Site icon CPI(M)

Language, Land ,Nourishment- Subhomoy

ভাষা নিয়ে কোনো কথা উঠলে ফরাসি কথাকার আলফোঁস দোদে (১৮৪০-৯৭)-র সেই গল্পটার কথা কতবার বলেছি আপনমনে।
সেই ১৮৭০-৭১ সালের কথা- ভয়ানক ধূর্ত আর আর বাহুবলী বিসমার্কের আগ্রাসনে হাতবদল হচ্ছে ফ্রান্সের আলসেস-লোরেন অঞ্চল। ফ্রান্সের হাত থেকে চলে যাচ্ছে জার্মানির দখলে। সেই সময় একটি ছেলে দৌড়ে চলেছে তার ইস্কুলের দিকে।
ক্লাস শুরু করেন ব্যাকরণের মাস্টারমশাই। শুধু ক্লাসের ছাত্ররাই নয়, ক্লাসে এসেছেন শহরের মেয়র সমেত বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষ।
মাস্টারমশাই প্রথমেই জানিয়ে দিলেন সেই খবর, আগামীকাল থেকে স্কুলে আর ফরাসি পড়ানো হবে না। পড়াতে হবে জার্মান ভাষা। মাস্টারমশাই বলে উঠলেন,” প্রিয় শিশুরা মনে রেখো, ফরাসি হল সবথেকে সুন্দর ভাষা। অন্যরা হয়তো আমাদের দেশ দখলে নেবে, কিন্তু ভাষাটা ভুলে যেও না। নিজের ভাষা ভুলে যাওয়া মানে কারাগারের চাবিটা হারিয়ে ফেলা।”
প্রিয় পাঠক অনায়াসে ফরাসির জায়গায় বাংলা বা অন্য যে কোনো ভাষার নাম বসিয়ে নিতে পারেন। আসলে সব মাতৃভাষার ক্ষেত্রে মানুষ তো এমন করেই ভাবে, এমন করেই ভাবা উচিত।
মাস্টারমশাই বলে চলেছেন, “তোমরা হয়তো ফরাসিই থাকবে। কিন্তু ফরাসি শিখবে না, ফরাসি শিখতে ভুলে যাবে। ফরাসি থাকার ভান করবে।”
এমনও হতে পারে, আমি কোনো জায়গায় এই গল্পটার নানা শব্দের অদলবদল ঘটিয়েছি। গল্পটাকে খানিক বানিয়ে তুলেছি। অথবা, গল্পটাই এই লেখাটাকে বানিয়ে তুলছে পুরোপুরি।
তারপর মাস্টারমশাই বোর্ডে লিখলেন বড়ো অক্ষরে:
ভিভা লা ফ্রাঁসে।
ফ্রান্স জয়ী হোক। ফ্রান্স দীর্ঘজীবী হোক।
শেষবারের মতো ক্লাস শেষ। স্কুল শেষ।

ভাষা তাহলে ভূমি। আগ্রাসন যখন ভূমি দখলে নেয়, ভাষাও দখলে নেয়।
ভাষা হল মানুষ। খেটে খাওয়া বৃহত্তর মানুষ। তাই ভাষাই আদতে গণতন্ত্র।
ঠিক এমন করে ভেবেছিলেন আমার পাশের গাঁয়ের এক পণ্ডিৎ। আমাদের দেশের অন্যতম শ্রেষ্ট ভাষাতাত্বিক মহামহোপাধ্যায় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
আমাদের বাংলা ভাষার বিবর্তনে এক দ্বন্দ্বরেখা নিরূপণ করেছিলেন তিনি : ‘বৈদিক ভাষা বনাম লৌকিক ভাষা, সংস্কৃত বনাম লৌকিক পালি, পালি বনাম প্রাকৃত, উচ্চশ্রেণীর পালি বনাম নিম্নশ্রেণীর অপভ্রংশ এবং তারও পর বাংলা ভাষার আধুনিকতায় সাধু বনাম চলিত।
এই দ্বন্দ্বে, প্রতিবারই লৌকিক কিংবা নিম্নশ্রেণীর জয়, এমনই নির্ণয় করেছেন মহামহোপাধ্যায়। ধ্রুবপদের মতো উচ্চারণ করেছেন,’গণতন্ত্রের নিকট অভিজাততন্ত্রের পরাজয় হইল।’
আমাদের সময়ে, বিশ শতকের শেষ দিকটাতে ভাষার এই গণতন্ত্র বিপন্ন হচ্ছে আরও এক দানবীয় দুশমনের কবলে। যে দানবের নাম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন। ধনবাদের বিশ্বায়ন, লগ্নিপুঁজির বিশ্বায়ন তার হাতে নয়া মারণাস্ত্র– ভাষার আধিপত্যবাদ।


দান্তে কিংবা পেত্রার্ক, অথবা গোয়টে কিংবা তাঁদের প্রতি আনত থেকে কার্ল মার্কস কিংবা ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস মায়ের ভাষাকে সম্মান জানিয়েই বিবিধ ভাষার ঐশ্বর্যকে যেভাবে গ্রহণের সাধনা শেখাতে চেয়েছেন, তার বদলে একালের চলন হয়ে উঠেছে একটি ক্ষমতার ভাষার কাছে অনুগত হও, সব ভুলে বসে। ফলত দেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে বিপন্ন ভাষার সার্বভৌমত্ব, ভাষার গণতন্ত্র।
নিজেদের দিকে তাকালে তো হিম হয়ে আসে শিরদাঁড়া। নিত্য গজিয়ে ওঠা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। আমাদের দেশের শৈশব না শিখছে ইংরেজি, না শিখছে মায়ের ভাষা। বস্তুত বাড়ির মায়েরাই কী এক আতঙ্কে শিশুকে মাতৃভাষার মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত করে চলেছেন।
এরাজ্যের বামপন্থীরা ক্ষমতায় এসেই ভূমিসংস্কারের সঙ্গে প্রবর্তন করেছিলেন প্রাথমিক শিক্ষায় মাতৃভাষার আবশ্যিকতা। তা নিয়ে আজও গালমন্দ শুনতে হয়। একটু খেয়াল করলেই ধরা পড়বে, কেরল সরকার সে রাজ্যে যে কোনো বোর্ডেই আবশ্যিক করেছে মালয়ালম আর আমাদের রাজ্যে বিগত পাঁচ বছর প্রতিবার কমে চলেছে মাধ্যমিক পরিক্ষার্থীর সংখ্যা।


আমির খুসরো থেকে গালিব, বিদ্যাসাগর থেকে মধুসূদন হয়ে রবীন্দ্রনাথ মায়ের ভাষা নিয়ে পরম গরব পোষণ করেই বসুধার কুটুম্ব হিসাবে ডেকেছেন নিমন্ত্রণ করেছেন নানা ভাষাকে। অথিতি হয়ে এসো, আধিপত্যবাদ নিয়ে নয়। ভাষাসাধনার ভাষা গণতন্ত্রের সেই মন্ত্রটাই শেখাতে চেয়েছেন লেনিন থেকে ফিদেল।

Spread the word