নভেম্বর বিপ্লব – মতাদর্শেরও সংগ্রাম

সূর্যকান্ত মিশ্র

উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে প্রথমে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটবে এবং তার ফলে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশগুলিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সহজসাধ্য হবে- মার্কস-এঙ্গেলস এমনটাই ভেবেছিলেন বলে একটা একপেশে ধারনা রয়েছে। একথা সর্বাংশে সত্য নয়। নভেম্বর বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হল রাশিয়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশগুলিতে একের পর এক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হওয়া শুরু হল (দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া)। বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের লক্ষ্যে সংগঠন ও সংগ্রামের নির্দিষ্ট কাজও শুরু হয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গড়ে ওঠার সময় থেকে।

সত্য হল এই যে মার্কস-এঙ্গেলস উভয়েই তাদের জীবদ্দশার শেষভাগে পৌঁছে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে নিজেদের মতামত আরও বিস্তৃত করেছিলেন। অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশে (যেমন চীন) বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বাস্তবিক সম্ভাবনার উপরে বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে এঙ্গেলসের বক্তব্য- বিপ্লব যে রুশ দেশে সম্ভব একথা তিনি স্পষ্টভাবেই জানিয়েছেন।

জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে কার্ল মার্কস রুশ বিপ্লবের সম্ভাবনা সম্পর্কে উৎসাহিত হন, সেই বিষয়ে আরও গভীরে অনুশীলন করতে এক দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন। তৎকালীন রাশিয়ার কিছু অঞ্চলে যৌথ চাষের সুপ্রাচীন কমিউন ব্যবস্থা রীতিমত সক্রিয় ছিল। সেই ব্যবস্থাকে অক্ষত রেখেই বিপ্লব সম্ভবপর কি না মার্কস সেই গবেষণায় বিশেষ মনোযোগ দেন। রুশ দেশের ভূমিব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে মার্কস ছয় মাসের মধ্যে রুশ ভাষা শেখেন, বিস্তারিত আকারে ঐ ভাষায় লেখা বইপত্র পড়তে শুরু করেন। সেই সময় তাঁর ক্যাপিটাল গ্রন্থের দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড চূড়ান্ত করার কাজ চলছে, কিছুটা সমস্যা হয় তাতে। ক্যাপিটাল ২য় ও ৩য় খণ্ডের খসড়া নিয়ে সম্পাদনার কাজ শেষ করতে তিনি এঙ্গেলসকে অনুরোধ করেন। পুঁজি গ্রন্থ শেষ করার কাজটি ওভাবে ফেলে রেখে রাশিয়ায় বিপ্লব সম্ভাবনা নিয়ে মার্কসের মনোযোগ অগ্রাধিকার পাচ্ছে দেখে কিছুটা পরিহাসের ছলেই এঙ্গেলস একবার তাকে বলেছিলেন- ‘ক্যাপিটালের ২য় ও ৩য় খণ্ডের কাজ শেষ না করে এসব নিয়ে পড়ে থাকতে দেখলে রাশিয়া সম্পর্কে আপনার বইপত্র সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে!’

অনেকেই নবীন ও প্রবীণ মার্কসের মতামত, চিন্তাভাবনা ও কাজের মধ্যে পার্থক্য বিবেচনা করেন। সেই বিবেচনা থেকেই এরা নবীন মার্কস কিংবা শুরুর দিকে মার্কসের কাজের প্রতি বাড়তি গুরুত্ব ধার্য করেন। আসলে নবীন মার্কস ও এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইশতেহার লেখার পর কিছুদিনের মধ্যেই কার্যত কমিউনিস্ট লীগ ভেঙ্গে যায়। তারপর প্রথম আন্তর্জাতিক গড়ে তোলা ও ‘প্যারি কমিউন’ পতনের পর ১৮৭২ সালেই তার পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল। তাই তার সদর দপ্তর নিউইয়র্কে স্থানান্তরিত করতে হয়। প্যারি কমিউনের শিক্ষা তাদের নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করেছিল।

