Site icon CPI(M)

“Save Rail-Save Nation” – Amit Kumar Ghosh*

আজ থেকে ৬ বছর আগে, ২৫ শে মার্চ ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছিলেন এই ভাষায় “সৌগন্ধ মুঝে ইস্ মিট্টি কি – এ দেশ নেহি বিকনে দুঙ্গা।” বাস্তবে, ক্ষমতায় আসার পর আমরা দেখতে পাচ্ছি – দেশের সমস্ত রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি যা বিগত সত্তর বছর ধরে সাধারণ মানুষের টাকায় তিল তিল করে গড়ে উঠেছে, সেগুলি বিক্রি করে দিচ্ছে।

দেশের গর্বের শিল্প প্রতিষ্ঠান যেমন কোল ইন্ডিয়া, এয়ার ইন্ডিয়া, ভারত সঞ্চার নিগাম – ইত্যাদি সংস্থাগুলির নাম থেকে ভারত বা ইন্ডিয়া শব্দটি মুছে ফেলতে চাইছে। এবার মোদি সরকারের নজরে ভারতীয় রেল।


এই ভারতীয় রেল ও তার ভূমিকা জাতীয় ক্ষেত্রে কী :-
*জাতীয় অর্থনীতির মেরুদন্ড
* কর্মসংস্থানের বৃহত্তম ক্ষেত্র
* সব চাইতে সুলভে দেশের ৭০% গরিব মানুষের যাতায়াতের দূষণমুক্ত বৃহত্তম পরিবহন ব্যবস্থা
* দেশের সেনাবাহিনী ও তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার সেরা মাধ্যম
* স্বল্প মাশুলে খাদ্যপণ্য ও শিল্পের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ ও শিল্পজাত সামগ্রীর পরিবহনকারী
* প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো অন্যতম হাতিয়ার
* প্রবীণ নাগরিক, বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষ, দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষ, ছাত্র সমাজ ও চাকুরী প্রার্থীদের যাতায়াতে বিশেষ ছাড় প্রদানকারী – এ সকল সামাজিক বিশেষ দায়িত্ব নিরবচ্ছিন্নভাবে পালন করে চলেছে ভারতীয় রেল।
সে কারণেই ভারতবর্ষ আর ভারতীয় রেল সমার্থক। যেমন মানব দেহের শিরা উপশিরা গুলো সারা দেহে রক্ত পরিবহন করে মানুষকে সজীব রাখে, ঠিক একই ভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা রেলপথে যাত্রী থেকে পণ্য সামগ্রী নিয়ত পরিবহন করে ভারতকে আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে সচল রেখেছে, তাইতো ভারতীয় রেল ভারতর্ষের লাইফ লাইন, যার কোন তুলনা হয় না।
সারা বিশ্বের নিরিখে ভারতীয় রেলের অবস্থান চতুর্থ।নেটওয়ার্ক ও যাত্রী পরিবহনের নিরিখে বিশ্বের প্রথম। দেশজুড়ে ৬৮ হাজার কিলোমিটারের কিছু বেশী বিস্তৃত ভারতীয় রেল পথে প্রায় ২৩ হাজার ট্রেন প্রতিদিন চলাচল করে। বর্তমানে ভারতীয় রেলের বার্ষিক রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ১,৯৭,৪১৪ কোটি টাকা। বার্ষিক লাভের পরিমাণ ৬,৫০০কোটি টাকা, যা ভারতীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।


