Abhas Roy Chowdhury
অনেক বছর আগে ‘পদাতিক’ কবি লিখেছিলেন, ‘ প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা….।’ সর্বাধিক কম মজুরিতে শ্রমিকের শ্রম আত্মসাৎ করে মালিকের মুনাফা বাড়ে, পুঁজি ফুলেফেঁপে ওঠে। পুঁজিবাদে শ্রমজীবী মানুষ তার জীবন দিয়ে পুঁজির স্ফিতি ঘটিয়ে চলতে বাধ্য হয়। আবার শ্রমজীবী মানুষের অস্তিত্ব, শ্রম দেবার ক্ষমতা, সুযোগ এসবই পুঁজিবাদের টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য। তাই সস্তায় শ্রম ক্ষমতাকে শুষে নেওয়ার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, পুঁজিবাদ ততটুকুই শ্রমিকদের দেয়, দিতে চায়। তাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক শেষ পর্যন্ত মানুষের মতো বেঁচে থাকে না, টিকে থাকে মাত্র। ‘রক্তকরবী’র যক্ষপুরে তিন হাজার বছর টিকে থাকা ব্যাঙটির মতো। এই ব্যবস্থা কখনোই শ্রমজীবী মানুষদের ফুল খেলবার ব্যাবস্থা নয়, প্রতিদিন প্রতিক্ষণে এখানে শ্রমজীবীরা ধ্বংসের মুখোমুখি। পদাতিক কবি ‘মে দিনের কবিতা’য় এই কথাগুলি যখন বলেছিলেন তখনও পৃথিবীতে নয়া উদারবাদের নামে উৎপাদন ক্ষেত্র ধ্বংস করে শুধুমাত্র বেপরোয়া লুটপাট চালিয়ে মুনাফা সর্বোচ্চকরণের পথ পুঁজিবাদ গ্রহণ করেনি। বিগত সাড়ে তিন দশকে বিশ্বব্যাপী নয়া উদারবাদ শ্রমিক শ্রেণির অস্তিত্বকেই ধ্বংস করে দিয়েছে প্রায়।
আট ঘন্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম, আট ঘন্টা আমোদ-প্রমোদ’র দাবিতে ১৮৮৬ র আমেরিকার হে মার্কেটে শ্রমিকদের ঐতিহাসিক লড়াই ও শহীদি বরণ থেকে মে দিবসের ইতিহাস। অবশ্য তার আগেই পৃথিবী ১৮৪৮ এ কমিউনিস্ট ইস্তেহারের আহ্বান শুনেছে, ১৮৭১’র প্যারিস কমিউন গঠন ও ধ্বংস হতে দেখেছে। তখনও পুঁজিবাদ বিকাশের পর্বেই ছিল। অবশ্য এর মধ্যে সংকটও শুরু হয়েছে। সবই তখন ঘটছে উৎপাদনমুখী পুঁজিবাদের মধ্যে। ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণি তখন রাজনৈতিক ভাবে অনেক বেশি সংগঠিত। মেশিন ভাঙ্গার আন্দোলনের পথ থেকে সরে এসে সংগঠিত ধর্মঘট ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেতনায় উন্নীত হতে শুরু করেছে। ইউরোপের শ্রমিক আন্দোলনের এই ঢেউ পৌঁছেছিল আমেরিকায়, এমনকি আমাদের দেশেও। তারপর পৃথিবী পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ বিকাশ সাম্রাজ্যবাদের পৌঁছেছে। পুঁজিবাদের সংকট পৃথিবীকে বিশ শতকের তিরিশের দশকে মহামন্দা এবং দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে পৃথিবী সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার উত্থান ও শক্তিশালী রূপ দেখেছে। যুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধের দিনগুলিতে শান্তি আন্দোলনে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া ও জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির উজ্জ্বল ভূমিকাও পৃথিবীর মানুষ দেখেছে। এই পর্বে পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণির শক্তি বেড়েছিল। আবার বিশ শতকের শেষ দশকে পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের পর বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণি রক্ষন সামলাতে ব্যস্ত। তবে আজ নয়া উদারবাদের বর্তমান মন্দা ও সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আবার নতুন করে শ্রমিক শ্রেণি ও খেটেখাওয়া মানুষদের লড়াই শক্তিশালী হচ্ছে।