সত্য হল এই যে মার্কস ও এঙ্গেলস উভয়েই তাদের জীবনের শেষাংশে যেমন নতুন নতুন অনেক বিষয়ে সত্যানুসন্ধান চালিয়েছিলেন তেমনই নিজেদের পুরানোসব গবেষণাগুলিতেও অনেক নতুন বিষয় যুক্ত করেছিলেন। গভীর পর্যালোচনার মাধ্যমে নিজেদের আগেকার মতামত আরও বেশি ত্রুটিমুক্ত ও সময়োপযোগী করেছিলেন। সবকটি বিষয়ে এই একটি প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। যারা উৎসাহী তাদের সংশ্লিষ্ট বইপত্রগুলি নিজেদের নিয়মিত চর্চায় রাখতে হবে। রাশিয়াতে বিপ্লবের সম্ভাবনা সম্পর্কে মার্কস-এঙ্গেলসের নতুন মতামত খুঁজে পাওয়া যাবে কমিউনিস্ট ইশতেহারের (Communist Manifesto) রুশ সংস্করণের মুখবন্ধে। কার্ল মার্কসের মৃত্যুর পরে ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস রাশিয়ার বিপ্লব সম্ভাবনা সম্পর্কে নিজের মতামত আরও স্পষ্ট করেছিলেন।

সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় (Imperialism: The Highest Stage of Capitalism) বইতে লেনিন উল্লেখ করেছেন- ‘পুঁজির ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীভবন ও উৎপাদনহীনমুখিনতার প্রভাবে একসময়ের প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদের (১৮৭০-১৯০০ পর্যায়ের) প্রবণতা ক্রমশ একচেটিয়া পুঁজিবাদ হিসাবে বিকশিত হচ্ছে’ এই ধারণা সর্বপ্রথম দেন মার্কস এবং তাঁর পর এঙ্গেলসই। সেই ধারনার উপরে ভিত্তি করেই পুঁজিবাদের দুর্বলতম গ্রন্থিতে আঘাতের মধ্যে দিয়ে বিপ্লব সংগঠনের সম্ভাব্যতার তত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন লেনিন।

অবশ্য একথাও ঠিক, জার্মানিতে বিপ্লব হবে- লেনিনও সেই আশা করতেন। সেদেশে প্রতিবিপ্লব সংগঠিত হওয়ার সময়কালে তিনি রোজা লুক্সেমবার্গকে জরুরী সতর্কতা অবলম্বন করতে বার্তা দেন। সেই সতর্কবার্তা মান্য করা হয়নি। পরবর্তীতে রোজা লুক্সেমবার্গ এবং কার্ল লিবনেখটকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। জার্মানির মতো একটি উন্নত পুঁজিবাদী দেশে প্রতিবিপ্লবের সাফল্যে লেনিন ব্যাথিত হয়েছিলেন। জার্মানির ঘটনার প্রভাবে রাশিয়ার বিপ্লবের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে- এই ছিল লেনিনের ঐতিহাসিক উপলব্ধি। কৃষি এবং শিল্প উভয় ক্ষেত্রেই রাশিয়ার মতো অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের পথে বাধা হতে চলেছে একদেশদর্শী মনোভাব একথা বুঝতে লেনিনের দেরি হয়নি। নয়া অর্থনৈতিক নীতি (NEP-New Economic Policy) প্রতিষ্ঠার ভিতই ছিল রাশিয়ার অনগ্রসর অবস্থা, যদিও এমন বন্দোবস্তের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে লেনিন যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছেন- ‘সমাজতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করলে পুঁজিবাদ একটি অভিশাপ। মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা, ক্ষুদ্র উৎপাদন ব্যবস্থা এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য খুদে উৎপাদকদের থেকে সৃষ্ট আমলাতন্ত্রের ক্ষতিকর প্রভাবের তুলনায় পুঁজিবাদ একটি আশীর্বাদ। ক্ষুদ্র উৎপাদন এবং বিনিময়ের প্রাথমিক উপাদান হিসাবে পুঁজিবাদের অস্তিত্ব অনিবার্য হওয়ায় আমরা এখনো ক্ষুদ্র উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে সরাসরি সমাজতন্ত্রে পৌঁছতে পারিনি। ঠিক সেকারণেই ক্ষুদ্র উৎপাদন ও সমাজতন্ত্রের একটি মধ্যবর্তী যোগসূত্র হিসাবে পুঁজিবাদকে আমাদের ব্যবহার করতেই হবে (বিশেষত এটিকে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের প্রবাহে চালিত করে) এবং উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি উপায়, পথ ও পদ্ধতি হিসাবে একে গ্রহণ করতে হবে।’

