Site icon CPI(M)

Order Prevails in Berlin: Rosa Luxemburg

Read Rosa

প্রাককথন

জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৯ সালের ১লা জানুয়ারি। এর ঠিক দু সপ্তাহ পরে ১৫ই জানুয়ারি রোজা লুক্সেমবার্গ কার্ল লিবনেখটকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে যায় জার্মানিতে সর্বহারা বিপ্লবের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

গ্রেপ্তার করে রোজা তার সহযোগীদের জেলে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু যাওয়ার পথেই তাকে খুন করা হয়।  ল্যান্ডহ্যয়ার খালের জলে রোজার মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয়। খুনিদের পরিচয় বহু Year অবধি অজানা ছিল। ১৯৯৩ সালে, জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয় দ্য মার্ডার অফ রোজা লুক্সেমবার্গ ক্লাউস গেটিংগারের লেখা সে বইতেই আততায়ীদের বিশদ বিবরণ রয়েছে। কারাগারে নিয়ে যাওয়ার গাড়িতে ওঠার সময় ইনফ্যান্ট্রি অফিসার অট্টো রুঙ্গে রোজার মাথায় রাইফেলের বাঁট দিয়ে সজোরে আঘাত করেন। গাড়ির পাদানিতে পড়ে গেছিলেন, কোনোমতে ওঠার চেষ্টা করছেনঠিক তখনই আরেক ইনফ্যান্ট্রি অফিসার হেরম্যান জুশোঁ তার কপালের বাঁদিকে রিভলভার চেপে ধরে গুলি চালিয়ে দেন। জুশোঁ রিভলভারের গুলিতেই রোজার মৃত্যু হয়, তিনিই খুনি। খালের জলে ভাসিয়ে দেওয়ার সময় আততায়ীরা চিৎকার করে বলতে থাকে– ‘ লাশের সাথে ভাইমার রিপাবলিকেরও সলিল সমাধি ঘটল তাকে হত্যা করার তিন মাসের মধ্যে অন্য আরও বিপ্লবী কমিউনিস্টদের সাথে রোজার দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গী লিও জোগিচেসকেও হত্যা করা হয়েছিল। ইতিপূর্বে State ওয়েবসাইটের পক্ষ থেকে আমরা লিও’কে রোজার লেখা তিনটি চিঠির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছি।

যাকে লেনিন বিপ্লবের ঈগল বলে চিহ্নিত করেছিলেন তারা ব্যর্থ হলেন কেন?

কীভাবে?      

রোজা নিজেই সে মূল্যায়ন করে গেছেন।

তার মৃত্যুর আগে ‘লাল নিশান’ (র‍্যতে ফ্যানা)নামের পত্রিকায় একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। সে প্রবন্ধ লিখেছিলেন রোজা নিজেই। ইতিহাস নির্দিষ্ট বিপ্লবী পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই চুড়ান্ত সংগ্রামে নামার মূল্য চোকাতে হয়েছিল জার্মান কমিউনিস্টদের। পরাজয় থেকে কমিউনিস্টরা অভিজ্ঞতা অর্জন করে, কীভাবে সেই ঐতিহাসিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় প্রবন্ধে রোজা তারই উল্লেখ করেন। তার শেষ রচনা বলেই প্রবন্ধের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে এমন না। প্রবন্ধের শেষে রোজা এক অদম্য বিপ্লবী উত্তরাধিকারের ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছেন। ইতিহাসের সার সংগ্রহ করে আগামিকে আঁচ করার দূরদৃষ্টি, নির্মম আক্রমণের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও মাথা তুলে সত্য কথা বলার সাহস তার ছিল। প্রবন্ধ সেই মেজাজেরই প্রতিফলন।