কেন্দ্রের মোদি সরকার রেলের বেসরকারিকরণের জন্য মরিয়া উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যদিও বেসরকারিকরণের কথা তারা স্বীকার করে না। ইতিমধ্যেই একাধিক পদক্ষেপ সরকার কার্যকরী করেছে। আউটসোর্সিং এর নামে রেলের বহু কাজের ঠিকাদারিকরন করা হয়েছে। বর্তমানে ভারতীয় রেলওয়েতে IRCTC, RITES, IRCON সহ ২৪ টি কর্পোরেশন কাজ করছে। RSDA (রেলওয়ে স্টেশন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি) গঠন করে বহু গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। রেলের বিভিন্ন প্রোডাকশন ইউনিট, রিপেয়ারিং ওয়ার্কশপ বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
সম্প্রতি রেলমন্ত্রক বিজ্ঞপ্তি জারি করে ঘোষণা করেছে যে – গোটা দেশে ১০৯ রুটে ১২ টি ক্লাষ্টারে ১৫১ জোড়া ট্রেনকে বেসরকারি সংস্থা চালাবে। ঐ রুট এবং ক্লাষ্টারগুলো দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও যাত্রীসংখ্যার নিরিখে আর্থিকভাবে লাভজনক। এর মধ্যে আমাদের রাজ্যে ৯ টি রুটে ১১ জোড়া ট্রেন রয়েছে। ৩৫ বছর মেয়াদী এক গোপন চুক্তি করা হয়েছে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর সাথে, যা দেশের মানুষকে জানানো হচ্ছে না। আমাদের দাবি ঐ মৌ অর্থাৎ চুক্তিপত্রে কি কি শর্ত আছে তা শ্বেতপত্র প্রকাশ করে দেশের নাগরিকদের জানানো হোক, কারন যে বা যারাই সরকার চালাক না কেন, সরকার দায়বদ্ধ দেশের জনগণের কাছে, প্রকৃত অর্থে জনতাই দেশের মালিক, তাই ঐ চুক্তির শর্ত জানার অধিকার নাগরিকদের আছে।
উপরে বর্ণিত ১৫১ টি ট্রেন বেসরকারী সংস্থাকে চালাতে দেওয়ার পক্ষে সরকারের যুক্তি:
১) কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি এর ফলে ৩০ হাজার কোটি টাকা রেলের আয় হবে।
** বিপক্ষে যুক্তি – সরকারি দাবি সর্বৈব মিথ্যা, বাস্তব হলো মোদি সরকার দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে কর্পোরেটারদের ঐ পরিমান টাকা ঋণ দেবে, রেলে লগ্নি করার জন্য (অর্থাৎ ঐ ট্রেনগুলির মালিক হওয়ার জন্য ) যা দেশের মানুষের টাকা।কর্পোরেট সংস্থাগুলো কেবলমাত্র রেলের পরিকাঠামো ব্যবহার করার জন্য লাভের একটা অংশ সরকারকে দেবে। প্রশ্ন হলো তাহলে সরকার, নিজে কেন লগ্নি করবে না? অভিজ্ঞতা বলছে, বিভিন্ন সময়ে কর্পোরেট মালিকরা কোটি কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করে সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতে বিদেশে পালিয়ে গিয়েছে। সেই বিপুল পরিমাণে অনাদায়ী ঋণ বা Non-Performing Assets ব্যাংকের আর্থিক কাঠামোকে দুর্বল করেছে। সম্প্রতি ৬৮ হাজার কোটি টাকা অনাদায়ী কর্পোরেট ঋণ বর্তমান সরকার মুকুব করে দিয়েছে, যে টাকা দেশের মানুষের যা দিয়ে বহু জনহিতকর কাজ করা যেত।
২) সরকারের দাবি রেলের ভাড়া হ্রাস পাবে।
