Site icon CPI(M)

Koshal Ki Raat: The Darker Tide

Koshaler Raat Cover

কৃষ্ণ প্রতাপ সিংহ

১                      

প্রণয় কুমার কবি, বৈশালীর বাসিন্দা। ওর একটি কবিতা আমার বিশেষ পছন্দের। কবিতাটির নাম ‘চন্দ্রনাথের স্মৃতিতে’। এ কবিতায় উল্লেখ রয়েছে ‘উত্তর আধুনিক যুগের কথা / যখন দুনিয়া থেকে সাম্যবাদ বিদায় নিতে চলেছে’, আরেকজায়গায় দেখা যায় ‘যখন মানুষ ক্রমশই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে’। এমনই এক কঠিন সময়ে ‘আদমির শেষকৃত্যের দায় নিজের কাঁধে নেয় চন্দ্রনাথ’। একদিন সকাল হলে ‘বড় রাস্তার মোড়ে নালার কিনারে তার মৃতদেহ মেলে/ যা কেউ বোঝেনি, এত জায়গা থাকতে অমন শিক্ষিত লোকটি নালার পাশে শুয়েই মরল কেন?’   

অযোধ্যারই বাসিন্দা আমি। এখানে সকলে নিজেদের বসতবাড়িকেই রামের আশ্রয় বলে চিনতে, জানতে, বিশ্বাস করতে শেখে। নিজের ঘরে বসে এই কবিতাটি যে কতবার পড়ি সেকথা নিজেই জানি না। যতবার পড়ি ততবারই আমার মনস্তত্ব গোলমাল হয়ে যায়। পুরাকালে কোশল ও বৈশালী গণরাজ্য ছিল বলে শুনেছি, সেকথা ভাবলেই আমার সীতা মায়ের কথা মনে পড়ে। আজকে যা অযোধ্যা সে তো কোশলেরই রাজধানী ছিল। কোশল, বৈশালী কিংবা অযোধ্যা যে শুধু রামের বিষয় না, সীতাও যে আমাদের ঐতিহ্য সেকথা সবাই ভুলতে বসেছে। সীতার পরে জনকপুরের আর কোনও মেয়ের বিয়ে অযোধ্যায় হয়নি, হয় না- কেন? এ রহস্যের সমাধানে মাথার চুল ছিঁড়তেই যা বাকি রাখি- উত্তর মেলে না। চন্দ্রনাথ মরার জন্য নালার কিনারা বেছে নিয়েছিল। আমি তো আমার গোটা জীবনটাই অযোধ্যায় কাটিয়ে দিলাম। এ মাটিতেই বেঁচে থাকা, এ মাটিতেই মরব, তবু একটা চিন্তা মাথার ভিতরে নড়া-চড়া করতে থাকে, অস্বস্তি দেয়- কবে থেকে আমি, আমাদের মত যারা, আমরা কবে থেকে অযোধ্যা’কে ‘যাই হোক না কেন সহ্য করে নেওয়ার’ আস্তানা বানিয়ে ফেললাম?             

আজ অযোধ্যায় অন্ধকারের রাজত্ব। এমন নিকশ, ঘন কালো সময় যে আসতে চলেছে কেন আগে থেকে অনুভব করতে পারলাম না? দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিষয়-আসয়ের লালসা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ঘরছাড়া পথিকদের আশ্রয় – এই তো ছিল অযোধ্যা। সেই মাটিতে পা রেখে বড় হওয়া আমাদের মনের কোনও একটি কোনে রয়ে যাওয়া ‘মায়ার বাঁধন’কে আমরাই হয়ত ছিন্ন করতে পারিনি। ‘মোক্ষ লাভই সফল জীবনের প্রকৃত পরিণতি’ একথাও ভুলে গেছি। আজকের অযোধ্যায় এসবই গল্প কথা মনে হবে, জীবনের পুর্বাহ্ন অনুভবে ‘দ্রাবিড় প্রানায়াম’ করতেও আজকাল হাঁফ ধরে যায়।    

