Site icon CPI(M)

Share Market, India and the People: A Report

Economic Crisis in India

বাবিন ঘোষ

প্রেক্ষাপট

৩রা জুন, ২০২৪।

দেশের তাবৎ সব এক্সিট পোলে জানিয়ে দেওয়া হল’ যে বিজেপি একক দল হিসাবেই ৪০০ আসন পেতে চলেছে! কিছু বিশষজ্ঞ আবার খানিকটা সাবধানি হয়ে বললেন ‘নেহাত যদি ৪০০ পার নাও করে, ৩৫০ পেরোবে তো বটেই’। শেয়ার মার্কেটের সূচক হু হু করে বেড়ে গেল।

৪ঠা জুন, ২০২৪।

বিজেপি কোনো মতে ২৪০ ছুঁতে পারল। বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পরাজয় ঘটল, ইন্ডিয়া জোট ভোট বিশেষজ্ঞদের প্রত্যাশার চাইতে অনেক বেশি আসনে জয়ী হল। শেয়ার বাজার সেদিন দুপুর দেড়টা অবধি প্রায় ৯% ধ্বসে গেল, যদিও তার পরের দুই ঘন্টায় প্রায় ৪% উঠল।

৫ই জুন-৭ই জুন।

বিজেপি’র প্রায় ভুলে যাওয়া এনডিএ জোট সঙ্গী নীতিশ কুমার আর চন্দ্রবাবু নাইডু’র সমর্থনে ভর করে ‘মোদী সরকার’র বদলে ‘এনডিএ সরকার’ গঠন হল’। জাতীয় রাজনীতিতে প্রায় এক দশক বাদে আবার ‘এনডিএ’ শব্দবন্ধটি শোনা যেতে শুরু করল’। শেয়ার বাজার ৪ঠা জুনের যাবতীয় ধ্বস-কে ছাপিয়ে আবারো চাঙ্গা হয়ে উঠল।

প্রশ্ন হল শেয়ার বাজার ৩রা জুন কী পেয়েছিল? ৪ঠা জুন কী হারিয়েছিল দুপুর দেড়টা অবধি?

তারপর থেকে আজ অবধি আবার নতুন করে ঠিক কী পেল?

দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তিগুলো তো নিশ্চই এই কদিনে খুব কিছু বদলায় নি! খুব নতুন কিংবা অভূতপূর্ব সরকারি সিদ্ধান্ত’ও নেওয়া হয়নি অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই ক’দিনের মধ্যে, বিশ্বঅর্থনীতিরও বিরাট কিছু পরিবর্তন হয়নি। তাহলে ভারতের শেয়ার বাজারের এই মারাত্মক নাটকীয়তাকে কীভাবে বিবেচনা করা যায়?

