Site icon CPI(M)

Merrut Day: A Memoir

প্রাককথন

ব্রিটিশ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রসারিত করার কাজে অন্যতম বাধা ছিল সরকারী নিষেধাজ্ঞা, আজীবন কারাবাসের শাস্তি অথবা পুলিশের গুলিতে প্রান হারানো। কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা নিজেদের প্রাণ বাজি রেখেই সেই কাজ করেছিলেন – সারা দেশে পার্টি সংগঠন প্রসারিত করতে বহু বাধার পাহাড় তাদের পেরোতে হয়েছে তবু সেই কাজ একদিনের জন্যেও থেমে থাকেনি। তাই প্রথম থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে অন্যতম বিপদ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। ১৯২৩-২৪ সালে নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এলাকায় পেশোয়ার কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা এবং ১৯২৪ সালে কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হয়। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কলকাতায় সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেকগুলি গোষ্ঠী একত্রে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টি গড়ে তোলে। অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসেও তখন কমিউনিস্টদের প্রভাব অনেকটাই বেড়েছে। আসন্ন কমিউনিস্ট বিপ্লবের ভয়ে ব্রিটিশ সরকার প্রমাদ গুনেছিল। এই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে তারা ১৯২৯ সালে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেছিল।

ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ধ্বংস করতে চেয়েই এই মামলা হয়েছিল, কিন্তু ফল হল একশো আশি ডিগ্রি বিপরীত। এই মামলায় অভিযুক্ত কমিউনিস্ট নেতৃত্ব আদালতের কাঠগড়াকেই পার্টির কাজের প্রচার এবং প্রসারের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন পার্টির পক্ষে কেউ নিজের বক্তব্য আলাদা করে না জানিয়ে সম্মিলিত একটি সাধারণ বক্তব্য তুলে ধরা হবে। সেই বক্তব্যই হবে আদালতের সামনে তাদের জবাব, দেশবাসীর সামনে তাদের কর্মসূচী। গোটা দেশে কমিউনিস্টদের খবর ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রচারের কাজ, বিস্তারের কাজ সরকারী বিধিনিষেধের কারনেই বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল – সরকারী প্রাঙ্গণকে সেই উদ্দেশ্যেই অসাধারণভাবে ব্যবহার করলেন কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা। ফ্যাসিস্ত বাহিনীর হাতে বন্দী হয়ে একই কায়দায় জর্জি দিমিত্রভ নিজের বক্তব্য প্রচার করেছিলেন। বিচারাধীন বন্দী হিসাবে আদালতে দাঁড়িয়ে কিউবা বিপ্লবের নেতা ফিদেল কাস্ত্রোও একই পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালীন কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা আদালতের সামনে যে সাধারণ বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন তাকেই ‘Communists Challange Impearialism From The Dock‘ শিরোনামে একটি ইংরেজি বই প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ন্যাশনাল বুক এজেন্সি। বইটিতে মুখবন্ধ লেখেন কাকাবাবু, কমরেড মুজফফর আহমদ – যিনি নিজেই মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অন্যতম একজন অভিযুক্ত ছিলেন। কমরেড মুজফফর আহমদের লেখা সেই মুখবন্ধের উল্লেখযোগ্য অংশবিশেষ বাংলায় অনুবাদ করে পার্টির রাজ্য ওয়েবসাইটে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা হল।

মুজফফর আহমদ

“কলকাতা হাইকোর্টের স্বনামধন্য ব্যারিস্টার মিঃ ল্যাংফোর্ড জেমস’কে ব্রিটিশ প্রশাসন মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় সরকারী উকিল হিসাবে নির্বাচিত করেছিল, কাজে সহায়তার জন্য ব্যারিস্টার ল্যংফোর্ড নিজের অধিনস্ত মিঃ জ্যোতিপ্রকাশ রায়কে জুনিয়র কাউন্সিল হিসাবে নিযুক্ত করেন। ব্রিটিশ সরকার মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা সংক্রান্ত কাজে ব্যারিস্টার মিঃ ল্যাংফোর্ড জেমস’কে দিন প্রতি ৮০ গিনি এবং মিঃ জ্যোতিপ্রকাশ রায়কে দিন প্রতি ৫ গিনি খরচ দেবার চুক্তি করেছিল, সেই সময়কার হিসাব অনুযায়ী ১ গিনি = ভারতীয় মুদ্রায় ১৭ টাকা। ঠিক কবে থেকে তারা এই কাজে নিযুক্ত হন এই তথ্য পাওয়া যায় নি।”

