Site icon CPI(M)

Reclaim The Night: The Call

RG Kar Cover Image

দীধিতি রায়

এটি একটি ‘রাজনৈতিক’ লেখা। যা আসলে কয়েকটা রাতের অভিজ্ঞতা ও তার রাজনৈতিক প্রেক্ষিত।

(১)

৯ ই আগস্ট। রাত ৮ টা। আর জি করের পুলিশ মর্গের বাইরে পুলিশের ভিড়। লাশকাটা ঘরের গন্ধ ভেদ করে নাকে ঠেকছে ভয়ের গন্ধ! নীরবতা চারদিকে-শোকের না,আতঙ্কের। গোটা আর জি কর চত্বরে বিভিন্ন ছোট ছোট জটলা। কান পাতলে শোনা যাচ্ছে তিলোত্তমার ‘ক্যারেক্টর সার্টিফিকেট’ লেখা হচ্ছে। “মেয়েটা সাইকোটিক তাই এমন হয়েছে”! ততক্ষণে এসিস্ট্যান্ট সুপার তিলোত্তমার বাড়িতে ফোন করে বলেছে , এটি আত্মহত্যা! প্রিন্সিপাল বলেছে, রাতে মেয়েদের ঘোরাফেরার কী দরকার???

মরচুয়ারী ভ্যানে করে হাসপাতালের ভিতর থেকে দেহ নিয়ে ছুটে পালাতে চাইলো পুলিশ। আমরা অনেকেই আটকানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু হাসপাতালের ভিতর স্পিডে গাড়ি চালিয়ে কার্যত দেহ নিয়ে পালালো পুলিশ। তার বাবা মাও জানতে পারছিল না পুলিশ দেহ নিয়ে কোথায় গেল। বাবা মা কে টালা থানায় বসিয়ে রাখা হল দীর্ঘক্ষণ অকারণেই এবং সে সময় পুলিশ নিজে থেকেই দেহটা দাহও করে দিতে চাইলো । ওই এক ঝলক দেখায় দেখলাম তিলোত্তমাকে, ঠোঁটের কাছটা কালসিটে।সারা গাল ক্ষতবিক্ষত।

এখান থেকেই আমাদের মনে সন্দেহ হল এটা কেবল ধর্ষণ আর খুন নয়। আসলে এর পিছনে আরও কিছু আছে যাকে ঢাকতেই পুলিশের, প্রশাসনের এত তৎপরতা।

(২)

১২ই আগস্ট (ইংরেজি হিসাবে ১৩ই আগস্ট) । এখন রাত ২:৩৮। আমরা অবস্থানে বসেছি প্রায় ১৪ ঘন্টা ধরে আর জি কর এর এমার্জেন্সি বিল্ডিং এর উলটোদিকে। এই অবস্থান মঞ্চ থেকে ‘তিলোত্তমা’ র ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তির দাবীর জন্য স্লোগান দিতে দিতেই ভাবার চেষ্টা করছি আজ থেকে মাত্র ৩ দিন আগে আমাদের এই অবস্থান মঞ্চ থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরে ওই হাসপাতালের ভিতর এই একই সময় যন্ত্রণায় ছটফট করছিলো সে। আরও একবার বাঁচার জন্য আর্তনাদ করতে যাবে ও,আর ঠিক তখনই তার শরীর জুড়ে পৌরষত্বের দাঁত নখ নিজেদের “দখলদারি কায়েম” করতে চাইছে। সেমিনার হলের সাউন্ড প্রুফ দেওয়াল ভেদ করে সে আওয়াজ পৌঁছালো না বাইরে নার্সিং ইউনিটে! সে আওয়াজ আজও পৌঁছালো না তৃণমূল সরকারের কানে।

যন্ত্রণায় গোঙানিতে যখন সে তীব্র চেষ্টা করছে বাঁচবার,তখন তাকে খুন করা হল।

সারাদিন ধরেই পুলিশ ,এলাকার তৃণমূল এই অবস্থান মঞ্চ কে তুলে দেওয়ার নানা কৌশল অবলম্বন করেছে তবু তা প্রতিহত করেই আমরা এখানে আছি। গত ১০ তারিখ আমাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর পুলিশ যে আক্রমণ সংগঠিত করেছিল তার পর থেকেই আমরা বুঝতে পারছিলাম পুলিশ আসলে আমাদেরকেই আটকাতে চাইছে,ধর্ষকদের নয়।