জেনে রাখা ভালো

১। মার্চ ২০২০ তে এদেশের মিউচুয়াল ফান্ডের ফোলিও সংখ্যা (কোনো একটি নির্দিষ্ট স্কীমে একজন ব্যাক্তির বিনিয়োগ কে একটি ফোলিও ধরা হয় যা সরল ভাবে বলতে গেলে ব্যাঙের একটি একাউন্টের সাথে তুলনীয়) ছিল’৮.৯৭লক্ষ কোটি। মার্চ ২০২৪-এ ফোলিওর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭.৭৯ লক্ষ কোটি। অর্থাৎ বিগত মাত্র ৪ বছরে ফোলিওর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুন হয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের অঙ্কটা ৩১শে মে ২০১৪ সালে ছিল ১০.১১ লক্ষ কোটি ভারতীয় মুদ্রা। ৩১শে মে ২০২৪ সালে (মানে ঠিক এক দশকের মাথায়) এই বিনিয়োগের অঙ্কটা দাঁড়িয়েছে ৫৮.৬০ লক্ষ কোটি টাকায়। অর্থাৎ বিগত ১০ বছরে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ বেড়েছে প্রায় ৬ গুন।২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ভারতে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা সাড়ে চার কোটি ছুঁইয়ে ফেলে যা কিনা গত বছরের এপ্রিল মাসের তুলনায় ১৯% বৃদ্ধি পেয়েছে। শেয়ার মার্কেটের বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বর্তমান ভারতে প্রায় ১৩ কোটির কাছাকাছি, যা কিনা দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯%। এই সংখ্যাও বিগত ৫-৬ বছর আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন হয়েছে। ২৫-৩৫ বছর বয়ঃসীমার মধ্যের অংশ সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। এই মুহূর্তে ভারতের শেয়ার বাজারে নিট বিনিয়োগের প্রায় ৮.৫% খুচরো বিনিয়গকারীদের, অর্থাৎ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের। শেয়ার বাজারে এই শ্রেণীর অংশগ্রহণ বিগত এক দশকে দ্বিগুনের বেশি বেড়েছে। ৩রা জুনের শেয়ার বাজারের দুরন্ত চাঙ্গা ভাব ঘটে ফরেন পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারীদের তরফে বিপুল লগ্নীর কারণে এবং ৪ঠা জুনের বাজারের বিপুল ধ্বস ঘটে এই অংশেরই লগ্নী স্থানানন্তরের ফলে (প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা ভারতের শেয়ার বাজার থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়), কারণ বৈদেশিক পুঁজি নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপির একচ্ছত্র রাজনৈতিক আধিপত্য খর্ব হওয়া দেখে আশঙ্কিত হয়েছিল। ৪ঠা জুনের শেষ বেলা থেকে শুরু করে ৫-৬ জুনের মধ্যেই শেয়ার বাজারের সূচক আবারো আগের অবস্থায় পৌছে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল খুচরো বিনিয়োগকারীদের তরফে বিপুল বিনিয়োগ ঘটায় (প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা)।

২। ২০১১-১২ অর্থবর্ষে ব্যাঙ্কের দীর্ঘমেয়াদী আমানতের উপর প্রায় ৯/৯.২৫% হারে সুদ পাওয়া যেত’। ২০১৪ সালে সেটা দাঁড়ায় ৮.৫-৮.৭৫%। সময়ের সাথে সেই সুদের হার কমতে কমতে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে সেটা ৫-৫.২৫% এ এসে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ২০১০-১১ সময়ের তুলনায় তার ঠিক দশ বছর বাদে সরকারী সিদ্ধান্তে সুদের হার কমে যায় প্রায় ৪৫% এর কিছু বেশি। ২০২১-২২ অর্থবর্ষের তুলনায় নেহাৎ-ই দায়ে পড়ে খানিকটা বাড়িয়ে সুদের হার বর্তমানে ৬.৫-৭.১% এ দাঁড়িয়েছে।  পোস্ট অফিসের দীর্ঘমেয়াদী আমানতের ক্ষেত্রেও সুদের হার ব্যাঙ্কের কাছাকাছি ছিল এই সময়কালে। ভবিষ্যনিধি প্রকল্প (প্রভিডেন্ট ফান্ড) থেকে প্রাপ্ত সুদের (বার্ষিক আড়াই লক্ষ টাকার উপরে হলে) উপর আয়কর বসানো হয় বিজেপি সরকারের আমলে গত দশ বছরে। ব্যাঙ্ক আর পোস্ট অফিসের থেকে প্রাপ্ত সুদ আগে থেকেই আয়করের আওতায় ছিল, যা অপরিবর্তিত রাখা হয় এই সরকারের সময়কালে। সরকারি/ রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রে পেনশন ব্যবস্থা দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমল থেকেই তুলে দেওয়া হয়েছিল, তাও অপরিবর্তিত থেকে যায় এই সরকারের আমলে। যদিও কংগ্রেস বিভিন্ন রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে জিতে পুরনো ধারার পেনশন ব্যবস্থা আবারো ফেরত আনতে উদ্যোগী হয়েছে।