বৃদ্ধ গুলাম মহম্মদ সেই কবেই মুখের উপরে ‘না’ বলে দিয়েছিলেন। উর্দু সাহিত্যের কীর্তিমান গুলাম কলকাতায় পড়াশোনা করেছেন, পাশ করা হলে অযোধ্যায় চলে এসেছেন, সেই থেকে এখানেই রয়ে গেছেন। তিনিই আমাদের শিখিয়েছিলেন আসল মানুষ যদি কেউ হয় তবে যেকোনো ধর্মস্থান থেকেই সে ব্যক্তি সমান দূরত্ব বজায় রেখে চলবে। আমরা জানতে চাইলাম ঠিক কতটা দূরত্ব? বুড়ো বলেন সে ‘ দুরী ‘ অন্তত এটুকু হতেই হবে যাতে নিত্য ওপরওয়ালাকে স্মরণ করার কাজ মিটলে দ্বিতীয়বার স্মরণের আগে অবধি ঠাকুরের থানে যাওয়ার দরকার না পড়ে। আর শুধু বুড়োর কথাই বলছি কেন, আমাদেরও কি ছোট থাকতে শেখানো হয়নি দেবতাদের বেশি কাছে যাওয়া উচিত না? এসব তো জানাই ছিল! আমরা কবে থেকে এসব জানা কথা ভুলে গেলাম!

কোনও প্রশ্নেরই কেউ উত্তর দেয় না। মাথার ভিতর কিংবা চোখের সামনে আজ সকলেই নিরুত্তর। তাই মাঝে মাঝে ভাবি মনস্তত্ত্বের যে গোলমাল সেটা শুধু আমার একার ঘটেছে এমন না, অযোধ্যার আরও অনেকেই এমন রোগের শিকার। তাজ্জব এটাই যে সারা দেশে এত লোক, তবু কোথাও কারোর মুখে কোনও কথা নেই। প্রয়াত শলভ শ্রীরাম সিংহের কথা মনে পড়ছে। হিন্দি কবি হিসাবে তার বিশেষ পরিচিতি ছিল। যুৎসবাদ নাম দিয়ে নিজস্ব জীবনদর্শনের চর্চা করতেন শ্রীরাম। তার বক্তব্য ছিল মানুষের মনস্তত্ত্বে গোলমালের সুযোগে যেমনটা হয়েছে দু চারটি ধ্বংসের ঘটনাও ততটা ক্ষতি করতে পারেনি। ঐ অবধি বলেই উনি থামেননি, আরও কিছুটা এগিয়ে গেছেন। বলেছেন কোশলে রাত যত গভীর হয় তখন আমরা কেন নিরর্থক উত্তেজনার পিছনে ছুটে চলেছি? ধর্ম আর রাজনীতির অন্ধকারে যাদের পিষে মারা হচ্ছে সেই বিকট আওয়াজের চোটে কি আমরা নিজেদের কর্তব্য ভুলে যাচ্ছি?

আমি আর কীই বা করতে পারি? আঁধার যখন গভীর ঠিক তখনই তো হাতে প্রদীপ তুলে নেওয়ার সময়। আজ যে বিকৃত মনস্তত্ত্ব আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে সে অনুভবই আমাকে এসব কথা ভুলতে দেয় না। পবিত্র মন্দির নির্মাণ করতে গিয়ে আজকের অযোধ্যায় যেভাবে সব ভেঙে চুরে তছনছ করে দেওয়া হচ্ছে সেই নির্মাণের দিকে তাকালে কি কেউ রামকে দেখতে পায়? চারিদিকে সবই তো অন্ধকার! অশ্বঘোষের হাতে শুরু হওয়া দিওয়ালির উৎসবও আজ সরকারী উদ্যোগে পর্যবসিত হয়েছে। তাই তো আজ নিরন্তর দীপ জ্বেলে রাখা প্রায় অসম্ভব। আজ জীবন মানে দেশলাইয়ের কাঠি। অন্যকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হওয়া ব্যতীত তার আর কোনও উপায় নেই।

