মৃদুল দে
কমরেড মুজফফর আহমদ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সেরা পথিকৃৎ, শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী মুজফফর আহমদের এটি ১৩২তম জন্মবর্ষ। ১৮৮৯ সালের আগস্ট মাসের এক সোমবারে (বাংলা শ্রাবণ) অবিভক্ত বাংলার নোয়াখালি জেলার অন্তর্ভুক্ত বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ দ্বীপের মুসাপুর গ্রামে কমরেড মোজাফফর আহমদের জন্ম। তার পিতা মুন্সি মনসুর আলী সাহেব ছিলেন একজন মোক্তার। তার অগ্রজ তিন সহোদর ভাই হলেন মহব্বত আলী, মকবুলী আহমদ ও খুরশিদ আলম।কমরেড মুজফফর আহমদ এর জীবনকালেই তাঁদের মৃত্যু হয়।তাঁর স্ত্রী ও কন্যা দীর্ঘদিন ধরে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে ছিলেন।
কমরেড মুজফফর আহমদ সন্দীপের কার্গিল হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। তারপর তিনি নোয়াখালী জেলা স্কুল থেকে১৯১৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় (ম্যাট্রিকুলেশন) পাশ করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার পরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯১৩ সালেই কলকাতা আসেন।হুগলি মহসিন কলেজে তিনি দু-তিন মাস আই এ ক্লাসে পড়াশোনা করেন।পরে বঙ্গবাসী কলেজেও কিছুকাল পড়াশোনা করেন।কলেজ ছাড়ার পর বাংলা সরকারের অনুবাদ দপ্তরে কিছুদিন উর্দু থেকে ইংরেজি অনুবাদক এর কাজ করেন। জীবিকার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চাকরি নিতে বাধ্য হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাবে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে আকৃষ্ট হন। প্রগতিশীল সাহিত্যের দিকে সবসময়ই তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। ১৯১৮-১৯ সালে তিনি ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা সমিতি’তে যোগদান করেন। এদের প্রকাশিত ত্রৈমাসিক বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকার পরিচালনার দায়িত্বভার পান মুজফফর আহমদ।এই পত্রিকার সূত্রেই মুজফফর আহমদের সঙ্গে কবি নজরুল ইসলামের যোগাযোগ হয়।করাচির সেনানিবাস থেকে নজরুলের পাঠানো কবিতা ও গল্প এই পত্রিকায় প্রকাশিত হত। পল্টন থেকে ফিরে ১৯২০ সালে নজরুল ইসলাম বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে ওঠেন। এখান থেকেই দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। আমৃত্যু তা বজায় ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় মহান নভেম্বর বিপ্লব এর প্রভাব পড়ে সারা বিশ্বে।১৯২০ সালে তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় অধিবেশনে লেনিনের নেতৃত্বে ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে বিপ্লবের কর্মসূচি গৃহীত হয়।এরপর চিনে ও ভারতবর্ষে বৈপ্লবিক আন্দোলন, স্বাধীনতার সংগ্রাম তীব্র হয়ে ওঠে।১৯২১ সালে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন এবং শ্রমিক-কৃষকের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আন্দোলন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে তুলেছিল।১৯২০সালে ভারতের শ্রমিক সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ করে গঠিত হয় অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস।