৩। ১৯৮০ সালের পর থেকেই দেশের মোট রাজস্ব আদায়ে প্রত্যক্ষ করের ভাগ বাড়ছিল। কিন্তু সেই ধারা বিগত এক দশকে উলটো পথে চলতে শুরু করে। ভারত সরকারের রাশিবিজ্ঞান দপ্তরের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০১১-১২ অর্থবর্ষে প্রত্যক্ষ করের সাথে অপ্রত্যক্ষ করের অনুপাত ছিল ৫৫.৮% এবং ৪৪.২%। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ভারতে প্রত্যক্ষ কর আদায় মোট রাজস্ব আদায়ের ৫১.৫% ছিল, অর্থাৎ অপ্রত্যক্ষ কর (আর্থিক লেনদেন/ বেচাকেনার ওপর আরোপিত কর) মোট ৪৮.৫% রাজস্বের যোগান দেয়। প্রত্যক্ষ করের অনুপাত এতখানি কমে যাওয়ার পেছনে মূল কারনটাই হল’ মোদী সরকারের আমলে ঢালাও কর্পোরেট ট্যাক্সে ছাড়। অর্থাৎ যে প্রত্যক্ষ কর আজ দেখা যাচ্ছে, তার ও বিরাট অংশ (প্রায় ৬০%) এসেছে চাকরিজীবি মানুষের উপর বসানো আয়করের থেকে। তদুপরি অপ্রত্যক্ষ কর থেকে ৪৮.৫% আয়ের মানে দাঁড়ায় আয়করের আওতাতেই আসেন না, অর্থাৎ দেশের বিপুল পরিমাণ গরিব/ নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উপর আরোপিত করের পরিমাণ গত এক দশকে বিপুল ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

৪। দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার ২০১৪ সালে ছিল ৬.৬৭% এবং বর্তমানে তা প্রায় ৬.৭০%। অর্থাৎ “বহুত হুই মেহেঙ্গাই কা মার” ইত্যাদি ভাষণবাজির পরেও মূল্যবৃদ্ধির হার কমাতে ব্যর্থ হয়েছে মোদী সরকার বিগত ১০ বছরে। ২০২১ সালে ৫.৩১% এ মুদ্রাস্ফীতির হার কিছুটা নেমে আসার কারণটা কোনো সরকারি সাফল্য নয়, বরং কোভিড অতিমারির ফলে সাধারণ মানুষের আয় বিপুলভাবে কমে যাওয়ার কারণে চাহিদা হঠাৎ-ই কমতে বাধ্য হওয়ায়।

৫। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী ভারতে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ২০১১-১২ সালে ছিল ২.৭৫%। মোদী সরকারের আমলে সেটা বাড়তে বাড়তে ২০১৮ সালে ১১% পার করে যায়। বর্তমানে তা প্রায় ৩.৮%। অনাদায়ী ঋণের গত ৬ বছরে এই কমে যাওয়া যতখানি না ঘটেছে ঋণ উশুল করার মাধ্যমে, তার চেয়ে বেশি ঘটেছে অনাদায়ী ঋণ মকুবের মাধ্যমে। বলাই বাহুল্য যে ঋণখেলাপীদের সিংহভাগ-ই কর্পোরেট সংস্থাসমূহ এবং সবচেয়ে বেশি অনাদায়ী ঋণের বোঝা বইতে হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কগুলিকেই।

৬। এনডিএ জোটে বিজেপির সহযোগী আঞ্চলিক দলগুলির কোন রকম বিরোধীতা নেই বিজেপির আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে।