(লেনিন কালেক্টেড ওয়ার্কস, ভল্যুম-৩২)

কিন্তু এর মানে কি পুঁজিবাদের পুনরুত্থান ? লেনিন নয়া অর্থনৈতিক নীতির (এনইপি)-র যুগে প্রশ্নটির খুব স্পষ্ট উত্তর দিয়েছেন : ‘এর অর্থ, কিছুটা হলেও, আমরা পুঁজিবাদের পুনরুত্থান ঘটাচ্ছি। এটা ঘটাচ্ছি খুব খোলাখুলিই। এটা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। কিন্তু পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ আর সর্বহারা রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ দুটি ভিন্ন ধারণা। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ বুর্জোয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও তাদের স্বার্থে এবং সর্বহারার বিরুদ্ধে পরিচালিত একটি ব্যবস্থা। সর্বহারা রাষ্ট্রে তা পরিচালিত হয় শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থে এবং টিকে থাকা বুর্জোয়া অবশেষের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিদেশী পুঁজি ও বিদেশী পুঁজিপতিদের ছাড় দিতেই হবে। সামান্যতম বিরাষ্ট্রীকরণ না করেও, আমরা খনি, অরণ্য, তৈলক্ষেত্র প্রভৃতি বিদেশী পুঁজিপতিদের লিজ দেব এবং বিনিময়ে তাদের উৎপাদিত পণ্য, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি গ্রহণ করবো। এভাবেই আমাদের নিজস্ব শিল্পভিত্তি পুর্নগঠিত হবে।’

রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ ও উৎপাদিকা শক্তির দ্রুত বিকাশের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে লেনিন অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তার বিপদের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ গঠনের প্রক্রিয়াকে একটি যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে লেনিন বলেছেন: ‘এই যুদ্ধের মূল প্রসঙ্গটি হলো এতে জয়লাভ করবে, কে এই পরিস্থিতির প্রথম সুযোগ গ্রহণ করবে: পুঁজিপতি; যাকে আমরা দরজা খুলে ঢুকতে দিয়েছি এমনকি বেশ কয়েকটি দরজা খুলে দিয়েছি (বা আমাদের অজ্ঞাতসারে হয়তো আরও অনেক দরজা, যা আমরা ছাড়া বা আমরা থাকা সত্ত্বেও খুলে গেছে) নাকি সর্বহারা রাষ্ট্রশক্তি ?

(লেনিন কালেক্টেড ওয়ার্কস, ভল্যুম ৩৩)

