সোমনাথ ভট্টাচার্য
‘‘আমার বক্তব্য ধর্ম এবং রাজনীতিকে কখনও মেশাবেন না। এটা মেশালে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমাদের যে সংবিধান আছে তা হলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তার জন্য আমরা গর্বিত। …নানা সংস্থা আছে যারা ধর্ম এবং রাজনীতি মিলিয়েছেন এবং বিশেষ করে রাম জন্মভূমি এবং বাবরি মসজিদ নিয়ে।’’
কমরেড জ্যোতি বসু সারা জীবন ধরে যে যে প্রশ্নে নিরলস সংগ্রাম করেছেন তার অন্যতম সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রাম।
এই রচনায় কমরেড জ্যোতি বসু তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখন, কীভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দৃঢ় এবং বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছেন তার কিছু নিদর্শন পেশ করা হবে।
কমরেড জ্যোতি বসু বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফেরেন ১৯৪০-এ। তখন থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হয়েছিলেন এবং রেলওয়ে শ্রমিক কেন্দ্র থেকে হুমায়ুন কবীরের মতো কংগ্রেসের ডাকসাইটে নেতাকে পরাজিত করে নির্বাচনে জয়ী হন। এই ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট ঘটে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের ঘটনা। যাতে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রায় চার হাজার মানুষ মারা যান।
এর কিছুদিন পরে ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ সালে জ্যোতি বসু বঙ্গীয় আইন সভায় বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, “আমি মনে করি শ্রমিকশ্রেণির কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে এই আলোচনায় আমার অবশ্যই অংশগ্রহণ করা উচিত। যে কেন্দ্রে হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বী মানুষই আছেন। গোটা শহরজুড়ে সাম্প্রদায়িক হানাহানি এই মহানগরীকে হতমান করেছে।”
‘ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা বন্ধ হোক’ এই শিরোনামে তাঁর বক্তব্যে জ্যোতি বসু বলেন, “অতীতে যখনই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে তখনই আমরা, সঠিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদকে তার প্রধান উসকানিদাতা হিসাবে ভর্ৎসনা করেছি এবং আমরা দেখেছি সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে দেশবাসী কিরকম অসহায় দুর্বল দাবার বোড়েতে পরিণত হয়। এবারের দাঙ্গা সম্পর্কেও আলাদা করে কিছু ভাবনার কোনও কারণ নেই। সমস্ত দেশপ্রেমিক শক্তির সঙ্গে আমিও অভিযুক্ত করছি এই দাঙ্গার প্রধান অপরাধীদের।”
এই দাঙ্গা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী (তখন এ রাজ্যের প্রধানকে প্রধানমন্ত্রী বলা হতো) সুরাবর্দি এবং তার দল মুসলিম লীগেরও কঠোর সমালোচনা করেন কমরেড জ্যোতি বসু।
আমরা সকলেই জানি ১৯৪৮-র ৩০ জানুয়ারি হিন্দুত্ববাদী নাথুরাম গড্সে খুন করে গান্ধীজিকে। যার ফলে স্বাধীন ভারতে আরএসএস নিষিদ্ধ হয়ে যায়। পরে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মধ্যস্থতায়, মুচলেকা দিয়ে তবে নিষেধাজ্ঞা ওঠে। সে এক লম্বা কাহিনী। আজ আমরা সে কথায় যাচ্ছি না।