আজকের পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে উৎপাদনের ধরণের মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গেছে এবং ঘটে চলেছে। পুঁজিবাদী বিকাশের সূচনা পর্বের খোলাবাজার কেন্দ্রিক উদারনীতিতে উৎপাদনের ক্ষেত্রটাই ছিল প্রধান। পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমিক শোষণের মাধ্যমে মুনাফা সর্বোচ্চকরণের চমৎকার বর্ণনা রয়েছে কমিউনিস্ট ইশতেহারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদে পুঁজিপতি শ্রেণি, মুনাফা, রাষ্ট্র ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছিল পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। অবশ্যই তা ছিল পুঁজিবাদের স্বার্থে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বড় বড় ম্যানুফ্যাকচারিং কর্পোরেশনগুলির দাপাদাপি ছিল। স্বাধীনতার পর আমাদের দেশেও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পুঁজিবাদকে গড়ে তোলার এই পথ নেওয়া হয়েছিল। আজকের নয়া উদারবাদ সারা পৃথিবীর মতোই আমাদের দেশেও উৎপাদনের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে মুনাফা সর্বোচ্চকরণের পথ বেছে নিয়েছে। নয়া উদারবাদের চলতি তিন দশকে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্র এবং সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণির অস্তিত্ব ক্রমশ সংকুচিত করা হচ্ছে, বিপন্ন হচ্ছে। ফিনান্স এখন আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির নিয়ন্ত্রক। পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান পরিষেবা ক্ষেত্র বা সার্ভিস সেক্টরের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি নয়া উদারবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বলা বাহুল্য পরিষেবা ক্ষেত্রগুলি ক্রম পরিবর্তনশীল উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর। আমাদের দেশেও নয়া উদারবাদের এই তিন দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্র বিপদাপন্ন। বড় বড় উৎপাদনের ক্ষেত্র ক্রমশ প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছে। ফলে উৎপাদনমুখী পুঁজিবাদের কল-কারখানার মতো আজকে আর শ্রমিক শ্রেণি, শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে না বরং ক্রমবর্ধমান হারে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণির অস্তিত্ব বিপদাপন্ন। বেসরকারি উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিংবা বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস সেক্টরের বিভিন্ন ধরনের কর্মরত মানুষদের সংখ্যা বাড়ছে। সারা পৃথিবী এবং আমাদের দেশেও অতি দ্রুত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রয়োগ শুরু হয়েছে এবং আগামী দিনে তা আরও সর্বগ্রাসী হবে। অর্থাৎ শ্রমজীবী মানুষের অস্তিত্ব আরও সংকটের মধ্যে পড়বে। উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর পরিষেবা ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষদের সংখ্যা গোটা পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশেও একটা স্তরে আটকে যাচ্ছে। এবং তা আরও আটকে যাবে। কোভিড উত্তর পৃথিবীতে এই ক্ষেত্রে কর্মরতদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ কমে গেছে।