এই প্রসঙ্গেই নভেম্বর বিপ্লবের চতুর্থ বার্ষিকীর মঞ্চে বিপ্লবের সাফল্যগুলির পাশাপাশি দুর্বলতা ও ভুলত্রুটি সংশোধনে নিউ ইকনমিক পলিসি সম্পর্কে লেনিনের বক্তব্যের একটি অংশও আমাদের মনে রাখতে হবে- ‘উচ্ছ্বাসের তরঙ্গশীর্ষে ভূমিষ্ঠ হয়ে জনসাধারণের মধ্যে প্রথম জন্ম নেয় রাজনৈতিক উৎসাহ, তার পরে আসে সামরিক উদ্দীপনা (enthusiasm)। এই আগ্রহ ও উদ্যমকে সরাসরি কাজে লাগিয়ে আমরা রাজনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রের করণীয়গুলোর সাফল্যের উপর নির্ভর করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের করণীয় কাজগুলিও শেষ করতে চেয়েছিলাম। আমরা আশা করেছিলাম বা বলা ভালো, যথেষ্ট বিবেচনা না করে ধরে নিয়েছিলাম, যে ক্ষুদ্র-কৃষক নির্ভর রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় উৎপাদন এবং রাষ্ট্রীয় পণ্যবন্টন প্রক্রিয়াকে সর্বহারা রাষ্ট্রের চাহিদামাফিক কমিউনিস্ট ধারায় সংগঠিত করতে পারবো। অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে আমাদের ধারণা ভুল ছিলো। মনে হয়েছে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রকে উত্তরণের পথে বেশ কয়েকটি অন্তর্বর্তীকালীন স্তর আমাদের পেরিয়ে যেতে হবে। এবং শেষ পর্যন্ত সাম্যবাদে পৌঁছনোর পথে প্রতিটি স্তরেই আমাদের প্রয়োজন হবে দীর্ঘ সময়ের উদ্যম। সরাসরি স্বতঃস্ফূর্ততার উপর নির্ভর করে নয়, মহান বিপ্লব সঞ্জাত প্রেরণা এবং ব্যক্তিগত আগ্রহ, ব্যক্তিগত স্বার্থপ্রেরণা ও হিসেবিয়ানার ভিত্তিতে আমাদের এই ক্ষুদ্র কৃষক নির্ভর রাষ্ট্রে কাজ শুরু করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের অভিমুখে মজবুত সাঁকো নির্মাণ করতে হবে। তা নাহলে আমরা কখনোই সাম্যবাদে পৌঁছতে পারবো না, লক্ষ লক্ষ মানুষকে সাম্যবাদে নিয়ে যেতে পারবো না। অভিজ্ঞতা এবং বিপ্লবের বস্তুগত বিকাশের ধারা আমাদের এই শিক্ষাই দেয়।’

নয়া অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণের বাধ্যবাধকতা ও রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে লেনিন সতর্কও করেছেন- ‘আমাদের সরাসরি এই প্রসঙ্গটির মুখোমুখি হওয়া দরকার—কে জয়ী হবে? হয় পুঁজিপতিরা প্রথম সংগঠিত হতে সফল হবে সেক্ষেত্রে তারা কমিউনিস্টদের বিতাড়িত এবং নিশ্চিহ্ন করবে। অথবা সর্বহারা রাষ্ট্রশক্তি, কৃষক সমাজের সমর্থন নিয়ে, এই সমস্ত পুঁজিপতি ভদ্রলোকদের যথার্থ লাগাম পরাতে সমর্থ হবে যাতে এই পুঁজিবাদকে রাষ্ট্রের খাতে চালনা করা যায় এবং এমন এক পুঁজিবাদ তৈরি করা যায় যা রাষ্ট্রের অধীনস্থ এবং রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে।’

(লেনিন কালেক্টেড ওয়ার্কস, ভল্যুম ৩৩)

স্মরণে রাখা প্রয়োজন লেনিনের এই সতর্কবার্তা পরবর্তীকালে উপেক্ষা করে হয়েছিল। নব্বই’র দশকে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার বিপর্যয় লেনিনের সাবধানবানীকেই সঠিক প্রমান করেছে। বলা বাহুল্য এখন চীন, ভিয়েতনাম সহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি লেনিন নির্দেশিত পথেই কমবেশি অগ্রসর হচ্ছে।

লেনিনের মৃত্যুর পরে স্তালিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল তিনটি। পিছিয়ে থাকা অর্থনীতির দেশে উৎপাদিকা শক্তির দ্রুত বিকাশ, দেশ গঠনে নির্ধারিত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সফল রূপায়ন এবং ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা। একদিকে শত্রুর আক্রমণের মোকাবিলা আরেকদিকে অভ্যন্তরীণ বিকাশের হার দ্রুত বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা- এইদুয়ের প্রভাবে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র ও আন্তঃপার্টি গনতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সেই সুযোগেই আমলাতান্ত্রিকতা মাথাচাড়া দেয়। ফ্যাসিবাদকে সরাসরি যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাস্ত করে। তার পরেই উপনিবেশের শৃঙ্খল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত দেশগুলিতে (যেমন চীন, ভিয়েতনামসহ পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহ) সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের সাথে সমাজতান্ত্রিক শিবির নির্মিত হলে গোটা পৃথিবীর রাজনৈতিক ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটে। এ ছিল এক বিরাট সাফল্য, যার অভিঘাত ঐতিহাসিক।

