Site icon CPI(M)

Artificial Intelligence, Its Applications & Reality

AI Cover

সৌভিক ঘোষ

মূল কথা

সাধারণভাবে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের ফারাক উপলব্ধিতে কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে। এআই ইত্যাদি বলে যে ঢাক পেটানো চলছে তাতে নতুন কিছু একটা বলেই আমাদেরও তালে তাল মেলাতে হবে একথা যেমন সঠিক না তেমনই নতুন যা কিছু সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে সেসবকিছু নিয়েই যে আমাদের সচেতন থাকতে হবে এটাও জরুরী। তাই খেয়াল রাখতে হয় দেশের সরকার কৃষি উৎপাদন প্রসঙ্গে ঠিক কি ভাবছে, কি করছে। আজকাল সরকার নিজের ভাবনা নিজের দেশের লোকজনের থেকেই গোপন রাখতে চায়, তবু কিছুটা অবশ্যই জানা যায়। সরকারী বিভিন্ন মন্ত্রক, দপ্তর ও স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী কমিটির আলোচনা, প্রতিবেদনই সেসব জানার সুত্র, কেতাবি ভাষায় প্রাইমারি সোর্স। কেউ ভাবতে পারেন তবে যা গোপন রয়ে গেল সেই নিয়ে কি হবে? বাড়তি কথা আপাতত তুলে রেখে একটি সহজ সত্য মনে রাখলেই চলে। আমরা যে বিজ্ঞানসম্মত দার্শনিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে সবকিছুকে যাচাই করি, সেই আলোকেই সরকারের পরিকল্পনা, ঘোষিত ও অঘোষিত ইচ্ছা, অনিচ্ছাকে বুঝে নিতে হয়। এই প্রবন্ধে আমরা তেমনই কিছু করার চেষ্টা করব।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আসলে কি?

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (ছোট করে এআই) আদতে একটি গবেষণা। এই গবেষণায় বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির একাধিক শাখা সমবেত হয়ে কাজ করে। ইদানিং পত্র-পত্রিকায় এআই সম্পর্কে ইচ্ছাকৃত কায়দায় এমন একটা ভাব দেখানো হচ্ছে যেন গোটা দুনিয়ায় সবই পাল্টে যাচ্ছে! অমন আলাদীনের প্রদীপ আর যাই হোক বিজ্ঞান না। প্রযুক্তি গবেষণার প্রাথমিক বোঝাপড়া চিরকাল একই ছিল, মানুষের কায়িম শ্রমকে কমাতে হবে, অন্তত অহেতুক বাড়তি পরিশ্রম তো কমাতে হবেই। এতে লাভ কি? মানুষ যত বেশি করে কায়িক শ্রমের বোঝা থেকে মুক্তি পাবে তত বেশি মানসিক ক্রিয়ার মধ্যে যাওয়ার সুযোগ পাবে। মে দিবসের প্রাথমিক দাবীগুলি আরেকবার তাকিয়ে দেখা যায়, আটঘন্টার শ্রম, আটঘন্টার বিশ্রাম ও আটঘন্টার বিনোদন। বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ের জন্য মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাসে এর চাইতে বিজ্ঞানসম্মত দাবী আজও নেই।

সেই উদ্দেশ্যেই অনেকদিন ধরে চেষ্টা চলছে কি করে মানুষের সমান বুদ্ধিমত্তাওয়ালা মেশিন বানান যায়। তারই লক্ষ্যে যেসকল প্রযুক্তি কাজ করে কম্পিউটার সায়েন্স সেই তালিকার একেবারে প্রথমে রয়েছে। সেই সায়েন্সেরই একটি বিভাগ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসে রয়েছেন যিনি তাকেই সাধারণভাবে ব্যবহারকারী ধরে নেওয়া যায়। একধরণের মাধ্যম নির্মাণ করা হয় যার একদিকে রয়েছে মানুষ (যিনি ব্যবহারকারী) আরেকদিকে কম্পিটারের মগজ (যাকে প্রসেসর বলে)। মানুষটি প্রশ্ন করবেন, কম্পিউটার উত্তর দেবে। এই হল মোটের উপরে বন্দোবস্তের মূল কথা।