ভারতে উগ্র-দক্ষিণপন্থী অর্থনীতির অভিমুখ

ঐতিহাসিকভাবে দুনিয়া জুড়েই সাবেকি দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রশক্তির অর্থনীতির অভিমুখ থেকেছে একদিকে দেশের বাইরে ঔপনিবেশিক শোষণ-লুন্ঠন আর দেশের অভ্যন্তরে খেটে খাওয়া মানুষের উপর করের বোঝা চাপানো। মোটামুটি সপ্তদশ শতক থেকে এই ধারায় পরিচালিত্ ইউরোপীয় দক্ষিণপন্থী অর্থনীতির ধাঁচ বদলে যায় গত শতকের মধ্যভাগ থেকে। সোভিয়েত রাশিয়ার চোখ ধাঁধানো আর্থিক/ সামরিক উত্থান, দুনিয়া জুড়ে জাতীয় মুক্তিকামী সংগ্রাম একদিকে সাবেকি ঔপনিবেশবাদ এবং অন্যদিকে নির্লজ্জ আভ্যন্তরীণ লুন্ঠনের সমাপ্তি ঘটায়। প্রয়োজন হয়ে পড়ে লুঠের নতুন পদ্ধতির। প্রযুক্তির যুগান্তকারী যে উল্লম্ফন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পর ঘটে, তার হাত ধরেই খুলে যায় আদিম আত্মসাতের আধুনিক এক অধ্যায়। সোভিয়েত ব্যবস্থার রাজনৈতিক মোকাবিলার প্রয়োজনে সামাজিক সুরক্ষার যে সকল ব্যবস্থা উন্নত দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রশক্তিগুলি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, ১৯৪৫ সাল পরবর্তী তিনটি দশকের পুঁজিবাদের উল্লম্ফনে অনেকখানি ভূমিকা সেসবের ও রয়েছে। ত্রিশ বছর সময়কালের মধ্যে পর পর দুটি মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ১৯৪৫-১৯৭৫ সময়কালের মধ্যে আবারো ঘুরে দাঁড়ায় মূলতঃ সকল প্রকার প্রযুক্তির বিপুল অগ্রগতি এবং দুনিয়া জুড়েই বিংশ শতকের প্রথমার্ধের তুলনায় দ্বিতীয়ার্ধে জাতিরাষ্ট্রগুলির তরফে অনেক বেশি সামাজিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ফলে। সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন পুনরুত্থিত পুঁজিবাদের জন্য ওয়াক-ওভার হয়ে যায়। ঠিক এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণেই এক দিকে যেমন রেগান-থ্যাচারদের উত্থান ঘটে, অন্য দিকে নরসিংহ রাও-মনমোহন সিংহ’দের ও উত্থান হয়। ‘রেগানমিক্সের’ সূত্র মেনেই জাতীয় সঞ্চয়ের বড় অংশকে শেয়ার বাজারের দিকে চালিত করার স্পষ্ট নীতি গ্রহণ করা হতে থাকে। ফিরে আসতে শুরু করে উদারবাদ (অর্থাৎ রাষ্ট্র কোনো রকম ‘চুক্তির স্বাধীনতায়’ হস্তক্ষেপ করবে না) নতুন রূপে। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্র যা দুনিয়া জুড়ে গড়ে উঠেছিল একদিকে মহাযুদ্ধের চাহিদার যোগান দেওয়ার তাগিদে এবং অপর দিকে সদ্য স্বাধীন দেশগঠনের লক্ষ্যে, সেগুলির থেকে জাতিরাষ্ট্রের পিছিয়ে আসার প্রক্রিয়া, মানে, সরকারের মালিকানা বেসরকারি ব্যক্তিপুঁজির হাতে বেচে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় প্রায় সাড়ে তিন দশক আগের থেকেই। ‘রেগানমিক্সের’ এক ধ্রুপদী (এবং দুরভষন্ধিমূলক) লাইন কয়েক মাস আগেও নরেন্দ্র মোদী সংসদে আওড়ান “সরকারের কাজ ব্যবসা বাণিজ্য করা নয়”। মানে, বাণিজ্য বা উৎপাদন বিষয়টাই ব্যাক্তিমালিকানাধীন থাকতে হবে।

ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসার পুঁজির যোগান কোত্থেকে আসবে? সংশ্লিষ্ট পুঁজিপতি নিজের পকেট থেকে এই টাকা দেবে? না। দুটি উপায়ঃ এক, ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সুদের বিনময়ে ঋণ নেওয়া আর দুই, শেয়ার বাজার থেকে টাকার উপায় করা। ব্যাঙ্ক ঋণ নিলে তা সুদসমেত ফেরত দেওয়ার একটা আইনি দায় থেকেই যায়। সেই দায় থেকে  মুক্তি পাওয়া সম্ভব ঋণের বদলে কোম্পানীর কিছু শেয়ার বাজারে বিক্রী করে। শেয়ারহোল্ডারদের কোনো অধিকার নেই কোম্পানীর থেকে শেয়ারের দাম আদায় করার, কারণ সেই দাম অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী খোলা বাজারের চাহিদা-যোগানের ওঠানামার মধ্য দিয়ে স্থির হয়। শেয়ারের দাম ওঠানামার উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না সরকারের, কাজেই সরকারের ও কোনো আইনি দায় নেই এ ক্ষেত্রে। ফলতঃ ব্যক্তিমালিকানাধীন বাণিজ্যের পুঁজির যোগানের জন্য শেয়ার বাজারের চাইতে সুবিধাজনক বন্দোবস্ত আর কিছু হয়না পুঁজিবাদের কাছে। এবারে, সেই বাজারে যথেষ্ট পরিমাণ পুঁজির যোগান বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগকারীদের। ভারতের মত তুলনামূলক ভাবে খানিক গরিব/ উন্নয়নশীল দেশে এই সংখ্যক বিনিয়োগকারী পাওয়া যাবে কী করে? এখানেই আগের পরিচ্ছেদে আলোচিত ২, ৩ এবং ৪ নং প্যারাগ্রাফের তথ্যের ভুমিকা রয়েছে। অর্থাৎ সরকারকে পরিকল্পিতভাবে ব্যাংক, পোস্ট অফিস বা প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে প্রাপ্য সুদ কে কমিয়ে আনতে হবে যেন তেন প্রকারেণ এবং সেই সুদের হার যাতে মুদ্রাস্ফীতির হারের নীচে থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ মানুষের সঞ্চিত অর্থ হতে যে আয় (সুদ) তা মুদ্রাস্ফীতির কারণেই রিয়েল-ইনকামের নিরিখে কমতে কমতে আসল আমানতের মূল্যমানের-ই ক্ষয় ঘটাতে থাকবে। সে ক্ষেত্রে মানুষের কাছে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা বাদে আর কোনো উপায় থাকবে না তার উপার্জিত অর্থের মূল্যমানের ক্ষয়টুকু আটকানোর জন্য। বর্তমান যে কর্মক্ষম প্রজন্ম এ দেশে রয়েছে (১৮-৪৫ বয়ঃসীমার মধ্যে), তাদের মধ্যে ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিস সম্বন্ধে ব্যাপক অনীহা সৃষ্টি করা গেছে ধারাবাহিক ভাবে উপরোক্ত প্রক্রিয়া চালিয়ে গিয়ে। শেয়ার বাজারের আইনি ও লেনদেনের প্রক্রিয়া বেশ খানিকটা জটিল হওয়ার ফলে এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ ঢিলেঢালা হওয়ার কারণে বিবিধ উপায়ে জালিয়াতি-জোচ্চুরি অনেক বেশি সম্ভব ব্যাঙ্ক ঋণের তুলনায়। সবচাইতে বড় কথা ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিস প্রাপ্য টাকা আমানতকারীকে ফেরত দিতে না পারলে তা সরকারের দায় হয়ে দাঁড়ায়। শেয়ার বাজারের ক্ষেত্রে এই পুরো দায়িত্বটাই সরকারকে নিতে হয়না। শেয়ার বাজার সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্পষ্ট ধ্যান ধারণা এখনো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এই অজ্ঞতার সুযোগ নেওয়া কর্পোরেটদের পক্ষে অনেক বেশি সহজ ব্যাঙ্কের ঋণখেলাপ করার তুলনায়। যত বেশি মানুষ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেন বা করতে বাধ্য হ’ন, তত’ বেশি চাঙ্গা হয় বাজার, যার প্রতিফলন ঘটে নিফটি বা সেনসেক্সের সূচক-বৃদ্ধির গ্রাফে। সূচকের এই বাড়-বৃদ্ধি আরো বেশি সংখ্যক মানুষকে উৎসাহিত করে শেয়ার বাজারে টাকা বিনিয়োগের জন্য। সোজা কথায়, মানেটা দাঁড়ায় যে শেয়ার বাজারের সূচকের বৃদ্ধি নির্দিষ্টভাবে দেশের অর্থনীতির অগ্রগতির সূচক নয়, বরং তা বিনিয়োগকারীদের ‘সেন্টিমেন্ট’ অর্থাৎ এই “মনে হওয়ার” সূচক যে শেয়ার বাজার নিকট ভবিষ্যতে আরো চাঙ্গা হবে। শেয়ার বাজারের সূচক কে বিনিয়োগকারীদের বড় অংশের ভবিষ্যত সম্বন্ধে এই ‘ধারনা’ / ‘সেন্টিমেন্ট’র একটি জমাট বাঁধা রূপ বলা যেতে পারে, যার সাথে দেশের শিল্প বাণিজ্যের অগ্রগতির সম্পর্ক বহু সময়েই থাকে না। উদাহরণ হিসাবে দেখানো যেতে পারে যে কোভিড অতিমারির লকডাউনের সময়কালে যখন পণ্য বা পরিষেবা উৎপাদন শিকেয় উঠেছিল, বিরাট সংখ্যক মানুষের কর্মচ্যুতি ঘটেছিল’, শেয়ার মার্কেটের সূচক মারাত্মকভাবে বেড়েছিল!   

আরেকটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে মানুষকে এক প্রকার শেয়ার বাজারের দিকে যেতে বাধ্য করার পেছনে। ব্যক্তি মানুষের জীবনের অর্থিক স্বার্থ বা আর্থিক প্রয়োজনের সাথে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর লাভ লোকসান কে একেবারে অঙ্গাঙ্গীভাবে এক করে দেওয়া। এর সুবিধা হল’ এই সকল সংস্থার কোনো রকম আর্থিক সমস্যার ক্ষেত্রে সরকারি অর্থ ব্যয় করে মদত যোগানোর ক্ষেত্রে (বেল-আউট) যাতে জনসাধারণের বিরোধীতার সম্মুখীন না হতে হয়। অর্থাৎ ব্যক্তি পুঁজির স্বার্থকে ঢালাও হারে ‘জনগনের স্বার্থে’ রূপান্তরিত করা যেতে পারে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, যারা কিনা পুঁজিবাদের পেষণের মধ্যেই বেঁচে আছে, তাদেরকেই পুঁজিবাদের পদাতিক বাহিনীতে (‘ফুট-সোলজার’)পরিণত করা। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় পুঁজিবাদে উৎপাদন সামাজিক-ই ছিল চিরকাল, সাথে যুক্ত হল’ তার লগ্নীপুঁজির সামাজিক উৎস (শেয়ার বাজারের মারফত সাধারণ মানুষের পুঁজিকে কাজে লাগানো) যদিও পুঁজিবাদের উৎপাদিত উদবৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে যাবে সেই মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিরাই! এই ব্যবস্থাকেই ‘সামাজিকভাবেই’ রক্ষা করবে কারা? সেই শোষিত সাধারণ মানুষ-ই কারণ নয়া উদারবাদে তাদের রোজকার বাঁচামরা শেয়ার বাজারের সূচকের সাথে বেঁধে দেওয়া গেছে। একবিংশ শতকের নয়া উদারবাদী জাতিরাষ্ট্র এই মারাত্মক মানুষখেকো একটি ব্যবস্থা গঠনে সাফল্য অর্জন করেছে যে পুঁজিবাদের উৎপীড়নের সবচাইতে কোনঠাসা অংশটিকেই পুঁজিবাদের ফুট সোলজারে পরিণত করা গেছে (আরেক ভাবেও শ্রেণীগতভাবে এ দেশের সবচাইতে পিছিয়ে পড়া অংশকে পুঁজিবাদের লেঠেল বাহিনীতে পরিণত করার চেষ্টা হচ্ছে- “অগ্নিবীর স্কীম” নামক ফন্দির মাধ্যমে গরিব ঘরের কর্মক্ষম সদ্যযুবকদের ক্যাজুয়াল শ্রমের সশস্ত্র বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে)। বর্তমান ভারতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ফ্যাসিস্ত রাজনীতির দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রশক্তি ফ্যাসিবাদের ধ্রুপদী নিয়ম মেনেই এই সকল প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ড বেচাকেনার উপর করের হার আয়করের তুলনায় অত্যল্প। অর্থাৎ ‘সেন্টিমেন্ট’-এর ওঠানামা বা ফাটকাবাজির থেকে আয়কে শ্রমশক্তির দ্বারা লব্ধ আয়ের তুলনায় সরকার অনেক বেশি প্রশ্রয় দেয়। এই মনোবৃত্তির নেতিবাচক সামাজিক ফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে।