সমাজতন্ত্র থেকে কমিউনিজমের দিকে যাত্রাপথে এক দীর্ঘকাল ব্যাপী সংগ্রামের পথ পেরোতে হবে- লেনিনের সেই শিক্ষা কিন্তু সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পক্ষ থেকে অনুসরণ করা হয়নি। এই প্রসঙ্গে আমাদের পার্টির ২০-তম কংগ্রেসের মতাদর্শগত দলীলে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। মতাদর্শ সম্পর্কে আগ্রহীদের সেই দলীল বারে বারে পড়তে হবে, আপাতত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে ভাষণ দিতে গিয়ে লেনিনের বক্তব্য উল্লেখ রইল- ‘এটা বলা হয় যে পার্লামেন্টারি সংগ্রামে অংশ নেওয়া হলো সময়ের অপচয়। পার্লামেন্ট ব্যতীত তেমন অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কথা কেউ কি ভাবতে পারেন, যেখানে সমস্ত শ্রেণীর মানুষ এমনভাবে আগ্রহী? এটা কৃত্রিমভাবে হয় না। সকল শ্রেণীর মানুষ পার্লামেন্ট-এ আগ্রহী হয়ে পড়ে, কারণ সমস্ত ধরনের শ্রেণী-স্বার্থ এবং দ্বন্দ্বের প্রমাণ এখানে ঘটে। যদি এখনই সর্বত্র সম্ভব হতো। ধরা যাক, একটি সাধারণ ধর্মঘটের মাধ্যমে পুঁজিবাদকে উৎখাত করে নিষ্পত্তি করে ফেলা যায়, তাহলে অনেকগুলি দেশেই বিপ্লব ঘটে যেতো। কিন্তু বাস্তব অনুধাবন করে আমাদের অগ্রসর হতে হবে এবং পার্লামেন্ট হলো শ্রেণী-সংগ্রামের মঞ্চ।’

(লেনিন কালেক্টেড ওয়ার্কস, খণ্ড ৩১)

‘বুর্জোয়া পার্লামেন্টকে ভেঙে দেওয়ার শক্তির অভাব যতদিন আমাদের থাকবে, ততদিন এই পার্লামেন্টের বিরুদ্ধেই আমাদের কাজ করতে হবে, বাইরে থেকে এবং ভিতর থেকে। শ্রমিকদের প্রতারিত করার জন্য বুর্জোয়ারা যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক হাতিয়ার ব্যবহার করছে, সেই হাতিয়ার সম্পর্কে মেহনতী জনগণের (শুধু প্রলেতারিয়েতের নয়, আধা প্রলেতারিয়েত ও ছোট কৃষকদের) বেশ উল্লেখযোগ্য অংশের যতদিন পর্যন্ত আস্থা থাকবে, ততদিন পর্যন্ত এই প্রতারণাকে ব্যাখ্যা করতে হবে সেই প্ল্যাটফরম থেকেই যে প্ল্যাটফর্মকে শ্রমিকদের এবং বিশেষ করে শ্রমিক, মেহনতী জনগণের পশ্চাৎপদ অংশগুলি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবচেয়ে কৃতিত্বপূর্ণ বলে মনে করে থাকে।’

(লেনিন কালেক্টেড ওয়ার্কস খণ্ড ৩১, পৃঃ ২৬৮-২৬৯)

একইসাথে লেনিন জোর দিয়েছেন এবং সতর্কও করেছেন ‘শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী পার্টিকে তার নিজের শ্রেণীর পশ্চাৎপদ অংশকে জ্ঞানের আলোকে জাগ্রত করার জন্য পার্লামেন্টারি নির্বাচনে এবং পার্লামেন্টের মধ্যে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু পার্লামেন্টই সব এবং সর্ব অবস্থায় পার্লামেন্টারি সংগ্রাম হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক সংগ্রামের একমাত্র বা প্রধান রূপ—এই ধারণা অথবা অন্য সব আন্দোলনকে পার্লামেন্টারি কাজের নিচে স্থান দেওয়া আসলে প্রলেতারিয়েতের পক্ষ পরিত্যাগ করে বুর্জোয়া পক্ষে চলে যাওয়ার শামিল।’

