Site icon CPI(M)

১৭৫ বছর পেরিয়ে- পার্থ মুখোপাধ্যায় ..

২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ (মঙ্গলবার)


আজ থেকে ১৭৫ বছর আগের কথা। তারপর গঙ্গা ও ভল্গার ওপর দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। বদলেছে পৃথিবী, আমি বদলেছি আপনি বদলেছেন । ইতিমধ্যে সোভিয়েতের বিপ্লব হয়েছে আবার ভেঙেও গেছে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আলোচিত হচ্ছে কমিউনিস্ট ইস্তেহারের প্রাসঙ্গিকতা। ইস্তেহারের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি সাহিত্য পত্রিকা উল্লসিত হয়ে তাকে ‘ফতোয়া’ নাম দিয়ে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল । কমিউনিজম্ যদি মরেই যাবে তাহলে বারে বারে তারা এ কথা উল্লেখ কেন করে ? আসলে ইস্তেহারের সেই গোড়ার কথা। ইউরোপ ভূত দেখেছে কমিউনিজমের ভূত। বারে বারে ক্রোড়পত্র প্রকাশের মধ্যে দিয়ে ইস্তেহার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কমিউনিস্ট ইস্তেহার প্রসঙ্গে ১৯১৪ সালে কমরেড লেনিন বলেছিলেন, ” কমিউনিস্ট ইস্তেহার রচনায় প্রতিবাদীপ্ত স্বচ্ছতা ও ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে রূপ পেয়েছে এক নতুন বিশ্বদর্শন। সমাজ জীবনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এক সুসংহত বস্তুবাদ ।বিকাশের সবচেয়ে সুসংবদ্ধ ও গভীর তত্ত্ব দ্বন্দ্ববাদ রূপ পেয়েছে শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব এবং সর্বহারা শ্রেণীর বিশ্ব ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক ভূমিকার তত্ত্ব যে সর্বহারা শ্রেণী কিনা এক নতুন কমিউনিস্টদের সমাজের স্রষ্টা” ।উপরের কথাগুলিকে বিশ্লেষণ করে যদি এক কথায় প্রকাশ করি সে ক্ষেত্রে কমরেড স্তালিনের ভাষাকে ধার করে বলা যায়, সমস্ত সংগীতের মহা সংগীত হল এই কমিউনিস্ট ইস্তেহার অর্থাৎ সারেগামা না শিখে যেমন আপনি গান গাইতে পারবেন না ঠিক তেমনি ইস্তেহার ব্যতিরেকে সমাজকেও চিনতে পারবেন না। জার্মান ভাষায় প্রথম লেখা হয়েছিল কমিউনিস্ট ইস্তেহার । পৃষ্ঠা ছিল ২৩ ।এরপরে মোট সাতটি মুখবন্ধ যেগুলি ইস্তেহারের এক মহামূল্যবান সংযোজন। পৃথিবীতে প্রায় সব ভাষাতেই দুটি বই অনুবাদিত হয়েছে। এক বাইবেল দুই কমিউনিস্ট ইস্তেহার।

পুঁজিবাদ বিরোধী বিপ্লবের কর্মসূচি হলেও ইস্তেহার। একচেটিয়া পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদের পর্যায়ে আবির্ভূত হওয়ার পূর্বেই ১৮৪৮ সালে ইস্তেহার বিস্ময়কর ভাবে ধনতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিকাশ ও বিশ্বায়নের প্রবণতা সম্পর্কে অবহিত করেছেন । অনিয়ন্ত্রিত বাজারের শক্তি এবং বহুজাতিক কর্পোরেটের বিশ্বব্যাপী ভূমিকায় মার্কসের বক্তব্য , “উৎপাদিকা শক্তির ব্যাপক ও বিশাল চেহারা” কে প্রতিষ্ঠিত করেছে কিন্তু এর ফলশ্রুতিতে মানব সভ্যতার খাদ্যাভ্যাস অপুষ্টি অসাস্থ্য প্রভৃতি ব্যাধিগুলিকে নিরসন করতে পারেনি। ইস্তেহার গণতন্ত্র প্রসঙ্গে বলেছে “গণতন্ত্রের লড়াইয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের প্রথম ধাপ হল সর্বহারা শ্রেণীকে শাসক শ্রেণীতে স্থাপন করা” ।গণতন্ত্রের এই সংগ্রামে জয়যুক্ত হতে হলে গোষ্ঠীগত অধিকার ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অধিকারের নিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে এরকম একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিকশিত হওয়া দরকার । এই প্রসঙ্গেই বুর্জোয়া জমিদার রাষ্ট্র কাঠামোয় এই পরিপ্রেক্ষিতে স্বশাসন অথবা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে প্রশ্ন গুলি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ইস্তেহারে আলোচিত প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধ শক্তিকে প্রতিটি সমাজের নির্দিষ্ট পরিস্থিতি অনুযায়ী সৃজনশীল ভাবে মার্কসবাদ এর প্রয়োগ ঘটাতে হবে। যার মধ্যে দিয়ে ইস্তেহারের কাঙ্ক্ষিত মানব মুক্তির লক্ষ্য পূর্ণ হবে।