Order Prevails in Berlin’ শিরোনামে মূল প্রবন্ধটি মার্কসিস্ট ডট অর্গ ওয়েবসাইটের ইংরেজি সংস্করণ থেকে সংগৃহীত। সেখানে প্রবন্ধটি লেখার প্রকাশের তারিখ একই দিনে১৪ই জানুয়ারি, অর্থাৎ তার মৃত্যুর ঠিক আগের দিন। প্রবন্ধ লেখা তা প্রকাশের তারিখ একই হওয়াটা কতদূর সঠিক নিয়ে ওয়েবডেস্কের কিছু সংশয় রয়েছে।

বার্লিন নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে

রোজা লুক্সেমবার্গ

১৮৩১ সালে প্যারিসে ডেপুটিদের সভায় মন্ত্রী সেবাস্তিয়ানি ঘোষণা করেছিলেনওয়ারশতে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কোন পরিস্থিতিতে তিনি অমনটা বলেছিলেন? প্রাগের মফঃস্বল অঞ্চল ধ্বংস করার পরে কষাই মত করে বিদ্রোহীদের হত্যা করার জন্য পাসকেভিচের লুঠেরা বাহিনী তখন পোল্যাণ্ডের রাজধানী আক্রমণ করেছে।

আমাদের এখানে বুর্জোয়া সংবাদপত্রগুলি ঠিক সেই কায়দায় বিজয়োল্লাস করছে। এবার্ট নোস্কে এবংবিজয়ী বাহিনী অফিসাররা  ‘বার্লিনে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে’; রুমাল উড়িয়েহুররে!’ বলে চিৎকার করে একই দাবি করছে। বার্লিনের পাতি বুর্জোয়াদের ভিড় এদের উৎসাহ যোগাচ্ছে। বিশ্ব ইতিহাসের সামনে জার্মান অস্ত্রের গর্ব সম্মান প্রমাণিত। যারা ফ্লেন্ডার আরগোনিতে নাস্তানাবুদ হয়েছিলো,  তারা তাদের সম্মান ফিরে পেয়েছেন এক চমৎকার বিজয়ের মাধ্যমে- ৩০০ জনের বেশিস্পার্টাসিস্টস Vorwart’ বাড়িতে আটক। সেই দিনগুলি যখন গর্বিত জার্মান বাহিনী প্রথমে বেলজিয়ামে প্রবেশ করে। লিয়েজে বিজয়ী জেনারেল ভন এমমিখের সেই দিনগুলি, যখন ম্লান হয়ে যান রেইনহার্ডট বাহিনীর সামনে। সরকারের তছনছ করা বাহিনী সেই মধ্যস্থতাকারীদের ধ্বংস করে যারা ভরোয়ার্টস (Vorwarts) বিল্ডিং আত্মসমর্পণের বিষয়ে চেষ্টা করছিলেন। ধ্বংস করে,  মধ্যস্থতাকারীদের আঘাত করে রাইফেলের বাট দিয়েতাদের বোঝার আগেই। যে বন্দীরা দেওয়ালে লাইন করে অপেক্ষমানতাদের কষাই মতন এতো হিংস্র ভাবে আক্রমণ করে যে তাদের মাথার খুলি মস্তিস্কের ঘিলু যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়ে। বর্ণিত উজ্জ্বল কাজকর্ম দেখে,  কে আর স্মরণ করবে ফরাসী, ব্রিটিশ আমেরিকানদের হাতে অসম্মানজনক পরাজয়ের? এখনস্পার্টাকাসহলো শত্রু। বার্লিন হলো সেই জায়গা যেখানে আমাদের অফিসাররা বিজয়ের স্বাদ গ্রহণ করছেন।শ্রমিকনোস্কে এখন জেনারেল যে বিজয় অর্জন করতে পারে যেখানে লুডেনডর্ফ ব্যর্থ।