(লেনিন কালেক্টেড ওয়ার্কস খণ্ড ৩০, পৃষ্ঠা ৯২)

স্তালিন জীবনের শেষদিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লেখেন- ইকোনমিক প্রবলেমস অফ সোশ্যালিজম ইন দি ইউএসএসআর। এই বইতে তিনি সমাজতন্ত্রে বাজারের অস্তিত্ব, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পণ্যের মূল্য নির্ধারণে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। পুঁজিবাদের বিশ্বব্যাপী সংকটের অর্থ ঠিক কেমন- সেই অবস্থায়ও যে কিছু জায়গায় অর্থনীতির সূচক উর্ধমুখী থাকে এমন গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণও স্তালিনের লেখায় রয়েছে। জেনারেল ক্রাইসিস অব ক্যাপিটালিজম ও ফাইনাল ক্রাইসিস অব ক্যাপিটালিজমের সম্পর্ক, পার্থক্য সহজ কথায় ব্যখ্যা করেছেন তিনি। এমনটা না যে স্তালিনের আমলে কোনও ভুল ত্রুটি হয়নি। মাও বলেছিলেন স্তালিন ৭০% সঠিক, ৩০% ভুল করেছিলেন। মাও-এর মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে একই মূল্যায়ন করে চীন পার্টির কংগ্রেস। আমরা শতাংশ হারে বিচার করিনি, ভুলগুলি নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করেছি। ভুলগুলি অস্বাভাবিক নয়। সেগুলি থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাই আমাদের পথ দেখায়।

স্তালিনের মৃত্যুর পরে সিপিএসইউ’র বিংশতিতম কংগ্রেসে নিকিতা ক্রুশ্চেভ তাঁর অবদানের কুৎসাপূর্ণ অবমূল্যায়ন করেন। অকস্মাৎ এমন পরিবর্তন হয়েছে এমনটা না। একথা ভুললে চলে না, স্তালিনের মৃত্যুর আগে থেকেই সোভিয়েতে সংশোধনবাদী প্রবণতা ফুটে উঠছিল, তার মৃত্যুর পরে সেই প্রবনতাই সরাসরি সংশোধনবাদে রুপান্তরিত হল। এই প্রসঙ্গেই খেয়াল রাখতে হবে সমাজতন্ত্র থেকে কমিউনিজমে উত্তরণের যে দীর্ঘ সংগ্রাম তাকে সরাসরি এড়িয়ে গিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতা ও শান্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক রূপান্তর জাতীয় শব্দবন্ধের আড়ালে প্রলেতারীয় রাষ্ট্রের লেনিনীয় ধারণা বদলে দিয়ে বলা শুরু হল ‘পার্টি অ্যান্ড স্টেট অব দি হোল পিপল’। তারই অনুষঙ্গ হিসাবে এল আপোষের ভিত্তিতে ১৯৫৭ সালে ১২ পার্টির দলিল ও ৬০’র দশকে ৮১ পার্টির দলিল রচিত হয়েছিল। সমাজতন্ত্রের ধারণার বিরুদ্ধে Days are not far- বলে তখন যে কথা বলা হয়েছিল তার প্রভাবে বাস্তবিক অবস্থার ভুল ব্যখ্যা সহ লেনিনের শিক্ষার একেবারেই বিপরীতমুখী পথে এগোনো হয়েছিল। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের পার্টির মধ্যে মতান্তর তীব্রতর হয় এবং বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়। কেবল চারটি শাসক পার্টি ছাড়া আর কোনও পার্টির সঙ্গে আমাদের ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক ছিল না। ৭০’র দশকের শেষদিকে পরিস্থিতি বদলায়।

