Site icon CPI(M)

Independence is the only way to peace in Palestine

Gaza under atttack Cover

এই মুহূর্তে প্যালেস্তাইন রক্তস্নাত। পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত প্যালেস্তাইন ভূখণ্ড গাজা। চলছে প্যালেস্তাইনের হামাস গোষ্ঠী ও ইজরায়েল সরকারের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ। গত তিন দিনে দুপক্ষের সব মিলিয়ে সেনা সহ সাড়ে ৩ হাজার জন মানুষ নিহত হয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বিপুল। এই বীভৎস সংঘর্ষ ও প্রাণহানির পশ্চাতে রয়েছে এক আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের দীর্ঘ ইতিহাস।


প্যালেস্তাইন উগ্র জাতিবাদী আগ্রাসনের নির্মম পীড়নে নিষ্পেষিত বিপন্ন মানচিত্রের একটি রাষ্ট্র। নিজভূমে পরবাসী, সম্ভ্রমহীন, অধিকারহীন জাতির ঠিকানা। সেই প্যালেস্তাইনের একটি ছোট্ট ভূখণ্ড গাজা। ভূমধ্যসাগরের পূর্ব প্রান্তের এই ভূখণ্ডের জনসংখ্যা মাত্র ১৮ লক্ষ। যা আমাদের অনেক জেলার জনসংখ্যারও কম। এহেন একটি ভূখণ্ডের নারী-শিশুসহ আপামর মানুষ বারবার ইঙ্গ-মার্কিন মদতপুষ্ট মহাপরাক্রমশালী রাষ্ট্র ইজরায়েলের বর্বর ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণে চূড়ান্ত বিপন্নতার শিকার হয়েছে বিগত দীর্ঘ বছর ধরে। দলে দলে সেখানকার মানুষ হয় রাষ্ট্রসংঘ পরিচালিত শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে নতুবা পার্শ্ববর্তী দেশ মিশরে পালিয়েছে রাফা সীমান্ত পেরিয়ে। আর এইরকম অমানবিক, ভয়ানক আগ্রাসন ও আক্রমণের বীভৎস রূপ দেখেশুনে স্তম্ভিত হয়েছে বিশ্বের শান্তিপ্রিয়, স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ।


এই একতরফা বর্বর আক্রমণের প্রেক্ষাপটটা কী? তা হল জায়নবাদী আধিপত্যবাদ। জায়ন (Zion) কথার অর্থ হল পবিত্র জেরুজালেম—যীশু খ্রিষ্টের জন্মস্থান। জায়নবাদ হল ইহুদিদের একটি ভাবাদর্শ। থিওডর হের্জল ছিলেন আধুনিক জায়নবাদী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত তাঁর পুস্তিকা ডের জুডেনস্টাটে তিনি বিংশ শতাব্দীতে একটি ভবিষ্যত স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন দেখেন। ইহুদিদের ধর্মের সঙ্গে জায়নবাদকে সম্পৃক্ত করে ১৮৯৭ সাল থেকে জায়নবাদী আন্দোলনের সূচনা হয় ইউরোপে। এর লক্ষ্য স্থির করা হয় জেরুজালেম সহ সমগ্র প্যালেস্তাইনকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এই লক্ষ্য পূরণে বাধ সাধে জনসংখ্যার বিন্যাস। ইহুদিদের তুলনায় আরব জনসংখ্যার বিপুল সংখ্যাধিক্য। তাই ১৯২০ সাল থেকেই ব্রিটিশ মদতে প্যালেস্তাইনের আরব জনজাতির মানুষদের জমি থেকে উৎখাত করে সেই জমিতে বলপূর্বক ইহুদি বসতি বিস্তারের প্রচেষ্টা শুরু হয়। এই নিয়ে দুই ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষও হয় ১৯২১ ও ১৯২৮ সালে। সেই সময়ে প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে ইহুদি ছিল ৬০ হাজার। আরব জনজাতির মানুষ ছিল ৬ লক্ষেরও বেশি। বৃটিশ মদতে ১৯৩৬ সালে ইহুদিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪ লক্ষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সাল নাগাদ ব্রিটিশ-মার্কিন কর্তৃপক্ষ প্যালেস্তাইনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তখন ইহুদি জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬ লক্ষ ৮ হাজার। উল্টোদিকে আরব জনসংখ্যা ১২ লক্ষ ৬৯ হাজার। দ্বিগুণ জনসংখ্যা নিয়েও আরব জনজাতির মানুষদের সেদিন থেকেই নিজভূমে পরবাসী হবার চরম ট্রাজেডিকে মেনে নিতে হল সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির ষড়যন্ত্র ও আধিপত্যের চাপে। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের আলোচনার ভিত্তিতে ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে ইহুদি রাষ্ট্র হিসাবে ইজরায়েলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল প্যালেস্তাইনের আরব জনজাতির মানুষদের ‘নাকবা’ বা মহাবিপর্যয়। কারণ সেদিন থেকেই শুরু উগ্র জায়নবাদী আগ্রাসনের নির্মম পীড়নে আরব জনজাতির নিষ্পেষিত হওয়া। সেদিন থেকেই নিজভূমে পরবাসী হয়ে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে প্যালেস্তিনীয়রা। আজ পর্যন্ত ইজরায়েল তাদের চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণ করে নি। প্রতিনিয়তই চলছে প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে নারীঘাতী, শিশুঘাতী ইজরায়েলের বর্বর আগ্রাসন। ইতিমধ্যে সেদেশে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর অতি দক্ষিণপন্থী সরকারের ক্ষমতাসীন হবার ঘটনায় বর্বরতার চেহারা আরো বহুমাত্রায় বেড়ে গেছে।