(৩)

১৩ ই আগস্ট (ইংরেজি মতে ১৪ ই আগস্ট)। এখন রাত ১:৫৫। আমাদের এই অবস্থান মঞ্চের নাম এখন “তিলোত্তমা চত্বর”। রাস্তা জুড়ে লিখেছি আমরা ফিদেলের কথা, মহিলাদের বিপ্লবী হওয়ার প্রেক্ষিত। রাস্তা জুড়ে আজ মেয়েরা লিখেছে ‘we want justice’। গতকালের চেয়ে আজ আমরা সংখ্যায় আরো বেশি। শপথে ও স্পর্ধায়ও আরো বেড়েছি। আজ সন্ধ্যায় খবর এসেছিল সেমিনার রুম ভাঙা চলছে রেনোভেশন এর নামে। আসল উদ্দেশ্য ছিল তথ্য প্রমাণ লোপাট করা। খবর পেয়েই আমরা অবস্থান মঞ্চ থেকে ছুটে গেছিলাম আটকাতে। এবং আমাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ প্রশাসনের তথ্য প্রমাণ লোপাটের প্রথম প্ল্যান কে ভেস্তে দিয়েছিল। তবে আমরা আরো একবার বুঝতে পারছিলাম ঘটনাটা কেবল ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা নয়। এগুলো হিমশৈলের চূড়ামাত্র!

প্রিন্সিপালের নাটকীয় পদত্যাগের পরপরই তাকে পুরষ্কার হিসাবে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের সুপার করা হল।অথচ চারদিকে তার কুকীর্তির নানা স্ক্রিনশট,অডিও ভাইরাল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শাসক দলের নেতামন্ত্রীরা নানা ভাবে পরিস্থিতিকে লঘুকরণ করতে চাইছে।

(৪)

আজ স্বাধীনতা দিবস। গত রাতে মেয়েরা রাত দখল, রাস্তার দখল নেওয়ার জন্য সারা পশ্চিমবাংলা জুড়ে প্রায় ২০০ এর বেশি জায়গায় লাখে লাখে সংখ্যায় সংগঠিত হয়েছিল। আমরা অবস্থান মঞ্চ থেকে মশাল মিছিল শুরু করি পূর্বঘোষিত কর্মসূচি হিসাবেই।

আর জি করের চারদিকে থিক থিকে ভিড় ।মানুষের ,পুলিশের। আর জি করের আউটডোরের  গেট পেরোনোর পরই আমরা দেখতে পেলাম চিতপুরের দিকে রাস্তা আর কলকাতা স্টেশনের রাস্তায় কাতারে কাতারে “মব” জড়ো হওয়া। আমাদের মিছিল এগোচ্ছে পাঁচ মাথার মোড়ের দিকে আর তার দুদিক ধরে পিল পিল করে লোক আর জি করের দিকে ঢুকছে। মিছিল ইউ টার্ন করে যখন আমরা ফিরে এসেছি তখন অলরেডি তান্ডব শুরু হয়ে গেছে। দেখতে পাচ্ছি আর জি করের ভেতরের অবস্থান মঞ্চ ভাঙা। এমার্জেন্সি ভাঙছে,বাইরের সিসিটিভি ভাঙছে।

