Site icon CPI(M)

Stalin: As Scientist (Part II)

stalin o bigyan bhabna

ওয়েবডেস্কের পক্ষে মুখবন্ধ

আজকের ভারতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জগতে প্রতিদিন যে কায়দায় উগ্র-দক্ষিনপন্থী রাজনীতি নিজেদের হাত শক্ত করছে, ইতিহাসের চূড়ান্ত বিকৃতি সাধনের মাধ্যমে অতীত গৌরব পুনরুদ্ধারের নামে আসলে স্বাধীন ভারত নির্মাণের ভাবনাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে, রাজনৈতিক পরিসরে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির গুরুত্বকে আমাদের সেই প্রেক্ষিতে উপলব্ধি করতেই হবে। জে ভি স্তালিন শুধু রাশিয়ার নেতা ছিলেন না, এক অভুতপূর্ব ভূ-রাজনৈতিক সংকটের সময়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন গোটা দুনিয়ায় মুক্তিকামী জনসাধারণের নেতা। এমন অসাধারণ অর্জনের গভীরতায় কোন সার্বিক ভাবনা ছিল যার জোরে সোভিয়েত ইউনিয়ন একদিকে ফ্যাসিবাদের বর্বর সামরিক আক্রমণ প্রতিহত করেছিল, আরেকদিকে মুছে যাওয়ার মুখ থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনে বিশ্বের দরবারে ‘সমাজতান্ত্রিক দেশ’ হিসাবে নিজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? এর উত্তর খুঁজতে শুধু রাজনীতি কিংবা বিচ্ছিন্ন করে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আলোচনা করলে চলে না। মার্কসবাদী হিসাবে স্তালিনের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব এই যে তিনি শুধুই পুঁজিবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে মার্কসবাদ’কে প্রতিষ্ঠা করেননি, বাইরের সংগ্রামে বিজয়ের পাশাপাশি ভিতরের লড়াইতেও (মার্কসবাদী মহলের অভ্যন্তরীণ বিতর্ক) বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতাদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে তিনি ছিলেন অজেয়। তাই স্তালিন, আর তাই স্তালিন ও তাঁর বিজ্ঞানভাবনা।

স্তালিন অ্যাজ সায়েন্টিস্ট শিরোনামে দ্য মর্ডান কোয়াটার্লি রিভিউ পত্রিকা (১৯৫৩ সাল, Vol. 8- No. 3) বিখ্যাত ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জে ডি বার্ণাল-র এই প্রবন্ধটি প্রকাশ করে। বর্তমান প্রবন্ধটি তারই ভাষান্তর। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছিলেন আয়েষা আখতার, আমরা জরুরী কিছু সম্পাদনা করেছি, সম্পূর্ণ লেখাটি তিন পর্বে প্রকাশিত হল। বাংলা শিরোনাম ওয়েবডেস্কের নিজস্ব।   