** বাস্তব যুক্তি:- ১৫১ জোড়া ট্রেন চালানোর লাইসেন্স পাওয়া কর্পোরেট সংস্থাগুলি রেলে দাতব্য পরিষেবা দিতে আসছে না, তারা রেল থেকে পয়সা অর্থাৎ মুনাফা লুটতে আসছে। যাত্রীবাহী ট্রেন চালাতে রেলকে ৪৭% ভর্তুকী দিতে হয়, ইহজগতে কোন কর্পোরেট সংস্থা আছে কি,যারা ভর্তুকী দিয়ে রেল চালাবে? প্রথম প্রাইভেট ট্রেনের ( তেজসের ) ভাড়া দেখলেই অনুমান করা যাবে আসন্ন প্রাইভেট ট্রেন গুলোর ভাড়া কি হতে পারে! “Satabdi Exp” একটি Premium Train – এর কোন দূরত্বের জন্য AC – Chair Car- এর ভাড়া ৯৭০ টাকা, ঠিক সেই দূরত্বের জন্য তেজসের ভাড়া ১,২৮০ টাকা। প্রতিটিতেই dynamic fare system এর ব্যবস্থা করা আছে। উল্লেখিত ১৫১ টি বেসরকারি ট্রেনের ভাড়াও ডাইনামিক ফেয়ার সিস্টেমে হবে। এছাড়া আমাদের দেশে বেসরকারী মেট্রোরেলের ভাড়া, সরকারি মেট্রোরেলের ভাড়ার তিনগুণ, কখনো তারও বেশি হয়। ট্রেন বেসরকারী সংস্থার দ্বারা পরিচালিত হলে ভাড়া হ্রাস পাবে সরকারের এই যুক্তি হাস্যকর – শিশু ভোলানো গল্প ছাড়া কিছুই নয়। গোপন চুক্তির কারণে ট্রেন পরিচালনার ক্ষেত্রে রেলমন্ত্রক ঐ বেসরকারী ট্রেন গুলোকে অগ্রাধিকার দেবে, ফলস্বরূপ ‘রাজধানী’ ‘দুরন্ত’ ‘শতাব্দি’ এক্সপ্রেসের মত অভিজাত ট্রেন গুলির গুরুত্ব ও গতি দুটোই হারাবে।
৩) সরকারের যুক্তি বিশ্বমানের যাত্রী পরিষেবা দেওয়া যাবে।
** বাস্তব হলো, বিশ্বমানের পরিষেবা প্রদান করতে দরকার উন্নতমানের কোচ, কোচের মধ্যে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ রাখা, যাত্রী নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। এই সব শর্তগুলো রেল নিজেই পূরণ করার ক্ষমতা রাখে। রেলের Coach Factory গুলি বিশ্বমানের কোচ তৈরী করতে সক্ষম, “LHB” ও “Bande Purusotam” তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আর উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিশ্বমানের ইঞ্জিন তৈরী করতে চিত্তরঞ্জন লোকোমটিভ যথেষ্ট। তাই শুধু মাত্র স্বল্প বেতনে নিয়োগ করা “Rail Hostess” দিয়ে On Board Service প্রদান করাকেই বিশ্বমানের পরিষেবা বলে না।
৪) সরকারের দাবি উল্লেখিত ১৫১ জোড়া ট্রেন উচ্চ গতি সম্পন্ন হবে, ঘন্টায় ১৩০কিমি।
** বাস্তব অবস্থা হলো – ভারতবর্ষ বহুদিক থেকেই বৈচিত্র্যে ভরা, এদেশের মাটিও বৈচিত্র্যময়। এই বৈচিত্র্যেভরা মাটিতে ট্রাকের আমুল পরিবর্তন না করে ট্রেনের গতি বৃদ্ধি করার কথা বলা আষাঢ়ে গল্প ছাড়া কিছুই নয়। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের বুলেট ট্রেনের পরিকল্পনা কেন স্বপ্নই রয়ে গেল সেটা দেখা দরকার।
৫) সরকার বলছেন ট্রেন বেসরকারী হলে বহু কর্মসংস্থান তৈরী হবে।
** বাস্তবে বহু রেলকর্মীর চাকরি যাবে, কিছু শিক্ষিত বেকার যুবক – যুবতী সামান্য মাইনেতে অনিশ্চিত কিছু কাজ পাবে On Board Service আর টিকিট বিক্রির জন্য। তাদের কাজ-ঘন্টার কোন সীমা পরিসীমা থাকবে না, একাধিক কাজ করতে হবে, যেমন টিকিট চেক যে করবে, সেই আবার চা – কফি – টিফিন বিক্রি করবে, Air hostess দের মতো। চাকরি কতদিন থাকবে সেটা ” কচু পাতায় জলের” মতো অনিশ্চিত। তাহলে নির্দিষ্ট বেতন ও সুনিশ্চত চাকরির পরিবর্তে কিছু স্বল্প বেতনের অস্থায়ী দাসসুলভ চাকরি – এটাই সরকারের ভবিষ্যতের কর্মসংস্থান !