পরদিন সোশ্যাল মিডিয়া ও খবরের চ্যানেল দেখে বুঝতে পারি উত্তর কলকাতা ,বেলগাছিয়া,মানিকতলা,লেকটাউন সহ কলকাতার নানা প্রান্ত এমনকী হাওড়া,উত্তর ২৪ পরগণা থেকে একেবারে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ দাগী দুষ্কৃতিদের এনে এই তান্ডবলীলা অর্গানাইজ করেছে কালীঘাট। এবং ঘটনাস্থল থেকে নিকটবর্তী তিনটে থানার গড় দূরত্ব ১ থেকে ১.৫ কিলোমিটার হলেও দেড় ঘন্টা পর পুলিশ এলো। ঐদিকে বেলগাছিয়া ব্রিজের তৃণমূল জমায়েতও তখন আরেকদফা আর জি কর এর সামনে আসছে। আমাদের মঞ্চের সামনে রয়েছেন মহিলারা,বয়স্ক মানুষ এবং প্রথমবার মিছিলে আসা বহু ছাত্র। আমাদের কর্মীরাই এই জমায়েতের থেকে দুষ্কৃতিদের আলাদা করার জন্য ব্যারিকেড গার্ডরেল জড়ো করে হিউম্যান চেইন করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকে বুঝতে পারছিলাম প্রশাসন ছেড়ে দিয়েছে সমাজবিরোধীদের হাতে আর জি করকে যাতে তান্ডবের নামে তথ্য প্রমাণ লোপাট করা যায়। সরকারের পক্ষ থেকে প্রমাণ লোপাটের পরের প্ল্যান।বুঝতে পারছিলাম আমরা তো নইই এমনকী ডাক্তার রুগী কেউই আর নিরাপদ নয় এই বাহিনীর সামনে। এবং ভাংচুর শেষ করে এই দুষ্কৃতিবাহিনী ছুটে পালাল শ্যামবাজারের দিকে একদল ,আরেকদল বেলগাছিয়ার দিকে। তারপর এরিয়া “ডোমিনেশনে” এল র‍্যাফ,পুলিশ। এরপর আমরা ফোনাফুনি করে বাকিদের থেকে জানতে পারি কলকাতা স্টেশন ,রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীট সহ প্রতিটা রাস্তায় একদল করে মদ্যপ লোক বাইকে তিনজন করে বসে (দুজন পুরুষ এবং একজন মহিলা ) টহল দিচ্ছে। এবং যে সাধারন মানুষ ,আমাদের কর্মীরা এই কর্মসূচীতে যোগদান করছে তাদের ওপর লাঠিচার্জ করতে যাচ্ছে। বাকী ঘটনার বিভিন্ন ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় সকলেই দেখেছেন।

পরবর্তীতে-

আর জি কর-রাধা গোবিন্দ কর। কলকাতার উত্তরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার ভিতর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দালাল চক্র,সিন্ডিকেট রাজ। রোগী পরিষেবাকে অস্ত্র করে তৃণমূলের লুটে পুটে খাওয়ার অন্যতম আরেকটি ক্ষেত্র- স্বাস্থ্যব্যবস্থা। আর সেই লুটেপুটে খাওয়ার ভাগ প্রিন্সিপাল থেকে শুরু করে বিধায়ক, সাংসদ সবার ব্যাংক একাউন্টেই জমে প্রতিমাসে। তাই সন্দীপ ঘোষ ,সঞ্জয় বশিষ্ঠরা ডেডবডির পাশে বসে এই ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য প্ল্যানিং করতে শুরু করেন বলেই তদন্ত থেকে জানা যাচ্ছে। এবং পুলিশ ডাকায় যথেষ্ট দেরী হওয়া সহ নানা অসঙ্গতিও আসছে।

অনেকেই এই সময়ে বলছেন আমাদের রাজনীতি করা উচিত না। কিন্তু রাজনীতি যখন আমার বেঁচে থাকাকে নিয়ন্ত্রণ করছে তখন আমাদের এই রাজনীতি কে নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। আন্দোলনকারী ডাক্তাররাও বুঝতে পারছেন খুনী ধর্ষকদের আড়াল করার জন্য “বিরাজনীতির” চাষ করতে চাইছে সরকার। ডাক্তারদের এই আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ ভাবনার উদ্রেকের জন্য প্রচার চালানো হচ্ছে যে গরীব মানুষকে পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে না। অথচ আমরা দেখেছি এই কদিন এবং ডাক্তাররাও বারবার বলছেন এমার্জেন্সি,আউটডোর সব চালু আছে।জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলনে আছেন বলে তাদের আন্দোলনকে সংহতি জানিয়ে সিনিয়র ডাক্তাররা আউটডোর এবং এমার্জেন্সিতে রুগীর চিকিৎসা করছেন। আন্দোলনকারী ডাক্তাররাও ক্রমশঃ বুঝতে পারছেন অরাজনীতি ও বিরাজনীতির নামে সরকার আসলে কী জলঘোলা করতে চাইছে। তাই তারাও নিজেদের সহকর্মীর ধর্ষণ ও খুনের বিচার চেয়ে, নিজেদের নিরাপত্তা চেয়ে পক্ষ নিচ্ছেন, সরকার বিরোধী অবস্থানে পক্ষ নিচ্ছেন।

