Site icon CPI(M)

ইতিহাস ভুলবে না নেতাজীর সঙ্গে আরএসএসের বিশ্বাসঘাতকতার দাস্তান – ময়ূখ বিশ্বাস …


২৩ জানুয়ারি,২০২১ শনিবার

আমাদের স্কুলে সুগতবাবুর ইতিহাস ক্লাসে প্রায়ই বিতর্কের সূত্রপাত হত- কে শ্রেষ্ঠ? গান্ধী না নেতাজী! স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি মানসে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আপোষহীন ভাবে লড়াই করা সুভাষ ও তার আজাদ হিন্দ ফৌজ চেতনার জগতের অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছিল। আমাদেরও তা ছুঁয়ে ছিল। বলা ভালো সেটাই রাজনীতিতে আসার সহজপাঠ ছিল। ভালো লাগত বিরোধ থাকা সত্ত্বেও নেতাজী কি সুন্দরভাবে আজাদ হিন্দ ফৌজের তিনটি ব্রিগেডের নাম যথাক্রমে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদের নামেই রেখেছিলেন। এটাই শ্রদ্ধা। পথ আলাদা হলেও যে লড়াই ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে তারা করছে, তাদের প্রতি সম্মান নেতাজী দেখিয়েছিলেন।এটাই তার মহত্ব। অন্যদিকে চাড্ডিরা তখন কোথায়! বরং মনে রাখতাম জ্যোতি বাবু যখন বিলেতে সুভাষ বোসের সাথে দেখা করেছিলেন, সেই সময় সুভাষ বোসের অমোঘ বাণী, “Politics is not bed of roses.” আমাকে বা আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাত বড্ড এগুলো।
আসি এবার একটু আধুনিক ইতিহাসে।কংগ্রেসে থাকাকালীন নেতাজী ও নেহেরু ছিলেন সোভিয়েত ঘেঁষা। সোভিয়েত রাশিয়ার সাফল্যে তাঁরা যথেষ্টই অনুপ্রাণিত ছিলেন। পূর্বে জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে ভারতীয় কমিউনিস্টদের পূর্বেকার বিচ্ছেদ নিয়ে সুভাষ আমাদের কমিউনিস্টদের সমালোচনা করলেও পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট ‘ইউনাইটেড পিপলস্‌ ফ্রন্ট’ এবং পরে ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট’-এর লাইন সুভাষচন্দ্রের কাছে অনেক গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। কংগ্রেস সভাপতিরূপে সুভাষচন্দ্র বসু বাংলার কমিউনিস্টদের কাছেও অনেক বেশি কাছের হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষত হরিপুরা কংগ্রেস নিয়েও বাংলায় কমরেডদের প্রভূত উৎসাহ ছিল।আর একথা সর্বজনবিদিত যে, ত্রিপুরী কংগ্রেসে যে ‘প্লান অব ওয়ার্ক’ কমিউনিস্টরা রেখেছিল পরবর্তীকালে সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লকের যে কর্মসূচী প্রণয়ন করেন তা ছিল এরই প্রতিলিপি। এসবের ফলে ১৯৩৮ সাল থেকেই কমিউনিস্ট ও সুভাষ বোস একে অপরের খুবই কাছের হয়ে উঠেছিলেন। কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে তিনি শ্রদ্ধাভরে বলেন ,‘‘আমি সর্বদাই মনে করে এসেছি এবং বিশ্বাস করি যে মার্কস ও লেনিন অনুসারী কমিউনিজম এবং কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের আদর্শ ও নীতিসমূহ সর্বদাই জাতীয় মুক্তি সংগ্রামগুলির প্রতি সহানুভূতিশীল। তাঁদের বিশ্ববীক্ষার সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রাম ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত।’’ এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য, “১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র বসুর সভাপতি পদে নির্বাচনের পরে প্ল্যানিং কমিশন গঠন, চীনে মেডিকেল মিশন প্রেরণ প্রভৃতি সংগ্রামী বামপন্থী কার্যকলাপের প্রেক্ষিতে যখন ১৯৩৯-এর ত্রিপুরী (মধ্য প্রদেশ) কংগ্রেসে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী অংশ রাজেন্দ্রপ্রসাদ ও সর্দার প্যাটেলের নেতৃত্বে গান্ধীজীর উপরে চাপ সৃষ্টি করতে আরম্ভ করলো যাতে সুভাষচন্দ্রকে পুনরায় কংগ্রেস সভাপতি পদে মনোনয়ন না দেওয়া হয় তার জন্য, তখন তাঁকে সমর্থনের প্রশ্নে ‘কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের’ মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব তাঁকে অন্তত নির্বাচনকালে ও অনাস্থা প্রতিহত করার কাজে নির্দ্ধিধায় সমর্থন করেছিল। এর আগের বছর হরিপুরা কংগ্রেসকে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী প্রভাব প্রতিষ্ঠা করার প্রধান ক্ষেত্র রূপে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৩৮ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বাংলা শাখা যখন নব পর্যায়ে মাসিক ‘গণশক্তি’ পত্রিকা প্রকাশ করে তার প্রথম সংখ্যায় কংগ্রেস সভাপতি রূপে সুভাষচন্দ্র শুভেচ্ছা-সূচক অভিনন্দন বাণী প্রেরণ করেছিলেন।” সোমনাথ লাহিড়ী, বঙ্কিম মুখার্জি, গোপাল হালদার প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতাও সক্রিয় ভাবে এইসময় সুভাষ বোসকে সমর্থন জুগিয়ে যান। আর দেশ ছাড়ার সময়ে নেতাজীকে যিনি বর্ডার পেরিয়ে আফগানিস্তান নিয়ে যান, সেও এক কমরেড- ভগৎরাম তলোয়ার। আর কাবুলে যার বাড়িতে আশ্রয় নেন নেতাজী, তিনিও পার্টির গোপন সদস্য ছিলেন।
আর অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক ধারা ছাড়া যে ধারাটি বিভাজনের কাজ করত দেশে তাদের তীব্র সমালোচনা করতেন সুভাষ বোস ।কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পরই কংগ্রেসের ভিতরে অতিদক্ষিণপন্থীদের ইঙ্গিত করে বলেছিলেন সুভাষ, যে হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লীগের যেসব সদস্য কংগ্রেসে আছেন তাদের ঘাড় ধরে বের করে দিতে হবে। ফরোয়ার্ড ব্লক তৈরী করার পর নেতাজী আরোও তীব্র সমালোচনা করেন হিন্দুমহাসভাকে এই বলে ,যে তারা “ধর্মের সুযোগ নিয়ে ধর্মকে কলুষিত করে।” আরও একধাপ এগিয়ে তিনি হিন্দু মহাসভাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালালও বলেন। যা পরবর্তীকালে একদম সঠিক বলে চিহ্নিত হয়। নেতাজী তাঁর বক্তৃতায় একথাও বলেন, “আমরা যদি হিন্দু সভা কে চ্যালেঞ্জ দেবার জন্য না দাঁড়াতাম তাহলে পরে হয়ত যাদের উপর নির্ভর করে কাজ করেছি সেই পাব্লিক এর মনোভাব বদলে যেত। আমাদের সমাজতন্ত্রবাদী এবং সাম্যবাদীরা বাস্তবিক পরিষ্কার করে শিখিয়েছেন দেশে যে শত্রু আমাদের কে? শত্রু শুধু বিদেশী নয়, British Imperialism and its Indian allies। এরা মিলে মিশে যে প্রকান্ড শক্তি হয় সেইটাই আমাদের শত্রু। Indian allies দের বাদ দিলে বিদেশী শক্তি কতটুকু? সুতরাং যখন সংগ্রাম করতে হবে আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের শত্রু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং যারা সেই সাম্রাজ্যবাদ এর সমর্থন করে তাঁরা আমাদের শত্রু এবং ভারতের জাতীয়তার শত্রু। আজকে হিন্দু মহাসভা ,মোসলেম বিদ্বেষের দ্বারা প্রণোদিত হয়ে অবলীলা ক্রমে ইংরাজদের সঙ্গে মিলতে পারেন। মুসলমানদের জব্দ কর যেনতেনপ্রকারেণ। এর জন্য ইংরাজদের শরণাপন্ন হতে হয় তা কোন আপত্তি নাই। মুসলমান আমাদের শত্রু, ইংরাজ আমাদের মিত্র – এ মনোভাব বুঝি না।”
সুভাষ চন্দ্র বসুর মহাসভা বিরোধী কঠোর মনোভাব দেখে হিন্দু মহাসভার ফাদার ফিগার শ্যামাপ্রসাদ মুখুজ্জে ভয় পেয়ে তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন, সুভাষ ক্ষমতায় এলে তাদের নিবংশ করে ছাড়বেন।