Tejas Express


৬) সরকার বলছেন যে উন্নত দেশগুলোতে রেল ব্যবস্থা বেসরকারি সংস্থার হাতে।
** বাস্তব চিত্র হলো, বিশ্বে আমেরিকা ও কানাডা বাদে উন্নত ধণতান্ত্রিক দেশ গুলোতে রেল পরিচালন ব্যবস্থা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে।আমেরিকাতেও রেল ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবি উঠেছে। অতীতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার ব্রিটিশ রেলওয়েওকে বেসরকারিকরণ করেছিলেন।যার পরিণতি দেখে অপর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার তার উপলব্ধি ব্যক্ত করেছিলেন – “যদি পৃথিবীতে নরক বলে কিছু থাকে – সেটা ব্রিটিশ রেলওয়ে।” বর্তমানে ব্রিটিশ রেল রাষ্ট্রের অধীনে। এখানে অবশ্যই উল্লেখ্য যে, বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশেই রেলের যাত্রী ভাড়ায় সরকারি ভর্তুকি বর্তমান।
৭) কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে, বেসরকারি উদ্যোগে বিমান পরিষেবা হতে পারলে – রেল কেন নয়?
** সরকারের এই যুক্তি আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথমত, বিমান পরিষেবা শুধুমাত্র ধনীরাই নিতে সক্ষম, গরিব মানুষের নাগালের বাইরে। যে দেশের ৭০ কোটি মানুষের “নুন আনতে পান্তা ফুরায়” সেখানে সরকারের মুখ থেকে এই সব কথা শোনা শুধু পরিহাসের ব্যাপার নয়, অপমানজনক ও বটে। কারণ রেল সরকারি থাকার ফলে কয়েক কোটি প্রান্তিক মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্বল্প পয়সা ব্যয় করে যাতায়াত করতে পারছে, রেলকে নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে। এটা যদি সরকার না দেখতে পায়, তবে এই সরকার কাদের সেই প্রশ্ন উঠে আসছে।
দ্বিতীয়ত, সাহারা, কিংফিশার, জেট এয়ারলাইন্স্ এর মতো একাধিক বেসরকারি বিমান সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে এয়ার ইন্ডিয়ার মতো সরকারি বিমান সংস্থাগুলি লকডাউনেও জাতীয় স্বার্থে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে নারাজ। কারণ? দেশী-বিদেশী কর্পোরেট হাউস গুলির সঙ্গে গোপন আঁতাত। কর্পোরেটের স্বার্থরক্ষা করতে এই সরকার দায়বদ্ধ। বিগত দুই লোকসভা নির্বাচনে কর্পোরেট হাউসগুলোর বিপুল লগ্নি নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছে। এখন তার-ই প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পালা। যার পরিণতি – ভূগর্ভ থেকে মহাকাশ – সর্বত্র কর্পোরেটদের অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া। অর্জিত স্ব-নির্ভরতা বিক্রি করে আত্ম-নির্ভর ভারত গড়ার ডাক!
বাস্তবে “বনিকের মানদন্ড ইতিমধ্যেই রাজদন্ড রূপে দেখা দিয়েছে – নব কলেবরে” আজ সরকার বনিক বা কর্পোরেট মালিকদের ইচ্ছা অনুযায়ী নীতি নির্ধারণ করছে, দেশের জাতীয় সম্পদ বেনিয়াদের হাতে উজার করে দিচ্ছে। Coal India, Air India, Life Insurance Corporation, ভারত সঞ্চার নিগম, ভারত পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি সরকার অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর নামের থেকে “India” বা “ভারত” শব্দটা তুলে দিতে এই সরকার বদ্ধপরিকর। এক কথায় সরকার কর্পোরেট মালিকদের প্রতিনিধি হয়ে দেশ চালাচ্ছে।রেল বেসরকারি করে দিতে পারলে কর্পোরেট মালিকদের স্বার্থ পূরণের প্রায় শেষ ধাপে পৌঁছে যেতে পারবে। রেল বেসরকারিকরণে সহজ রাস্তা হিসেবে সরকার বেছে নিয়েছে সরাসরি ট্রেন বিক্রি করে দেওয়া অর্থাৎ বেসরকারি সংস্থাকে ট্রেন চালানোর লাইসেন্স দেওয়া। আগামদিনে রেলের নিজেস্ব ট্রেন চলার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার হারাবে, বেসরকারি ট্রেনের গতি যাতে না কমে সেদিকে বাধ্যতামূলক নজর রাখতে হবে, কারন বেসরকারি সংস্থার যাতে ব্যবসা মার না খায়। তার ফলে রেলের Premium Train গুলি তাদের গতি, মর্যাদা ও গুরুত্ব সবই হারাবে, আর সরকারি ট্রেনের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাবে, বেসরকারি সংস্থাগুলো কালক্রমে লোকাল ট্রেনও চালানোর লাইসেন্স পেয়ে যাবে। যাত্রী টিকিটের দাম প্রতিটি যাত্রীবাহী ট্রেনের ক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাবে, যা নিন্মমধ্যবিত্ত, নিন্মবিত্ত তথা প্রান্তিক মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে। প্রচলিত সমস্ত রকম যাত্রী concession রেল থেকে চিরতরে মুছে যাবে।