সিপিএসইউ’র ২৭ তম পার্টি কংগ্রেসে চারটি মৌলিক দ্বন্দ্ব সম্পর্কে কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গীকে মেনে নিয়েও নভেম্বর বিপ্লবের ৭০ তম বার্ষিকীতে মিখাইল গর্বাচেভের ভাষণে তারই চূড়ান্ত বিপরীতে অবস্থান নিতে দেখা যায়। ঐ আলোচনায় গর্বাচেভের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমাদের পার্টির প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ কিছু কথা বলার জন্য প্রেসিডিয়ামের কাছে সময় চাইলে সেই আবেদন অগ্রাহ্য করা হয়। আমাদের ভিন্নমত জানিয়ে দেওয়া হয়। নিস্পত্তি হয়নি।

এরপর ‘সমাজতান্ত্রিক বিপর্যয় প্রসঙ্গে’ শীর্ষক দলিলে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ ঘটনাবলীর পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়। ১৯৮৮ সালের মে মাসের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির অধিবেশনে প্রথম আমাদের ভিন্নমতগুলি বিশদে ব্যখ্যা করা হল। যে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্বইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে ভাঙন ও সমাজতান্ত্রিক বিপর্যয় ঘটছিল সেগুলি সম্পর্কে তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া এই দলিলগুলিতে পাওয়া যাবে। ১৯৯২ সালে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত পার্টির চতুর্দশ কংগ্রেসে ‘কয়েকটি মতাদর্শগত বিষয় প্রসঙ্গে’ প্রস্তাবে বলা হয়- ’২৭ তম কংগ্রেসের দলিলের দিকনির্দেশ থেকে সিপিএসইউ গুরুতরভাবে সরে এসেছিল। সব মিলিয়ে এর অর্থ দাঁড়ালো গর্বাচেভের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রকে ভেঙ্গে ফেলা ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে টুকরো টুকরো করার পরিকল্পিত প্রয়াস (প্যারা নং ৪)’।

এই প্রস্তাবে পার্টির মতাদর্শগত অবস্থানকে সময়োপযোগী করার কথা বলা হয়। সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে বিশ্ব ভারসাম্যের পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে পার্টি কর্মসূচী সময়োপযোগী করা হয়। ২০০০ সালে ২০-২৩ অক্টোবর তিরুবনন্তপুরমে সিপিআই(এম)-র বিশেষ সম্মেলনে ১৯৬৪ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত পার্টির সপ্তম কংগ্রেসের কর্মসূচী সময়োপযোগী করে গৃহীত হয়। এতে সমাজতন্ত্রের সাফল্যগুলির কথা উল্লেখ করেই বলা হয় ‘সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের অনির্ধারিত পথের যাত্রায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি গুরুতর ভুলও করে। এই ভুলের উৎস সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের দীর্ঘস্থায়ী চরিত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব, পার্টি ও রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা, অর্থনীতি ও তার পরিচালনার ক্ষেত্রে অর্থনীতি ও তার পরিচালনার ক্ষেত্রে সময়মতো যথাযথ পরিবর্তন আনার ব্যর্থতা, পার্টি রাষ্ট্র ও সমাজে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, আমলাতান্ত্রিকতার বৃদ্ধি ও মতাদর্শগত চেতনার অবক্ষয় - এইসব কারণ সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য সাম্রাজ্যবাদের নিরন্তর প্রচেষ্টাকে সাহায্য করেছিল ...(অনুচ্ছেদ ২.৩)'।

'সাম্রাজ্যবাদ ও তার শোষণ মূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণী ও তার সংগঠনগুলিকে মতাদর্শগতভাবে, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে। ... বিশ্বজুড়ে বামপন্থী, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির ঐক্য গড়ে তুলতেই হবে। সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রতি অনুগত পাটি হিসাবে সিপিআই (এম) সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অঙ্গীকারবদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদ নির্দেশিত বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, শান্তি, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের স্বপক্ষে সংগ্রামরত বিশ্বের মিত্রশক্তির প্রতি সিপিআইএম সংহতি জানাচ্ছে (অনুচ্ছেদ ২.৯)'।

পার্টি কর্মসূচির এই আহ্বান ও কোঝিকোড়ে করে অনুষ্ঠিত পার্টির কুড়ি তম কংগ্রেসের গৃহীত সর্বশেষ মতাদর্শগত দলিলের দিকনির্দেশ অনুশীলনই এই নভেম্বরেও আমাদের শক্তি জোগাতে সক্ষম।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন