ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
আজ যে দেশকে আমরা উজবেকিস্তান বলি ১০১ বছর আগে সেই ভূখণ্ড ছিল তুর্কিস্তান রিপাবলিক অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই দেশেরই রাজধানী তাসখন্দ। ভারতে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করার সংকল্প নিয়ে সাতজন বিপ্লবী তাসখন্দে একটি সভায় মিলিত হলেন। এরা কারা?
মানবেন্দ্রনাথ রায়, ইভিলিন ট্রেন্ট রায়, অবনী নাথ মুখোপাধ্যায়, রোজা ফিটিংগোফ, মহম্মদ আলী, মহম্মদ শফিক সিদ্দিকি এবং এম প্রতিবাদী বায়াংকার আচার্য।
এই সভায় সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে দেশকে মুক্তি দিতে এবং মেহনতি মানুষের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হলেন মহম্মদ শফিক। যদিও ব্রিটিশ ভারতে এই খবর এসে পৌঁছায় অনেক পরে। ততদিনে দেশের মাটিতে একই লক্ষ্য নিয়ে কয়েকজন বিপ্লবী কাজ শুরু করেছেন। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন গ্রুপ হিসাবে দেশের মধ্যে বিভিন্ন প্রান্তে তারা কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজ করছিলেন। মুজফফ্র আহম্দ ছিলেন এমনই একজন।
নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য দেশের বাইরে থেকে অস্ত্র আনার কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন, ব্রিটিশ ভারতে সেই যুগে এমন কাজ সহজ ছিল না। অনেক বাধা পেরিয়ে নরেন্দ্রনাথ আমেরিকায় পৌঁছালে গ্রেপ্তারী এড়াতে নিজের নাম পাল্টে ফেলে হলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। পরবর্তী জীবনে তিনি এম এন রায় হিসাবেই পরিচিত হলেন, আসল নাম চিরকালের মতো পিছনে চলে গেল। আমেরিকায় থাকতেই তার সাথে পরিচয় হয় ইভিলিন ট্রেন্টের। পরে তারা একে অন্যকে বিবাহ করেন – ইভিলিন একজন আমেরিকান কমিউনিস্ট ছিলেন।
সেই যুগে দেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে দেশের বাইরে থেকে অস্ত্র এবং অন্যান্য সাহায্যের বন্দোবস্ত করতে একদল অসমসাহসী ব্যক্তি পৃথিবীর নানা প্রান্তে রওনা হতেন। এম এন রায়, অবনী নাথ মুখোপাধ্যায় এবং এম প্রতিবাদী বায়াংকার আচার্য ছিলেন এমনই ব্যক্তিত্ব। এইসব বিপ্লবীদের অনেককেই তখন বিদেশের মাটিতে সেখানকার বিপ্লবীরা আশ্রয় দিতেন, সহযোগী হতেন – এমনকি চিরসখা অবধি হতেন। ইভিলিন ট্রেন্ট এবং রোজা ফিটিংগোফ ছিলেন এমনই দুই বিপ্লবী। রোজা ছিলেন রাশিয়ান।
তখন খিলাফত আন্দোলনের ঢেউ স্তিমিত হয়ে এসেছে। গান্ধীজী অনেক চেষ্টা করেও সেই রেশ ধরে রাখতে পারছেন না। ভারত থেকে একদল মুসলমান শিক্ষিত যুবক রাশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। উদ্দেশ্যে – লেনিনের দেশ নিজেদের চোখে দেখবেন, জানবেন – শিখবেন। তারা নিজেদের মুহাজির বলে পরিচয় দিতেন। এরা আফগানিস্তানের পথে এসে উপস্থিত হলেন তাসখন্দে। তাদের দুচোখে স্বপ্ন – শ্রমিক রাষ্ট্র ব্যাপারটা শিখে নেবার। এম এন রায় ইতিমধ্যেই পরিচিত হয়েছেন লেনিনের কমরেড মিখাইল বরোদিনের সাথে। সশস্ত্র যুদ্ধের সেনানী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য দীক্ষিত হলেন শ্রমিকের দর্শনে – পৃথিবীটা পাল্টে দেবার বিজ্ঞানে – মার্কসবাদে। এম এন রায় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে প্রতিনিধি হয়েছিলেন, ভারতের নয়, মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে। তিনি মিখাইল বরোদিনের থেকে মেক্সিকোয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার কাজ পেয়েছিলেন, যোগ্য ছাত্র হিসাবে সেই পরীক্ষাতে সফল হয়েছিলেন। রায় খবর পেলেন একদল ভারতীয় যুবক সোভিয়েত ইউনিয়নে এসেছেন যারা কমিউনিজম সম্পর্কে আগ্রহী। এদের অনেকেই তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। রায় এমন সুযোগ নষ্ট করতে চান নি, বহু যুদ্ধের সাক্ষী এম এন রায় উপলব্ধি করেছিলেন বিদেশের মাটিতে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট পার্টি খুব বেশি কিছু হয়তো করতে পারবে না, কিন্তু লেনিনের উপস্থিতিতে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের স্বীকৃতি পাবে, এই খবরে দেশের মেহনতি মানুষ এবং কমিউনিস্ট সংগঠকরা অত্যন্ত উৎসাহ পাবেন এই ছিল রায়ের যুক্তি – ততদিনে রাশিয়ার বিপ্লবের খবর ভারতে পৌঁছে গেছে, দেশের মেহনতি জনগণ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন – একদিন নিজেদের দেশে তারাও প্রতিষ্ঠা করবেন শ্রমিক রাষ্ট্র। লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিপ্লব সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে বাস্তব করেছিল – শ্রমিক রাষ্ট্র কল্পনার আকাশ থেকে পৃথিবীর মাটিতে নেমে এসেছিল।
