অঞ্জন বসু
আজ যে মানুষটির জন্মদিন তিনি শুধু একজন অসাধারণ বিজ্ঞানীই নন,একজন অসাধারণ মানুষ ও ব্যক্তিত্ব বটে,তার তৈরী “বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল” থেকে ফিনাইল থেকে করোনা রোগে ব্যবহ্রত “হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ” প্রস্তুত হয়েছে ,তিনিই বাঙালীকে “স্বাবলম্বী ” হতে শিখিয়েছিলেন |
হ্যাঁ আজ “বিজ্ঞানাচার্য ” আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জন্মদিন,১৮৬১ সালের ২ রা আগষ্ট অবিভক্ত বাংলার যশোর জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলি গ্রামে প্রফুল্লচন্দ্র রায় জন্মগ্রহণ করেন,তার বাবার নাম ছিলো হরিশচন্দ্র রায় এবং মা ছিলেন ভুবনমোহিনী,এক বিত্তবান ও জমিদার বংশের সন্তান প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও সব বিষয়ে অত্যন্ত তুখোড় |
প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের শিক্ষাজীবন শুরু হয় তার বাবার তৈরী এম ই স্কুলে,এরপরে তিনি ১৮৭২ সালে কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন,কিন্তু রক্ত আমাশায় আক্রান্ত হবার দরুণ তিনি তার গ্রামে ফিরে আসেন ,তার বাবার লাইব্রেরীতে থাকা বই তার অবসর জীবনের সঙ্গী ছিলো |
যাইহোক দুবছর পরে অর্থাৎ ১৮৭৪ সালে তিনি কলকাতার অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং এখান থেকেই ১৮৭৮ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন, এরপরে তিনি মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) এ ভর্তি হন এবং এখান থেকেই এফ এ বা কলেজ ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি প্রেসীডেন্সী কলেজে বি এ ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৮৮১ সালে এখান থেকে বি এ পাশ করে তিনি গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং বি এসসি পাশ করেন সেখান থেকেই |
এই এডিনবরা কলেজ থেকেই তিনি একইসঙ্গে পি এইচ ডি ও ডি এসসি সি ডিগ্রীর জন্য পড়াশোনা শুরু করেন,দুবছরের কঠোর সাধনার পরে তিনি পি এইচ ডি ও ডি এসসি ডিগ্রী লাভ করেন,তার গবেষণার বিষয় ছিলো “কপার ম্যাগনেশিয়াম শ্রেণীর সম্মিলিত সংযুক্তি পর্যবেক্ষণ” তার এই গবেষণাপত্রটি “শ্রেষ্ঠ” হিসাবে মনোনীত হয় এবং তাকে “হোপ ” পুরস্কারে ভূষিত করা হয় |
১৮৮৮ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং প্রেসীডেন্সী কলেজে সহ অধ্যাপকের পদ অলংকৃত করেন,দীর্ঘ ২৪ বছর তিনি এই কলেজে অধ্যাপনার কাজ করেছিলেন এবং এখান থেকেই তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছিলেন,১৯০১ সালে মানিকতলায় ৪৫ একর জমিতে “বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ” প্রতিষ্ঠিত হয় |
তার অধ্যাপনার জন্য তাকে “আচার্য ” উপাধিতে ভূষিত করা হয় এবং বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু,মেঘনাদ সাহা,জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ প্রমুখেরা ছিলেন তার কৃতী ছাত্র এবং তিনি নিজে ছিলেন “আচার্য” জগদীশচন্দ্র বসুর সহকর্মী |
১৮৯৫ সালে তিনি “মারকিউরাস নাইট্রাইট” নামক জৈব যৌগের আবিস্কার করে সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দেন,এরপরে “সমবায় ” এর পুরোধা প্রফুল্লচন্দ্র রায় নিজ জন্মভূমিতে ১৯০৯ সালে একটি “কো অপারেটিভ ব্যাঙ্কের” প্রতিষ্ঠা করেন এবং আর কে বি কে হরিশ্চন্দ্র (নিজের পিতার নামে) একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯১৮ সালে “পি সি নামে” বাগেরহাট জেলায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন |
১৯১৯ সালে তিনি “নাইট ” উপাধি লাভ করেন এবং ১৯৩৬ সালে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “সাম্মানিক ডক্টরেট” উপাধি লাভ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,বেনারস ও মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি ” ডক্টরেট” উপাধি লাভ করেছিলেন |
সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই মানুষটি ছিলেন আদ্যন্ত স্বদেশপ্রেমিক,তিনি গোপনে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন,চপ,চা এসব দেখলে তিনি অত্যন্ত রেগে যেতেন তার বদলে মুড়ি এবং নারকোল খেতে খুব ভালোবাসতেন ,প্রসঙ্গত একবার সুভাষচন্দ্র বসু তার সঙ্গে দেখা করতে এলে তাকেও মুড়ি ও নারকোল খাইয়েছিলেন |
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও উদারমনা ব্যক্তিত্ব,তিনি প্রেসীডেন্সী কলেজের অন্য শিক্ষকদের বিরোধীতাকে অগ্রাহ্য করে ডঃ কুদরত এ খুদাকে তার বিষয়ে প্রথম বিভাগ দেন,তার কাছে যোগ্যতা ও মেধাই ছিলো আসল |
গ্রন্থাবলি
হিন্দু প্রাণীবিদ্যা
মোট গবেষণাপত্রের সংখ্যা ১৪৫ টি,
সরল প্রাণীবিজ্ঞান,বাঙালী মস্তিস্ক ও তার অপব্যবহার |
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় শুধু একজন বিজ্ঞানী বা রসায়নের দিকপাল ব্যক্তিত্ব হিসাবেই নন,তিনি পরিচিত হয়ে আছেন “দেশীয় শিল্পায়নের প্রবক্তা ” হিসাবেও ,কবি ও সাহিত্যিক হিসাবেও তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন |
১৯৪৪ সালের ১৬ ই জুন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্যে চলে গেছেন,বাঙালীর ব্যবসার প্রতি অনীহা ও চাকুরীর প্রতি অত্যধিক মোহকে তিনি তীব্র কষাঘাত করেছেন |
আজ “বিজ্ঞানসাধক” আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ১৬৪ তম জন্মদিনে তাকে জানাই প্রণাম ও শ্রদ্ধান্জলি