Site icon CPI(M)

কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের জন্মশতবার্ষিকীতে -এম বাসবপুন্নাইয়া

৫ আগস্ট ২০২১( বৃহস্পতি বার)

কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গণশক্তি পত্রিকা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত করছে জেনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। অধুনা বাংলাদেশের নোয়াখালি জেলার সন্দীপে ১৮৮৯ সালে ৫ই আগস্ট কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন। অগ্নিগর্ভ তরুণ কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ ১৯২০ দশকের প্রথম দিকেই সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকান্ডের প্রতি আকৃষ্ট হন। তার ৰাজনৈতিক জীবনের সূচনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ বলেছেন তিনি কাজ শুরু করেন ‘১৯১৮ সালের শেষ দিকে সর্বক্ষনের কর্মী হিসাবে’। অচিরেই তিনি রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের ঘটনায় অনুপ্রাণিত হন এবং সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের আদর্শে আকৃষ্ট হন এবং ১৯৭৩ সালে ৮৪ বছর বয়সে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কোনো না কোনো মিথ্যা ওজরে কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ তাঁর জীবনের বেশ কয়েকবছর কারাগারের অন্তরালে কাটিয়েছিলেন। কুখ্যাত ‘কানপুর বলসেবিক ষরযন্ত্র মামলাতে’ তাকে জড়ানো হয় এবং ৪বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

১৯২৯ সালের মার্চে কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ আবার গ্রেপ্তার হন এবং ব্রিটিশ শাসকরা আরেকটি মিথ্যা মামলায়(মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা) তাকে অভিযুক্ত করে।
স্বাধীনতার উত্তরকালেও অনেকবার তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং জেলে আটকে রাখা হয়েছে। এমনকি ১৯৬২ সালে ৭৩বছর বয়সেও ভারত চীন সীমান্ত যুদ্ধের সময় মিথ্যা অজুহাতে তাঁকে গ্রেপ্তার ও আটকে রাখা হয়।
কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ১৯২০’র দশকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে। ১৯৬৪ সালে যখন কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হলো তখনও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি(মার্কসবাদী) প্রতিষ্ঠার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ। ১৯৬৪’র ১১ই এপ্রিল দিল্লিতে জাতীয় পরিষদের বৈঠক থেকে যে ৩২ জন সদস্য বেরিয়ে আসেন তাদের মধ্যেকমরেড মুজফ্ফর আহমেদ ছিলেন অন্যতম। পার্টির চেয়ারম্যান এস এ ডাঙ্গের নেতৃত্বে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বৈরতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে এই ঘটনা ছিল একটা প্রতিবাদ। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদী রাজনৈতিক তত্ত্বের নীতি নিয়ে চলছিল তাতেই এই বিভাজন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন ১৯৬১’র ৭-১৬ই এপ্রিল বিজয়ওয়াদায় ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসে পেশ করা রাজনৈতিক প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের নেতৃত্বেই পশ্চিমবঙ্গের সমমনোভাবাপন্ন প্রতিনিধিরা প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসেন। কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ এবং তাঁর সহকর্মীদের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগিরিষ্ঠ অংশ পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত অজয় ঘোষের সরকারী রাজনৈতিক লাইনটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।
পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগিরিষ্ঠ প্রতিনিধিরা এবং অন্যান্য রাজ্যের তাদের সমমনোভাবাপন্ন প্রতিনিধিরা চাপ দিতে থাকেন যে অজয় ঘোষকে খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাবাবলী প্রত্যাহার করতে হবে এবং তার ভাষণকে পার্টি কংগ্রেসে সরকারী রাজনৈতিক প্রস্তাবাবলী হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।

আসলে ১৯৬১’র ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেস ছিল আদর্শগত প্রশ্নে তীক্ষ্ণ ভাবে বিভক্ত পার্টির দুই শিবিরের মধ্যে একটা জোড়াতালি দেওয়ার চেষ্টা এবং সিপিআই(এম)’র আসন্ন বিভাজনকে আটকানোর চেষ্টা। তারপর ২-৩বছর কেটেছে আমাদের প্রস্তুতি নিতে এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৬৪ ৩১অক্টোবর-৭ই নভেম্বর কলকাতায় আমরা আমাদের সপ্তম পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করতে সমর্থ হই। ১৯৩৪-৩৫ সালে যেদিন থেকে আমি কমিউনিস্ট হয়েছি সেদিন থেকে কমরেড মুজফ্ফর আহমেদকে শুধুমাত্র সিপিআই(এম)’র সদস্য হিসাবেই জানিনি, তাঁর নাম আমার কাছে শ্রোদ্ধা আর সম্মানের অনুভূতি তৈরি করতো।
কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের স্মৃতি ও লেখা সিপিআই(এম)’র কাছে এক অমূল্য সম্পদ। ১৯২০ এবং ৩০’র দশকের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনা পর্বের ইতিহাস তার লেখাগুলি থেকে আমরা জানতে পারি। সত্যি কথা বলতে কি বিভিন্ন প্রজন্মের মুকুলিত হতে চাওয়া কমিউনিস্টরা এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বার্তাকে ভারতীয় জনগন বিশেষকরে অবিভক্ত বাংলার জনগনের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি।


বাংলায় কমরেড মুজফ্ফর আহমেদকে আপনকরে ‘কাকাবাবু’ নামে ডাকা হতো। তার নেতৃত্বেই পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টদের একটি ছাপাখানা এবং ন্যাশনাল বুক এজেন্সির মতো আরও সংগঠনের প্রতিষ্ঠা হয়।
শেষ করার আগে একটি বিশেষ ঘটনা উল্লেখ করবো। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা সংক্রান্ত সকল নথিপত্র দিল্লিতে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির অফিসে রক্ষিত ছিল। এইসব নথিপত্র দীর্ঘকাল ধরে কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের নাগালের বাইরে ছিল। বহুবার আমার সাথে কথা বলার সময় কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ এই বিষয়টি তুলেছেন। তাঁর অভিযোগ ছিল তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অজয় কুমার ঘোষ এইসব নথি প্রকাশও করছেন না এবং কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ এই বিষয়ে লেখবার জন্য সেগুলি বারে বারে চাওয়া সত্ত্বেও তাঁকে দিচ্ছেন না। ১৯৬০’র মাঝামাঝি সময়ে কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের আহ্বায়ক হিসাবে আমি কাজ শুরু করলাম। তখন অজয় ঘোষ বিশ্রাম ও স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য দিল্লির বাইরে ছিলেন। আমি এই সময় মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার এক ট্রাঙ্ক ভর্তি নথিপত্র কলকাতায় পাঠিয়ে দিলাম। কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ এগুলোকে যথাযথজগ্য ভাবে কাজে লাগালেন এবং সামগ্রিক ভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলন এতে উপকৃত হলো। এই সব কাগজপত্র এখন পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির তত্ত্বাবধানে রয়েছে।

ভারতবর্ষের শ্রমিকশ্রেণী ,কৃষক সমাজ এবং সাধারণ মানুষের দুঃখ -দুর্দশা মোচনে সংগ্রামের জন্য কমরেড মুজফ্ফর আহমদের বিরাট অবদান কে আমি জানাই বিপ্লবী শ্রদ্ধা।

কমরেড মুজফ্ফর আহমদ এবং তার রেখে যাওয়া মহান বিপ্লবী ঐতিহ্যকে আমি জানাই লাল সেলাম।

Spread the word