সংগ্রাম চ্যাটার্জী
“জীবনকে ভালোবেসে তারই সৌন্দর্য সন্ধানে নেমেছিলাম সংগ্রামে। তোমাদের ভালবেসেছিলাম হে জনগণ। যখন সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছ, খুশি হয়েছি। যখন আমাকে ভুল বুঝেছ, দুঃখও পেয়েছি।……”
পড়েছেন নিশ্চয়ই। নানা ভাষায় অসংখ্য অনুবাদ আছে, বাংলা অনুবাদে নামটা ‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে’। লেখক একাধারে একজন সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মী। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে অবিভক্ত চেকস্লোভাকিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। এবং সর্বোপরি ফ্যাসিবিরোধী লড়াই এর সামনের সারিতে থাকা এক সৈনিক। জুলিয়াস ফুচিক্।
আজ থেকে ১২২ বছর আগে আজকেরই দিন অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারীতে (১৯০৩ সাল) জুলিয়াস ফুচিকের জন্ম তত্কালীন চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগের স্মিচভে (প্রাহা স্ মিচভ)। ছাত্রজীবনেই একদিকে যেমন বিবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন, তেমনই লেখক হিসেবেও সুখ্যাতি অর্জন করেন। খুব অল্প বয়সেই পত্রিকা প্রকাশনার দক্ষতা অর্জন করেন। ছাত্রজীবনেই কাছাকাছি আসেন শ্রমজীবী মানুষের, যুক্ত হন চেক্ কমিউনিস্ট পার্টির সাথে। সামান্য কিছুদিনের মধ্যেই কমিউনিস্ট ছাত্র সংঘের অন্যতম শীর্ষ নেতৃত্বে আসীন হন, এবং চেক কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘রুদে প্রাভো’র এডিটর হিসাবে নিযুক্ত হন।
পরপর কয়েকবার সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে সেখানকার অভিজ্ঞতা লেখার সাথে সাথেই বিষনজরে পড়ে যান নাজি পার্টির নেতাদের, এবং কার্যত ১৯৪০ থেকেই ফুচিকের সন্ধানে লেগে পড়ে গেস্টাপো। (প্রসঙ্গত: সরকারিভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চেকস্লোভাকিয়া দখল করে হিটলার।)
১৯৪১’র ফেব্রুয়ারিতে নাজি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে গেল চেক কমিউনিস্ট পার্টির সিংহভাগ নেতৃত্ব, ফুচিক চলে গেলেন আত্মগোপনে। এরই মধ্যে হিটলার আক্রমণ করল সোভিয়েত ইউনিয়নকে (২২ জুন, ১৯৪১), এক লহমায় বদলে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চরিত্র! রাতারাতি প্রকাশিত হল চেক কমিউনিস্ট পার্টির মূল্যায়ন, আত্মগোপনে থাকা অসুস্থ ফুচিকের মুসাবিদা করা এক ঐতিহাসিক লিফলেট।
২৪ এপ্রিল, ১৯৪২:
“প্রথম আঘাত পড়ল মুখে। একজন লোককে ফেলে দেবার জন্য যথেষ্ট।
হাত তোল।
আবার ঘুষি,আবার।
আরও ঘুষি আর লাথি।
ওরা আমাকে টেনে হিঁচড়ে এনে তুলল একখানা গাড়িতে।….”
কয়েকদফা আত্মগোপন পর্ব পেরিয়ে অবশেষে ১৯৪২’র ২৪ এপ্রিল ধরা পড়েন ফুচিক্। জেলে সুতীব্র অত্যাচার সহ্য করেও বেঁচে থাকেন। শেষমেশ ফাঁসি হয় ১৯৪৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। জার্মান সাম্রাজ্যের পক্ষে চরম বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে চরম শাস্তির জন্য দিন গুনতে গুনতে গোপনে লিখে ফেলেন এক রোজনামচা!
কী ভাবে লিখলেন ঐ অত প্রহরার মধ্যেও?
