Site icon CPI(M)

Did the thief ever catch the thief ? Chandan Das

অন্তিম (৪) পর্ব

পিপিই কিট থেকে যুদ্ধ বিমান,
ঘুষ, কমিশন আছেই

বিজেপি যেখানে যায়, দুর্নীতি সঙ্গে যায়।
মহামারী রোধ হোক কিংবা দেশের সুরক্ষা — বিজেপি-র শাসনে কাটমানি, ঘুষ এক স্বাভাবিক ঘটনা।
আসামে বিজেপি-র সরকার। করোনার সময়কালে এক অত্যাশ্চর্য কান্ড করে দেখিয়েছে এই রাজ্যের সরকার। তা নিয়ে তথ্য জানার অধিকার আইনে দুটি প্রশ্ন রাখা হয়েছিল হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সরকারের কাছে। গত ৩রা মার্চ এবং ১৪ই মার্চ আলাদা ভাবে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন ও আসাম মেডিক্যাল সার্ভিস কর্পোরেশন লিমিটেড তার জবাব দিয়েছে।
সেই জবাব জানাচ্ছে, ২০২০-র ১৮ই মার্চ ‘জেসিবি ইন্ডাস্ট্রিজ’কে ৫ হাজার পিপিই কিট জোগানের বরাত দিয়েছিল আসামের স্বাস্থ্য দপ্তর। যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী করোনার জন্য দেশে লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন তার ৬ দিন পর — ২৪ মার্চ রাতে!
সংস্থাটি কার? রিনিকি ভুঁইঞা শর্মার। তিনি কে? মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী।
কান্ডর এখানেই শেষ নয়। মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রীর এই সংস্থার অংশীদার ঘনশ্যাম দাস ধানুকার মালিকানাধীন ‘মেডিটাইম হেলথ কেয়ার ও জিআরডি ফার্মাসিউটিক্যালস’। তারা ২০ হাজার পিপিই কিট ও স্যানিটাইজারের বরাত পায়। একইসঙ্গে ‘নর্থ ইস্ট সার্জিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামে আর একটি সংস্থাও পিপিই কিটের বরাত পায়।


কিন্তু বরাতের রেটে তফাৎ আছে। মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী ও তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদারকে প্রতিটি কিটের জন্য ৯৯০ টাকা করে দেয় রাজ্য সরকার। কিন্তু ওই একইসময় ‘নর্থ-ইস্ট সার্জিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ’ পেয়েছে ৬০০ টাকা প্রতি কিটে। অর্থাৎ প্রতিটি কিটে ৩৯০ টাকা বাড়তি পাইয়ে দেওয়া হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী এবং তাঁর অংশীদারকে।
কিন্তু করোনার মত আপৎকালীন সময়ে নির্দ্ধারিত সময়ে কিট সরবরাহ করতে পারেনি রিনিকি ভুঁইঞা শর্মা এবং তাঁর অংশীদার। তাদের বরাত ৩ ও ৪ এপ্রিল বাতিল ঘোষণা করে স্বাস্থ্য দপ্তর। কিন্তু দুই সংস্থার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি আসাম সরকার। বরং ফের বরাত পায় ধানুকার সংস্থা — ওই এপ্রিলেই। এবার ৬৩,৯৬৫টি পিপিই কিটের বরাত মেলে ধানুকার ‘মেডিটাইম হেলথকেয়ার’-এর। দ্বিতীয় বার বরাত পেয়ে আর ৯৯০ টাকায় পিপিই কিট দেননি মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রীর অংশীদার। এবার দাম উঠে যায় কিটপিছু ১৬৮০ টাকায়। ধানুকার কাছ থেকে ওই দরে ১০ কোটি ৮৪ লক্ষ ৮৫ হাজার ৮৫০ টাকা দিয়ে কিট কেনে বিজেপি-র সরকার।


এই যদি পিপিই কিটের হাল হয় আসামে, দেশে বিমান কেনায় কী কান্ড হতে পারে?
হ্যাঁ, রাফালের কথাই হচ্ছে। যা নিয়ে ফ্রান্সে বিচার বিভাগীয় তদন্ত জারি আছে। আর ভারতে সিএজি একাধিকবার রাফালে সরবরাহকারী সংস্থার বিরুদ্ধে তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে।
ফ্রান্সের থেকে এই বিমান কেনার জন্য ভারত সরকারের আলোচনা যখন শুরু হয়, মোদী তখনও প্রধানমন্ত্রী হননি। কিন্তু মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই সেই আলোচনার চরিত্র বদলে যায়।
২০১৫-র এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী মোদী ফ্রান্স সফরে যান। সেখানে হঠাৎই ঘোষণা করেন আগের আলোচনার সিদ্ধান্তের বদলে ৩৬টি রাফালে বিমান কেনা হবে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ফরাসি সংস্থার কাছ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকায় ৩৬টি বিমান কেনার চুক্তি করে। যদিও ইউপিএ-২ সরকারের সময়কালে যখন এই বিমান কেনা নিয়ে কথা প্রায় চূড়ান্ত হয়ে আসে, তখন ১২৬ টি বিমানের জন্য দাম নির্দ্ধারিত হয়েছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা। মোদীর আমলে মাত্র ৩৬টি বিমানের দাম হয় ৬০ হাজার কোটি টাকা।
অর্থাৎ, বিমানপিছু দাম দাঁড়ায় ৫৭০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৬৭০ কোটি টাকা!