আরএসএসও তাই বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগ হাতছাড়া করেনি। ইংরেজদের কাছে মুচিলেকা দেওয়া spineless সাভারকার ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে হিন্দুদের ব্রিটিশবাহিনীর সব বিভাগে হিন্দুদের ব্যাপকভাবে নাম লেখাতে অনুরোধ করেন ও ব্রিটিশদের সেই মত রিক্রুট করতেও অনুরোধ করেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ ও নেতাজীর স্বাধীনতা যুদ্ধর বিরুদ্ধে অত্যুৎসাহি ‘ওদের বীর’ সাভারকার কাল ঘাম ঝরিয়ে পরবর্তী কয়েক বছর ধরে রীতিমত রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প সংগঠিত করে ব্রিটিশ বাহিনীতে ‘হিন্দু’-দের নিয়োগ করতে থাকেন। যাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিক থেকে দেশপ্রেমী আজাদ হিন্দ বাহিনীকে রোখা। আর বিশ্বাসঘাতক সাভারকারের এই উদ্যোগে আজাদ হিন্দ বাহিনীকে বিধ্বস্ত করতে ব্রিটিশদের অত্যন্ত সহায়ক হয় এবং সাভারকারের অনুগত ‘হিন্দু’ সেবকরা উত্তর পূর্বাঞ্চলে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বহু সেনাকে নির্মমভাবে হত্যা ও বন্দী করে।


অন্যদিকে জাত-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের প্রতিষ্ঠিত আজাদ হিন্দ বাহিনী ছিল এদেশের ঐক্যের মূর্ত ছবি। অনেক প্রবীণ আজও আফসোস করেন, ওরা এলে হয়ত আর দেশভাগের জ্বালা সহ্য করতে হত না। আজ যখন নারীরা আক্রান্ত হচ্ছেন এই মনুবাদী সাভারকারদের উত্তরসূরীদের জমানায়, সেইদিন নেতাজীর বাহিনীতে ‘কমরেড’ লক্ষ্মী শেহগালের নেতৃত্বে চালিত সম্পূর্ণত মহিলা যোদ্ধা ও মহিলা অফিসারদের ‘ঝাঁসির রাণী ব্যাটেলিয়ন’ ছিল। এটা ছিল গার্গী, মৈত্রেয়ী,অপলার ভারতে, প্রীতিলতা- মাতঙ্গিনীর দেশের নারী-পুরুষ সকলের সমমর্যাদায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অঙ্গীকার। পরবর্তীকালে এই বীর আজাদহিন্দ বাহিনীর জওয়ানদের মুক্ত করতে লালকেল্লায় নেহেরু, কৈলাসনাথ কাটজু, তেজবাহাদুর সাপ্রুরা আইনি লড়াই লড়তে যান। অন্যদিকে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে জওয়ানদের মুক্ত করতে গণবিদ্রোহের আগুন দেখলো বোম্বাই, করাচি, কলকাতার রাজপথ। রশিদ আলির লালকেল্লায় বিচারের দিন কলকাতায় রশিদ আলি দিবস পালন করে ছাত্র ফেডারেশন। ( উৎপল দত্তের ‘কল্লোল’ মনে করুন।) শহীদ হোন রামেশ্বর। এদিকে নৌসেনারা বিদ্রোহ করল। পতাকা উড়ল তিনটি দলের। লাল ঝাণ্ডা ছিল।


ছিল না বিশ্বাসঘাতক আরএসএসের পতাকা।কারণ ওরা গদ্দার। আজ যতই নাটক করুণ মোদি, আজাদ হিন্দ ফৌজের সাথে ওর বাপ কাকাদের গদ্দারীর ক্ষমা করবে না ইতিহাস।


Spread the word