এই সময় থেকে মুজফফর আহমদের জীবনেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে।১৯২১ সালের শুরুতে দেশত্যাগী ভারতীয় মোহাজীর বিপ্লবীদের নিয়ে মধ্য এশিয়ার তাসখন্দে এবং পরে মস্কো শহরে ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। বাংলায় তিনিই প্রথম পার্টির সদস্য। কমরেড মুজাফফর আহমদের সঙ্গে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের যোগসূত্র স্থাপিত হয়।১৯২০ সালেই তিনি সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হবার সিদ্ধান্ত নেন।মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা ত্যাগ করে নজরুল ও অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং রুশ বিপ্লবের আদর্শে শ্রমিক-কৃষকের বৈপ্লবিক আন্দোলন গঠনে আত্মনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে মুজফফর আহমদ ও নজরুল ইসলামের উদ্যোগে মৌলভী এ কে ফজলুল হক ‘নবযুগ’ নামে একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা বের করেন।’নবযুগে’র যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন মুজফফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলাম।মার্কুইস লেনের একটি বাড়ির ঘরে দুজনেই থাকতেন। পরে মুজফফর আহমদ ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন।এখানেই তাঁর সঙ্গে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। খিদিরপুরে জাহাজের খালাসিদের সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ রাখতেন, বিভিন্ন শ্রমিক সভায় যোগ দিতেন। গোড়া থেকেই তিনি শ্রমিকদের সংগঠিত করা এবং কমিউনিস্ট মতবাদ প্রচারের সচেষ্ট হন। ভারতে কমিউনিস্ট সাহিত্যের প্রকাশ তখন নিষিদ্ধ ছিল। গোপনে তিনি কমিউনিস্ট পুস্তকাদি ও পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে গোপনে কমিউনিজমের প্রচার আরম্ভ করেন। অথচ সহায়-সম্বলহীন কঠোর জীবন তাকে যাপন করতে হচ্ছিল।একদিকে প্রচন্ড অর্ধাহার,অনাহার,দুঃখ-কষ্টের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অন্যদিকে সর্বক্ষণ পুলিশের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে প্রচার কাজ চালানোর কঠিন কাজ তাকে করতে হয়।থাকবারও কোন নির্দিষ্ট বাসস্থান ছিল না। এই সময় তাঁর একমাত্র ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিলেন কমরেড আব্দুল হালিম। কমরেড মুজফফর আহমদ বোম্বাইয়ে ডাঙ্গে এবং অন্যান্য প্রদেশের সমমতাবলম্বী বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করেন।’নবযুগ’ পত্রিকায় শ্রমিকদের জীবন,সমস্যাবলী এবং সংগ্রাম নিয়ে তিনি অনেক প্রবন্ধ লেখেন।১৯২২ সালে কাজী নজরুল ইসলাম অর্ধসাপ্তাহিক ‘ধুমকেতু’ বের করেন। ‘দ্বৈপায়ন’ ছদ্মনামে মুজফফর আহমদ ভারতের রাজনৈতিক সমস্যাবলী নিয়ে অনেক প্রবন্ধ লেখেন।
কমিউনিস্ট মতবাদ প্রচারের স্রাোত আটকাতে ব্রিটিশ সরকার আরও তৎপর হয়ে ওঠে। ১৯২২ সালের শেষে গয়া কংগ্রেসের অধিবেশনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচি সংবলিত এক সুদীর্ঘ ইশতেহার প্রচারিত হয়।এর আগে ১৯২১ সালে আমেদাবাদ কংগ্রেসেও এক ইশতেহার প্রচারিত হয়। এতে শঙ্কিত হয়ে ওঠে ব্রিটিশ সরকার।১৯২৩ সালে মোহাজীর বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে পেশোয়ারের দায়রা আদালতে বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হয়। তাদের বিরুদ্ধে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দায়ের করা হয়। এসবের ফলে গোপনে কাজ করাও মুজফফর আহমদ এর পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। ১৯২৩ সালের মে মাসে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। মার্কসীয় সাহিত্য পত্রিকা এবং বই উদ্ধারের জন্য পুলিশ এসময় বিভিন্ন জায়গায় খানাতল্লাশি চালায়।
১৯২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত সরকার মুজফফর আহমদ,ডাঙ্গে প্রমুখের নামে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দায়ের করে। এজন্য মুজফফর আহমদ কে নিয়ে যাওয়া হয় কানপুর জেলে।এছাড়া অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন ওসমানী ও নলিনী গুপ্ত। এটি কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা নামে খ্যাত। চৌরিচৌরা মামলায় একদিকে ১৭২ জন কৃষকের ফাঁসির হুকুম হয়। কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় মুজফফর আহমদ সহ সকলের চার বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। কয়েকজন অভিযুক্তকে সরকার কোর্টে হাজির করতে পারেনি। কিন্তু এই মামলার বিবরণের মধ্য দিয়ে সংবাদপত্রের মাধ্যমে মানুষ কমিউনিস্ট আন্দোলনের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারেন। সাধারণ কয়েদী হিসেবে মুজফফর আহমদকে পাঠানো হয় উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলি জেলে। এখানে তিনি কঠিন যক্ষা রোগে আক্রান্ত হন ফলে দন্ডকাল শেষ হবার আগেই তিনি মুক্তি পান