কার মনে পড়ছে না প্যারিসেআইন শৃঙ্খলারক্ষিত হবার মাতাল ভিড়ের উৎযাপন? কার মনে পড়ছে না কমিউনার্ডদের শবের উপর বুর্জোয়াদের অসচ্চরিত্র উৎযাপন!! সেই একই বুর্জোয়া যারা একটু আগেই প্রুশিয়ানদের কাছে লজ্জাজনক ভাবে আত্মসমর্পণ করেছে আক্রমণকারী শত্রুর হাতে রাজধানী ছেড়ে দিয়েছেতাদের পায়ে পায়ে ঘুরছে পদানত কাপুরুস হিসাবে। ওহ! কি ভাবে এই বুর্জোয়াদের প্রিয় সন্তানদেরস্বর্ণাভ যৌবনে পুরুষোচিত সাহস ফিরে আসে সামান্য অস্ত্রে সজ্জিত ক্ষুধার্তপ্যারিসের সর্বহারা তাদের নারী সন্তানদের বিরুদ্ধে!? কি ভাবে রোমান রণদেবতার এই সাহসী সন্তানেরা পাশবিক নিষ্ঠুরতার সাথে আত্মরক্ষা করতে অক্ষম মানুষ, বন্দী পতিতদের বিরুদ্ধে আক্রোশ মেটায়, যখন তারা নিজে বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে নিজের গলায় বকলেস এঁটে নতজানু হয়!?

ওয়ারশতে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে

প্যারিসে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে

বার্লিনে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে

প্রতি অর্ধশতাব্দী অন্তর এই রকম বুলেটিন প্রচারিত হয়নিয়ন্ত্রকদের অভিভাবকদের তরফ থেকে, বিশ্বের ঐতিহাসিক সংগ্রামের এক কেন্দ্র থেকে পরের কেন্দ্রে।আনন্দিতবিজয়ীরা এটা  খেয়াল করতে ব্যর্থ হয়,  যেকোনও নিয়ন্ত্রণ যার তা বজায় রাখতে প্রয়োজন হয় রক্তাক্ত ছিন্ন মস্তিস্ক, সে আসলে ক্ষমাহীন ভাবেই নিজের ঐতিহাসিক পরিণতি, তার নিজের ধ্বংসের দিকে হাঁটছে।

বার্লিনে এই সময়েস্পার্টাকাস সপ্তাহমানে কি? এটা কি নিয়ে এসেছে? এটা আমাদের কি শিক্ষা দেয়? যখন আমরা সংগ্রামের মধ্যে, যখন প্রতিবিপ্লবীরা তাদের বিজয় সম্পর্কে চিৎকার করছে, বিপ্লবী সর্বহারাকে হিসাব করতে হবে কি হয়েছে প্রতিটি ঘটনাকে তার ফলাফলকে মহান ইতিহাসের মাপকাঠিতে বিশ্লেষণ করতে হবে। নষ্ট করার মত সময় বিপ্লবের নেই। কোন দ্বিধা ছাড়াই এখন উন্মুক্ত কবর পেরিয়ে, ‘জয়’ ‘পরাজয় পাশ কাটিয়ে সম্মুখপানে নিজের লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে হবে। আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াকুদের প্রথম কাজ হবে বিপ্লবী নীতি পথ অনুসরণ করা।

এই সংঘর্ষের থেকে কি বিপ্লবী সর্বহারার চূড়ান্ত বিজয় আশা করা যায়? এবর্টস্কেইডেমমানের উচ্ছেদ সমাজতান্ত্রিক একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কি আমরা আশা করতে পারি? যদি আমরা সতর্ক ভাবে প্রশ্নকে ঘিরে সমস্ত পরিবর্তনশীল উপাদনের তুল্যমূল্য বিবেচনা করি, উত্তর হবে নিশ্চিতভাবেই না। বিপ্লবী প্রস্তুতির দুর্বল সূত্র হলো সৈন্যদলের রাজনৈতিক অপরিপক্কতা। যারা এখনো মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লবী লক্ষ্যে নিজেদের অফিসারদের অপব্যবহার করতে দেয়। এই একটি ঘটনাই দেখিয়ে দেয় মূহুর্তে কোনও সুদূরপ্রসারী বিপ্লবী বিজয় অর্জন সম্ভব না। অন্যদিকে সামরিক বাহিনীর অপরিপক্কতা হল জার্মান বিপ্লবেরই অপরিপক্কতার লক্ষণ।