“প্রাথমিকভাবে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় ৩১ জনের নামে অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয়। আমির হায়দার খান এবং হিউগ লেস্টার হাচিন্সনের নাম কিছুদিন পরে সেই তালিকায় যুক্ত হয়। হিউগ লেস্টার হাচিন্সন একজন ইংরেজ যিনি সাংবাদিক হিসাবে ভারতে কাজ করতে এসেছিলেন, পরে একটি ইংরাজি দৈনিক পত্রিকায় লেখার কাজ করতে গিয়ে বোম্বাইতে কমিউনিস্ট ট্রেড ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন – তাকে গ্রেফতার করে আদালতে পেশ করা হয়। ব্রিটিশ পুলিশ আমির হায়দার খানকে গ্রেফতার করতে পারে নি। তিনি আমেরিকায় নাবিক হিসাবে পৌঁছান, সেখানে একটি অটোমোবাইল কারখানায় কাজ করার ফাঁকেই ইংরেজি ভাষায় কথা বলা এবং লেখার কাজে নিপুণতা অর্জন করেন। বিমানচালনার লাইসেন্স অর্জন করে একটি পুরানো বিমান অবধি কিনেছিলেন। আমি হায়দার খান আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেছিলেন, সেই সুবাদেই তিনি প্রশিক্ষনের জন্য মস্কো চলে যান। মস্কোয় কমিউনিস্টদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষন অর্জন করার পরে দেশে ফিরে এসে জেনারেল মোটরস কোম্পানিতে চাকরি নেন এবং ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির কাজে যুক্ত হয়ে যান। এই সময় তার নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হয়, সেই খবর পাওয়া মাত্র সুকৌশলে গ্রেফতারী এড়িয়ে তিনি ইউরোপে চলে যান। ইউরোপ থেকে ফিরে তিনি মাদ্রাজে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে নিজেকে সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে নিয়োজিত করেন, আজকের দিনে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতৃত্বই তার হাতে প্রশিক্ষিত হয়েছেন। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার একেবারে শেষ লগ্নে পুলিশ তার নাগাল পায়। তাকে মিরাটের আদালতে হাজির করা হলে সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়া আবার প্রথম থেকে চালু করতে হবে বলে ব্রিটিশ সরকার আমির হায়দার খানকে মাদ্রাজ জেলেই বন্দী রাখে, সেখানেই তার বিচার হয় এবং দুবছর ভয়ানক শ্রমযুক্ত বন্দী হিসাবে জেলে থাকার শাস্তি ঘোষিত হয়।”

Convicted of Meerut Conspiracy Case

” এই মামলায় আসামী হিসাবে আমাদের গ্রেফতার করে মিরাট জেলা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। প্রত্যেককেই আলাদা সেলে রাখা হয়, অনেকটা সেল্যুলার ব্যারাকের মতো জায়গায়। সকালে একবার এবং বিকালে একবার কিছুক্ষণের জন্য আমাদের সেল থেকে বাইরে আনা হতো, কেবলমাত্র তখনই আমরা একে অন্যের সাথে কথা বলার সুযোগ পেতাম। আমার ডানদিকের ব্যারাক দুটিতে শওকত উসমানী এবং ডঃ গঙ্গাধর অধিকারীকে রাখা হয়েছিল। এর আগে, ১৯২৪ সালে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় আমি এবং শওকত উসমানী আসামী হিসাবে জেলে ছিলাম, ডঃ গঙ্গাধর অধিকারীর এই প্রথম জেলে আসা। কানপুর ষড়যন্ত্র মামলাকে বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা বলে প্রচার করতে ব্রিটিশ সরকার খুবই চেষ্টা করেছিল। সকাল এবং বিকালে কথা বলার সুযোগটুকু কাজে লাগিয়েই আমরা মামলা সম্পর্কে আলোচনা করে নিতাম। এমন আলোচনাতেই আমি ডঃ গঙ্গাধর অধিকারীকে জানাই, সরকার যেভাবে মামলা সাজিয়েছে তাতে আমাদের শাস্তির মেয়াদ দীর্ঘ হবেই, তাই সেশন কোর্টকেই আমাদের রাজনৈতিক প্রচারের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করবো না কেন ? আমি তাকে বলি যে এর আগে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলার সময়েই অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল, সেই সুযোগ আমরা নষ্ট করেছি। ডঃ গঙ্গাধর অধিকারী আমার প্রস্তাবে রাজী হলেন।”