দুনিয়া জুড়েই শেয়ার বাজারের চাঙ্গা ভাবের সাথে সে দেশের সরকারের ‘শক্তিশালী’ অবস্থানের একটা গভীর সম্পর্ক থাকে।  এ ক্ষেত্রে ‘শক্তি’র অর্থ হল স্বৈরতান্ত্রিকতা। যে সরকার যত কম গণতান্ত্রিক হবে আর যত বেশি অনমনীয় মনভাব নিয়ে চলবে, সাধারণভাবে সে দেশের শেয়ার বাজার তত বেশি চাঙ্গা থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে সকল সময়েই খানিক অনিশ্চয়তা থাকে, খানিক ‘chaos’ থাকে। অথচ শেয়ার বাজারের চাঙ্গা ভাব ধরে রাখার জন্য কোনো ধরনের অনিশ্চয়তা না-পসন্দ। বিগত দশ বছরে গোটা পৃথিবীতেই দক্ষিণপন্থী স্বৈরতান্ত্রিকতাকে মান্যতা দেওয়ার জন্য যে সকল ভাষ্য তৈরি করা হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হল এমন খানিকটা স্বৈরতান্ত্রিকতা নাকি অর্থনীতির জন্য ভাল- কারণ তা শেয়ার বাজারকে চাঙ্গা রাখে! এখনো অবধি এই লাইনের সমর্থনে এ দেশে ইউএপিএ বা সমগোত্রীয় কালা আইনের নির্বিচার প্রয়োগ চলছে রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে ইন্দোনেশিয়ার কুখ্যাত সেনাপ্রধান সুহার্তোর তিন দশকের কিছু বেশি সময় ধরে চালানো স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকেও মডেল হিসাবে দেখানো যেতে পারে, কারণ সেই সময়কালেই পশ্চিমী পুঁজির জন্য সবচাইতে কমদামে সবচেয়ে বেশি শ্রমশক্তি নিংড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা গেছিল দক্ষিণ এশিয়ায়!

বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও কিছু সম্ভাবনাময় কর্মসূচি

১। কর্পোরেট কর-ছাড়ের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। এ ক্ষেত্রে আয়করদাতা মধবিত্ত শ্রেণীর সামনে এই সত্য তুলে ধরা প্রয়োজন যে তাদের উপর আয়করের হার আদতে কর্পোরেট কে ট্যাক্স-ছাড়ের ভর্তুকির হারের সমতুল্য। ওয়াইট-কলার জবের যে বিপুল কর্মচ্যুতি বর্তমান সময়ে ঘটছে (মূলতঃ তথ্যপযুক্তি ও অনুসারী শিল্পে কৃত্রিম মেধার প্রয়োগের কারণে) তার প্রেক্ষিতে এই আন্দোলন আরো জরুরি হয়ে পড়েছে। বামপন্থীরা বাদে এই ইস্যু নিয়ে কোনো প্রকার আন্দোলন আর কোনো দক্ষিণপন্থী বা আঞ্চলিক দলগুলি করেনা।

২। ঋণখেলাপী কর্পোরেটদের বিরুদ্ধে সরকারকে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য করা প্রয়োজন।

৩। ব্যাঙ্ক এবং পোস্ট অফিসের দীর্ঘমেয়াদী আমানতে সুদের হার যে কোনো সময়ে মুদ্রাস্ফীতির হারের তুলনায় অন্ততঃ ১.৫-২% বেশি করা এবং সেই সুদকে কর ছাড়ের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে আন্দোলন প্রয়োজন। যাতে, অন্ততঃ মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলা করার জন্য সাধারণ মানুষকে শেয়ার বাজারের দ্বারস্থ না হতে হয়।

৪। মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্থা বা সংগঠনের সাথে মিলিতভাবে নিবিড় প্রচার চালানো।

৫। আইনিভাবে অনুমোদিত বিনিয়োগকারীদের সমিতি গঠন, অনেকটা পেনশনার্স এসোসিয়েশনের আদলে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে এই ধরনের সংগঠন।

বিশ্বজুড়ে নয়া-উদারবাদ বেশ কিছু অভিন্ন পন্থায় শোষণ চালায়। এগুলির মধ্যে অন্যতম হল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে নির্বিচারে শেয়ার বাজারের দিকে ঠেলে দেওয়া। অন্যান্য দেশের বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এ বিষয়ে লড়াই সংগ্রামের যে অভিজ্ঞতা তাকে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে এ দেশেও সঠিক যুগোপযোগী বোঝাপড়া গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে। দুনিয়া জুড়ে নয়া-উদারবাদের বিরুদ্ধে এই লড়াইকে এক সূত্রে গাঁথতে এমন কাজ অনেকটাই সহায়ক হতে পারে।

ব্যবহৃত ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত

Spread the word