বিপুল পরিমাণ অসংগঠিত ক্ষেত্রে অস্তিত্ব রয়েছে গোটা পৃথিবী এবং আমাদের দেশে। আমাদের দেশের শ্রমশক্তির ৯৬ শতাংশ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে। এখনও পর্যন্ত এদের বেশি ভাগ কায়িক শ্রম নির্ভর। যাদের কাজের ঘন্টা, স্থায়িত্ব, সামাজিক সুরক্ষার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এরই সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তি নির্ভর পরিষেবা ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ অসংগঠিত শ্রমিকের জন্ম হচ্ছে। আজকের অর্থনীতি যাদের নাম দিয়েছে ‘গিগ ওয়ার্কার’। সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে একটা বড় অংশের শ্রমিক পরিযায়ী শ্রমিক। যারা মূলত কৃষিতে কাজ না পেয়ে শহর ও শিল্পাঞ্চলে কাজের সন্ধানে গেছে অথবা কাজ করছে। শিল্পক্ষেত্রে মন্দার ফলে এই পরিযায়ীদের এক বড় অংশ কৃষি ক্ষেত্রেই ফিরে এসেছে এবং আসছে। ফলে কৃষিতে চাপ বাড়ছে এবং কৃষি শ্রমিকের প্রকৃত মজুরির ব্যাপক অবনমন ঘটছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষত দক্ষিণপন্থী দলগুলি দ্বারা পরিচালিত রাজ্যগুলিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা আরও বিপর্যয় কর। কোভিডের সময় গোটা দেশ দেখেছে পরিযায়ী শ্রমিকদের অমানবিক অবর্ণনীয় দুর্দশা। পশ্চিমবাংলায় গ্রাম শহরে কাজের অভাবে কয়েক লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ ভিন্ন রাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। নয়া উদারবাদী অর্থনীতিতে জনগণকে সরকারি পরিষেবা দেবার কাজ স্থায়ী কর্মচারীর পরিবর্তে কম মজুরির প্রকল্প কর্মীদের দিয়ে করানো হচ্ছে। সারা দেশ জুড়ে বিপুল গতিতে বেড়ে চলেছে প্রকল্প কর্মী। এই প্রকল্প কর্মীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই হলেন মহিলা। রাষ্ট্র বা সরকারের দ্বারা শ্রমিক কিংবা কর্মচারী হিসেবে তাঁদের স্বীকৃতি এখনও অধরা। এই শ্রমজীবীদের ন্যূনতম মজুরি, পেনশন, গ্রাচুইটি ইত্যাদি যাবতীয় সামাজিক সুরক্ষা সহ অন্যান্য প্রাপ্যগুলি অবহেলিত।
ভারতবর্ষের সংগঠিত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের শ্রমিক শ্রেণি এখনও লড়াই করে তাদের অধিকারগুলি ধরে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত বড় কিংবা ছোট-মাঝারি যতটুকু উৎপাদনের ক্ষেত্র চলছে, সেখানে শ্রমজীবী মানুষদের কাছে মে দিবসের দাবির বার্তা এখনও স্বপ্নের মতো শোনায়। দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের স্বার্থে দেশ ও অর্থনীতি চালাতে গিয়ে একদিকে অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের পথে ঠেলে দিয়েছে, অন্যদিকে শ্রমজীবী মানুষের সমস্ত অধিকারগুলিকে কেড়ে নেবার জন্য নয়া চারটি শ্রমকোড গ্রহণ করেছে আরএসএস/বিজেপি’র বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। বলাবাহুল্য নামে শ্রমকোড হলেও আসলে এটি হলো পুঁজির কোড। প্রাক স্বাধীনতা যুগ থেকে সংগ্রামের পথে এদেশের শ্রমিক শ্রেণি ও শ্রমজীবী মানুষ যে অধিকারগুলি অর্জন করেছিল সেগুলিকে সবই পুঁজিপতি ও পুঁজির স্বার্থে বলি দেবার জন্য এই নয়া শ্রমকোড। বিগত দশ বছরের আরএসএস/বিজেপি সরকার ভারতের শ্রমিক শ্রেণি ও সমস্ত খেটেখাওয়া মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই সরকার খেটেখাওয়া মানুষের অর্থনৈতিক জীবনকে শুধু বিপর্যস্ত করেছে তাই নয়, খেটেখাওয়া মানুষ যাতে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে তার জন্য জাত ধর্মের নামে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতিতে বিদ্বেষ বিভাজনের পরিমণ্ডল গড়ে তুলেছে। প্রতিক্রিয়াশীল মনুবাদের ভিত্তিতে চলা রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ সংখ্যালঘু, দলিত, আদিবাসী এবং সব অংশের মহিলাদের উপর আগ্রাসন চালাচ্ছে। এই সরকারের সময়ে বৈজ্ঞানিক, যুক্তিবাদী, প্রগতিশীল শিক্ষা সংস্কৃতির পরিমণ্ডল আরএসএস’র দ্বারা আক্রান্ত। আসলে শ্রমজীবী মানুষের ওপর আক্রমণ এবং বৈজ্ঞানিক, যুক্তিবাদী, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পরিমণ্ডলের উপর সংগঠিত আক্রমণ এক সূত্রে বাঁধা। তা হলো কর্পোরেট হিন্দুত্বের ভিতকে মজবুত করা।
পশ্চিমবঙ্গেও তৃণমূল কংগ্রেস দল ও সরকার একই পথের পথিক। এখানেও শ্রমজীবী মানুষের অস্তিত্বের উপর তীব্র আক্রমণ চলছে। বিগত ১৩ বছরে এ রাজ্যে কার্যত নতুন কোনো শিল্প গড়ে ওঠেনি। বরং যে সম্ভাবনা গড়ে উঠেছিল তা ধ্বংস হয়ে গেছে। এখানেও শ্রমিক শ্রেণির অস্তিত্ব বিপদাপন্ন। ভুল নীতি ও ব্যাপক তোলাবাজিতে বামফ্রন্ট সরকারের সময় গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প এখন কার্যত ধ্বংসের মুখে। এখনও যা টিকে আছে, সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষাগুলি আক্রান্ত। এক বড় অংশের শ্রমিক কার্যত মধ্যযুগীয় দাসত্বের মধ্যে টিকে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। রাজ্য সরকারের অবস্থান স্পষ্টভাবেই মালিকদের স্বার্থে, কর্পোরেটের স্বার্থে। আরএসএস/বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের মতোই পশ্চিমবঙ্গেও শ্রমিক কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারের উপর আক্রমণ সংগঠিত করা হচ্ছে। রাজ্যের সরকার পরিবর্তনের পর ২০১৪ এবং ২০১৭ সালে কৃষি বিপণন ব্যবস্থাকে কর্পোরেটের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। সাম্প্রতিক অতীতে জমির ঊর্ধ্বসীমা বাতিল করে দিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের ভূমি সংস্কারকে ধ্বংস করে রাজ্যের জমি, জঙ্গল ও গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষের অধিকার লুট করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতি ও সরকারি পদক্ষেপ আসলে কর্পোরেট হিন্দুত্বের ভিতকেই শক্তিশালী ও প্রসারিত করে রাজ্যের শ্রমিক কৃষক খেতমজুর সহ খেটেখাওয়া মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা।
নজিরবিহীন লুট আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির কেন্দ্রীভবন প্রক্রিয়াকে পুঁজির আদিম সঞ্চয়নের পর্যায়ে পুনরায় পৌঁছে দিয়েছে। উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও মুনাফা লাভের জন্য এই প্রক্রিয়া, প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে ক্রুর ও অমানবিক হয়ে উঠছে। সীমাহীন শোষণ অব্যাহত রয়েছে। শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রকে কে কখনও পরিষেবা ক্ষেত্রের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা যায় না। উভয় ক্ষেত্রকে পাশাপাশি চলতে