উত্তর আছে ফুচিকের নিজের লেখাতেই—
“চেক পুলিশের উর্দি পরা লোকটি আমাকে কাগজ আর পেন্সিল এনে দিয়েছে। আমার লেখার সময় কেউ যেন এসে না পড়ে তার জন্যে পাহারাও দিচ্ছে। আর একজন চেক প্রহরী আমাকে লিখতে উৎসাহ জুগিয়েছে। লেখা হয়ে গেলে কাগজগুলো সে লুকিয়ে রাখে। যখন সময় আসবে তখন ছাপানো হবে… “
সময় এসেছিল। তবে অনেক পরে।
আরও লক্ষ লক্ষ মানুষের মত নাজিবাহিনির কয়েদখানায় আটক ছিলেন ফুচিকের স্ত্রী অগাস্তিনাও। ১৯৪৫’র মে মাসে হিটলারের পতনের পর মুক্তি পান অগাস্তিনা। যে চেক রক্ষী গোপনে ফুচিককে কাগজ পেন্সিল এনে দিতেন, সেই কেলিনস্কীর কাছ থেকে ফুচিকের লেখাগুলো জোগাড় করেন তিনিই।
এই লেখা ফুচিকের মৃত্যুর বহু বছর পর প্রকাশিত হয় বই আকারে। পরে ইংরেজি অনুবাদে ‘Notes from the Gallows’। বাংলা অনুবাদে ‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে’, NBA থেকে প্রকাশিত, পড়ে দেখতেই পারেন।
“আমার নামের সঙ্গে যেন বিষন্নতা না জড়িয়ে থাকে। তোমাদের কাছে এই আমার শেষ অনুরোধ।”
পড়লে দেখবেন কী অদ্ভুত এক মায়া জড়ানো আছে ঐ দিনলিপির লাইনে লাইনে, পাতায় পাতায়।
সামনে নিশ্চিৎ মৃত্যু, এদিকে ফুচিক্ লিখছেন জীবনকে ভালোবাসার কথা— যে লাইনগুলো একদম শুরুতে লিখেছি ওগুলোই আরেকবার পড়ে দেখেন: “জীবনকে ভালোবেসে তারই সৌন্দর্য সন্ধানে নেমেছিলাম সংগ্রামে। তোমাদের ভালবেসেছিলাম হে জনগণ। যখন সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছ, খুশি হয়েছি। যখন আমাকে ভুল বুঝেছ, দুঃখও পেয়েছি।……”
এক অদ্ভুত প্রত্যয় নিয়ে লিখে চলেছেন ফ্যাসিবাদের অবশ্যম্ভাবী শেষের কথা। ভয়কে অবলীলাক্রমে পাশে সরিয়ে রেখে, নিশ্চিৎ মৃত্যুকে সামনে বসিয়ে, তার চোখে চোখ রেখে লিখছেন আগামীর স্বপ্নের কথা। এই অংশটা একবার পড়েই দেখুন—
যুদ্ধ আর আশার মধ্যে এ’এক দৌড় চলছে বটে! একরকম মৃত্যুর সাথে আরেকরকম মৃত্যুর প্রতিযোগিতা। কে আগে? — ফ্যাসিজমের মৃত্যু? না আমার? আর এ’কি শুধু আমারই ব্যক্তিগত প্রশ্ন?
না না। হাজার হাজার বন্দী, লাখো লাখো সৈনিক এই একই প্রশ্ন করছে। সারা ইউরোপের লাখো লাখো জনতার মুখে, সারা পৃথিবীর মুখে এই একই জিজ্ঞাসা। কারও আশা কম, কারও বা বেশী। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, এ’তো অবশ্যম্ভাবী। ধনতন্ত্রের ক্ষয়িষ্ণুতা আজ পৃথিবীকে বিভীষিকায় আচ্ছন্ন করেছে। হাজার হাজার মানুষ মরবে! তারপর যারা বেঁচে থাকবে তারা বলবে— ফ্যাসিজমের অধ্যায় আমি পার হয়ে এলাম!
১৯৪৫ সালের ৮ (বা ৯) মে, জার্মান পার্লামেন্ট রাইখস্টাগের মাথায় উড়ল লাল পতাকা।ফ্যাসিবাদের এক অধ্যায় পার হল বিশ্ব মানবতা।
গোটা ইউরোপের ইতিহাস তার ভুগোলের মত পাল্টে গেল। ইউরোপের পূর্ব দিকের একের পর এক দেশ তখন লালে লাল!
ওদিকে এরই ধাক্কায় এশিয়া অ্যাফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে শক্তি পেল জনগণের মুক্তি আন্দোলনের গতিবেগ, একটার পর একটা দেশে স্বাধীনতার পতাকা উড়ল।
ফ্যাসিবাদের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় পার হল বিশ্ব মানবতা কয়েক কোটি মানুষের জীবনের বিনিময়ে, যাঁদের অসামান্য অবদান ছাড়া এই হার্ডল পার করা অসম্ভবই ছিল বলা যায়। জুলিয়াস ফুচিক তাঁদেরই একজন।
আজকের এই সময়ে নবরূপে সামনে আসা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যাঁদের কথা বারেবারে মনে করতে আর করাতে হয়, জুলিয়াস ফুচিক তাঁদেরই একজন, যিনি বলতে পারেন “জীবনের চলচ্চিত্র শেষ হবার আগেই যদি জল্লাদের ফাঁস আমার শ্বাস রোধ করে দেয়, তবে লাখো লাখো মানুষ রইল যারা লিখবে তার ‘মধুর উপসংহার’।”