মার্কসবাদীরা গণতন্ত্রের সংগ্রামের সাথে জনগণতন্ত্রের অথবা সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের জীবন্ত সম্পর্ক বুঝতে সক্ষম। কারো কারো মার্কসবাদ বোঝাটা যদি পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে সীমায়িত থাকে তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলে তর্জন-গর্জন করলেও অন্ধকারে কালো বেড়াল খোঁজার মতো দিশেহারা হয়ে পড়েন। কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহারের মূল নীতিগুলি ব্যবহারিক প্রয়োগ নির্ভর করে তার ঐতিহাসিক অবস্থার ওপরে। মূল বিষয়গুলি মৌলিক ।কিন্তু প্রয়োগের দিকটি দেশ কাল পাত্রের ভিত্তিতে আলাদা হওয়াই স্বাভাবিক। চীন বা ভিয়েতনামের প্রয়োগের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু মূল লক্ষ্য শ্রমিক শ্রেণীর আধিপত্যের সুরক্ষা দেওয়া। ভারতবর্ষের পথ‌ও তার নির্দিষ্ট স্বাভাবিক অবস্থানকে ঘিরেই গড়ে উঠবে। রাশিয়ার সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনে রুশ জাতির আধিপত্য থাকায় কমরেড লেলিন ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’ টিকে সংযুক্ত করে অন্য জাতি গুলির অধিকার কে সুনিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু ভারতবর্ষে কোন বিশেষ জাতির শোষণ না থাকার পরিপ্রেক্ষিতে একটি নির্দিষ্ট অংশের মধ্যে একই ধরনের মানুষের অবস্থান যদি থাকে (নেপালি আদিবাসী)সেক্ষেত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণ অপেক্ষা স্বায়ত্তশাসনের কথাই বিবেচিত হয়েছে।
কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো তার কর্মসূচি প্রণয়নের পাশাপাশি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছে, “এই ব্যবস্থাগুলি অবশ্যই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের হবে”। শ্রেণী সংগ্রামের বিকাশের পরিস্থিতি থেকেই যুক্তিসঙ্গত কারণগুলিকে খুঁজেই কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করে। এই ধরনের পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে এঙ্গেলস্ বলেছিলেন, “কোন অনড় মতবাদ নয়, এটা একটা আন্দোলন; যার উদ্ভব হয় কতগুলি নীতি থেকে নয়, ঘটনাবলী থেকে।” মার্কস্ ও এঙ্গেলসের সামাজিক বিশ্লেষণও বিশ্বব্যাপী সঠিক বলেই ধরা পড়েছে। এ কথা আজ সত্য জাতি ঘৃণা বা অপরধর্মের প্রতি ঘৃণা এটি কোন জার্মান দেশের বৈশিষ্ট্য নয়। এই ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়াশীলরা আজও সক্রিয়। আজকের ভারতবর্ষকে উল্লেখ করে বলা যেতে পারে জাতি ঘৃণা, ধর্মের প্রতি ঘৃণাগুলিকে সঙ্গে নিয়ে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধ শক্তি গুলি ভারতবর্ষে এক নতুন ধরনের ফ্যাসিবাদের জন্ম দিচ্ছে। এর পিছনে বুর্জোয়া শ্রেণী আছে, আর আছে কিছু বিকৃত বুদ্ধিজীবিরও সমর্থন। ইস্তেহার রচনার ১৭৫ বছর পরেও জ্বলজ্বল করছে কথাগুলি।

কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহার আমাদের কাছে ভবিষ্যতের দিক নির্দেশ করেছে। তার মূল নীতিগুলিকে একটি দেশ ও কালের প্রয়োগ করার মধ্যে দিয়ে লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। আসলে প্রয়োগের মধ্যেই কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর আসল প্রকাশ।

Spread the word