আজ অযোধ্যায় যেমন জবরদস্তি চলছে তাতে আর যাই হোক না কেন ফুল ফোটে না। গাজোয়ারির গর্ভে আনন্দ নেই। এসব ভাবতে ভাবতে হাজির হয়েছিলাম এখানকার সংখ্যালঘু মানুষের নেতা খালিক আহমেদ খান, তার সামনে। তিনি বলেন – ‘১৯৯২ সাল থেকেই গাজোয়ারি করা শুরু হয়। সেবছর ৬ ডিসেম্বর কয়েকশ’র ওপরে বাড়িঘর ও দোকানপাট পোড়ে, প্রায় দেড় ডজন মানুষ প্রাণ হারায়। সে ছিল এক ভয়ানক বিপর্যয়, যদিও মানুষ ওখানেই আটকে থাকেনি, থমকে যায়নি। বেঁচে থাকার সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তিই তাদের বাঁচতে শিখিয়েছে। খড়, টালী এবং হেসিয়ান পর্দা দিয়ে তৈরি মাটির বাড়িগুলিই স্থায়ী বসতবাড়ি হয়ে ওঠে। আগের থেকে ফারাক একটাই, এইবার বাড়ির মুখে কাঠের পরিবর্তে লোহার দরজা লাগানো হয়’।   

এসব কিভাবে সম্ভব হল? এখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য আয়ের অন্যতম উৎস ছিল রামনামী চাদর বুনন-ছাপানো, খাদাউন তৈরি করা, কাপড় সেলাই করা, জল বা টেম্পো চালানো, ফুল চাষ এবং মন্দিরের জন্য ফুলের মালা তৈরি। সেবার অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন এমন ব্যক্তিরা সরকারি ত্রাণ পেয়েছিলেন। ক্ষতির তুলনায় সেসবের পরিমাণ যদিও খুব একটা বেশি ছিল না। নিপীড়ন, অত্যাচার এমন যে মাটিতে মিশে যাওয়ার কথা ছিল, তবু তারা বেঁচে রইলেন কিভাবে? খালিক বললেন- জীবনের প্রতি মানুষের ইতিবাচক চিন্তাধারার জোরেই এমন অসম্ভব ঘটনাটি ঘটেছে। অমন চিন্তার মাধ্যমেই তারা প্রমাণ করে ছাড়ে মানুষ নিজে না চাইলে কেউ, কোনও শক্তি তাকে হারিয়ে দিতে পারে না! প্রবল বিদ্বেষের রাজনীতি ক্ষমতাসীন হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের জোরে মানুষ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবিলায় লড়াই করে যাচ্ছেন। আর হ্যাঁ, এসব করার জন্য কোনও আইএসআই তাদের টাকাপয়সা দেয়নি, যেমনটা বিদ্বেষের প্রবক্তারা প্রচার করেন।

একে কি বলব? সরকারী সহায়তায় আদায় করে নেওয়া যাবতীয় গ্ল্যামার ও উন্নয়ন সত্ত্বেও, অযোধ্যার সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি বোধহয় এটা। যারা নিজেদের ধর্মাচরণের অহমিকায় প্রায়ই আকাশ ছোঁয়ার কথা বলে তারাই কি এমন ঘটনায় বেকুব প্রমাণ হল না?   