ইউপিএ-২ সরকারের সময়ে ঠিক হয়েছিল ১০৮টি বিমান ভারতে হিন্দুস্তান অ্যারোনেটিকস তৈরি করবে। মোদী তা বাতিল করে দেন। হয়ে যায়। এই বরাত নিয়ে ফরাসি সরকারের পক্ষ থেকে কোনও দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়নি। অফসেট মূল্য হিসাবে অনিল আম্বানির সংস্থাকে টাকা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। বিমান নির্মাণে কোনও অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও আম্বানির সংস্থাকে ‘সহযোগী’ করতে ফরাসি সংস্থা দাসাউ বাধ্য হয়েছে বলেই অভিযোগ। ফরাসি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য। নরেন্দ্র মোদী ৩৬ বিমানের বরাত ঘোষণা করেছিলেন ২০১৫-র ১০ এপ্রিল। ঠিক তার ১৫ দিন আগেই দাসাউয়ের সঙ্গে অনিল আম্বানির রিলায়েন্সের প্রথম সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর হয়। ২০১৭সালে দাসাউ এবং রিলায়েন্স মিলে যৌথ উদ্যোগের কোম্পানি দাসাউ রিলায়েন্স এয়ারোস্পেস লিমিটেড তৈরি হয়। ‘মিডিয়াপার্ট’ আগেই যে তথ্য সামনে এনেছে তা থেকে স্পষ্ট রাজনৈতিক কারণ ছাড়া দাসাউয়ের ওই কোম্পানি বানানোর কোনও কারণই ছিল না। যৌথ কোম্পানিতে সর্বোচ্চ ১৬ কোটি ৯০ লক্ষ ইউরো বিনিয়োগ হবে বলে ঠিক হয়। এর মধ্যে ১৫ কোটি ৯০ লক্ষ ইউরো দেয় দাসাউ, যদিও তাদের শেয়ার ৪৯%। রিলায়েন্স দেয় মাত্র ১ কোটি ইউরো অথচ তাদের শেয়ার হয় ৫১%। কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়া এমন অদ্ভুত বাণিজ্যিক চুক্তি হতে পারত না। অভিযোগ, মোদী তাঁর ঘনিষ্ঠ কর্পোরেটকে সুবিধা পাইয়ে দিতেই এই পথ নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা খরচ করে।
ভারত সরকার ও ফরাসি সরকারের মধ্যে চুক্তিতে দালাল ঢুকলেন কীভাবে, তাঁকে টাকাই বা দেওয়া হলো কেন— এই প্রশ্নও উঠেছে।


ফরাসি সরকারের দুর্নীতি নিরোধক সংস্থা এজেন্সে ফ্রাঞ্চাইসে অ্যান্টিকরাপশান-এর রিপোর্ট উদ্ধৃত করে ফরাসি সংবাদমাধ্যম ‘মিডিয়াপার্ট’ ২০২১-র নভেম্বরে জানিয়েছিল ভারতে রাফালে বিমানের বরাত পেতে ভারতীয় মধ্যস্থতাকারীকে বিপুল পরিমাণ উৎকোচ দেওয়া হয়েছে। রাফালে নির্মাতা দাসাউ ১০ লক্ষ ইউরো (ভারতীয় অর্থমূল্যে ৮.৬০ কোটি টাকা) ঘুষ দিয়েছে এক ভারতীয় কোম্পানিকে। ভারতের ডিফসিস সলিউশনকে ওই বিরাট অঙ্কের টাকা দেওয়া হয়েছে। ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে চুক্তি সই হবার পরপরই দাসাউ ভারতে তাদের ‘সাব কন্ট্রাকটর’ ডিফসিস সলিউশনকে ওই টাকা দেয়। ২০১৮-র অক্টোবরে ফরাসি সরকারের দুর্নীতি নিরোধক সংস্থা এজেন্সে ফ্রাঞ্চাইসে অ্যান্টিকরাপশান এই টাকা দেওয়ার বিষয় চিহ্নিত করে। তারা দাসাউয়ের কাছে জানতে চায় কেন ওই টাকা দেওয়া হয়েছে। দাসাউ উত্তরে জানায়, রাফালের ৫০টি রেপ্লিকা মডেল তৈরির জন্য ওই টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই মডেল বাস্তবে তৈরি করা হয়েছে বা কোথাও প্রদর্শিত হয়েছে এমন কোনও প্রমাণই দাসাউ দিতে পারেনি।
আইন অনুসারে ভারতে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনায় কোন মধ্যস্থতাকারী থাকতে পারে না। থাকলে তা দুর্নীতি বলেই চিহ্নিত হবে। ভারত সরকার ও ফরাসি সরকারের মধ্যে চুক্তিতে এমন দালাল ঢুকলেন কীভাবে, তাঁকে টাকাই বা দেওয়া হলো কেন— এই প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশ্ন উঠেছে, বেশি দামে বিমান কেনার চুক্তি করিয়েই কি এই টাকা পেয়েছেন ওই দালাল সংস্থা?

Spread the word