গান্ধী খুনের কয়েকদিন পর ১৯৪৮-র ১০ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বসু বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, “সারা দেশের সঙ্গেই আমার পার্টি গান্ধীজির হত্যায় শোকাহত।…যখন ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ আমাদের মন ছেয়ে ফেলেছিল, …তখন নিজস্ব সহজসরল পথে গান্ধীজি নোয়াখালি,কলকাতা,দিল্লি দেশের সর্বত্র সাধারণ মানুষের দরজায় দরজায় তাঁদের মৌলিক মনুষ্যত্বের দরবারে আবেদন জানিয়ে ফিরেছেন। …কি হিন্দু, কি মুসলিম, ভারতে কি পাকিস্তানে, সর্বত্র সাধারণ মানুষ তাঁর ডাকে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছিল। গান্ধীজি তাঁর জীবন উৎসর্গ করলেন, খুন হয়ে গেলেন সাম্প্রদায়িক হিন্দুমহাসভার আততায়ীর নোংরা হাতে।”
কমরেড জ্যোতি বসুর বাক্য বন্ধে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা এবং গান্ধীজি হত্যার ধিক্কার প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে।তিনি স্পষ্ট করে বললেন, “ভাবে গদগদ একটা প্রস্তাব পাশ করে কিংবা প্রার্থনা সভায় যোগ দিয়ে কিংবা স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে কখনই গান্ধীজির অত্যন্ত প্রিয় সেই কর্তব্য পালন করা যাবে না। রেডিওতে আর জনসভায় সর্বক্ষণ এই প্রচার করা হচ্ছে, ‘পিতা, তুমি ওদের ক্ষমা করো, কেন না ওরা জানে না ওরা কি করছে’ — সে তো এক মিথ্যে কান্না। সাম্প্রদায়িকতার অসূয়াপরায়ণ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায় আমরা দায়বদ্ধ, আমাদের মধ্যে তিক্ততার বীজ বপন করেছে জঘন্য যে শক্তি, তার প্রতি ঘৃণায় আমরা দায়বদ্ধ … তাদের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করবো।”এভাবেই দৃপ্তকণ্ঠে সারাজীবন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন।
১৯৫২ সালে কংগ্রেস বিরোধী বৃহত্তম ঐক্যের ডাক দেওয়া হয়েছিল। সে প্রসঙ্গে ১০ জুন সাংবাদিক সম্মেলনে বসু ব্যাখ্যা করেন কিভাবে ব্যাপকমঞ্চ গড়ে তুলতে নানা ধরনের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানেও স্পষ্ট করে বলেন, “জনসংঘ ও হিন্দু মহাসভার সঙ্গে কর্মসূচির ভিত্তিতে কোনও ঐক্য সম্ভব নয় বলিয়া আমরা তাঁহাদের আমন্ত্রণ করি নাই।”
১৯৮০-র জানুয়ারিতে দেশে সপ্তম লোকসভা নির্বাচন সংগঠিত হয়। এর অব্যবহিত পূর্বে ৬ ডিসেম্বর ১৯৭৯ রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারের অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। সেখানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে জ্যোতি বসুর একটি এবং বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান হিসাবে প্রমোদ দাশগুপ্ত-র একটি; মোট দু’টি আহ্বান প্রকাশিত হয়। জ্যোতি বসুর আহ্বনে পরিস্কার করে ঘোষণা করা হয়, পশ্চিমবঙ্গে স্বৈরতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতার কোনও স্থান নেই।
একই বক্তব্য পুনরুচ্চারিত হয় ১৯৮৪-র ১৪ ডিসেম্বর আকাশবাণী প্রচারিত ভাষণে। যেখানে তিনি বললেন, “পশ্চিমবঙ্গে এই ভেদ-বিভেদের কোনও স্থান নেই। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এ রাজ্যে প্রত্যেকে প্রত্যেকের আপনজন।” সত্যিই, এ এক গভীর প্রত্যয়ের কথা।
১৯৮৬ সালের ৬ ডিসেম্বর দেশ পত্রিকা জ্যোতি বসু সংখ্যা প্রকাশ করে। সেখানে জ্যোতি বসুকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের লেখার পাশাপাশি তাঁর নিজের একটি সাক্ষাৎকার ছিল। দেশ পত্রিকার তরফে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। যেখানে জ্যোতি বসু রাজনীতি থেকে সাহিত্য আবার প্রশাসন থেকে ট্রেড ইউনিয়ন সমস্ত বিষয়ে সাবলীল উত্তর দিয়েছেন। কিন্তু সেই সাক্ষাৎকারে বসু সবচেয়ে বলিষ্ঠভাবে আমাদের সংবিধানের Unity in Diversity বা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সুরটি তুলে ধরেছেন। যে কারণে দেশ পত্রিকা সাক্ষাৎকারটির শিরোনাম দিয়েছিল : আমরা চেয়েছি বিভিন্নতার মধ্যে ঐক্য।