” ১৯২৯ সালের ১৪ই মার্চ ইন্ডিয়া ইন কাউন্সিলের গভর্নর জেনারেল কয়েকজন ভারতবাসীর (কমিউনিস্ট বিপ্লবী – অবশ্য যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন তাদের মধ্যে এমনও কেউ কেউ ছিলএন যারা কমিউনিস্ট নন) বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২১-এ ধারায় মামলা মুঞ্জর করেন। পরেরদিন, ১৫ই মার্চ মিরাটের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করেন। এই পরোয়ানার ভিত্তিতে ব্রিটিশ পুলিশ অত্যন্ত তৎপরতার সাথে সারা দেশে ধরপাকড় এবং তল্লাশি শুরু করে। তল্লাশি করার সময় বইপত্র, কাগজ, লিফলেট যা কিছু সম্ভব পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে। এমনকি কলকাতায় ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টির দপ্তরের কাঠের ফলকটিও তারা বাজেয়াপ্ত করে। অভিযুক্ত যারা, সবাইকেই গ্রেফতার করা হয় ঐদিনই। চার বছরেরও বেশি সময় ধরে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার বিচার চলে। সেই থেকে প্রতি বছর ২০শে মার্চ তারিখটিকে সারা দেশে শ্রমিক, কৃষক এবং মেহনতি মধ্যবিত্ত মানুষ মিরাট দিবস হিসাবে পালন করতে শুরু করে।”

“এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি ডঃ স্যার শাহ সুলেইমান এবং বিচারপতি জে ইয়ং-এর রায়ের ভিত্তিতে ১৯৩৩ সালের ৩রা অগাস্ট ভারতের প্রধান বিচারপতি মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার রায় ঘোষণা করেন। এই মামলার রায়ে মুজফফর আহমদকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের শাস্তি ঘোষণা করা হয়। এস এ ডাঙ্গে, ফিলিপ স্প্রাট, এস ভি ঘাটে, কে এন যোগলেকর এবং আর এস নিম্বকরের ১২ বছরের জন্য দ্বীপান্তরের শাস্তি হয়। বি এফ ব্রাডলে, এস এস মিরজকর, শওকত উসমানীর ১০ বছরের জন্য দ্বীপান্তর, মির আবদুল মজিদ, সোহন সিংহ যশ, ধরনীকান্ত গোস্বামীর ৭ বছরের জন্য দ্বীপান্তর, অযোধ্যা প্রসাদ, গঙ্গাধর অধিকারী, পূরণ চাঁদ যোশী এবং এম জি দেশাইয়ের ৫ বছর দ্বীপান্তর ঘোষিত হয়। গোপেন্দ্র চক্রবর্তী, গোপাল চন্দ্র বসাক, এইচ এল হাচিন্সন, রাধা রমণ মিত্র, এস এইচ ঝাবওয়ালা এবং কেদার নাথ সেহগলকে ৪ বছরের জন্য সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়, শামসুল হুদা, এ এ আল্ভে, জি আর কাসলে, গৌরি শংকর এবং লক্ষণ রাও কদমকে ৩ বছরের জন্য সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়।”

“এই মামলার পরে ৩৫ বছর কেটে গিয়েছে। আদালতে দাঁড়িয়ে কমিউনিস্টদের সেইদিনের বক্তব্য আজ বইয়ের চেহারায় পড়া যায়। ভারতীয়রা তো বটেই, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষজনও বইটি আগ্রহের সাথে পড়বেন বলেই আমার একান্ত বিশ্বাস। ভারতে আজকের প্রজন্মের কমিউনিস্টদের জন্য বইটি একটি প্রয়োজনীয় দলীল যা অধ্যয়ন করলে তারা বুঝবেন ৩৫ বছর আগে মিরাটে জেলে বন্দী থাকা কালীন কমিউনিস্টরা কি করেছিলেন, কি ভেবেছিলেন।”

কলকাতা

১২ই ডিসেম্বর, ১৯৬৬

ওয়েবডেস্কের পক্ষে প্রাককথন ও অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ

Spread the word