ঐ যে মাধ্যমটি তাকেই আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তির পরিভাষায় কনসোল বলে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বলা হচ্ছে কেন? কারণ মানুষের প্রশ্নের জবাবে যে ধরণের উত্তর কম্পিউটার দিচ্ছে তার সবটা আগে থাকতে প্রোগ্রামড করা নেই (অর্থাৎ কম্পিউটারের মধ্যে আগে থেকে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নেই), মানুষ যেমন নিজের সামনে বসা লোকজনের কথা শুনে ভেবেচিন্তে উত্তর জানায়- কম্পিউটার সেটাই করছে বা বলা ভালো সেই দিকে ক্রমশ এগোচ্ছে। এমনটা করতে পারছে বলেই বলা হচ্ছে কম্পিউটার মানুষের বুদ্ধিমত্তার কাছাকাছি চলে আসছে। যেহেতু ব্যবহারকারীর উল্টোদিকে যে রয়েছে সে মানুষ না, মানুষের মতো জবাব দিচ্ছে, সমস্যার সমাধান বাৎলে দিচ্ছে তাই যেন প্রায় মানুষই করছে বলে মনে হয়। এই যে বুদ্ধিমান মেশিন, তার মেধা আসলে মানুষের না, নকল তাই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।

এই প্রযুক্তির গবেষণা আচমকা গজিয়ে ওঠা আজকের বিষয় না, এই প্রবন্ধের লেখক যখন ইঞ্জিনয়ারিং কলেজের ছাত্র তখনও তার সিলেবাসের একটি স্পেশাল পেপার ছিল।

তাহলে আজ হঠাৎ এত হৈচৈ হচ্ছে কেন?

কারণ ঐ গবেষণায় বেশ কিছুটা উন্নতি করা গেছে।

কতটা?

এখন ব্যবহারকারীর জিজ্ঞাসা অনুযায়ী কম্পিউটার ছবি এঁকে দিচ্ছে, পুরানো লেখার বানান ইত্যাদি শুধরে দিচ্ছে, আবার একেবারে শিক্ষার্থীসুলভ সহজ ভাষায় ছোট বড় প্রবন্ধও লিখে দিতে পারছে। অবশ্য সেসবের সমস্তটাই যে খুব পাতে দেওয়ার মতো কিছু হচ্ছে এমনটা না, কিন্তু করছে। এতেই প্রযুক্তি নির্মাণ করেছে যারা তারা বিজ্ঞাপনের লোভে সব হয়ে গেল, সব হয়ে গেল বলে গলা ফাটাচ্ছে। এই প্রযুক্তি কিছুদূর এগিয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু যেমনটা ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার চলছে তার মতো কিছু এখনও আদৌ ঘটেনি।  

এই যে প্রচার চলছে তার আসল উদ্দেশ্যের অর্ধেকটা অর্থনীতি, বাকিতা রাজনৈতিক। ইউরোপের বাজারে সস্তা শ্রম মেলা দুষ্কর। শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে মানুষ অনেকটাই সচেতন। উপজুকত কাজকম্ম না পেলে সেখানকার মানুষজন রাষ্ট্রব্যবস্থাকে রীতিমত শায়েস্তা করে দিতে জানেন। তাই পুঁজি সবসময়েই চায় মানুষকে এড়িয়ে বিভিন্ন কাজের বেশিরভাগটাই যন্ত্রের জোরে সেরে নিতে। এতদিন তারাই আমাদের মতো দেশ থেকে সস্তা শ্রমিক ও শ্রম দুইই আমদানি করত, এখন এআই’র সুবাদে তারা সেই বন্দোবস্তে আগের চাইতে কিছুটা বাড়তি দর কষাকষি করতে পারবে। কারণ কম মজুরিতে রাজি না হলে আগে বলত তুমি নেই তো কি হয়েছে ও আছে, ওরা আছে, এখন বলবে ‘তুমি নেই, তোমরাও নেই- পরোয়া নেই, এআই আছে’। দারুন হল, জগত পাল্টাচ্ছে বলে এত আওয়াজের পিছনে আসল গপ্পোটা এটাই।

ভারতের কৃষিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রয়োগের প্রেক্ষিত