সৈন্যবাহিনীর নিম্নতম স্তরের বৃহৎ শতাংশ যেখান থেকে আসে, সেই গ্রামাঞ্চলকে বিপ্লব আদৌ ছুঁতে পেরেছে। বার্লিন এখনও পর্যন্ত গোটা দেশের থেকে কার্যতঃ বিচ্ছিন্ন। একথাটা সত্যি যে রাইনল্যাণ্ড, উত্তর উপকূল, ব্রুনসউইক, স্যাক্সনি, ভুর্টেমবার্গ (Wurttemberg) মত বিভিন্ন অঞ্চলের বিপ্লবী কেন্দ্রগুলি বার্লিনের শ্রমিকদের পিছনে সর্বস্ব নিয়ে অপেক্ষা করে রয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তারা সমান ছন্দে একে অন্যের সাথে এগোতে পারছে না। এখনো পর্যন্ত কাজের বেলায় তেমন কোনও ঐক্য নেই যা বার্লিনের শ্রমিক শ্রেণির এগোনর ঘাত লড়াই ইচ্ছাকে অতুলনীয় ভাবে আরও ফলপ্রসূ করতে পারত। আরও একটা Subject থেকে যাচ্ছে। সেটিই হল বিপ্লবের অপরিপক্কতার একমাত্র গভীর কারণঅর্থনৈতিক সংগ্রাম এখনো পর্যন্ত তার একেবারে প্রাথমিক স্তরে আছে। সেটাই বিপ্লবের প্রকৃত আগ্নেয় উৎস। এগুলিই কারণ, যা বুঝিয়ে দেয় বিপ্লবী শ্রেনি সংগ্রাম কেন নিজের শৈশবে পড়ে রয়েছে।

সমস্ত আলোচনা যে বাস্তবতায় পৌঁছে দেয়, তা হল এক নিশ্চিত দীর্ঘস্থায়ী বিজয়ের উপর মূহুর্তে নির্ভর করা যায় না। এর মানে কি এই যে গত সপ্তাহের লড়াই একটাত্রুটি’? যদি আমরা এক পূর্বপরিকল্পিতঅভিযানউৎখাতে  কথা বলি, তবে এসবের উত্তর হবে হ্যাঁ। কিন্তু সপ্তাহের লড়াই কী থেকে শুরু হল? আগেকারর সব ক্ষেত্রের মতই, যেমনটি হয়েছিল গত ২৪ ডিসেম্বর। এটা ছিল সরকারের তরফ থেকে এক হিংস্র উস্কানি। সোজিসস্ত্রাসে (Chausseestrasse)-তে আত্মরক্ষাহীন বিক্ষোভকারীদের রক্তস্নানের মত, কষাই মত নাবিকদের কুচি কুচি করে কাটার মত, এবার বার্লিন পুলিশের সদর দপ্তরে আক্রমণই ছিল পরবর্তী যাবতীয় ঘটনার কারণ। নিজস্ব প্রক্রিয়ায় সমান পরিস্কার লড়াই ময়দানে বিপ্লব বিকশিত হয়নি,   চতুর কৌশলীর ধূর্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়েছে।

এছাড়াও যা মনে রাখতে হবে তা হল বিপ্লবের শত্রুরা আগে উদ্যোগ নিয়েছে। যুদ্ধ জেতার নিয়ম মেনে বিপ্লবের তুলনায় নিজেদের উদ্যোগের বারংবার প্রয়োগও তারা করেছে। এবার্টস্কেইডিমানের নির্লজ্জ উস্কানির মুখোমুখি হয়ে বিপ্লবী কর্মীরা প্রতিবিপ্লবকে বাধা দেওয়ার জন্য নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়। নিজের উপরে শাণিত আক্রমণকে দ্রুত নিবারণের উপরেই বিপ্লবের ইজ্জত নির্ভর করে। সমস্ত শক্তি নিয়ে লড়াই চালাতে হয়, যাতে প্রতিবিপ্লবী শক্তি নিরুৎসাহিত হয়। এমনটা করতে হয় যাতে সর্বহারার বিপ্লবী বাহিনীর শেষ স্তর আন্তর্জাতিকের সমীপে জার্মান বিপ্লবের নৈতিক মর্যাদায় এতটুকুও চিড় না ধরে।