খালিক আহমেদ খানের সোজা উত্তর– ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। অযোধ্যায় সংখ্যালঘুদের জীবনযাত্রার মান কিছুটা উন্নত হয়েছে কারণ তারা নিজেদের জীবনকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার কাজে রীতিমত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। আর সেই চ্যালেঞ্জ মোকাববিলায় যে তারা সফল হল তার কারণ অযোধ্যার সাধারণ জনগনের বেঁচে থাকা এমনভাবেই একে অন্যের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে বিরাট ধাক্কা সত্ত্বেও তার কোনও রদবদল ঘটেনি, অমন আলাদা আলাদা করে লোকজনকে বিবেচনা করা এখানে সম্ভব নয়। আবার এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। অযোধ্যায় থাকা সাধু-সন্ন্যাসী কিংবা ঠাকুরের থান আঁকড়ে বাঁচা গৃহস্থরা বেশিরভাগই ভক্তদের থেকে পাওয়া আয়ের উপর নির্ভরশীল, যা ক্রমশ কমতে কমতে আজ আর যথেষ্ট হয়ে উঠতে পারছে না। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এবং তার পরেও অযোধ্যায় বিশৃঙ্খলা চলেছিল, শহরের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকা রামকোটের কয়েক ডজন মন্দিরের গৌরবও ধ্বংস হয়েছিল। যাইহোক, এখন একটি বিশাল আকারের রামমন্দির তৈরি করা হচ্ছে এবং ২২শে জানুয়ারী রামলালার পবিত্র মূর্তি উন্মোচিত হবে… ওরা যদি তার সুবাদে একটু হলেও সুখের মুখ দেখেন তাহলে তো খুবই ভালো হয়!’

খালিক আহমেদ খান, সংখ্যালঘুদের নেতা এসব বলছেন! আমি তো চমকে উঠে তাকে কথা বলতে বাধা দিয়ে বললাম- ‘দেশ-বিদেশ থেকে ভক্ত ও পর্যটকরা অযোধ্যায় আসবে, সাধু-মহন্তদের থলে ভরে যাবে। আপনি কি সে কথাই বলতে চাইছেন? আমি তো মনে করি যে সেই থলে কেবলমাত্র বিশাল রাম মন্দিরের লোকেরাই পূরণ করবে, যা ইতিমধ্যেই বেশ কিছুটা ভরে উঠেছে। ভক্তদের কাছ থেকে আদায় করা বেশিরভাগ প্রসাদ কেবল সেখানেই যাবে এবং অন্যান্য মন্দিরের বেশিরভাগই তার উচ্ছিষ্টভোগের জন্য গালে হাত রেখে অপেক্ষাই করবে’।

এবার খালিক আমায় থামালেন- ‘আমি কিন্তু অন্য কথা বলব। অযোধ্যায় মন্দির ও মসজিদ নিয়ে একটাই বিরোধ ছিল, সেটা মিটে গেছে। এখন মন্দিরের দখল নিয়েই অসংখ্য বিরোধ রয়েছে। তাদের নিয়ে রক্তপাত ঘটেছে। প্রতিটি মন্দিরের অন্তত চারজন দাবিদার রয়েছে এবং দুঃখের বিষয় এই তারা যে কোনও তুচ্ছ বিষয়েও একমত নন। মন্দিরের ভিতরে না হোক অন্তত বাইরের দিকের সাজসজ্জা, কারুকাজ সঠিকভাবে হওয়া উচিত। চারিদিকে ভাঙা-চোরা মঠ-মন্দিরগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। এমন অবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখলেই বোঝা যায় সরকারি সাহায্য-অনুদান কার্যত ‘ক্ষুধার্ত উটের মুখে জিরেটুকু দেওয়া’ বৈ আর কিছুই না।’

ঐ অবধি বলেই খালিক আহমেদ চলে গেলেন। আমি অযোধ্যার অন্যান্য বিড়ম্বনার কথা ভাবতে লাগলাম। আজ অযোধ্যার দুই পায়েই শিকল বাঁধা। একটিতে রাজনীতি জড়িয়ে, অন্যটিতে ধর্ম। এসব থেকে পরিত্রাণ না পাওয়া অবধি তার ঐতিহ্য, তার প্রগতিশীল মূল্যবোধকে অযোধ্যা রক্ষা করতে পারছে না, চাইলেও আরেকবার সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে পারছে না। আজ মন্দির নির্মাণের নামে সরকারি কোষাগার থেকে যেভাবে বিপুল অপচয় হচ্ছে সেসব দেখে শ্রীরাম নিজে কি ভাবছেন?