মোদী সরকার এ আই নিয়ে উচ্ছ্বসিত, অন্তত তাদের হাবভাব তেমনই। এমনিতেই এ সরকারের সেই সবকিছুতে বিশেষ আগ্রহ রয়েছে যাতে কর্পোরেটদের মুনাফা বাড়ে, আরও বাড়ে, আরও আরও বাড়ে। নয়া তিন কৃষি আইন সেই উদ্দেশ্যেই প্রণীত হয়েছিল। কেউ কেউ ভুলে যেতে পারেন তাই ধান ভাঙ্গার আগে কিছুটা শিবের না হোক এদেরই কৃতকর্মের গান গেয়ে রাখা যাক।

প্রভাত পট্টনায়েক মনে করিয়ে দিয়েছেন- একচেটিয়া পুঁজি অতি-মুনাফা (Super-Profit)-র কায়দায় লুট চালায়। প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফার যে সাধারণ হার বজায় থাকে তার উপরে, কেবল শ্রমিক শোষণ করেই (উদ্বৃত্ত মূল্যের হার বাড়িয়ে) নয়, বরং ছোট পুঁজিপতিসহ ক্ষুদ্র উৎপাদক হিসাবে কৃষকদেরকেও এই ব্যবস্থা শোষণ করে। একচেটিয়া পুঁজি স্বাভাবিক কৃষিব্যবস্থার বিরুদ্ধে ‘ব্যবসার শ্রেণী শর্তাবলী’ চাপিয়ে দেয়। এই লক্ষ্যে রাষ্ট্রকেও এই ব্যবস্থা মধ্যস্থতাকারী হিসাবে হাজির করে। এর উদাহরন হিসাবে মনে রাখতে হয় কৃষক নির্ভর কৃষিব্যবস্থা থেকে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের দিকে রাষ্ট্রীয় আর্থিক সহায়তার অভিমুখ কিভাবে পরিবর্তন হয়েছে। একচেটিয়া পুঁজির সহায়তায় ভর্তুকি এবং কর-ছাড় ঠিক সেই অনুপাতেই বৃদ্ধি পায় যে অনুপাতে কৃষকদের জন্য ন্যুনতম সহায়ক মূল্য এবং অন্যান্য খরচে সরকারী ব্যাবরাদ্দ কমিয়ে রাষ্ট্র নিজেকে দায়মুক্ত করে। কৃষকদের দুর্দশার বিনিময়ে একচেটিয়া পুঁজিকে মুনাফা লুটের বন্দোবস্ত করা চলে।

কিন্তু কৃষক নির্ভর কৃষিব্যবস্থায় একচেটিয়া পুঁজির এহেন দখল কেবল একটি নিরবিচ্ছিন্ন লগ্নীর চেহারাতেই থেমে থাকে না, অর্থাৎ, আয়ের পুনর্বণ্টন কেবল এক গোষ্ঠী থেকে আরেক গোষ্ঠীর হাতে হস্তান্তরের চেহারাই নেয় না, বরং এই হস্তান্তর চলে স্টক আদান-প্রদানের কায়দাতেও। পরের থেকে লুট করা সম্পদের পুনর্বণ্টনে এই দুই কায়দা কার্যত একে অন্যের সাথে মিলেমিশে যায়। যার ফলে কৃষক নির্ভর কৃষিব্যবস্থা ধ্বংস হয়, দুর্দশাগ্রস্থ কৃষকরা চাকরির সন্ধানে শহরের দিকে চলে যেতে বাধ্য হয়।

কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট দখলদারির দ্বিতীয় যে কারণটি উঠে আসে তা হল প্রযুক্তিগত উন্নতিসাধনের এক প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের প্রবর্তন। নয়া-উদারবাদের নিজস্ব কায়দা হিসাবে তুলনামূলক অনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যই এহেন প্রবর্তনের বৈশিষ্ট্য। এর ফলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার সাধারণভাবে হ্রাস পেতে থাকে। নয়া-উদারবাদী জমানায় জিডিপি বৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত হলেও ঐ একই সময়ে শ্রমের উৎপাদনশীলতার হার মন্থর রয়ে যায় ফলে কর্মসংস্থান আটকে থাকে; যখন জিডিপি’র বৃদ্ধি হয় না, তখন কর্মসংস্থানের চেহারা হয় আরও করুণ।