১৯৮৯ সালের অক্টোবরে ওয়ার্ল্ড মার্ক্সিস্ট রিভিউ-এ কমরেড জ্যোতি বসুর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেখানে অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দেবার সময়ও তিনি পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশ্নটিকে তুলে ধরতে ভুলে যাননি। তিনি বললেন, “সারা ভারতে জাত-পাত, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের জটিল সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু এরাজ্যে মানুষ শান্তিতে বাস করছে এবং এরাজ্য সাম্প্রদায়িকতার বিপদমুক্ত।”
এই সাক্ষাৎকারেই তিনি তুলে ধরেছেন পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরালায় কেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নেই। বিজেপি, আরএসএস যখন রামমন্দির বানানোর পরিকল্পনা করছে। দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো শুরু করেছে এরকম সময় ১৯৯০, ২৪ জানুয়ারি কমরেড জ্যোতি বসু বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে এক অনবদ্য বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, “আমার বক্তব্য ধর্ম এবং রাজনীতিকে কখনও মেশাবেন না। এটা মেশালে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমাদের যে সংবিধান আছে তা হলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তার জন্য আমরা গর্বিত। …নানা সংস্থা আছে যারা ধর্ম এবং রাজনীতি মিলিয়েছেন এবং বিশেষ করে রাম জন্মভূমি এবং বাবরি মসজিদ নিয়ে।”
তিনি আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, যে যার ধর্ম পালন করবে। এদেশের সংবিধান আমাদের সেই অধিকার দিয়েছে। কিন্তু একে রাজনীতির সঙ্গে মেশালে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই বক্তৃতাতেই তিনি আমাদের শিক্ষকের ন্যায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা অত্যন্ত সাবলীলভাবে শিখিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, এ দেশে অনেক মন্দির আছে আরও একটা মন্দির হলেই বা ক্ষতি কী? আরও একটা মসজিদ হলেই বা ক্ষতি কী? কিন্তু মসজিদ ভেঙে কেন মন্দির হবে? আপত্তিটা এই জায়গাতেই। অর্থাৎ তিনি আমাদের বোঝালেন কেউ যদি উপাসনার জন্যে মন্দির বা মসজিদ বানায়, সেটা হয় ধর্ম। আর মসজিদ ভেঙে মন্দির বানালে সেটা তখন আর ধর্ম থাকে না, সেটা হয়ে যায় রাজনীতি।
ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মিশিয়ে কেউ যখন আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করেছে তার বিরুদ্ধে এভাবেই সোচ্চারে গর্জে উঠেছেন কমরেড জ্যোতি বসু। তিনি বললেন, “এখন এই যে মৌলবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে, এর বিপদ হিন্দুদের মধ্যে যেমন আছে তেমনি মুসলমানদের মধ্যেও আছে। সবাই মিলে এই মৌলবাদের বিরোধিতা করতে হবে।” বিধানসভায় সকলের কাছে তিনি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বললেন, “বিরোধী পক্ষে যাঁরা আছেন তাঁদের এবং আমাদের সম্মিলিতভাবে এর বিরোধিতা করতে হবে। এছাড়া আমাদের পথ নেই। এটা না করলে আমরা ভারতবর্ষকে বাঁচাবো কি করে?”
