Site icon CPI(M)

Panchayat: A Story Of Loot (Part X)

Panchayat 10

২৩ অক্টোবর ২০২২, রবিবার

চন্দন দাস

দশম পর্ব

প্রায় ৮লক্ষ ১০ হাজার আসন। উত্তরপ্রদেশে — পঞ্চায়েতের তিনটি পর্যায়ে। বিজেপি পরিচালিত সেই রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছে ২০২১-র মে থেকে জুলাই — তিন মাস জুড়ে।

৩লক্ষ ১৯ হাজার ৩১৭টি আসনে কোনও নির্বাচনের দরকার হয়নি। কারন একের বেশি প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিলেন না। এর মধ্যে পঞ্চায়েত পর্যায়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন প্রায় ৩লক্ষ ১৭ হাজার জন। ব্লক পর্যায়ে এই সংখ্যা ২০০৫জন। জেলা পর্যায়ে বিনা নির্বাচনে জয়ী প্রার্থী ছিলেন ৭জন।

অর্থাৎ প্রায় ৪০% আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন একজন। এই ’একজন’-র বেশিরভাগ বিজেপি-র!

উদাহরণ?

উত্তর প্রদেশে ‘মহকুমা প্রমুখ’ আসন আছে ৮২৫টি। তার ৩৪৯টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একজন করে নির্বাচিত হয়েছেন। সেই ৩৪৯জনের ৩৩৪জন বিজেপি সমর্থিত। ‘জেলা পরিষদের সভাপতি’ নির্বাচনে কী হল? ৭৫টি আসন। ২৮%, অর্থাৎ ২১জন জিতলেন বিনা নির্বাচনে। তারা সবাই বিজেপি সমর্থিত।

উত্তর প্রদেশে সরাসরি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রতিক নিয়ে নির্বাচন হয় না পঞ্চায়েতে। কিন্তু এবার নির্বাচনের সময়েই বিজেপি জানিয়ে দেয়, কোথায় তারা কাকে সমর্থন করছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা বেশিরভাগ প্রার্থী বিজেপি-র। নির্বাচনের আগে, পরে বিরোধীদের ভয় দেখানো, হামলার মত অনেক অভিযোগ উঠেছে যোগী সরকারের বিরুদ্ধে।

ভয়ের ভোটে জিতেছে বিজেপি। উত্তর প্রদেশে। ত্রিপুরাতেও।

ত্রিপুরায় পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছে ২০১৯-র জুলাইয়ে। নির্বাচন না বলে প্রহসন বলাই শ্রেয়। কারন, সেই রাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের মোট আসন ৬৬৪৬টি। ১৪ই জুলাই নির্বাচন কমিশন ঘোষনা করেছিল,‘‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজেপি জয়ী হয়েছে ৫৬৫২টি আসনে।’’

অর্থাৎ প্রায় ৮৬% আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে বিজেপি। লড়াই হয়েছিল ৯৯৪টি আসনে। তার মধ্যে সিপিআই(এম)সহ বামফ্রন্ট প্রার্থী দিতে পেরেছিল ৪১৩টি আসনে। আটটি জেলা পরিষদের মোট আসন ১১৬টি। বিরোধী দলের প্রার্থী ছিল মাত্র ৭৯টি আসনে। এর মধ্যে সিপিআই(এম) লড়তে পেরেছিল মাত্র ৬৮টি আসনে। ৩৫টি পঞ্চায়েত সমিতির ২০টি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে নিয়েছিল বিজেপি। পঞ্চায়েত সমিতিগুলির আসন ৪১৯টি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পেরেছিল ৮২টি আসনে। সিপিআই (এম) লড়তে পেরেছিল ৫৭টি আসনে। গ্রাম পঞ্চায়েতে মোট ৬১১১টি আসন। লড়াই হয়েছিল মাত্র ৮৩৩টি আসনে। বামফ্রন্ট লড়তে পেরেছিল ৩১০টি আসনে।

যে ১৪% আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল, সেগুলিতেও জিততে ২০১৯-র ২৭শে এপ্রিল ব্যাপক ভোট লুট, হামলা চালিয়েছিল বিজেপি-র দুষ্কৃতীরা।

পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ফারাক বিশেষ নেই।

২০১৮-র ২২শে মার্চ। মেদিনীপুরে প্রশাসনিক সভা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। সেদিন তিনি বলেন,‘‘পঞ্চায়েত শাসক দলের হাতে না থাকলে কিভাবে কাজ হবে?’’ ইঙ্গিত স্পষ্ট — ‘কাজের’ জন্য পঞ্চায়েত দখল কর। আর কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত কী বলেছিলেন? রাজ্যের প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে বামফ্রন্টের তৎকালীন চেয়ারম্যান ১৯৭৮-র ১৯শে এপ্রিল কলকাতায় বলেছিলেন,‘‘বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচনে অনেক সময় সাধারন মানুষের প্রতিনিধিত্ব হয় না। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা সাধারন মানুষকেই নির্বাচিত করতে চাই। সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।’’

তফাৎ গনতন্ত্র সম্পর্কে ধারনায়।

মমতা ব্যানার্জির শাসনে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০১৩-র জুলাইয়ে। রাজ্যের মোট ৪৮৮০০টি পঞ্চায়েতের আসন ছিল। নির্বাচনের আগেই, আতঙ্ক সৃষ্টি করে ৫৩৫৬টি আসন দখল করেছিল তৃণমূল। পঞ্চায়েত সমিতির ৯২৪০টি আসনের মধ্যে ৮৭৯টি আসনেরও একই কায়দায় দখল নিয়েছিল তারা। রাজ্যে ১৭টি জেলা পরিষদের মোট আসন ছিল ৮২৫টি। তার মধ্যে ১৫টি আসনও ভোটের আগেই দখল করেছিল তৃণমূল। তারপরও যেগুলিতে নির্বাচন হয়েছিল, সেগুলিতে দেদার ছাপ্পা, ভোট লুঠ, বিরোধীদের মেরে বের করে দেওয়া, বুথ দখল করে পঞ্চায়েত দখল করতে চায় তৃণমূল কংগ্রেস। পাঁচ দফা নির্বাচন শেষে ফলপ্রকাশ ৩রা আগস্ট। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘এই জয় গণতন্ত্রের জয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির জয়।’’

জয়ী হয়েছিল ৫১শতাংশ আসনে। সতেরোটার মধ্যে তেরোটা জেলা পরিষদ দখল করে। যদিও গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের প্রায় অর্ধেক আসনেই তৃণমূল হেরে গিয়েছিল। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা-বুথ দখল-ছাপ্পা ভোট-ভোট লুট করেও তৃণমূল জয়ী হয়েছিল ৫১শতাংশ আসনে। তার মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা প্রায় ৫৫০০ আসনও ছিল। সেগুলি বাদ দিয়ে হিসাব করলে সোজাসুজি ভোটে লড়াই করে তৃণমূল জিতেছিল মাত্র ৪৫শতাংশ আসনে। আবার এই শতাংশের হিসাবে বুথ দখল, ব্যাপক ছাপ্পা ভোট এবং গণনার সময় ভোট লুটের হিসাবও থাকছে।

তবু বামফ্রন্ট জয়ী হয়েছিল ১৫,৫৯৩টি আসনে। শতাংশের বিচারে ৩২ভাগ। কংগ্রেস ৫৫০৬টি আসনে জিতেছিল। শতাংশের বিচারে ১১ভাগ।

সরকার গঠনের পরে প্রথম নির্বাচনেই জোর জুলুমের পরেও বেশ ধাক্কা খাওয়ায় পরের নির্বাচনে আরও মরীয়া হয়েছিল তৃণমূল।

জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর এবং মুর্শিদাবাদে তৃণমূল জিততে পারেনি। একইভাবে বহু পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েতেও বিরোধীদের জয় হয়েছিলো। কিন্তু তাতে কি! নির্বাচনের পরে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে শুরু হয় নতুন খেলা। গরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য এমন সব ঘৃণ্য প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেওয়া হয় যা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে শুধু নতুন নয়, শিউড়ে দেওয়ার মতন। 

দল ভাঙিয়ে পঞ্চায়েতের তিন স্তরেই দখলদারি শুরু হয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়াটি হলো নির্বাচিত সদস্যকে প্রাণে মেরে দেওয়া। সন্ত্রাসের পর্ব পেরিয়েই যেখানে বামপন্থীরা পঞ্চায়েত গঠন করেছিল, অঙ্ক কষে সেখানে খুনও করা হয়েছে। সভাপতি হিসাবে কাজ শুরুর আগেই নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে উত্তর ২৪ পরগণার হাসনাবাদ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম গাজিকে খুন করা হয়েছিল।

২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের কয়েক ঘণ্টা আগে, ১৪ই মে গভীর রাতে কাকদ্বীপে দীপঙ্কর দাসের বাবা, মা-কে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা। তার কিছুদিন আগে গোঘাটে কী ঘটেছিল? বিশ্বনাথ কারকের স্ত্রী, পুত্রবধূ ৭ই এপ্রিল মহকুমা শাসকের অফিসে গেছিলেন পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র জমা দিতে। অফিসে ঢুকতে পারেননি তাঁরা। তার আগেই পুলিশের সামনে তাঁদের চুল ধরে মাটিতে ফেলে, শাড়ি খুলে দিয়ে, মুখে কালি ছিটিয়ে দিয়েছিল মমতা ব্যানার্জির দলবল।

৪০জন খুন হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে, ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে।

মমতা ব্যানার্জির সরকারের প্রকাশিত হিসাব অনুসারে ৫৮,৬৯২টি আসনের মধ্যে ২০,১৭৮টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসক দলের প্রার্থীরা ‘জয়ী’ হয়েছিল। গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক এই তথাকথিত নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। শুক্রবার সেই মামলার রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। যদিও সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ওই প্রায় ৩৪.৩৭ শতাংশ বিরোধীহীন আসনে তৃণমূলই জিতেছে বলে সাব্যস্ত হয়েছে। তবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় যে ‘গুরুতর’ তা বলতে বাধ্য হয় সুপ্রিম কোর্টও।

যেখানে নির্বাচন হয়েছে, সেখানে বুথ দখল হয়েছে বেপরোয়া। ১৯জনের প্রাণহানি ঘটেছিল নির্বাচনের দিন — ১৪ই মে। বেপরোয়া ভোট লুটে মরীয়া তৃণমূলের দুষ্কৃতীবাহিনীর হাতে ৫ জন সিপিআই (এম) কর্মী সমর্থকসহ ১২জন খুন হয়েছিলেন। আরও বাকি আছে। যখন ভোটগণনা হচ্ছে, সেখানেও তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের দেখা গেছে ছাপ্পা দিচ্ছে প্রকাশ্যে, ক্যামেরার সামনে। হিংসার প্রতিক্রিয়ায় রেহাই পাননি তৃণমূলও। গ্রামবাসীদের প্রতিরোধে অন্তত ৭জন তৃণমূলকর্মীর মৃত্যু হয়েছে।

ক্রমশ

পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক চন্দন দাসের এই প্রবন্ধটি মোট ১২ টি পর্ব প্রকাশিত হবে।

Spread the word