এইসবের ফলে যা হয়, শহরে কাজের খোঁজে কৃষকদের অভিবাসন যেমন একদিকে বাড়তে থাকে তারই সাথে শহরে বেকার শ্রমিকদের মজুত বাহিনীটি ফুলে-ফেঁপে ওঠে, যা মোট শ্রমিকদের তুলনায় সংখ্যায় অল্প হলেও সংগঠিত শ্রমিকদের মালিকগোষ্ঠীর সাথে দরকষাকষির ক্ষমতা কমতে থাকে। কর্মহীন শ্রমিকদের মজুত বাহিনী জনগণের মধ্যে কোন নতুন গোষ্ঠী নয় তারা শ্রমিকই, ফলে মোট বেকারত্বে তারাও যুক্ত হলে কাজে যুক্ত হবার সুযোগ আগের চাইতে আরও অনেক বেশি সংখ্যকদের মধ্যে ভাগ হয়। এর প্রভাবে কৃষক নির্ভর কৃষিব্যবস্থার উপরে আরও বেশি চাপ পড়ে যা গোটা দেশে কর্মক্ষম জনগণের জীবনযাত্রার মানে চরম অবনতি ঘটায়।

একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আজকের সংগ্রামে শ্রমিক-কৃষক জোটটি এই জন্যই আরও বেশি প্রয়োজনীয়। একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মানে অতীত দিনের প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদে ফিরে যাওয়া নয়, এই সংগ্রাম হল সমাজ বিকাশের ধারায় পুঁজিবাদকে উৎখাত করার লড়াই।