পরিশেষে এই প্রসঙ্গে আমাদের কয়েকটা রাজনীতির কথা বলতেই হবে। এই ধর্ষণের সংস্কৃতি একটি নির্দিষ্ট রাজনীতির ফল। মনু যে ধরণের রাজনীতির প্রবক্তা। মনুবাদী রাজনীতিকে প্রয়োগ করে আর এস এস।  রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। যাদের সদস্য কোনো মহিলা হতে পারে না। কারণ মহিলাদের মত ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’-রা আরএসএস-এর মত ‘পবিত্র’ সংগঠনের যোগ্য নয়। তাদের জন্য আলাদা সংগঠন রয়েছে রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতি। যাদের মূল শ্লোগান মাতৃত্ব। তারা মহিলাদের কে কেবলমাত্র ভোগ্যপণ্য হিসাবে গণ্য করে।এবং একজন মহিলার প্রথম ও প্রধান কাজ সন্তান উৎপাদন করা। তাদের ধারণা মহিলারা  কেবল ‘রমণক্রিয়া’ করার জন্য জন্মেছেন। তাই মহিলারা কারো না কারো অধীনই থাকবে। এবং তাদের ধর্ষণ করার মধ্য দিয়ে আসলে এই আধিপত্যবাদকেই প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এবং এই মনুবাদী ভাবনাকেই প্রমোট করে আমাদের রাজ্যে তৃণমূল এবং দেশে বিজেপি। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী গত দশ বছরে রাজ্যে দেশে দ্বিগুন তিনগুন হারে বেড়েছে ধর্ষণ। গড়ে ৮৬ জন মহিলা ধর্ষিত হন এদেশে প্রতিদিন। উন্নাও ,হাথরস থেকে শুরু করে কামদুনি ,পার্কস্ট্রিট ,হাঁসখালি এগুলো এরই ফসল-বিজেপি তৃণমূল ধর্ষকদের সমর্থনে পক্ষ নিয়েছে প্রতিবার। নাগপুর কিংবা কালীঘাট ধর্ষিতাকেই অপরাধীর তকমা দিয়েছে। এমনকী গত ৯ তারিখের পর থেকে আমাদের সামনে  এসেছে ভাতারের ঘটনা, এসেছে শক্তিগড়ের ঘটনা।

একজন  ডাক্তার কেবল অন ডিউটি ধর্ষিত হয়েছেন তা নয় ,এক জন  ছাত্র তার ক্যাম্পাসে ধর্ষিত ও খুন হল। ক্যাম্পাসে যে সেন্সিটাইজেশন কমিটি এগেনস্ট সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেল অর্থাৎ জিএসক্যাশ সেল গুলো থাকার কথা তা  বন্ধ হয়ে পরে আছে। ফলেই একজন ছাত্র ক্যাম্পাসেও নিরাপদ নয়।

এই জিএসক্যাশ সেল কী?

ভানওয়ারী দেবী রাজস্থানের ভাটেরী অঞ্চলের সমাজকর্মী।১৯৯২ সালে তিনি রাজস্থান সরকারের নারী উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ করার সময় গণধর্ষণের শিকার হন। রামকরণ গুজ্জরের নাবালিকা মেয়ের বিয়ে আটকানোর জন্য উনি রামকরণ গুজ্জর ও তার পাঁচ বন্ধুর দ্বারা ধর্ষিত হন। এবং আদালত অভিযুক্তদের ছাড় দিয়ে দেয় কারণ প্রথমত গ্রামের লোকেরা প্রভাবশালী রামকরণ গুজ্জরের বিরূদ্ধে মুখ খোলেননি আর দ্বিতীয়ত রামকরণ গুজ্জররা উচ্চবর্ণের হিন্দু বলে ধরে নেওয়া হয় যে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিম্নবর্গের মানুষকে স্পর্শ করে না। মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় এটি।