হয়। মানুষের সমাজে পরিষেবা ক্ষেত্র কখনও চূড়ান্ত চাহিদা হতে পারে না। কাজ ও ক্রয়ক্ষমতা না থাকায় বাজার ক্রমবর্ধমানভাবে সংকুচিত হয়ে পড়ছে। চলতি তিন দশকের নয়া উদারবাদের এটাই সবথেকে বড় স্ববিরোধিতা এবং ধ্বংস হয়ে যাওয়ার প্রধান উপাদান। বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ২০০৮ থেকে শুরু হওয়া মন্দার কথা আজ সর্বজনবিদিত। অর্থনীতিবিদেরা অনেকেই দৃঢ়তার সঙ্গে বলছএঁর, নয়া উদারবাদী পথে এই মন্দা ও সংকট নিরসনের কোনো সম্ভাবনা নেই। তথ্য-পরিসংখ্যানে দেখা যায় মার্কিন দেশে এই সংকটের পরিপ্রেক্ষিত আরও অনেক পুরনো। ২০০০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত সময়কাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রের জন্য ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন ছিল। ১৯৬৫ থেকে সে দেশে শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রে মোটামুটি ১৭ মিলিয়ন শ্রমিকের কাজের নিশ্চয়তা ছিল। একুশ শতকের প্রথম দশকে তা কমে দাঁড়ায় ৫.৮ থেকে ১২ মিলিয়নের নিচে (১ মিলিয়ন = ১০ লক্ষ)। ২০০৮ থেকে শুরু হওয়া বিশ্ব পুঁজিবাদের মন্দা আমাদের দেশকে তেমনভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি। তার প্রধান কারণ ছিল ইউপিএ-১ সরকারে বামপন্থীদের সমর্থনের শর্ত হিসেবে তখনও পর্যন্ত টিকে থাকা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির কোর সেক্টর ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলি। ২০১৪ থেকে চলতি দশ বছরে আরএসএস/বিজেপির সরকার দেশি-বিদেশি কর্পোরেটের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ভিত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলির অন্তর্জলী যাত্রা প্রায় সম্পূর্ণ করেছে। এই কাজে তার সর্বশেষ হাতিয়ার হলো ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন। আজ বিশ্ব পুঁজিবাদের সংকট ও মন্দার প্রত্যক্ষ প্রভাব ভারতীয় অর্থনীতি ও কাজের বাজারে পড়েছে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ বেকারত্বের দেশ এখন ভারত। অর্থনীতির পণ্ডিতরা বলছেন নয়া উদারবাদের আজকের সংকট পুঁজিবাদের কোনো সাধারণ সংকট নয়। এটা হলো সিস্টেমিক ক্রাইসিস। খেটেখাওয়া মানুষের ভবিষ্যৎ পুড়ছে, কিন্তু লুটেখাওয়া কর্পোরেটদের রমরমা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে।
পুঁজিবাদের নয়া উদারবাদী পর্ব হলো, শ্রমিক শ্রেণির অস্তিত্ব বাতিল করেই মুনাফার পথ খোঁজা ও তাকে নিশ্চিত করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্র পরিচালিত পুঁজিবাদে শ্রমিক আন্দোলনের তীব্রতা এবং শ্রমিক শ্রেণির দর কষাকষির শক্তি সর্বোচ্চ হয়েছিল। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক লগ্নীপুঁজি বুঝেছে শ্রমিক শ্রেণির অস্তিত্ব থাকলে তার দর কষাকষির শক্তিও থাকবে। এই কাজে নেতৃত্ব দেয় ট্রেড ইউনিয়ন। তাই আজ শ্রমিক শ্রেণির অস্তিত্ব বিপন্ন করা এবং ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার কেড়ে নেওয়া ছাড়া পুঁজির সামনে অন্য কোনও রাস্তা খোলা নেই। এই কারণেই পৃথিবীর দেশে দেশে এবং আমাদের দেশ ও রাজ্যে অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে প্রমোট করা হয়েছে।