১৯৪৮ সালে ইজরায়েল গঠনের পরবর্তী বছরগুলিতে মার্কিন মদতে ইজরায়েল তুমুল বিক্রমে প্যালেস্তাইন তথা আরব জনজাতি অধুষ্যিত ভূখণ্ডে বারবার হামলা চালিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে। এই সময়ে ঘটেছে একের পর এক যুদ্ধ। ১৯৪৮ সালে আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ, ১৯৫১ সালে সুয়েজ খালকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ, ১৯৬৭ সালে মিশর ও সিরিয়ার সঙ্গে ইজরায়েলের যুদ্ধ। এই যুদ্ধগুলির পরিণতিতে কয়েক লক্ষ প্যালেস্তিনীয় উদ্বাস্তু হল।’মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর নামে প্যালেস্তাইনের পাশে থেকে অন্য আরব দেশগুলির লড়াই তারপরে আর ঘটে নি। কারণটা অবশ্যই ‘পেট্রো ডলার’।সে অন্য আলোচনা। এর মধ্যেই ইয়াসের আরাফতের নেতৃত্বে ১৯৬৪ সালে গঠিত হল ‘প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ (পি এল ও)। ১৯৮৮ সালের ১৫ই নভেম্বর আলজিয়ার্সে ৪০টি দেশের স্বীকৃতিতে আরাফতের স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র ঘোষণা। ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রসংঘের মধ্যস্থতায় ‘অসলো’ চুক্তির মধ্য দিয়ে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের সহাবস্থানের ঘোষণা স্বাক্ষরিত হল। গঠিত হয় ‘প্যালেস্তাইন ন্যাশনাল অথরিটি’ (পি এন এ)। আরাফত ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দিলেও, ইজরায়েল ও তাদের মদতদাতারা প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদানে অস্বীকৃত হয়। সেই সময়েই অসলো চুক্তির স্বাক্ষরকারী অপেক্ষাকৃত উদার মনোভাবের তৎকালীন ইজরায়েলী প্রধানমন্ত্রী রাবীন জায়নবাদী উগ্রপন্থীদের হাতে খুন হয়ে যান। বিশ্ব জনমতের চাপে ইজরায়েল গাজা ও জর্ডন নদীর পূর্ব প্রান্তে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ভূখণ্ডের ওপর প্যালেস্তিনীয়দের সীমিত স্বাধিকার মেনে নেয়। ১৯৯৬ সালে আরাফত প্যালেস্তাইনের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন।
২০০৪ সালে ইয়াসের আরাফতের জীবনাবসান হয়। ২০০৬ সালে বিপুল জন উন্মাদনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘প্যালেস্তাইন ন্যাশনাল অথরিটি’র নির্বাচন। এই নির্বাচনে আরাফত প্রতিষ্ঠিত ফাতাহ্ পার্টিকে পরাস্ত করে জয়লাভ অর্জন করে হামাস গোষ্ঠী। ইজরায়েল ও তাদের মদতদাতা ব্রিটিশ-মার্কিন কর্তারা হামাসকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করে এই সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। কিন্তু ইজরায়েল যে শতগুণ বেশি সন্ত্রাসবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ সে কথা চাপা পড়ে যায়। ফলে প্যালেস্তাইন পরিস্থিতি আবার ঘোরালো হয়ে ওঠে। প্যালেস্তাইন মুক্তি আন্দোলনের দুই প্রধান শক্তি হামাস ও ফাতাহ্ নিজেদের মধ্যে বিরোধের বোঝাপড়া অন্তে যথাক্রমে গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে ও নিজেদের দপ্তর স্থাপন করে। ২০০৮ সাল থেকে ইজরায়েল হামাসকে উৎখাত করার লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে গাজা আক্রমণ শুরু করে। বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রের বারংবার আক্রমণে বিগত বছরগুলিতে নারী-শিশু সহ কয়েকশ প্যালেস্তিনীয় মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে ইজরায়েল। উদ্বাস্তু করেছে আরো কয়েক গুণ বেশি মানুষকে। এমনকি ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেও তারা আগ্রাসন চালিয়ে ইহুদি বসতি বিস্তার ও গুন্ডামি করে চলেছে। রাষ্ট্রসংঘের সিদ্ধান্তও তারা মানছে না। এইভাবে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত চলছে কখনও সংঘর্ষ, কখনও সংঘর্ষ বিরতি।