দেশের সম্প্রীতি সম্পর্কে তাঁর এই আর্তি আমাদের এক মূহুর্তের জন্যেও ভুললে চলবে না। ২০০১ সালের ২-৪ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলিপুর ক্যাম্পাসে ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের ৬১তম অধিবেশন হয়েছিল। ২ জানুয়ারি রবীন্দ্রসদনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল। উদ্বোধক ছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। প্রধান অতিথি ছিলেন রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ‘গেস্ট অব অনার’ বা সম্মানিত অতিথি হিসাবে এই অনুষ্ঠানে জ্যোতি বসু যে বক্তব্য রেখেছিলেন তার শিরোনাম ছিল: Historians have to counter Falsification of History।
এই ভাষণে তিনি ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেস যে বিজ্ঞানভিত্তিক ও সংকীর্ণতামুক্ত ইতিহাস গবেষণার এক গৌরবজনক ঐতিহ্য বহন করে সে কথা উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে আক্ষেপ করে বলেন, “কিন্তু সংকীর্ণতাবাদী ও মৌলবাদী রাজনৈতিক শক্তির ট্র্যাজিক উত্থানের কারণে আজকের ভারতে এসবই ভয়ঙ্করভাবে বিপন্ন। ইতিহাসকে সামাজিক অগ্রগতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার পরিবর্তে, আমাদের পশ্চাৎগামী করতে এবং কুসংস্কার ও মৌলবাদী ধ্যান-ধারণায় বিচার বুদ্ধিকে প্রভাবিত করার কাজে ইতিহাসকে ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। চেষ্টা চলছে সংগঠিতভাবে, যাতে করে মানুষের দৃষ্টি মন্দির-মসজিদ-গির্জার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সে সময় অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি জোটের এনডিএ-র সরকার দেশের ক্ষমতায়।
এই সভায় উদ্বিগ্ন বসু আরও বলেন, “এছাড়াও পাঠক্রম সংস্কারের নামে সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের ভিত্তিতে পাঠ্যপুস্তকগুলি পুনর্লিখিত হচ্ছে। আমরা যখন তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লবের কথা বলছি তখনই বৈদিক গণিত এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার মতো বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। কিছু স্কুল পাঠ্যপুস্তকে ভারতের মানচিত্রে শুধু যে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাই-ই নয়, সেখানে নেপাল, ভুটান, তিব্বত এবং বার্মার কিছু অংশকেও ভারতবর্ষের মানচিত্রের মধ্যে দেখানো হয়েছে।” এরপরই কমরেড জ্যোতি বসু অত্যন্ত বিচলিতভাবে স্বগতোক্তি করেন, “আমি জানি না আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি এসব দেখে কী ভাবছে!”
এই বক্তব্যে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে বসু তুলে ধরেন এক কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকর্তার কথা। যিনি গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি ১৯৪৬-এর দাঙ্গায় অংশ নিয়েছিলেন এবং নিজে প্রতিবেশী মুসলিমদের বিরুদ্ধে উন্মত্ত জনতাকে খেপিয়ে তুলতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বসু সেখানে এইটুকু বলেই থেমে যাননি। বরং সর্বসমক্ষে দৃপ্তকণ্ঠে জানান, “এর বিপ্রতীপে আমি এবং আমার সহকর্মীরা ১৯৪৬-র সেই দুর্যোগের দিনগুলিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে সক্রিয় হয়েছিলাম এবং দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম।”বলাবাহুল্য, এই বক্তব্যের পরে সেদিন রবীন্দ্রসদনে করতালি থামতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল।
জ্যোতি বসুর দুর্ভাগ্য হয়নি মমতা ব্যানার্জির রাজত্ব দেখে যাবার। কিন্তু তার আগে তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন বলতেন, মমতা ব্যানার্জি আর তার তৃণমূল কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় অপরাধ বাংলার বুকে সাম্প্রদায়িক বিজেপি-কে টেনে আনা। আর বিজেপি সম্পর্কে জ্যোতি বসু প্রকাশ্যে বলতেন, অসভ্য বর্বর দল। এব্যাপারে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁকে প্রশ্ন করলে বসু বাজপেয়ীজিকে জিজ্ঞাসা করেন আপনারা যেসব কাজ করেছেন তাতে আপনাদের কোন বিশেষণ বলব একটু জানিয়ে দেবেন। পরে ব্রিগেড ভর্তি জনসভায় বসু বলতেন, বাজপেয়ীজি আজও জানালেন না বিকল্প কোন্ শব্দ আমি তাদের জন্য ব্যবহার করব! দর্শকরাও হাপিত্যেশ করে বসে থাকত জ্যোতি বসুর মুখ থেকে এই কথাটা শোনার জন্য।
আজ যখন দেশের সরকারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িকতার বিষ সমাজকে কলুষিত করছে, রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে তখন ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধ্রুবতারা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আর সেই আঁধার পথে আমাদের আলো দেখাবেন আলোর পথযাত্রী কমরেড জ্যোতি বসু।