সুত্র- পিপলস ডেমোক্র্যাসি, ৩রা অক্টোবর, ২০২১

দীর্ঘ এগারো মাস ব্যাপি দেশের রাজধানীর উপকণ্ঠে কৃষকরা আটকে ছিলেন – মোদী সরকার তাদের দিল্লীতে ঢুকতে দেয় নি, তারা চেয়েছিলেন দিল্লীর রামলীলা ময়দানে নিজেদের সমাবেশ আয়োজন করতে। সরকার রাস্তা কেটে, ব্যারিকেড বসিয়ে, দেওয়াল তুলে অবরোধ করেছে। এই আন্দোলন সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুললে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা জানিয়েছে দেশের রাজধানী ঘিরে তারা অবরোধ করেনি- করেছিল সরকার নিজেই। আসলে মোদী সরকার কৃষকদের কথা শুনতেই চায় নি, পরে দীর্ঘ আন্দোলনের চাপে তারা নিজেদের সুর নরম করে কোর্টের কাছে হাজির হয়েছে। সারাদেশে ৫০০টিরও বেশি কৃষক সংগঠন একসাথে মিলে তৈরি হয়েছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা, এই জোট গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। জোট গড়তে নেতৃত্বে রয়েছে সারা ভারত কৃষক সভাই। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার লক্ষ্য একটাই – নয়া তিন কৃষি আইন বাতিল না করে তারা পিছু হটবেন না। আমাদের দেশে এমনিতেই সরকারী ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের সুবিধা পেতেন মাত্র ১০ শতাংশ কৃষক, নয়া আইনের ফলে সেই সুযোগটুকুও তারা হারাবেন। সারা দেশে বেশিরভাগ জায়গাতেই কৃষক মান্ডী নেই, স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ ছিল দেশ জুড়ে ২.৫ লক্ষ কৃষকমান্ডী প্রতিষ্ঠার (চাষের জমি থেকে প্রতি ৯ কিলোমিটারের মধ্যে একটি মান্ডী থাকতে হবে, কারন ছোট, মাঝারি কৃষকের পক্ষে বেশি দূরে ফসল নিয়ে গিয়ে বিক্রির সুযোগ নেই)। কমিশনের সুপারিশ ছিল কৃষকের উৎপাদন খরচের ১.৫ গুণ দামই হবে ন্যুনতম সহায়ক মূল্য এবং একইসাথে সরকারকে এককালীন কৃষকদের ঋণ মুকুব ঘোষণা করতে হবে – তবেই দেশের কৃষক এবং কৃষি ব্যবস্থা বাঁচবে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মোদী ক্ষমতায় এলে তারা সেই সুপারিশ মেনে ঋণ মুকুব করবে এবং ন্যুনতম সহায়ক মূল্যে (খরচের দেড়গুণ হিসাবে) ফসল কিনতে মান্ডী ব্যবস্থার সম্প্রসারন করবে। অথচ ভোটে জিতে তারা সেই কথার খেলাপ করল, কোর্টের সামনে সরকার জানিয়ে দিল ঋণ মুকুব করা হবে না, মান্ডী সম্প্রসারনও কিছুই হয় নি। কৃষকদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে মোদী সরকার নয়া তিন কৃষি আইন নিয়ে আসে যাতে দেশের কৃষক নির্ভর কৃষি ব্যবস্থাটাই ধ্বংস হয়ে যায়। গোটা ব্যাবস্থাটাকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতেই এমন আইন করেছিল সরকার। ভারতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে উদার অর্থনীতির জমানা চলছে। এই সময়কালে চার লক্ষ কৃষক ঋণের বোঝায় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন, নতুন আইন এলে কৃষকদের যেটুকু অধিকার রয়েছে তাও চলে যেত। মোদী সরকারের এই কৃষক মারা নীতির কথা বুঝে গেছেন দেশের কৃষকরা। তারা লড়াই শুরু করেছেন শুধু সরকারের আইন বাতিলের নয়। আন্দোলনের মাধ্যমে আইন বাতিলের পাশাপাশি এই আন্দোলন সারা দেশে কর্পোরেট শক্তির বিরুদ্ধেও। তাই আক্রমনের নিশানায় রয়েছে আদানি, আম্বানির ব্যাবসায়ী গোষ্ঠীগুলিও। পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং সংলগ্ন প্রদেশগুলিতে ধনী চাষিদের ঘনত্ব বেশি- নয়া আইনে সবার আগে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন তারাই। সেই কারনেই সেখানকার কৃষকরা এই লড়াইতে সবার আগে রাস্তায় নেমেছেন। আমাদের রাজ্যে ছোট, মাঝারি কৃষক বেশি তাদের উপরে এই আঘাত নামবে ধীরে। পশ্চিমবঙ্গে কৃষকসভার কাজের গুরুত্ব ঠিক সেখানেই। এই রাজ্যে কৃষকদের লড়াই-আন্দোলনকে সংহত করতে হবে আগামির ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদের যথাযথরূপে ওয়াকিফহাল করেই। সারা ভারত কৃষকসভা সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছে।

প্রয়োগের বিষয়টি যতটুকু এগিয়েছে বলে জানা যায়

দেশের কিছু রাজ্যে কৃষিতে এআই প্রয়োগ হচ্ছে। মহারাষ্ট্র সরকার ওয়াদওয়ানি এআই নামক সংস্থাকে দিয়ে তুলা চাষে সহায়ক হবে এমন একটি মোবাইল অ্যাপ নির্মাণ করিয়েছে। এই অ্যাপ ঠিক করবে? তুলা চাষিদের মোবাইল ব্যবহার করাটা একান্তই জরুরী। বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে কেননা বেশিরভাগ জায়গায় উপযুক্ত ইন্টারনেট প্রযুক্তি না থাকায় মোবাইলের সাথে আধার সংযোগ না হওয়ায় একশো দিনের এমএনরেগা প্রকল্পে গরীব মানুষ কাজ করেও মজুরির টাকা পান না। এই অ্যাপ মোবাইলের ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখে (আসলে অ্যানালাইজ বা বিশ্লেষণ করে) বলে দেবে উঠতি ফসলে পোকামাকড়ের আক্রমণ ঘটেছে কিনা, ঘটে থাকলে কোন মাত্রায় এবং তার প্রতিষেধ হিসাবে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী ইত্যাদি। একজায়গার কৃষিতে এমনসব কাজের অভিজ্ঞতা ক্লাউডে সংরক্ষিত রাখা হবে যাতে অন্যান্য জায়গায় কৃষকরা সেই অভিজ্ঞতা জেনে নিতে পারেন। তেলেঙ্গানা সরকারও এমন কাজে কিছুটা এগিয়েছে। তারা একটি এআই সল্যুশন (আসলে কনসোল বেসড ইন্টারফেস) বানিয়েছে যার মাধ্যমে নিজেদের রাজ্যে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। তাদের সরকারী প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে ইতিমধ্যেই প্রায় ৬০০০০টি বিভিন্ন কৃষি জমি থেকে এমন উদ্দেশ্যে তথ্য (ডেটা) সংগ্রহ চলছে। এছাড়াও আরেকধরনের অ্যাপের কথা শোনা যাচ্ছে যা আবহাওয়া (অর্থাৎ রোদ, ঝড়, জল, বৃষ্টি ইত্যাদি) সম্পর্কে আগাম খবর দেবে। কয়েকটি ক্ষেত্রে সাবমার্সিবল পাম্পের জল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতেও নির্দিষ্ট অ্যাপ ব্যবহারের কথা জানা যাচ্ছে।