হে মার্কেটের ঘটনা সারা পৃথিবীতে শ্রমজীবী মানুষের ট্রেড ইউনিয়ন সচেতনতা গড়ে তুলেছিল। মে দিবসের আহ্বান শ্রমিক শ্রেণির কাছে সব সময়ই চিরজাগরুক থাকবেই। নয়া উদারবাদে শ্রমিকের অস্তিত্বকে বিপন্ন করার যে রাস্তা ও গতি তৈরি হয়েছিল, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার করে পুঁজি এখনও যতটুকু শ্রমিকের অস্তিত্ব রয়েছে তাকেও স্থাপিত করবে প্রযুক্তি দিয়ে। এতে তার সাময়িক মুনাফার পরিমান ও হার বৃদ্ধি পাবে, অথচ শ্রমিক আন্দোলনের সামনে পড়তে হবে না। কিন্তু বিপুল ছাঁটাই ও ক্রমবর্ধমান কর্মহীন মানুষের সংখ্যা সরাসরি বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলবে পুঁজিবাদের প্রাণভোমরা বাজারে। বাজার আরও সংকুচিত হবে। মানুষের উদ্বৃত্ত শ্রম শোষণের মাধ্যমে মুনাফা সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় বাজারে মানুষ ও তার ক্রয়ক্ষমতা কম-বেশি টিকে থাকে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যে অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চলেছে সেখানে না থাকবে মানুষের কাজ, না থাকবে বাজার। কর্মহীন, ক্রয়ক্ষমতাহীন উদ্বৃত্ত মানুষ মুনাফা সর্বোচ্চকরণের কোনো কাজে লাগবে না। পণ্য কেনার লোক না থাকলে মুনাফা আসবে কোত্থেকে? এই সহজ কথা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু তা যাতে সহজে বুঝতে না পারা যায় তার জন্যই কর্পোরেট মিডিয়ার কতো আয়োজন।
তবে কি শ্রমিক শ্রেণি প্রযুক্তির বিরোধিতা করবে? কখনোই নয়। শ্রমিক শ্রেণি হলো আধুনিক শ্রেণি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিতরেই তার সৃষ্টি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উৎপাদন প্রক্রিয়াকে চালানোর হাতিয়ার সে। ফলে এই ব্যবস্থায় প্রযুক্তি থেকে শ্রমিক মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে না। প্রযুক্তি মানুষের জীবনধারা উন্নত করার জন্য। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে এই কাজেই লাগাতে হবে, মানুষের অস্তিত্বকে গিলে খাবার জন্য নয়। কিন্তু পুঁজি যদি তার নিয়ন্ত্রক হয়, তাহলে এটা মানুষের অস্তিত্বকে গিলে খাবেই। মে দিবসের কথার সঙ্গে পৃথিবী বিখ্যাত ‘জন হেনরি’ গানটি ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত। ওই গানে প্রযুক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে মানুষের বীরগাথা বর্ণনা করা হয়েছে। তবে কি আজ আবার শ্রমজীবী মানুষের অস্তিত্বের লড়াই প্রযুক্তির মুখোমুখি হবে? এ প্রশ্নের উত্তর এখন দেওয়া সম্ভব নয়। তবে আজ যা কল্পনা করা যাচ্ছে না, কিন্তু আগামী দিনে বিপুল পরিমাণ কর্মহীন উদ্বৃত্ত শ্রম বিনা প্রতিবাদে মনুষ্যত্বের চরম অবমাননাকে কখনোই মেনে নেবে না। প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম ও সমন্বয়ে মানুষের মধ্যে যে সীমাহীন সৃষ্টিশীল শ্রম সৃষ্টি হয়েছে তা যদি অব্যবহৃত অবস্থায় সঞ্চিত থেকে ক্রমশ নিঃশেষ হওয়ার দিকে যেতে থাকে, প্রজাতিসত্তা হিসেবে মানুষ ফুরিয়ে যাবার আগে শেষ লড়াইয়ে অংশ নেবেই। এখানেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা, ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রমিক শ্রেণির নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তির ভূমিকা।
