Site icon CPI(M)

“Aswathhama hatha, iti Narova Kunjarova” Elephant’s Death Case In Kerala Reminds Mahabharat Katha!

ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

গত ২৭ মে তারিখে কেরলে একটি গর্ভবতী হস্তিনীর মৃত্যু হয়। হস্তিনীটি অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করে জলে দাঁড়িয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ – ধীরে ধীরে তার শরীর অবসন্ন হয়ে এলে জলে ডুবে তার মৃত্যু ঘটে। কেরলের বনদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মীরা ঐ জায়গায় পৌঁছে হস্তিনীটিকে জল থেকে তুলে আনার অনেক চেষ্টা করেও ব্যার্থ হন। পরে মৃতদেহর ময়না তদন্ত হলে জানা যায় তার মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ জলে ডুবে যাওয়া, তার মুখের ভিতরে বিস্ফোরণের ফলে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় যার আঘাতে, যন্ত্রণায় প্রায় দু সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে সে কিছুই খেতে পারে নি। তার গর্ভস্থ সন্তানটিকেও বাঁচানো যায় নি।

Picture Source: Google Images

এসবই হল এই মৃত্যুর ঘটনায় প্রকৃত তথ্য যা সামনে আসার অনেক আগেই টিভির পর্দায় খবরের চ্যানেলগুলিতে প্রচার হয়ে যায় গোটা ঘটনাটি নাকি কেরলের মলপ্পুরম অঞ্চলে হয়েছে – সেখানকার মানুষজন ইচ্ছাকৃত নৃশংসতায় ক্ষুধার্ত হস্তিনীটিকে একটি বিস্ফোরক ভর্তি আনারস খাইয়ে দেয় যার ফলে হস্তিনীটির পেটের মধ্যে বিস্ফোরণ হলে সে পেটের সন্তানকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে জলে ডুবে নিজের যন্ত্রণা কমাতে চেষ্টা করেছে, পরে সেভাবেই মারা গিয়েছে। বনদপ্তরের কর্মীদের তাকে বাঁচানোর জন্য দীর্ঘক্ষণ লড়াইয়ের খবর চাপা পড়ে যায় হস্তিনীটির নিদারুন যন্ত্রণায় মানুষের উপর থকে বিশ্বাস হারিয়ে যাবার আবেগঘন হস্তিমনন বিশ্লেষণে বিশেষজ্ঞসুলভ ব্যাখ্যায়।

Picture Source: Google Images

স্বনামধন্য NDTV’র পক্ষ থেকে প্রথমে প্রচারিত হয় এই ঘটনা হয়েছে কেরলের মলপ্পুরম অঞ্চলে, পরে তারা নিজেদের ত্রুটি সংশোধন করে পুনরায় জানায় ঘটনাটি পলক্কড় জেলায় ঘটেছে।

ইতিমধ্যেই এই ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার শুরু হয়ে যায় কেরলের সরকার, সেখানকার প্রশাসন এবং সারা দেশের মধ্যে কেরলের শিক্ষার হার নিয়ে ব্যাঙ্গ, বিদ্রুপ এবং কটুক্তি সম্বল করে। বলা ভাল এই প্রচার সংগঠিত করা হয় নির্দিষ্ট রাজনৈতিক স্বার্থে যার লক্ষ্য ছিল কেরলে বামপন্থিদের সরকার। অনেক সাধারণ মানুষজন সেই চক্রান্ত সম্পর্কে না জেনে বুঝেই মৃত পশুটির কষ্টে দুঃখ অনুভব করে এই প্রচারে জড়িয়ে পড়েন। এদেশে বারে বারে যেকোনো ঘটনায় নির্দিষ্ট রাজনৈতিক স্বার্থে ফেক খবর প্রচার করার ঘটনা এখন আকছার ঘটছে। পশুটি যেভাবে মারা গিয়েছে তাতে যেকোনো মানুষের হৃদয় আর্দ্র হবেই, তার মৃত্যু আটকাতে পারলে খুশি হতেন না এমন কেউই বোধহয় নেই। কিন্তু এই ঘটনায় নির্দিষ্ট সাম্প্রদায়িক রং চাপিয়ে দিতে যেভাবে মলপ্পুরম এলাকার নাম জড়িয়ে দেওয়া হল তাতে উদ্দেশ্য স্পষ্ট – যেভাবে হোক দেশের জনগণের মনে যেনতেন প্রকারেণ সাম্প্রদায়িক ঘৃণার প্রচার করাই ছিল লক্ষ্য। মলপ্পুরম এলাকায় মুসলমান মানুষের সংখ্যা বেশি, এই সুযোগে প্রচার করিয়ে দেওয়া হল ঐ এলাকায় এইধরনের অমানবিক, নৃশংসতার ঘটনা রোজকার ব্যাপার। বিজেপি’র নেত্রী , পশুপ্রেমিক হিসাবে পরিচিত স্বনামধন্যা মানেকা গান্ধী ট্যুইট করে সবার কাছে আবেদন রাখলেন তারা যেন ঐ এলাকায় দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা এধরণের অমানবিক ঘটনার প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন।