কি বোঝা গেল?

পাঠক খেয়াল রাখবেন কেন্দ্রের হোক বা রাজ্যের সরকার যারাই কৃষিতে এআই প্রয়োগের বিষয়ে মনযোগী হন না কেন তিনটি প্রবণতা স্পষ্ট।

এক, প্রযুক্তি প্রয়োগের ধরণেই বোঝা যাচ্ছে এখনও অবধি খাদ্যশস্যের বদলে অর্থকরী ফসলের প্রতি কৃষকদের মনে বাড়তি আশা জাগানোর প্রচেষ্টাই প্রধান। উৎপাদন বৃদ্ধির গল্পটা এমনভাবে শোনানো হচ্ছে যাতে যেন তেন প্রকারেণ দ্রুত ফলনই হয়ে দাঁড়ায় কৃষকদের প্রধান উদ্দেশ্য। এতে কার লাভ? একবার যদি আমাদের দেশের কৃষি ব্যবস্থায় খাদ্য স্বনির্ভরতার বিষয়টা ভুলিয়ে দেওয়া যায় এবং গোটা ব্যাপারটাকে অর্থকরী ফসলের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় তাহলেই বিদেশ থেকে যথেচ্ছ খাদ্য সামগ্রী আমদানির দরজাটা খুলে ফেলা যায়। তখন কারা দোকান খুলবে? এখন যারা সপ্তাহের বিশেষ দিনে অবিশ্বাস্য ছাড় দিয়ে মাল বেচার গল্প শোনায় তারাই। তখন কিন্তু তারা যে দামেই বেচুক আমরা কিনতে বাধ্য থাকব।

দুই, প্রযুক্তি ব্যবহারের নামে আসলে দেশের বিভিন্ন অংশে কৃষিজমির চরিত্র, সংশ্লিষ্ট এলাকায় আবহাওয়ার বৈশিষ্ট ও রদবদল সবটাই ক্লাউড অর্থাৎ কেন্দ্রীভূত বেসরকারি মালিকানার দখলে চলে যাবে। সেই তথ্য চড়া দামে বিক্রি হবে, মুনাফা লুটবে ব্যবসায়ীরা।

তিন, এই গোটা প্রক্রিয়ায় কৃষিকাজের কিংবা কৃষকদের চিরায়ত সমস্যাগুলির সমাধান দূরে থাক, ছুঁয়ে দেখারও ইচ্ছা নেই। সেই সমস্যার গোড়ার কথা হয় উৎপাদন কমে যাওয়া, নয়তো অতি উৎপাদন। দুদিকেই কৃষকদেরই বোঝা বইতে হবে। আগাম সতর্কতা জেনে বুঝে যারা হাত ধুয়ে বিনিয়োগ সরিয়ে নিয়ে চলে যাবে তারা কারা? যারা ভারতের কৃষিতে ফরোয়ার্ড কন্ট্র্যাক্ট ইত্যাদির পক্ষে সবচেয়ে বেশি প্রচার করে আসছে। কারন তেমনটা হলে চলতি বন্দোবস্তে তাদের যতটুকু ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হতে হয় সেটুকুও থাকবে না। যে ফড়ে ব্যবস্থার ঘাড়ে চেপে আজকের ভারতে নয়া উদারবাদ দেশীয় কৃষিকে পুঁজিবাদী বন্দোবস্তে রূপান্তরিত করতে চাইছে তারাই ফেউ’র মতো করে বড় বাবুদের দরজায় গোড়ায় বিপদের খবর পৌঁছে দেবে। হাত ধুয়ে পালিয়ে যাওয়াই হোক বা বিনিয়োগ সরিয়ে নেওয়া এসমস্ত কাজ কৃষক করেন না, করে বাবুরাই। এই বন্দোবস্ত তাদেরই জন্য নিবেদিত প্রাণ।