পরবর্তীতে বিভিন্ন মহিলা গোষ্ঠী, এনজিও একসাথে বিশাখা প্ল্যাটফর্মে সংগঠিত হয়ে মামলা করে। এবং ১৯৯৭ সালে বিশাখা নির্দেশিকা প্রকাশিত হয় এবং ২০১৩ সালে তা বিশাখা আইন হিসাবে স্বীকৃত পায়।

সংবিধানের ১৪, ১৫ এবং ২১ নং ধারাকে মাথায় রেখে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা,শোষণ রুখতেই এই গাইডলাইন। এর মাধ্যমেই আইসিসি অর্থাৎ ইন্টারনাল কমপ্লেইন্ট সেল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জিএসক্যাশ কার্যকরী করার কথা।

এই কমিটিতে ১০ জন থাকার কথা। এবং পরিচালন মন্ডলীর কেউ এর সদস্য হতে পারবে না। আমরা যতদূর জানতে পেরেছি আরজিকরের আইসিসি-তে খোদ সন্দীপ ঘোষ উপস্থিত ছিলেন।  ফলত এই কমিটির আর কোনো বৈধতাই থাকে না। এখানে চারজন আইন বিশেষজ্ঞ বা সমাজকর্মী শিক্ষক থাকবেন যার মধ্যে দুজন পুরুষ ও দুজন মহিলা হবে। একজন বাইরের এন জিও কর্মী থাকবেন। পাশাপাশি অশিক্ষক বা শিক্ষাকর্মী প্রতিনিধি এবং ছাত্র প্রতিনিধি রাখতেই হবে।

এই জিএসক্যাশ ও আইসিসি কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তার তদন্তের জন্য তৈরী হয়নি কেবল বরং নিয়মিতভাবে এর আওতাঁভুক্ত সবাইকে যৌন নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেতন করে তোলাই মূল কাজ।

অথচ এই ঘটনার পর, আমরা দেখলাম রাজ্যের সরকার ১২ দফা দাবী ঘোষণা করে “নারী সুরক্ষা” সুনিশ্চিত করার কথা বললো।

তার প্রায় প্রতিটা নিয়েই কিছু না কিছু বক্তব্য থাকে এবং সন্দেহ থাকে যে এগুলোর দ্বারা আদৌ একজন মহিলা তার কর্মক্ষেত্রে, একজন ছাত্রী তার শিক্ষাক্ষেত্রে সুরক্ষিত বোধ করবেন কিনা। কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগের যেটা, তা হল মহিলাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে রাতের শিফটে মহিলাদের “যথাসম্ভব কাজ না দেওয়ার” বিধান দিয়েছে রাজ্য সরকার। আমাদের এখানেই প্রশ্ন ধর্ষণ মোকাবিলায় মহিলাদের গতিবিধি কেন নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে সরকার? আদ্যোপান্ত পুরুষতান্ত্রিক এবং লিঙ্গবৈষম্য মূলক ভাবনা এটি। কেবলমাত্র হাসপাতালে কিংবা আইটি সেক্টরে মহিলারা রাতে কাজ করেন তা নয় কলকাতার মত শহরে ক্যাব ড্রাইভার, ডেলিভারি পরিষেবা ও অন্যান্য নানা পেশায় মহিলারা যুক্ত আছেন যাদের হয় রাত করে ছুটি হয় অথবা রাতের শিফটে কাজ কর‍তে হয়। মফস্বলেও নানা কাজে মহিলাদের রাতে বেরোতে হয়। আর কাজ না থাকলেও একজন মহিলা কেন স্বাধীনভাবে দিনে রাতে ঘুরতে পারবে না?? কেন সরকারকে নিরাপত্তার নামে আসলে মহিলাদের বেরোনোর ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপাতে হবে??