জে ডি বার্ণাল

তিফলিসের মানমন্দিরে (অবজারভেটরি) একজন পর্যবেক্ষণ এবং গণক হিসেবে কাজ করা ছাড়া বিজ্ঞানের সঙ্গে স্তালিনের সরাসরি পেশাগত কোনও যোগাযোগ ছিল না, তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে তিনি সর্বদা এক সক্রিয়, কার্যকরী আগ্রহ বজায় রেখেছিলেন। সেই অগ্রগতির প্রয়োজন এবং সংশ্লিষ্ট সমস্যা সম্পর্কে তার ধ্যানধারণাই সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞানের উদ্ভাস এবং রূপান্তরের ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে গুরুত্বপূর্ণ ওঠে। ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস’ গ্রন্থে ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’ নামক যে অধ্যায়টি স্তালিন লিখেছিলেন তা তাঁর উপলব্ধির ব্যাপ্তি এবং তাকে উপস্থাপিত করার ক্ষেত্রে তাঁর নৈপুণ্যের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। এ হল সেই নৈপুণ্য যা ছেচল্লিশ বছর আগে লিখিত ‘নৈরাষ্ট্রবাদ এবং সমাজতন্ত্র’ গ্রন্থে তিনি প্রথম দেখিয়েছিলেন। বিশ্বজগৎ এবং সমাজের বিকাশ সম্পর্কে মার্কস, এঙ্গেলস এবং লেনিনের লেখায় বিভিন্ন স্থানে এবং প্রায়ই জটিলভাবে প্রকাশিত ধারণাগুলি এতে রীতিমত সহজ এবং যুক্তিগ্রাহ্যভাবে পেশ করা হয়েছে। এমন কার্যকরী সরলতা আমাদের জন্য এক রহস্য বিশেষ। এর স্বল্প পরিসরে রয়েছে বিভিন্ন ধারণা এবং সূত্রায়ন যা বারবার পড়া উচিত, তা থেকে নতুন অনেক চিন্তা এবং বাস্তব প্রয়োগ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। সামাজিক ইতিহাসের বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যগুলি বিশেষভাবে চমকপ্রদ, এ বিজ্ঞান ‘সমাজজীবনের ঘটনাবলির সমস্ত জটিলতা সত্ত্বেও যে কোনো বিজ্ঞান, যেমন, বলা যেতে পারে, জীববিজ্ঞানের মতো সুনির্দিষ্ট হয়ে উঠতে পারে এবং সমাজবিকাশের সূত্রগুলিকে বাস্তবে ব্যবস্তুর করার ক্ষেত্রে সমর্থ হতে পারে’ (লেনিনবাদ, পৃষ্ঠা-৬৬১)। এখানেও আমরা আদর্শগত উপরিকাঠামোর চরিত্র সামাজিক চিন্তার গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁর ভাবনার সাক্ষর পাই যা পরবর্তীকালে তাঁর ভাষাবিজ্ঞানে মার্কসবাদ প্রসঙ্গে (Conserning Marxism in Linguistics) গ্রন্থে আরও বিকশিত হয়েছিল- ‘সমাজের বস্তুগত জীবনযাত্রা সমাজের সামনে নতুন ইতিকর্তব্য স্থির করে দেওয়ার পরেই কেবলমাত্র নতুন সামাজিক চিন্তা এবং তত্ত্বগুলি জন্ম নেয়। কিন্তু একবার জন্ম নিলেই তা সবচেয়ে একটি শক্তি হয়ে দাঁড়ায়, যা সমাজের বস্তুগত জীবনের বিকাশের ফলে স্থিরীকৃত নতুন কর্তব্যগুলিকে সম্পাদন করার ক্ষেত্রে সাহায্য করে, আর সমাজের প্রগতিতে সহায়তা করে। ঠিক এখানেই নতুন ভাবনা, নতুন তত্ত্ব, নতুন রাজনৈতিক মত এবং নতুন রাজনৈতিক সংস্থার সাংগঠনিক, সংহতিকরণের এবং রূপান্তরের বিশাল মূল্য প্রকাশ পায়। নতুন সামাজিক চিন্তা এবং তত্ত্বগুলি জন্ম নেয় তাদের সামাজিক প্রয়োজনীয়তার কারণেই, জন্ম নেয় কারণ, এদের সাংগঠনের, সংহতির এবং রূপান্তরের ক্ষমতা ছাড়া সমাজের বাস্তব জীবনের বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি করা সম্ভব নয়। সমাজের বাস্তব জীবনের অগ্রগতির কর্তব্য থেকে উদ্ভূত এই চিন্তা এবং তত্ত্বগুলি তাদের রাস্তা করে নেয়, জনসাধারণের সম্পদ হয়ে ওঠে, সমাজের মুমুর্ষু শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে তাদের সংহত এবং সংগঠিত করে এবং এইভাবে সমাজের বস্তুগত জীবনের বিকাশের ক্ষেত্রে বিঘ্নসৃষ্টিকারী শক্তিসমূহের উচ্ছেদে সাহায্য করে’ (লেনিনবাদ, পৃষ্ঠা-৬০৩)। দক্ষতার সাথে মার্কসবাদ আয়ত্ত করার সূচনাপর্ব থেকে স্তালিন সর্বদাই প্রাকৃতিক এবং সামাজিক বিকাশ সম্পর্কে এক গতিশীল উপলব্ধি বজায় রেখেছিলেন।