গরীবের ছেলে মেয়েরা বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের “পথের পাঁচালির” অপু দুর্গা-র মতো রেল লাইনের ধার থেকে ট্রেন চলতে দেখবে – ট্রেনের সফর তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেবে। রেলে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও বেসরকারী সংস্থা কাজ শুরু করেছে। IRSDC (Indian Railway Station Development Corporation) – র মাধ্যমে রেল ষ্টেশনগুলো বেসরকারী সংস্থার হাতে তুলে দিচ্ছে। Station Modernization – নামে Platform Ticket – এর দাম, Rest Room – এর ভাড়া আকাশ ছোঁয়া করে দেওয়া হবে, যা সাধারণ যাত্রীদের নাগালের বাইরে থাকবে। বিমানবন্দরে যে অস্বাভাবিক দামে চা, বিস্কুট, কফি ও টিফিন খেতে হয় সে রকম দামে রেল ষ্টেশনেও খেতে হবে। রেল ষ্টেশনের গাড়ি পার্কিং এর দায়িত্ব ইতিমধ্যেই বেসরকারি সংস্থার হাতে যাওয়া শুরু করেছে, অর্থাৎ পুরো পরিষেবা দেশের সিংহভাগ নাগরিকদের হাতের বাইরে চলে যাবে, কারণ দেশের অধিকাংশ নাগরিক দরিদ্র থেকে হতদরিদ্র।RLDA ( Rail Land Development Authority) – র মাধ্যমে রেলের অব্যবহৃত জমি গুলো বেসরকারি সংস্থাগুলোকে খুব কম মূল্যে লিজে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, রেলে Workshops, Production Unit অর্থাৎ Coach Factory, Locomotive গুলোকে কর্পোরেটাইজেশনের মাধ্যমে বিলগ্নীকরণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এমনকি রেলের Maintenance Shed – এর পিট ( PIT) গুলোর Maintenance ও বেসরকারি সংস্থার হাতে চলে যাচ্ছে। রেলের ইতিহাস বলে ভারতীয় রেলের Printing Press দীর্ঘকাল ধরে রেলের যাবতীয় Printing – এর দায়িত্ব সুচারু ভাবে পালন করে আসছে। রেলে সমস্ত ধরনের ফাইল, লেটার প্যাড, ফর্ম সহ নানাবিধ ভাউচার, সাবেকী টিকিট প্রভৃতি রেলের নিজেস্ব প্রিন্টিং প্রেস দ্বারা মুদ্রিত। ভারতীয় রেলের বিভিন্ন জোনে ১৬টি Printing Press ছিল। প্রেসের কাজ অধিকাংশ আউটসোর্সিং করে দিয়ে Printing Press গুলো তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রায় বাস্তবায়ন করে ফেলেছে। দীর্ঘ আন্দোলন, প্রতিবাদ থেকে প্রতিরোধ করে আমরা ১৬টির জায়গায় মাত্র ৫ টিকে এখনো ধরে রাখতে পেরেছি, তার মধ্যে Eastern Railway -এর হাওড়ার প্রিন্টিং প্রেসটি আছে। কিন্তুু সেগুলোও ICU -তে আছে, যখন তখন মৃত্যুর খবর এসে যেতে পারে, কারণ রেলের মুদ্রনের সমস্ত কাজ বেসরকারি সংস্থার হাতে না দিতে পারলে কর্পোরেট মালিকরা অসন্তুষ্ট হতে পারে। তাই রেল বেসরকারীকরণ হবে না, সরকারের এই ভাষণ
সমস্ত দেশবাসীকে এক চরম ভাঁওতা দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়। রেল বিক্রিতে দেশের মানুষের সমর্থন আদায়ের জন্য এই সরকার প্রচার মাধ্যমকে এমন সব তথ্য ও মন্তব্য প্রচারের জন্য প্রদান করছে, যেন ভারতীয় রেল আর্থিক দিক থেকে ভীষণ ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে, যার ফলে কর্মীদের বেতন ও পেনশন দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে ভারতীয় রেল!