খানিক মজার অথচ জরুরী একটি প্রসঙ্গও ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। ধরুন একটা রোবট যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ভিত্তিতে কাজ করে আমাদের সামনে রাখা হল। ছাত্র ছাত্রীদের বলা হল যা জানার এর থেকেই জেনে নাও, স্কুলে কলেজে গিয়ে আর সময় নস্ট করতে হবে না! এবার ধরুন কোনও একজন শিক্ষার্থী যদি এই রোবটকে জিজ্ঞাসা করে বসে আমাদের দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনৈতিক ব্যাক্তিটি কে? রোবট এমন কোনও নাম বলে বসতে পারে যিনি হয়তো তার একঘন্টা আগে অবধি নিজেকে স্বচ্ছ রাজনীতির অবতার বলে ঘোষণা করেছেন, অনেকেই সেই ঘোষনায় সায়ও দিয়েছে! এবার কি ঘটবে? মানে ঐ শিক্ষার্থী যে প্রশ্নটা করেছিল সে কি করবে?

স্কুলে, কলেজে শিক্ষক শিক্ষিকাকে কোনও প্রশ্ন করা হলে তাদের উত্তরে যদি চিত্তচাঞ্চল্য হয় তবে আরও কিছুদূর এগোনোর উপায় আছেই। আমরা প্রায় সকলেই কোনও না কোনও সময় এমন পরিস্থিতির সামনে পড়েছি। কিন্তু এইবার কি হবে?

সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যকে যদি মান্যতা দিতে হয় তবে এমন ঘটনা ইতিমধ্যেই ঘটেছে!

আসলে এসবের পিছনে আছে একটি অন্ধবিশ্বাস। কেমন জানেন? ইদানিং জ্যোতিষী কিংবা হস্তরেখা বিশারদরা সেই কায়দায় নিজেদের প্রচার করেন। কম্পিউটার মারফত ফলাফল বিচার! অর্থাৎ ভাবটা এমন যে কম্পিউটার কোনও কিছু করছে মানেই সেটা নির্ভুল! বিজ্ঞান কিংবা প্রযুক্তির ন্যূনতম বোঝাপড়া পরিষ্কার রয়েছে এমন যে কেউই বলবেন ব্যাপারটা আদৌ অমন হয় না। যন্ত্রটা সেটাই করে যা তাকে করতে শেখানো হয়েছে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এখনও অবধি হিউম্যান ফিড বিনা দুপায়ে হেঁটে চলছে এমন না। সে কয়েকটি পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত (প্রযুক্তির পরিভাষায় প্রি ডিটারমাইন্ড ডিসিশন) কে ভিত্তি করে নিজের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, অর্থাৎ তাতে ভুল থাকলে নমঃ যন্ত্র জপা ছাড়া আর উপায় নেই!

তবে কি প্রযুক্তি মানেই খারাপ?

এমন হাস্যকর কথা বলে তারাই যারা হয় চায় না কৃষকরা ভালো থাকুক আর নয়তো যাতে সংগ্রামী কৃষক ঐক্য ভেঙ্গে দিতে আপাতত যারা আর অন্য উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। কৃষকরা তাদের লড়াইতে যে সকল দাবী করেছেন তাতে কোথাও এমন কোনও দাবী নেই। আমরা জানি এর আগে একবার কম্পিউটার প্রযুক্তি প্রসঙ্গে ভারতের শ্রমজীবীদের ভুল বোঝানো হয়েছে। আমরা তখনও বলেছিলাম যা প্রয়োজন তা হল প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে ব্যপক অংশের মানুষের প্রকৃত কল্যাণকে সুনিশ্চিতকরণ। এখনও আমরা সেই একই কথা বলছি। একটি কথা বেশিও না, কমও না।