বিকাশমান সামাজিক শক্তির বিজয় এবং ক্ষয়িষ্ণু শক্তির পরাজয় বিষয়ে তিনি নজর রাখতেন এবং এ বিষয়ে তাঁর আস্থা দৃঢ় ছিল, তা সময় বিশেষে তাদের আপাত ক্ষমতা যাই হোক না কেন। অনেকদিন আগে, ১৯০৬ সালে তিনি লিখেছিলেন- ‘জীবনে যা জন্ম নেয় এবং দিনে দিনে বেড়ে চলে, তা অপরাজেয়, তার বিকাশ বোধ করা যায় না। অর্থাৎ, উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, যদি শ্রেণি হিসেবে প্রলেতারিয়েত জন্ম নেয় এবং বেড়ে ওঠে তাহলে সে আজ যতই দুর্বল বা সংখ্যায় যত কমই হোক না কেন, ভবিষ্যতে তার জয় অবশ্যম্ভাবী। কেন? কারণ, সে বাড়ছে, শক্তি সঞ্চয় করছে এবং এগিয়ে চলেছে। পক্ষান্তরে, বাস্তবজীবনে যা বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে এবং কবরের দিকে যাত্রা করেছে তা পরাজিত হবেই, এমনকি আজ তাকে দেখে যদি এক বিশাল শক্তি মনে হয়, তাহলেও। অর্থাৎ, উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, যদি বুর্জোয়াদের পায়ের তলার মাটি ক্রমশ সরতে আরম্ভ করে এবং তা প্রতিদিন আরও সরে যায় তাহলে আজ তারা যতই শক্তিশালী আর অসংখ্য হোক না কেন, ভবিষ্যতে তার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। কেন? কারণ, শ্রেণি হিসেবে তারা ক্ষয়িষ্ণু, প্রতিদিন আরও দুর্বল প্রাচীন হয়ে পড়ছে এবং জীবনের ক্ষেত্রে এক বোঝাস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে’।

নৈরাষ্ট্রবাদ না সমাজতন্ত্র? জোসেফ স্তালিন, ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ পাবলিশিং হাউস, মস্কো, ১৯৫০

বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এই বিশ্বাসই ভরসা না হারিয়ে উপর্যুপরি বিপদকে অতিক্রম করতে সাহায্য করেছিল।

মার্কসবাদের এই ব্যাখ্যা অবশ্য শুধুই এক নিউক্লিয়াস মাত্র, যাতে স্তালিন নিজস্ব তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক অবদান যুক্ত করেছিলেন। তার মধ্যে প্রধান অবদানটি ব্যক্তি স্তালিন এবং এক দেশে সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গেই মানানসই, এককথায়-  জনগণের সাথে থেকে শেখা। এমন শেখার ক্ষমতাই ছিল কার্যক্ষেত্রে স্তালিনের সাফল্যের গোপন চাবিকাঠি। তাঁর প্রথম রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মাঝেই এই শিক্ষার সূচনা। ‘তিফলিসের শ্রমিকরাই ছিলেন আমার প্রথম শিক্ষক’ (প্রাভদা, ১৬ জুন, ১৯২৬) এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক সমস্যা (ইকনমিক প্রব্লেমস অফ সোস্যালিজম ইন দ্য ইউ এস এস আর) থেকে দেখা যায় যে, জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁর সেই অভ্যাস বজায় ছিল। উপকথার দৈত্য অ্যান্টিযুসের (যে অ্যান্টিযুসের জননী ছিল পৃথিবী। তাই মাটির উপর পা রাখলে তবেই সে নিজের শক্তি ধরে রাখতে পারত) সাথে বলশেভিকদের যে বিখ্যাত তুলনা তিনি টেনেছিলেন, এ ছিল তারই ভিত্তি, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের মা, অর্থাৎ জনগণের সাথে সংযোগ বজায় রাখবে, ততক্ষণ অবধি তাদের অপরাজেয় থাকার সুযোগও থাকবে’।

সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক) ইতিহাস, পৃঃ ৩৬৩

Spread the word