শক্তি দৃঢ়তার সাথে বার্লিনের জনগণের তরফে প্রতিরোধের সামনে তাৎক্ষণিক স্বতঃস্ফূর্ত বাধাগুলি এমনভাবে উড়ে যায় যে প্রথম দফায় রাস্তা নৈতিক জয় ছিনিয়ে নেয়।

বিপ্লবের একেবারে বুনিয়াদী আভ্যন্তরীন নিয়মই হলো, প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করার পর আর কখনো তা স্থির থাকে না, আর কখনো নিস্ক্রিয় বা নিরীহ থাকতে পারে না। শক্তিশালী আক্রমণই হল আত্মরক্ষার সবচাইতে ভালো উপায়। যে কোন লড়াইতে এটাই প্রাথমিক নিয়ম, বিপ্লবের প্রতিটি স্তরে একথা আরও বেশি করে সত্যি। বার্লিনের সর্বহারার স্বাস্থ্যকর সহজাত প্রবৃত্তি অন্তর্লীন তরতাজা শক্তির এও এক বহিঃপ্রকাশ যে আচরণবিধির পুনর্বহালে তারা খুশি হয়নি, বরং স্বতঃস্ফুর্তভাবেই তারা বুর্জোয়া সংবাদপত্র, আধা সরকারী সংবাদ সংস্থা, ভরোয়ার্টস (Vorwarts)’র দপ্তরের মতো প্রতিবিপ্লবী কম্যাণ্ড পোস্টগুলি দখল করেছে।  এসব কাজ আসলে ফলাফল। জনগণের সহজাত উপলব্ধি এই যে প্রতিবিপ্লব পরাজয় স্বীকার করবে না বরং তা নিজের শক্তির সমাবেশ ঘটাবে।

এখানেই আমরা পুনরায় বিপ্লব সংক্রান্ত এক মহান ঐতিহাসিক নিয়মের মুখোমুখি হই। যার মুখোমুখি হয়ে পাতি ইউএসপিডি ধাঁচারবিপ্লবীদের কুতর্ক অহংকার টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়ে। বিপ্লবের মূল সমস্যা পরিস্কার হওয়া মাত্রই যে কোন অজুহাতে লড়াই থেকে সরে পড়ার জন্য তারা উদগ্রীব হয়ে থাকে। বিপ্লবে সেই মূল সমস্যাটি হল এবার্টস্কেইডেমান সরকারকে উৎখাত করা। সমাজতন্ত্রের বিজয়ের পথে প্রাথমিক বাধা সরকার। মূল সমস্যাটি বারংবার নিজের সামগ্রিকতা নিয়েই সামনে আসবে। এক স্বাভাবিক নিয়মের অনিবার্যতা রূপে, লড়াই প্রতিটি অধ্যায় পরিপূর্ণ ভাবে সেই সমস্যাকে উন্মোচিত করবে। সমস্যা সমাধানের জন্য বিপ্লব কতখানি অপ্রস্তুত অথবা পরিস্থিতি কতখানি অপরিপক্ক তার তয়াক্কা না করেই তেমনটি ঘটবে। যাবতীয় আংশিক লড়াইকে একজোট করার জন্য একমাত্র সূত্রায়ন রূপে প্রত্যেকটি বিপ্লবী সংকটের প্রেক্ষিতেএবার্টস্কেইডেমান নিপাত যাক!’ স্লোগানটি নিশ্চিতভাবেই উত্থাপিত হবে। সুতরাং নিজস্ব আভ্যন্তরীন বিষয়গত যুক্তির ভিত্তিতেই প্রত্যেক ঘটনাকে লড়াইতে ফুটিয়ে তোলার জন্য বিপ্লব এগোনোর পথে মূল সমস্যাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সামনে টেনে আনবে, সেটা কোন ব্যক্তির ইচ্ছা হোক বা না হোক।