বছরের পর বছর নিজেদের দেশের মাটি থেকে উৎখাত হওয়া অত্যাচারিত, আক্রান্ত প্যালেস্তিনীয়রা গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে সীমাবদ্ধ হয়েও ইজরায়েলের আক্রমণ থেকে রেহাই পায় নি। জেরুজালেম শহরকে তাদের রাজধানী করার দাবিতেও কর্ণপাত করেনি ইজরায়েল ও তাদের মদতদাতারা। বরং উল্টে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরিত করা হয়। এমতাবস্থায় একান্ত নিরুপায় হয়েই হামাসকে হঠকারী আক্রমণের পথে যেতে হয়েছে। আর এই সুযোগে তাদের পুরোপুরি সন্ত্রাসবাদী দেগে দিয়ে বীভৎস প্রতি আক্রমণে গাজাকে গুড়িয়ে দিচ্ছে মহাপরাক্রমশালী ইজরায়েল তাদের ইঙ্গ-মার্কিন প্রভুদের অস্ত্র সাহায্যে। প্যালেস্তাইনের ওপর ইজরায়েলের এই ধারাবাহিক আক্রমণ না চললে হামাসের আক্রমণের কোনও প্রয়োজনীয়তা থাকত না। তাই ইজরায়েলের বর্তমান আক্রমণের বিরুদ্ধে সারা দুনিয়াজুড়ে জনমত সোচ্চার। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত হচ্ছে প্রতিবাদ। কিন্তু আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সংসদে বা কোথাও কোনও আলোচনা ছাড়াই নির্লজ্জভাবে ইজরায়েলের সরকার ও প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পাশে থাকার ঘোষণা করেছেন। ভারতের স্বাধীন বিদেশনীতিকে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন মোদী আমাদের দীর্ঘদিনের মিত্র প্যালেস্তাইনকে দূরে ঠেলে দিয়ে। ভারত সরকারেরই তো দায়িত্ব ছিল মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়ে দুই দেশের বিরোধ মীমাংসায় উদ্যোগী হওয়া!


বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দম্ভভরে ঘোষণা করেছেন গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক সহ সমগ্র প্যালেস্তাইনকে ইজরায়েলের অন্তর্ভুক্ত করার তথা পশ্চিম এশিয়ার মানচিত্র বদলে দেবার। এই জায়নবাদী আধিপত্যবাদের অবসান ঘটাতে, নারী-শিশু সহ নিরীহ মানুষের মৃত্যুমিছিল বন্ধ করতে বিশ্বজুড়ে জনমত সংগঠিত করতে হবে।রাষ্ট্রসংঘকে বলিষ্ঠতার সঙ্গে প্যালেস্তাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করতে হবে এবং সাম্প্রতিক হিংসা ও সংঘর্ষের অবসান ঘটিয়ে শান্তি স্থাপনে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। এই প্রক্রিয়ার ভিত্তিবর্ষ হবে ১৯৬৭ সাল। ওই বছর পর্যন্ত দুই দেশের সীমানা যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় ফেরানোর শর্তে যাবতীয় আলাপ-আলোচনা সংঘটিত হোক।
এই প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতাই শান্তির একমাত্র পথ।

Spread the word