আসলে পুঁজিবাদ কিছুতেই প্রযুক্তিগত উন্নতিসাধনের সাথে ব্যপক জনসাধারণের উন্নতির বিষয়টিকে এক রেখায় নিয়ে আসতে পারে না। এসব আজকের বিষয় না, প্রথম থেকেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার গোড়ার কথা হল উৎপাদনের হার বাড়িয়ে মুনাফা বাড়াও, নাহলে প্রযুক্তিগত উন্নতিসাধনের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমাও। আমাদের দেশে পুঁজিবাদ নিজের জঘন্যতম চেহারায় উপস্থিত হয়েছে, একেই আমরা নয়া-উদারবাদ বলি। একসময় পুঁজিবাদ ব্যপক জনসাধারণের সামনে মজুরির বিনিময়ে মুক্তির বার্তা এনেছিল, সেসব দুশো বছর আগের ব্যাপার। আজকের পুঁজিবাদের আর সেই সামর্থ্য কিংবা সাহস কোনটাই নেই, অথচ বয়স বাড়লে যেমন কারোর কারোর নোলা বেড়ে যায় সেই অবস্থা হয়েছে। তার বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা, প্রতিনিয়ত আরও আরো মুনাফা না লুটলে তার চলে না।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোনও ম্যাজিক না। বিজ্ঞান প্রযুক্তির স্বাভাবিক পরিণতি। বিজ্ঞানের উদ্দেশ্যে একটাই- মানুষের কল্যাণের জন্য প্রকৃতির রহস্যকে জানা। প্রযুক্তি সেই জানাকে কাজে লাগিয়ে মানুশ্বের শ্রমশক্তি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে কাজ করে। এই অবধি কোনও সমস্যা নেই। তবে ঝামেলাটা কোথায়? আজকের পৃথিবীতে উদ্ভাবন, প্রযুক্তির হাতিয়ার ও তার ফলাফল সবটাতেই একচেটিয়া মালিকানা কায়েম রয়েছে। আমরা প্রযুক্তিগত উন্নতিসাধনের এতটুকু বিরোধী নই, কিন্তু অনেকের মেরে নিজের পকেট ভরাতে যারা প্রযুক্তিগত উন্নতিসাধনের গুণগান করে তাদের অমন মুখোশের আড়ালে থাকা রাজনীতিকে দুরমুশ করে দিতে আমরা জানি।

এআই যা করছে, যতটুকু করেছে তা বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির যা মূল ধরণ তার তুলনায় কিছুই আলাদা না।

যারা প্রযুক্তিগত বিষয়ের উপরে দখলদারি কায়েম করে রেখেছে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ তাদেরই স্বার্থে কাজ করে, এআই’ও তাই করছে। আমরা চাই এআই সার্বিক ও আন্তরিকভাবে প্রয়োগ হোক, কিন্তু লক্ষ্যটা থাকুক গরীব মানুষ। যারা গোটা পৃথিবীর মুখে খাবার যোগান তাদের দুবেলা খেয়ে পরে, মানুষের মতো বেঁচে থাকাটা আগে সুনিশ্চিত হোক। সেটা না হলে এআই’তে আর যার হোক কৃষকদের এক পয়সার সুবিধা হবে না।

আবহাওয়ার রিপোর্ট ইত্যাদি প্রসঙ্গে যারা ভ্রু কুঁচকে ভাবছেন তারা জেনে রাখুন ওসব কৃষিকাজে ব্যস্ত মানুষ এমনিই শেখে, ওটুকু কাজের জন্য তাদের মোবাইল লাগে না। ওসব লাগে আসলে তাদেরই যারা কৃষিকাজ ও কৃষক কোনটাই বোঝে না, যেটা বোঝে তার নাম মুনাফা। তারা নিজের মুখে সেকথা স্বীকার না করলেও কৃষকরা ও গপ্পো ঠিকই জানেন,  বোঝেনও।

সুত্রঃ কৃষকসংগ্রাম, জানুয়ারি-মার্চ, ২০২৪ সংখ্যা

সারভারত কৃষক সভা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পত্রিকা

Spread the word