বিপ্লবী প্রক্রিয়ার প্রাথমিক স্তরে সুতীক্ষ্ণভাবে উত্থাপিত কর্তব্যকে সমাধান করার জন্য, কার্যে পরিণত করার জন্য কোনও পূর্বশর্তের অনুপস্থিতির মধ্যেকার দ্বন্ধ, বিপ্লবের আলাদা আলাদা লড়াইকে আনুষ্ঠানিক পরাজয়ে পরিণত করে। কিন্তু বিপ্লব হলযুদ্ধেরকেবলমাত্র একটি ধরণ। ইতিহাসের আরও একটি অদ্ভুত নিয়ম রয়েছেএকের পর একটি পরাজয় মধ্যে দিয়েই কেবলমাত্র শেষ বিজয় অর্জিত হয়।

সমাজতন্ত্রের সামগ্রিক ইতিহাস সমস্ত আধুনিক বিপ্লব আমাদের কি শেখায়? ইউরোপে শ্রেণি সংগ্রামের আলোকঝলক, ১৮৩১ সালে লিওনে সিল্ক বুননকারীদের বিদ্রোহ এক বিশাল পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল। ব্রিটেনে চার্টিস্ট আন্দোলন শেষ হয়েছিল পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। ১৮৪৮ সালে প্যারিসের সর্বহারাদের উত্থান এক ধ্বংসাত্বক পরাজয়ে পরিণত হয়। প্যারি কমিউন এক ভয়ংকর পরাজয়ের মধ্য দিয়েই শেষ হয়। বিপ্লবী লড়াই সাথে সংযুক্ত সমাজতন্ত্রের গোটা রাস্তায় একের পর এক বজ্রাঘাতসম পরাজয় ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু একই সাথে মনে রাখতে হবে পরাজয়ের বোঝা ঘাড়ে নিয়েই ইতিহাস ধাপে ধাপে চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে এগিয়ে যায়। সমস্তপরাজয়গুলি ছাড়া আজকে আমরা কোথায় এসে পৌঁছতাম? পরাজয় থেকে অর্জিত ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, বোঝাপড়া, ক্ষমতা মতাদর্শ ছাড়া আমরা কোথায় দাঁড়াতাম? আজকে যখন আমরা সর্বহারার শ্রেণি সংগ্রামের লড়াইতে আগুয়ান, আমরা দাঁড়িয়ে আছি এই পরাজয়গুলির ভিত্তির উপর। এদের বাদ দিয়ে আমরা এগোতে পারবো না, কারণ আমাদের শক্তি বোঝাপড়ায় এরা প্রত্যেকেই অবদান রেখেছে।

বিপ্লবী লড়াই সংসদীয় লড়াই সম্পূর্ণ বিরোধী। জার্মানীতে চার যুগ ধরে আমরা কেবলমাত্র সংসদীয়জয়পেয়েছি, আর কিছু নয়। সত্যি বলতে আমরা এক জয় থেকে অন্য জয়ে ভ্রমণ করেছি। কিন্তু ১৯১৪ সালের ৪ঠা আগস্ট আমরা যে ভয়ংকর ঐতিহাসিক পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিলাম তার ফলাফল হল তুলনাবিহীন ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক নৈতিক পরাজয়। আজ পর্যন্ত বিপ্লব আমাদের পরাজয় ছাড়া কিছু দেয়নি। কিন্তু এই অনিবার্য পরাজয়গুলি ভবিষ্যতের চূড়ান্ত বিজয় সম্পর্কে একের পর এক নিশ্চিত সম্ভাবনাকে জড়ো করেছে।

কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন রয়েছে, এই সকল পরাজয়গুলির কারণ কী? কি এমন ঘটেছে যাতে ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসা লড়াই শক্তিকে অপরিপক্ক ঐতিহাসিক বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে অথবা সিদ্ধান্তহীনতা, দোলাচল অভ্যন্তরীন দুর্বলতা বিপ্লবী আবেগকে পঙ্গু করে দিয়েছে?

