির সঙ্গে অসহযোগিতা করছেন, নয়তো নতুন কাঠামো রূপ কিরকম হবে তা বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন না। অনেকেই প্রত্যাশা করছেন আগের ব্যবস্থা ফিরে আসবে, অর্থাৎ শিক্ষা দপ্তর থেকে নির্দেশ আসবে আর তাঁরা তা বাস্তবায়িত করবেন। নারকমপ্রোস বিদ্যালয় মুক্ত শিক্ষার নীতি ঘোষণা করেছিল। অর্থাৎ শিক্ষা শুধু বিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। রঙ্গমঞ্চ, পাঠাগার, সংগ্রহশালা – এগুলিও হবে শিক্ষার কেন্দ্র। গ্রীষ্মকালে বিদ্যালয়ের সাধারণ পাঠদানও চার দেওয়াল্-এর বাইরে নেওয়ার কথা বলা হয়। দৈহিক শাস্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল নাচ, গান, নাটকের মাধ্যমে শেখানোর কথা। কিন্তু লুনাচার্‌স্কি দুঃখের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেন, এই সব নীতি গ্রামীণ রাশিয়ায় একেবারেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। যাজকরা, যারা আগে শিক্ষাপ্রদানের দায়িত্বে ছিলেন, শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে ধর্মের পৃথকীকরণের সূত্র মেনে তাঁদের কর্মচ্যুত করা হয়েছিল। এতে অধিকাংশই নতুন সোভিয়েত সরকারদের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁরা কৃষকদের মধ্যে প্রচার করছেন, খ্রিস্ট ভক্ত বাধ্য ছেলেমেয়ে-দের জায়গায় নতুন নাস্তিক শিক্ষাব্যবস্থা মুখে মুখে বড়োদের সঙ্গে তর্ক করা এক নতুন প্রজন্ম তৈরি করতে চায়, যারা স্কুলে গিয়ে শুধু নাচ-গান শিখবে, কাজের কাজ কিছুই শিখবে না। এই প্রচার কৃষক শ্রেণির একটি বড়ো অংশকে সোভিয়েত গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি বিরূপ করে তুলছে। তারা নতুন স্কুলে ছেলেমেয়েদের আর পাঠাতে চাইছেন না।   

প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার এই সংকটের মোকাবিলা কিভাবে করা যায়, সেই বিতর্কে লুনাচার্‌স্কির ভাবনার বিরুদ্ধে দুটি প্রধান ধারা দেখা যায়। দুটিই মস্কোকেন্দ্রিক ধারা ছিল। একটি ধারার বক্তব্য ছিল, নারকমপ্রোস-এর প্রস্তাবিত ‘সমন্বিত শ্রম স্কুল’ মডেল পূর্বতন শিক্ষাকাঠামো থেকে যথেষ্ট প্রগতিশীল হলেও মূলগত বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে না। তাঁরা ‘কমিউন-স্কুল’-এর ধারণার কথা বলেন, যেখানে গ্রামের ছেলেমেয়েরা শুধু স্কুলে পড়বেই না, স্কুল সংলগ্ন কমিউনে থাকবেও। এই কমিউনে একত্রে থাকা ও একত্রে শ্রমদানের মাধ্যমে তাদের মধ্যে যৌথতার আদর্শ আরও দৃঢ় হবে এবং সমাজতান্ত্রিক মানসিকতা গড়ে উঠবে। শ্রমের মাধ্যমে শিক্ষার এই আদর্শে টলস্টয়ের সুদীর্ঘ ছায়া ছিল। পরবর্তীকালে আন্তন মাকেরেঙ্কো ইউক্রেনে একটি সার্থক ‘কমিউন-স্কুল’ গড়ে তুলে এই আদর্শ যে বাস্তবেও প্রয়োগ করা সম্ভব, তা প্রদর্শন করেন। আরেকটি ধারার বক্তব্য ছিল, বড্ড দ্রুত বড্ড বিপ্লবী পদক্ষেপ নেওয়ার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। সোভিয়েত দেশে এখন শিক্ষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় নয়। নারকমপ্রোস-এর পূর্বতন ব্যবস্থাই সংস্কারের প্রচেষ্টা করা উচিৎ, নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে এত অর্থ ও পরিশ্রম ব্যয় না করে। প্রথম ধারার বিপক্ষে লুনাচার্‌স্কির বক্তব্য ছিল, ক্ষেত্র বিশেষে এই প্রকার কমিউন-স্কুল গড়ে তোলা সম্ভব হলেও, এটি কখনও কোনও মডেল হতে পারে না। কারণ গ্রামাঞ্চলে কৃষক পরিবার যেখানে সাধারণ সোভিয়েত স্কুলের প্রতিই সন্দেহ পোষণ করে, তখন তাদের ছেলেমেয়েদের তারা নতুন কোনও প্রকার আবাসিক স্কুলে পাঠাবে এমন আশা করা যায় না। তাছাড়া এইপ্রকার ‘কমিউন-স্কুল’ দৈহিক শ্রমের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান করে, যা শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব আনতে পারে। দ্বিতীয় ধারার বিপক্ষে বলতে গিয়ে তিনি মনে করিয়ে দেন, পূর্বতন শিক্ষাব্যস্থা ছিল সম্পূর্ণ শ্রেণি বিভাজিত এক ব্যবস্থা যেখানে খুব নিম্নমানের প্রাথমিক শিক্ষা সাধারণ জনগণের নাগালের মধ্যে ছিল। তা ব্যতীত মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক, উচ্চ পেশার জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা সবই ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। সেই কারণেই নতুন সোভিয়েত ব্যবস্থা এই পূর্বতন শিক্ষা ব্যবস্থাকে বজায় রাখতে পারে না, কারণ এই শ্রেণিবিভক্ত কাঠামো সংস্কারের ঊর্ধ্বে। নারকমপ্রোস নতুন ধরণের সমন্বিত শ্রম স্কুল এই প্রকার শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষা ভেঙে ফেলে সকল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ছাত্রছাত্রীদের সম সুযোগ দেওয়ার প্রচেষ্টা করছে। লুনাচার্‌স্কি বলেন, এইটুকুও যদি নতুন সোভিয়েত শিক্ষাব্যবস্থা না করতে পারে, তাদেরকে আবার যদি জারিস্ট আমলের শিক্ষাব্যবস্থার দিকেই পিছিয়ে যেতে হয়, তাহলে তাঁদের একটি শিক্ষা দপ্তরকে বিপ্লবী বলার কোনও অধিকারই থাকে না।

দুই পর্বে প্রকাশিত প্রবন্ধ

দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল

Spread the word