Maneka Gandhi’s Tweet (Snapshot)

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর নিজের ট্যুইটার হ্যান্ডেলে এও লিখে দেন এই ঘটনায় বিশদে তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির ব্যাবস্থা করবেন। ইঙ্গিত স্পষ্ট, নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের প্রতি প্রচ্ছন্ন হুমকি দিলেন সরকারি মন্ত্রী।

Prakash Javadekar’s Tweet (Snapshot)

এই ঘৃণার রাজনীতির প্রচারে অভ্যস্ত কেউ কেউ আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নাম না করে মলপ্পুরম এলাকায় বসবাসকারীদের বেজন্মা বলে গালাগালি শুরু করে দিয়েছেন। আধুনিকতার নামে ভার্চুয়াল জগতে অভ্যস্ত দেশের জনগণের এক বড় অংশই তখন এসব না জেনে বুঝেই গিলছেন, রিট্যুইট করছেন, পোস্ট শেয়ার করে চলেছেন! দেশজূড়ে ট্রেন্ড হচ্ছে মিথ্যাপ্রচার! যারা এই কাজ করেছেন তাদের মনে মৃত হস্তিনীটির যন্ত্রণার প্রতি সমবেদনা একশ শতাংশ সঠিক কিন্তু সেই নিয়ে যেভাবে তাদের জড়িয়ে ফেলে মিথ্যাপ্রচারের রাজনীতি করা হল সেই প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সচেতনতা অধিকাংশেরই নেই। এরই সুযোগ নিয়ে প্রায় দুদিন ব্যাপি সময় ধরে চললো সাম্প্রদায়িক ঘৃণার অত্যাধুনিক ডিজিটাল সম্প্রচার যার নাম ট্রেন্ডিং!

ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে মৃত হস্তিনীর দেহের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট! জানা গেছে তার মৃত্যুর আসল কারণ এবং এও জানা গেছে তাকে যে বিস্ফোরক ভর্তি আনারস খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল এই কথা একেবারেই অনুমান ভিত্তিক! তার মুখে বিস্ফোরণের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে এবং সেই আঘাতের ফলেই গত দু সপ্তাহ ধরে হস্তিনীটি কিছুই খেতে পারেনি, জলে ডুবে সেখা থকে উঠে আসার মতো শক্তি তার শরীরে আর ছিল না।

কিন্তু ততক্ষনে যেহেতু রাজনৈতিক প্রচার চালিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি হয়ে গেছে তাই এই নিয়ে আর কথা তোলা হচ্ছে না! এখন ট্রেন্ডিং’র বিষয় ঘুরে গেছে নতুন কোন কিছুর দিকে, সঠিক তথ্য জানিয়ে মানুষকে সচেতন করার কাজ যেহেতু “কুল” ঘরানার কোন কর্মসূচি নয় তাই সেকাজে আর পরিশ্রম করতে রাজি নয় বাজারি সংস্কৃতির দালালেরা! আসলে ট্রেন্ড করানোর নামে প্রতিদিন মানুষের মনে কিছু একটা ঢুকিয়ে দিতে হবে, তা সে যতই ভিত্তিহীন কিছু একটা হোক না কেন! সকাল থেকে সেই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় উঠবে বা বলা ভাল ঝড় তোলা হবে, সেই ঝড়ের কালিমা মানুষের চেতনাকে ঢেকে দেবে, জুক্তির ধার কমিয়ে দেবে, ইতিহাস সম্পর্কে উদাসীন করে তুলে Take The Matter As It Is নামক অবাস্তব্বাদী দর্শনকে জনচেতনার নামে চালিয়ে দেওয়া হবে! মস্তিস্ক নামক পেশির সঞ্চালনার বদলে মস্তিস্ক প্রক্ষালনই হল আধুনিক অভ্যাস! এসবকিছুতে লাভ কার? বাজার ব্যাবস্থার – চেতনায় বন্ধ্যাত্ব এলে মানুষকে প্রয়োজনমাফিক যা ইচ্ছা বুঝিয়ে দিতে পারলেই তো বিনা যুদ্ধেই সবটা জিতে নিতে পারে পুঁজিবাদ! তাইতো আধুনিকতার নামে Whatsapp University’র উদয়, জনপ্রিয় প্রযুক্তির নাম দিয়ে ইতিহাসবিমুখতা হয়ে ওঠে লক্ষ্য। লকডাউন সত্ত্বেও মানুষ যখন সংক্রমণ বেড়ে যাবার ক্রমান্বয়ী লেখচিত্র দেখে সন্ত্রস্থ হচ্ছেন রোজ, সেই সময়ে দেশের মানুষকে বাঁচাতে নির্বাচিত সরকার আসলে কি ভূমিকা পালন করল সেই চিন্তা যাতে জনগণের মাথায় বেশিক্ষন বাসা বাঁধতে না পরে তাই প্রয়োজন ছিল এমন একটা কিছুর যাতে সহজেই লোকজনের দৃষ্টি, মনন, চেতনা সবকিছুকে একধাক্কায় অন্যকিছুরদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। প্রায় আড়াই মাসব্যাপি ঘরবন্দী অবস্থায় ক্লান্ত, বিরক্ত হতাশাগ্রস্থ মানুষ যখন ক্রমশ খবর পাচ্ছেন আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েড নামের কালো চামড়ার এক মানুষের পুলিশের অত্যাচারে মৃত্যুর ঘটনায় সেদেশের জনগন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, দাম্ভিক সরকারের চোখে চোখ রেখে লড়াই করছেন – রাস্তা থেকে শুরু করে শ্বেতপ্রাসাদ অবধি জনগণের দখলে চলে যেতে বসেছে আর দুনিয়াজুড়ে হুমকি দেওয়া সেখানকার বিক্রমশীল রাস্ট্রপতি নিজেকে বাঁচাতে আশ্রয় নিচ্ছেন বাঙ্কারের তলায় তখন এদেশে আমেরিকান মডেলের নামে দু থালা ভাত বেশি খেয়ে নেয় যারা তাদের তো আতংক হবেই! ঘর পোড়া গরুর ন্যায় তারা তো চিরকাল সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পেয়েছেন! ঐ মেঘের রং লাল যে!

কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন এই ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। জানিয়েছেন যথাযথ তদন্ত শেষে দোষীরা শাস্তি পাবেই। সারা দেশের মানুষের মনে একটি হস্তিনীর যন্ত্রণার প্রতি গভীর সমবেদনা শুধুই ট্রেন্ডিং’র বিষয় নয় – এর অর্থ এখনও এদেশের জনচেতনায় মানবিকতা ভরপুর। যতই ঘৃণার প্রচার হোক না কেন মানুষকে অমানবিক করে তোলার মতো শক্তি এখনও তারা সঞ্চয় করতে পারেনি।

Pinarai Vijayan’s Tweet (Snapshot)
Forest Minister’s Tweet (Snapshot)

এদেশের সংস্কৃতিতে রামায়ন, মহাভারতের কাহিনিগুলির প্রাসঙ্গিকতা যথেষ্টই। তবে সেইসব কাহিনীকে হাতিয়ার করে শুধু একপক্ষই যে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিতে সফল হবে এরকম ভাবা সঠিক নয়। প্রয়োজনে এদেশের যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানধর্মী জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষদের সাথে নিয়ে বামপন্থিদের সেইসব কাহিনীর নির্যাস পৌঁছে দিতে হবে মানুষের কাছে। যা কিছুকে সম্বল করে বিভেদকামী শক্তি মানুষে মানুষে ফারাক দেখাতে চায়, ঘৃণা ঢুকিয়ে দিতে চায় চেতনায় সেইসবকিছুকে সঠিক অর্থে প্রয়োগ করতে হবে তাদেরো যারা চান ভারত তার নিজের একতায় স্থিত থাকুক। তাই মনে রাখতেই হবে মহাভারতে একটি অবলা পশুকে বোধ করে সেই খবরকে ব্যাবহার করে ইচ্ছাকৃত মিথ্যাপ্রচার করানো হয়েছিল স্বয়ং ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের মুখ দিয়ে। সেই কাহিনিতে লক্ষ্য ছিল সম্মুখসমরে অজেয় দ্রোনাচার্যকে হত্যা করা। মহাভারতের সেই কাহিনি আসলে আজকের দিনের ভুয়ো খবর বা ফেক নিউজকেই চিহ্নিত করে। সেবার দ্রোণাচার্য যে ভুল করেছিলেন আজকের দিনে সেই কাহিনী মনে রেখেই জনগন ঐ একই ভুল যাতে আর না করেন তা দেখার দায়িত্ব শুভবুদ্ধিকামী সবার। সেবার অশ্বত্থামা হত হন নি, আজও তিনি হত না হলেও কেউ কেউ মানুষকে ভুল বোঝাতে চাইছে – তারা ভুলে গেছে হয়ত ভারতে আজও অসাধারণ শিক্ষাগুরুদের দেশ যে পুরস্কার দেয় তা দ্রোণাচার্য’রই নামে নামাঙ্কিত!

Spread the word