উভয় ক্ষেত্রের চিরায়ত উদাহরণ হল ফ্রান্সের ফেব্রুয়ারী বিপ্লব অন্যটি হল জার্মানীতে মার্চ বিপ্লব। ১৮৪৮ সালে প্যারিসের সর্বহারাদের সাহস হয়ে উঠেছিলো সমগ্র আন্তর্জাতিক সর্বহারাদের শ্রেণি সংগ্রামের শক্তির ফোয়ারা। একই বছরে জার্মানীর মার্চ বিপ্লবের শোচনীয় ঘটনা আধুনিক জার্মানীর বিকাশকে এমন ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে যাতে জার্মানীর বিকাশ শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ে। জার্মান বিপ্লবের বিষয়ে এখনও পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে ঘটছে এবং যে নাটকীয় সংকটের অভিজ্ঞতা আমরা সঞ্চয় করেছি তা নিয়ে নির্দিষ্ট ইতিহাসের বয়ানে সরকারী জার্মান সমাজতন্ত্রী গনতান্ত্রিকরা চিৎকার করছে।

উপরে আলোচিত ঐতিহাসিক প্রশ্নের আলোকেস্পার্টাকাস সপ্তাহ পরাজয়কে কি ভাবে দেখা যায়? এটা কি একটা আবেগ সর্বস্ব, অনিয়ন্ত্রিত বিপ্লবী শক্তির, সম্পূর্ণভাবে পরিপক্ক নয় এমন এক পরিস্থিতির সাথে মুখোমুখি সংঘাত অথবা এক দুর্বল সিদ্ধান্তহীনতার প্রয়োগ?

দুটোই! সংকটটি দ্বৈত চরিত্রের। একদিকে বার্লিনের জনগণের শক্তিশালী সিদ্ধান্তে দৃঢ়সংকল্প মনোভাব অন্যদিকে বার্লিনের নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনিশ্চয়তা, শিথিলহৃদয়ের দোলাচলের দ্বন্দ্ব। এটাই মোদ্দা কথা যে Leadership ব্যর্থ। কিন্তু জনগণকে নিজেদের মধ্যে থেকেই এক নতুন Leadership তৈরী করতে হবে। জনগণই হল সবচাইতে জরুরী বিষয়। তারাই হলেন সেই শিলা যার উপর বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয় নির্মিত হবে। জনগণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এবারের পরাজয় থেকে তারা আগেকার ঐতিহাসিক পরাজয়গুলির সাথে একই সূত্রে নিজেদের যুক্ত করেছেন। সমস্ত পরাজয় আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের গর্ব শক্তি। সেজন্যই এবারেরপরাজয়থেকেও ভবিষ্যতের বিজয় উৎসারিত হবে।

‘বার্লিন নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে’

যত সব নির্বোধ দালালের দল!

তোমাদের নিয়ন্ত্রণআসলে বালির বাঁধ!

আগামীকাল বিপ্লব আবারতার অস্ত্রের ঝলকানি সহ জেগে উঠবে’।

তোমাদের আতঙ্ক তৈরী করে তার ভেরীর গনগনে আওয়াজে ঘোষণা করবে

আমি ছিলাম, আমি আছি, আমিই থাকবো

রোজা লুক্সেমবার্গের লেখার ভাষান্তরগৌতম গাঙ্গুলি

প্রাককথন- ওয়েবডেস্কের পক্ষে সৌভিক ঘোষ

ছবি- সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত

Spread the word