যদিও এটা অতিরঞ্জিত, দেশের মানুষের চিন্তা ভাবনাকে বিভ্রান্ত করে, প্রভাবিত করে দেশের স্বপ্নের তথা সবচেয়ে নির্ভরতা প্রদানকারী জাতীয় শিল্পকে বিক্রি করার রাস্তাকে সহজ করে নিচ্ছে বর্তমানের কেন্দ্রীয় সরকার।

সমাজ জীবনে এর বিপর্যয়কর প্রভাব পড়তে বাধ্য। রেল বেসরকারিকরণ হলে ৫০% কর্মী সংকোচন অনিবার্য। অবশিষ্ট রেলকর্মীরা তাদের প্রিভিলেজগুলো হারাবে, DA & DP -এর বর্দ্ধিত হার ইতিমধ্যেই হারিয়েছে। Privilege Pass & PTO সেগুলো বন্ধ করার চক্রান্ত চলছে, নতুন পেনশনের আওতাভুক্ত কর্মীরা তাদের ভবিষ্যত হারিয়েছে।

নতুন করে কর্মসংস্থান হবে না, বেকারি বাড়বে। ইতিমধ্যেই এই সরকারের সময়কালে দেশে কয়েক কোটি মানুষ রোজগার হারিয়েছে, করোনার আবহে বহু কর্পোরেট সংস্থা কর্মী সংকোচন করেছে, এই ভাবে কর্মী সংকোচেনের বিরোধীতা টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার রতন টাটার মুখেও শোনা গেছে। নতুন করে ১৪কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে চলে গেছে। রেল বেসরকারি হলে অগনতি শিক্ষিত বেকার দেশের বৃহত্তম সংগঠিত কর্মক্ষেত্রকে হারাবে। রেলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত কয়েক কোটি মানুষ জীবিকা হারাবে যেমন- রেল ভ্যান্ডার ব্যবহারকারী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, রেল হকার, রেল ষ্টেশনের দোকানী এমন কী রেল ভিখারী ইত্যাদি। শ্রম আইন সংশোধনের মধ্য দিয়ে শ্রমিক তার অর্জিত অধিকার হারাবে, ক্রীতদাসে পরিণত হবে। নিজীকরণ, ব্যক্তি মালিকের মুনাফা সৃষ্টি করে – সমাজের স্বার্থ রক্ষা করে না। নীতি নির্ধারণে সরকারের কোন ভূমিকা থাকবে না, কর্পোরেটদের ইচ্ছানুযায়ী সংস্থা চালিত হবে।
সে কারণেই, রেল বেসরকারিকরণের কেন্দ্রীয় সরকারের দেশবিরোধী হঠকারী পদক্ষেপকে প্রতিরোধ করা শুধুমাত্র রেল কর্মীদের বিষয় নয়। এটা সামাজিক ইস্যু – জাতীয় ইস্যু, তাই দেশের সর্বত্র এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য দেশপ্রেমিক মানুষ সংগঠিত হচ্ছেন। রেলকর্মী ও রেলকর্মী সংগঠনকে এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। আজকের দিনে ঐতিহাসিক কর্তব্য হলো রেলকর্মী সহ সমস্ত মানুষকে এই সংগ্রামে সামিল করা। এটা আমাদের দায়বদ্ধতা, অন্যথায় আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
আসুন সবাই মিলে “রেল বাঁচাও – দেশ বাঁচাও” এর আন্দোলনে সামিল হই।

* সাধারণ সম্পাদক ,ইষ্টার্ণ রেলওয়েমেন্স ইউনিয়ন

Spread the word