নিজের অস্তিত্বের কারণেই শ্রমিক শ্রেণির লড়াই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা। ১৮৪৮, ১৮৭১, ১৮৮৬, ১৯০৫, ১৯১৭ বিশ্ব শ্রমিক আন্দোলনের এই গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলকগুলি ইতিহাসের পাতায় আটকে নেই। ইতিহাস কখনোই ‘ইতিহাসের পাতায়’ আটকে থাকে না। মানুষ নিজের বাস্তবতায় তার নিজের ইতিহাস রচনা করে। শ্রেণিহীন, শোষণহীন সমাজ তৈরীর জন্য শ্রমজীবী মানুষের মূল লড়াই চলমান। সমাজের অন্য সমস্ত শ্রেণি ও অংশগুলিকে জড়ো করে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে পারে শ্রমিক শ্রেণি। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে এটাই শ্রমিক শ্রেণির প্রধান কর্তব্য।
আজ আমাদের দেশ, দেশের খেটেখাওয়া ও সাধারণ মানুষ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয়েছে। অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন এদেশে শুধুমাত্র একটি সরকার বদলে নির্বাচন নয়। এই নির্বাচন আরএসএস/বিজেপি এবং দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের জনবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে সমস্ত খেটেখাওয়া ও সাধারণ মানুষের লড়াই। শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, তরুণ প্রজন্ম সহ সমস্ত খেটেখাওয়া ও সাধারণ মানুষের অস্তিত্বের লড়াই এই নির্বাচন। লড়াইয়ে খেটেখাওয়া মানুষের পক্ষের শক্তি যদি জিততে পারে, তবে শ্রমজীবী মানুষের ওপর যে কর্পোরেট গিলোটিন ঝুলছে তাকে আটকানো যাবে। তাই দেশের শ্রমজীবী মানুষ ডাক দিয়েছে, কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় থাকা আরএসএস/বিজেপি ও তার সঙ্গীদের পরাস্ত ও বিচ্ছিন্ন করতে হবে। খেটেখাওয়া মানুষের নির্ভরযোগ্য বন্ধু বামপন্থীদের শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। তা যদি সম্ভব হয়, তবে বর্তমান দানবীয় সরকারের জায়গায় গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল বিকল্প সরকার তৈরি করা সম্ভব হবে। আরএসএস/বিজেপি মুক্ত জনগণের বিকল্প সরকার তৈরীর লড়াইয়ে পশ্চিমবাংলার শর্তটি হলো আরএসএস/বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসকে একই সঙ্গে পরাস্ত করা। কেবলমাত্র সরকার বদলের লড়াই মে দিবসের ডাক নয়। শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে চলমান রাখা ও শক্তিশালী করার ডাক দেয় মে দিবস। কিন্তু দেশ এখন যে মোড়ের মাথায় শ্রমজীবী মানুষের অস্তিত্ব যদি আরও বিপন্ন হয়, ভারতবর্ষের অস্তিত্ব যদি বিপন্ন হয়, তবে খেটেখাওয়া মানুষের লড়াই চালানো আরও ভয়ংকর কঠিন হবে। তাই এবারের মে দিবস ভবিষ্যতে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে জারি রাখার স্বার্থে আরএসএস/বিজেপি’র এই দানবীয় সরকারকে বদলের ডাক দিয়েছে।
নয়া উদারবাদের কাঠফাটা রোদে খেটেখাওয়া মানুষের অস্থি, মজ্জা ও চামড়া পুড়িয়ে দেওয়ার পরিবেশের বিরুদ্ধে আজকের সংগ্রামে পদাতিক কবির কথাতেই বলা যায়, ‘…..তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য জীবনকে চায় ভালবাসতে।’ জীবন ও ভালোবাসার জন্য নিঃশেষিত হওয়ার আগে এদেশ, এ রাজ্যের খেটেখাওয়া মানুষ আজকের রাজনৈতিক সংগ্রামে যে লড়াই দিচ্ছেন তা ভারতে নতুন ইতিহাস তৈরি করবেই। খেটেখাওয়া মানুষের এই লড়াইয়ের পাশে সাহস, আত্মবিশ্বাস ও অদম্য লড়াইয়ে জেদ নিয়ে আমাদের থাকতেই হবে।