আরও একটি বিড়ম্বনা আছে। বলা হয়, অযোধ্যা ও রাম সবার- কিন্তু সব দেশবাসী যেমন মানুষ, যেমন এক তেমনি তাদের জাতি, শ্রেণী, বর্ণ আলাদা আলাদা। অযোধ্যায়, প্রায় প্রতিটি বর্ণের আলাদা মন্দির রয়েছে এবং প্রত্যেকেরই নিজস্ব রাম রয়েছে। পিছিয়ে পড়া ও দলিত জাতিরা হয়তো একসময় তাদের জন্য আলাদা মন্দির তৈরি করেছিল যাতে স্বাধীনভাবে উপাসনা করতে পারে। এখন প্রায় সব মন্দিরেই এমন ‘উদারতা’ দেখা যাচ্ছে যে মেলায় বা ভিড়ের মিছিলে যে কেউ যে কোনও মন্দিরে প্রবেশ করতে পারে। সেখানে কেউ কারোর জাত জিজ্ঞেস করে না। কিন্তু একজন দলিত যে মন্দিরের চারপাশে ঝাড়ু দেয় সে তার পরিচয় প্রকাশ করে আজও সহজে ভিতরে ঢুকতে পারে না।

হ্যাঁ, নির্মীয়মাণ মন্দির যে বর্ণেরই অধিকারে থাকুক না কেন, পুরোহিত হবেন সেই একজন ব্রাহ্মণ। অন্য বর্ণের ব্যক্তি মহন্ত হওয়া সত্ত্বেও পূজা সম্পন্ন করার যোগ্যতা পাবেন না। কথিত আছে, অন্য বর্ণের পুরোহিত থাকলে মন্দিরে প্রসাদ কমে যায়।  কারণ ভক্তরা ব্রাহ্মণ পুরোহিতের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ করাকেই সবচেয়ে বেশী পুণ্যের কাজ বলে মনে করেন।  মন্ডল-কমন্ডলের সংগ্রামের সময় অযোধ্যার অন্যান্য পিছিয়ে পড়া বর্ণের অনেক মহন্তই নিজেদের বিভিন্ন পরিচিতি তৈরি করেছিলেন এবং উচ্চবর্ণের আধিপত্য কিছুটা হলেও ভাঙতে দেখা গেছিল। ‘পিছড়ে বর্গ’ বর্ণের মহন্ত যুগলকিশোর শরণ শাস্ত্রীর মতে, ‘সেবার ঐ আন্দোলনের সমস্ত সুযোগ সুবিধা দখল করে নিল উচ্চবর্ণের মহন্তরাই। শুরুর দিকে আমরা তাদের সাথেই ছিলাম। কিন্তু ক্রমশই বড় মহন্তরা বড় থেকে আরও বড় হতে থাকেন এবং আমাদের মত ছোটদের পক্ষে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের অবস্থান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।’

বলে রাখা ভালো, সাধু ও ঋষিদের মধ্যে দুটি শ্রেণী রয়েছে। একটি অংশ সুতো অর্থাৎ যজ্ঞোপবিতধারী এবং অন্যটি কাঁথি বা মালা। সুতোধারী মানে ব্রাহ্মণ আর মালাধারী মানে অন্যান্য অনগ্রসর জাতি।  কিন্তু এসব বিভাগের কোথাও কোনও নারীদের স্থান নেই। পুরো অযোধ্যায় একজনও মহিলা মহন্ত নেই। লক্ষ্মণ কিলাধীশ সীতারামশরণের শিষ্য ডক্টর সুনীতা শাস্ত্রী, একসময় করপাত্রী জি’র শিষ্য ছিলেন। বাল্মীকি রামায়ণ প্রসঙ্গে উনি রীতিমত পণ্ডিত। তা সত্ত্বেও, মহানতি উপাধি পেতে পারেননি। তাই বোধহয় লোকে বারবার বলে, অযোধ্যা কেবল রামেরই, অন্যদের কথা ছেড়েই দিলাম এমনকি সীতারও নয়।

