Site icon CPI(M)

“আমার চোখে সেই দৃশ্য এখনও স্পষ্ট” – বিমান বসুর স্মৃতিতে ছাত্র শহীদ দিবস

১ সেপ্টেম্বরঃ ছাত্র শহীদ দিবসের ইতিহাস

১৯৫৯ সালে ৩১শে আগস্ট আমাদের রাজ্যের বিভিন্ন জেলার মানুষের মিলিত বিক্ষোভ প্রদর্শন ছিল খাদ্যের দাবীতে। তখন স্লোগান হিসাবে আওয়াজ উঠেছিল “আমরা বাংলার জনগন, খাদ্য চাই”, “ক্ষুধার্ত মানুষকে খাদ্য দাও, নইলে গদি ছেড়ে দাও”। এই স্লোগানের ভিত্তিতে বিশাল জমায়েত হয়েছিল অক্টোরলোনি মনুমেন্টের তলায় – তখনও শহীদ মিনার নামকরণ হয় নি। কথা ছিল মহাকরণ অভিযান হবে দুপুরবেলা দেড়টার সময়। কিন্তু অনেকগুলি রেল বহু জায়গায় আটকে পড়ে (কিছুটা মালগাড়ির সমস্যা ছিলই বাকিটা ছিল রেল দপ্তরের বাহানা) – ফলে যে ট্রেনগুলো বেলা একটার মধ্যে কলকাতায় ঢুকে পড়ার কথা ছিল সেগুল দুপুর আড়াইটে নাগাদ এসে পৌঁছায়। আমরা সবাই ভলান্টিয়ার হিসাবে সেখানে উপস্থিত ছিলাম।

Image Source: CPI(M) WB Web Desk

মহাকরণ অভিযান শুরু হল সাড়ে তিনটে নাগাদ। রাজভবনের দেওয়ালকে একপাশে আর আরেকদিকে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের সামনের রাস্তায় মিছিল গিয়ে পড়লে পুলিশের ব্যারিকেড মিছিল আটকায়। মিছিলে তখন লক্ষাধিক মানুষ, স্বেচ্ছা সেবক হিসাবে আমরা সেই মিছিলের দুপাশে হাতে হাত রেখে শিকলির মতো করে এগোচ্ছিলাম। ঐ সময় জ্যোতি বসুর নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী থাকায় তিনি কলকাতাতেই আত্মগোপন করেছিলেন – মিছিলে থাকতে পারেন নি। পুলিশ ঐ এলাকায় অসংখ্য প্রাইভেট বাস এবং প্রিজন ভ্যানের ব্যাবস্থা করেছিল। আমাদের ধারণা হয়েছিল পুলিশ ব্যাপক গ্রেফতারী চালাবে। মিছিল শুরু হবার দুঘন্টা পরে যখন বলা যায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে একদিকে লাগামহীন লাঠিচার্জ এবং টিয়ার গ্যাস সেলিং শুরু করে পুলিশ, কেউ কেউ ঐদিনের মিছিলে গুলি চলার কথা বলেন, তা সঠিক নয়। টিয়ার গ্যাস সেলিং’র আওয়াজকেই ভুল করে হয়ত কারোর গুলি চালনার শব্দ বলে মনে হয়ে থাকতে পারে। টিয়ার গ্যাস সেলিং এত বেশি মাত্রায় করা হয় যে চোখে কিছু দেখাই যাচ্ছিল না, তার সাথে বীভৎস লাঠিপেটা চলতে থাকে। মিছিলের পিছনদিকের অংশেই সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন – সামনের দিকে আমরাও আক্রান্ত হই। তখন আমি বয়সোচিত পোশাক অর্থাৎ শার্ট – প্যান্ট পরেছিলাম, সেই প্যান্টের নানা জায়গায় রক্তের ছাপ ভর্তি হয়ে গিয়েছিল, একই ঘটনা আমাদের আরও অনেকেরই হয়েছিল। লাঠির আঘাতে অনেকেরই হাত-পা ভেঙ্গে যায় – আমারও পা ভেঙ্গেছিল। কার্জন পার্কে ( তখন ওখানে এত গাছ-গাছালি ছিল না) অনেক আহত মানুষ পড়ে রয়েছেন, যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন সেই অবস্থাতেই লাঠির আঘাতে তাদের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই সেদিন পুলিশ খুন করেছিল ৮০ জনকে।

Image Source: CPI(M) WB Web Desk

এরই প্রতিবাদে ১লা সেপ্টেম্বর বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্র সংগঠন মিলিতভাবে ছাত্রধর্মঘটের আহ্বান দেয়, একইসাথে ছাত্রসমাবেশেরও ডাক দেওয়া হয়েছিল। ধর্মঘট হলে অনেকেই ঘরে বসে থাকে, ছাত্র সংগঠনগুলি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা করলে চলবে না, সবাইকেই রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে সামিল হতে হবে। ইউনিভার্সিটির লনে সবার জড় হবার পরিকল্পনা ছিল, তখন সেন্টেনারি ভবন ছিল না, হলটি অনেক বড় ছিল – ছিল শুধু সেনেট হল (সমাবর্তন অনুষ্ঠান সেখানেই হত)। মিছিল যাত্রা শুরু করে ধর্মতলার দিকে, তখনও সেই রাস্তার নাম ধর্মতলা স্ট্রীটই ছিল লেনিন সরণি নামকরণ পরে হয়েছে। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের সামনে মিছিলকে প্রথমবার বাধা দেয় পুলিশ, যদিও সেই বাধা টপকে মিছিলের একটা অংশ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের বাড়ি ছিল এখন যেখানে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার সেই জায়গায়, জমায়েত ঐদিকে এলে মিছিলের উপর একই সাথে টিয়ার গ্যাস সেলিং এবং বেপরোয়া গুলি চালনা করে পুলিশ। গুলীর আঘাতে ওখানেই একজন ছাত্রের মৃত্যু হয় – ছবি তোলা যায়নি, কিন্তু আমার চোখে সেই দৃশ্য এখনও স্পষ্ট। লোহার রেলিঙয়ের একদিকে একটি হাত-পা আরেকদিকে অন্য হাত-পা’দুটি আটকে থাকা অবস্থায় সেই ছাত্রের মৃতদেহটি দেখতে পেয়েছিলাম। মিছিলের উপরে গুলিচালনার ফলে ৭ জন খুন হয়েছিল সেদিন, গুলির আঘাতে আহত হয়ে মেডিক্যাল কলেজের বেডে মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছে আরও অনেকে, তাদের কেউ কেউ সারাজীবনের মতো পঙ্গুও হয়ে গেছে। ৩১শে অগাস্ট খাদ্য চাই’র দাবী তোলা জনগণকে লাঠিপেটা করে খুন করে, ঠিক তার পরের দিন ১লা সেপ্টেম্বর সেই নারকিয় ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্রদের মিছিলেও অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল বিধান রায়ের সরকার। ২রা সেপ্টেম্বর আবার সারা রাজ্যে ছাত্রধর্মঘট ডাকা হয়, সেদিনও সারা রাজ্যজূড়ে পুলিশের অত্যাচার চলে, ব্যাপক গ্রেফতার করা হয়। ৩রা সেপ্টেম্বর সমস্ত বামপন্থী দলগুলি সম্মিলিতভাবে রাজ্যে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়।

Image Source: CPI(M) WB Web Desk

এদেশে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে ১লা সেপ্টেম্বর একটি গুরুত্বপূর্ন দিন। বুভুক্ষু মানুষের জন্য খাদ্যের দাবীতে, গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবীতে গণআন্দোলনের উপরে পুলিশি নিপীড়ন নামিয়ে আনা হলে ছাত্রসমাজ তার বিরুদ্ধে নামে – সারা পৃথিবীতেই এই ঘটনা ঘটে, আমাদের দেশেও লড়াই সংগ্রামের সেই ধারাতেই  ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। আজকের দিনে ছাত্র আন্দোলনের জন্যে এই ঐতিহ্য, এই উত্তরাধিকার জানা, বোঝা প্রয়োজন। শহীদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের কর্তব্য পালন করতে হয় আন্দোলনের ময়দানে থেকেই। আজকের দিনে ছাত্ররা শহীদ দিবস হিসাবে পালন করেন এই জন্যেই।

Image Source: CPI(M) WB Web Desk
Image Source: CPI(M) WB
Web Desk

১৯৫৯ সালে ১৬ই কিংবা ১৭ই সেপ্টেম্বর (বয়সের কারনে স্মৃতি কিছুটা বেগ দেয় ইদানিং) ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে সেদিনের ঘটনাকে মনে রেখে একটি শহীদ বেদী স্থাপন করেছিল, বামপন্থী দলগুলির পক্ষেও একটি শহীদ বেদী করা হয়। যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল দুটি আলাদা শহীদ বেদির বদলে সরকারের পক্ষ থেকেই একটি শহীদ বেদী স্থাপন করা হবে, যদিও প্রকৃতপক্ষে সেই কাজ করা হয় বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে। ১৯৫৯ সালের পর থেকে প্রতি বছর ঐ শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে, এবছরেও সেই কাজ যথাযথভাবে ছাত্রছাত্রীরা করবে।

নিজেদের সংগ্রামী ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকার সম্পর্কে সম্যকরূপে পরিচিত না হয়ে সংগ্রামের কাজে এগোন যায় না, তাই আরও বেশি করে সেই ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকারের প্রচার করাই হবে আজকের দিনে অন্যতম একটি কর্মসূচি।

Image Source: CPI(M) WB Web Desk
Spread the word