আরেকদল ছিলেন, যাদের বার্লিন গ্রুপ বলা হয়। বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সেই দলের নেতা। তারা মনে করতেন আগে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করে স্বাধীন হবে, তবেই সময় আসবে কমিউনিজম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার। সেই লক্ষ্যেই তারা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের থেকে সহায়তা প্রত্যাশা জানিয়েছিলেন। এম এন রায়ের নেতৃত্বে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে স্বীকৃতি দেবার বিরোধিতা করেছিল এই বার্লিন গ্রুপ। লেনিনের নেতৃত্বে তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন সম্পর্কে সবরকম মতামতকেই গুরুত্ব দিয়ে বিচার করে এবং সিদ্ধান্ত নেয় ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে যে পার্টি গঠিত হয়েছে তাকে ভারতীয় কমিউনিস্টদের গ্রুপ বলা হবে। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের বোঝাপড়া অনুযায়ী কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে স্বীকৃত হতে গেলে পার্টির উপযুক্ত কর্মসূচী প্রস্তুত করতে হত এবং তা আন্তর্জাতিকের অধিবেশনে অনুমোদন করাতে হত। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অধিবেশন চলার সময় নবগঠিত পার্টি সেই কর্মসূচী চুড়ান্ত করতে পারেনি – তাই তাদের গ্রুপ বলা হল। এম এন রায় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পক্ষ থেকে এশিয়াটিক ব্যুরোর কাজে নিযুক্ত হলেন।
তাসখন্দে যে পার্টি গড়ে ওঠে সেই কমিটি কর্মসূচী চুড়ান্ত করতে না পারলেও এম এন রায় ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তুলতে অসামান্য অবদান রাখেন। ১৯২১ সালে ভারতে জাতীয় কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে এম এন রায় এবং অবনী মুখোপাধ্যায় একটি খোলা চিঠি লেখেন – সেই চিঠিতে তারা কংগ্রেসের অধিবেশনে পূর্ণ স্বরাজের দাবী জানান। কংগ্রেস তখনও ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের আবেদনেই সীমাবদ্ধ ছিল – সেই প্রথম ভারতের মাটিতে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী উঠল, দাবী তুলল কমিউনিস্টরাই। এম এন রায় এবং অবনী নাথ মুখার্জি দুজনের কেউই তখন দেশে ছিলেন না – তাদের প্রতিনিধি হিসাবে সেই আবেদন পাঠ করেছিলেন মওলানা হসরত মোহানি, তার সাথে ছিলেন স্বামী কুমারানন্দ। এরা দুজনেই কমিউনিস্টদের প্রতিনিধি হিসাবে অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী নিজেই সেই পূর্ণ স্বরাজের দাবীকে অগ্রাহ্য করলেন।
এর কিছুদিন বাদে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সাহায্যে এম এন রায় ভারতের কমিউনিস্ট গ্রুপগুলির সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সমর্থ হয়েছিলেন। বাংলায় মুজফফর আহমদ, বোম্বাইতে শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে এবং মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার ছিলেন সেই তিনটি গ্রুপের নেতা। ১৯২১ থেকে ১৯২৩ অবধি বার্লিন থেকে প্রকাশিত হয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচারিত হতে থাকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ঘোষিত পত্রিকা ভ্যানগার্ড অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স। ব্রিটিশ সরকার সেই পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করলে দ্য ভ্যানগার্ড নামে পুনরায় নতুন পত্রিকা প্রকাশ হতে শুরু করে।
ভারতের রাজনীতিতে ১৯২০ সাল আরও একটি কারনে গুরুত্বপূর্ণ, একদিকে বিদেশের মাটিতে পার্টি গঠনের প্রথম ধাপ, অন্যদিকে দেশের বুকে গড়ে ওঠে সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (এ আই টি ইউ সি) – ভারতের শ্রমজীবীদের নিজস্ব সংগঠন।
পার্টি গঠন সম্পর্কে রায়ের উপলব্ধি আজ একশো বছর পরেও সঠিক প্রমানিত হয়েছে, সেদিনের সেই ছোট্ট সংগঠনই ছিল ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার ভ্রূণ। অনেকেই একে ছোট করে দেখেন, তাতে ইতিহাসের অপলাপ হয়।