এর একমাত্র ব্যতিক্রম হল মাইবরা, যেখানে নির্যাতিত নারী বা সাধু-ঋষিদের নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে। প্রাচীন সংস্কার থেকে মুক্ত, পরিবর্তিত দেশ ও সমাজের প্রভাব মাইবারায় স্পষ্টভাবে দেখা যাবে। এখন অবশ্য সেখানে নতুন ‘মা’র আবির্ভাব হওয়া অনেক কমে এসেছে। আগে তারা বিহার, নেপাল ইত্যাদি থেকে আসতেন। সম্ভবত এটিই নারীর ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন পরিকল্পনার প্রভাব যে আজ আর তাদের বাড়ি ছাড়ার প্রয়োজন নেই। হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে জরুরী পরিবর্তন এবং বার্ধক্য ও বিধবা পেনশনও এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে বলে জানা যায়।

বলাই বাহুল্য যে আজকের অযোধ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িকতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। একে প্রতিহত করতে না পারার কারনেই প্রতিদিন আমাদের অসহায় অবস্থা বেড়ে চলেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে যে স্বাভাবিক সম্প্রীতি, যা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অবধি প্রসারিত ছিল সেসবই এখন আনুষ্ঠানিক মাত্র হয়ে উঠেছে।  আগে বলা হতো হিন্দু-মুসলমানদের পাত্র ভিন্ন কিন্তু হৃদয় এক। এখন হয়ত বাসনপত্র আর অত দূরে নেই, কিন্তু হৃদয়টি একে অন্যের থেকে অনেক অনেক দূরে চলে গেছে বলে মনে হয়। এ শহরের স্বপ্নগুলো ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে কারণ স্বপ্নটা আসলে ঠিক কেমন হওয়া উচিত সে কথাটুকু বুঝতে এই শহর ব্যর্থ হয়েছে। আবার স্বপ্ন দেখতে হবে, দেশহিতে আসলে কী হওয়া উচিত, নিজেদের জন্য কী করা উচিত?

রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্লোগানের জোরে হিন্দুত্বের একমাত্র কেন্দ্র হয়ে উঠতে এই শহর আদৌ পছন্দ করে না। সমস্যা হল এ শহর, এ রুচি, এ সংস্কৃতির বহুরূপী শত্রুরা যে কিছুতেই ক্লান্ত হচ্ছে না। বৈশালীরই আরেক কবি নিজের লেখায় সেকথা ফুটিয়ে তুলেছেন-

‘হ্যাঁ, সেই বাবা এখানে থাকতেন, যিনি তার কৈশোরে গুরুর নির্দেশ শোনার পরে,

ব্রহ্মচর্যের ধর্মোপদেশে, চুলের খোঁপা দিয়ে নিজের লিঙ্গ কেটে ফেলেন।

হ্যাঁ, এখানেই বাবা থাকতেন,

বৃদ্ধ বয়সে সেই বিচ্ছিন্ন লিঙ্গের প্রদর্শনই তাঁর জীবিকা উপার্জনের একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়।’

নন্দকিশোর নওল তার কবিতার শেষে প্রশ্ন করেছেন – এ কি জীবের উপর ব্রহ্মার জয় নাকি ব্রহ্মার উপর জীবের জয়?  কিন্তু ওকে দেওয়ার জন্য কোনও উত্তর আমার কাছে নেই। আপনাদের কারোর জানা আছে? নেই? তাহলে এবার আপনারাই বলুন দিকি! কোশলের এই নিকশ, ঘন কালো রাত, এ নিয়ে আমি কী করব? এ যে অসহ্য!

সুত্রঃ গণশক্তি

Spread the word