সরকার দায়জ্ঞানহীনভাবে রাতের শিফটে মহিলাদের রাখা যাবে না এই ফতোয়া দিয়ে আসলে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। সমাজ বিকাশের ধারার আদিমতম শ্রম বিভাজনকে একুশ শতকে কায়েম কর‍তে হাতিয়ার করা হচ্ছে নারী নিরাপত্তার কথা। 

আচ্ছা কর্মক্ষেত্রে কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা কিংবা যৌন নির্যাতন,ধর্ষণ এগুলোকে কি কোনো নির্দিষ্ট একটি সময়ে ঘটতে পারে?? এবং জিএস ক্যাশ, আইসিসি সহ সমস্ত মেশিনারি কে দুর্বল করে বা অকার্যকর করে আদৌ রোখা যাবে যৌন হেনস্থা?

ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং তিলোত্তমার বিচার চেয়ে কলকাতা যখন উত্তাল হয়ে উঠছে তখন বারবার নানাভাবে কন্ঠরোধ করতে চাইছে রাজ্যের সরকার। সবুজ মেরুন, লাল হলুদ, সাদা কালো সমর্থকদের ওপর যেভাবে পুলিশ লাঠিচার্জ করলো তাতে আরো বেশি করে প্রমাণ হল,  সরকার আসলে তার মেশিনারীকে ধর্ষকদের ধরার জন্য ব্যবহার করছে না বরং ব্যবহার করতে চাইছে প্রতিবাদকে দমন করার জন্য।

পুঁজিবাদ ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতা মহিলাদের ভোগ্যপণ্য হিসাবেই দেখতে চায়, দেখাতে চায়। পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারীদের চেয়ার কেঁপে ওঠে লাখ লাখ মহিলা রাত দখল করতে চাইলে। তাই তারা লুম্পেনদের  সামনে আনে তথ্য প্রমাণের লোপাটের জন্য এবং তামাম মহিলাদের সামনে পৌরষত্বের, মাসল পাওয়ারের বার্তা দেওয়ার জন্য-ভয় পাওয়ানোর জন্য। তারা ফতোয়া ঝুলিয়ে দিতে চায় ‘রাত মহিলাদের জন্য নিরাপদ নয়,তাই রাতে কাজ করা যাবে না’।

অথচ ৯ই আগস্টের পর থেকে আমরা দেখছি কলকাতা জুড়ে প্রতিবাদী মানুষের গর্জে ওঠা। আমরা প্রত্যক্ষ করছি স্বাধীনতার রাতে মেয়েদের রাত দখল শহরের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে গেছে মফস্বলে,প্রত্যন্ত গ্রামে। কলকাতা শহর এরই মধ্যে আবার দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার মেয়েদের রাত দখলের সাক্ষী থাকল। আর তাই স্বৈরাচার ভয় দেখাতে চাইছে,প্রতিবাদকে স্তব্ধ করতে চাইছে। সেকারণেই এইসবের বিরূদ্ধে আমাদের লড়তে হবে রাস্তায়। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পুরুষতন্ত্র কে কায়েম করতে চাওয়া এবং দুষ্কৃতিবাদের আড়ালে থাকা শক্তির সাথে যৌথভাবে প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ গড়ে তুলেই। যে বিপুল অংশের মানুষ  দুর্নীতির এই প্রতিষ্ঠানের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আমাদের লড়াইয়ে স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান করেছেন, যে বাবা মা মমতা ব্যনার্জীর ‘মানুষ বড় সস্তা’ ভাবনার ফলপ্রসূ ১০ লাখের ঔদ্ধত্যকে ফুতকারে উড়িয়েছেন তাদের প্রত্যেককে একসাথে নিয়েই আমাদের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা এগোবে। তিলোত্তমা সুবিচার না পাওয়া পর্যন্ত ,আর জি কর সহ বিভিন্ন হাসপাতালের এই সকল র‍্যাকেটের মূল মাথাদের না ধরা পর্যন্ত এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী ,পুলিশমন্ত্রী আদৌতে মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ না করা পর্যন্ত রাস্তা আমরা ছাড়ব না- ‘We shall not be moved’ !

Spread the word