১৯২৫ সালে কানপুরের জনৈক সত্য ভক্ত প্রথম প্রকাশ্য কমিউনিস্ট সম্মেলনের নামে প্রস্তুতি হিসেবে দুটি ইশতেহার প্রকাশ করেন। এ বছরের ২৬ ডিসেম্বর কানপুরে এই সম্মেলন ডাকা হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কলকাতা ফেরার পথে মুজাফফর আহমদ এই সম্মেলনে যোগ দেন। সত্য ভক্ত আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট মতবাদ ও আন্দোলনের বিরুদ্ধেই ছিলেন, জাতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গঠনই ছিল তার মুখ্য উদ্দেশ্য।সত্য ভক্তের চেষ্টা সম্মেলনে ব্যর্থ হয়। বোম্বাইয়ের ঘাটে নবগঠিত কমিউনিস্ট পার্টির যুগ্ম সম্পাদক হন। এখানেই ঘাটের সঙ্গে মুজফফর আহমদ এর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়।কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য অফিস বলতে তখন শুধু দিল্লিতে চাঁদনী চকে একটা তৈরি হয়েছিল। তবে এই অফিসের কোনো ভূমিকা ছিল না। পরে এই অফিস উঠেও যায়। এসময়ে কমরেড মুজফফর আহমদ এর উদ্যোগে বোম্বাই ও কলকাতায় কমিউনিস্টদের নিয়ে একটি পার্টি কমিটি গঠিত হয়েছিল। পরবর্তী সময় তারাই ‘শ্রমিক কৃষক দলে’র ভেতর দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নীতি কার্যকর করে তোলেন। কানপুর সম্মেলনে মুজফফর আহমদ যখন বোম্বাইয়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের পরিকল্পনা ব্যস্ত ছিলেন সেই সময় ১৯২৫ সালের পয়লা নভেম্বর কলকাতায় ‘লেবার স্বরাজ পার্টি অফ দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ নামে নতুন একটি পার্টি জন্মলাভ করে।পার্টির মুখপত্র হিসেবে নজরুল ইসলামের পরিচালনায় প্রকাশিত হয় ‘লাঙল’। মুজফফর আহমদ কানপুর থেকে ফিরে এসে ‘লাঙল’ পত্রিকা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কমরেড আব্দুল হালিমও তাঁর সঙ্গে যোগ দেন।কমরেড হালিমের সঙ্গে ১৯২২ সাল থেকেই মুজাফফর আহমদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়। কয়েক মাস পর পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর লাঙলের নাম পরিবর্তন করে প্রকাশিত হয় ‘গণবাণী’। সম্পাদক হিসেবে গঙ্গাধর বিশ্বাসের নাম থাকলেও প্রকৃত সম্পাদক ছিলেন মুজফফর আহমদ। মার্কসবাদ ও বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে বহু নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এখানেই আন্তর্জাতিক সঙ্গীত এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। মুজফফর আহমদ এর উপরেই ছিল পত্রিকার প্রধান দায়িত্ব।অর্থাভাবে মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে যেত প্রকাশনা। সে যুগের কমিউনিস্ট মতবাদ প্রচারের কেন্দ্র ছিল ‘গণবাণী’। ১৯২৬ সালের মাঝামাঝি কলকাতার বুকে এক বীভৎস হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা সংঘটিত হলো।সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও সম্প্রীতির বাণী বহন করে আবার গণবাণী প্রকাশিত হয়।কমিউনিস্টরাই এই ঐক্যের জন্য ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে বিরাট ভূমিকা নেয়।
১৯২৬ সালের কঠোর পরিশ্রম এবং অর্ধাহারে-অনাহারে মুজফফর আহমদের স্বাস্থ্য আবার ভেঙে পড়ল।’গণবাণী’ও বন্ধ হয়ে যায়। স্বাস্থ্যদ্ধারে তিনি যান লাহোরে। সেখানে তিনি মস্কো প্রত্যাগত এবং পেশোয়ার মামলায় দণ্ডিত আব্দুল মজিদের বাড়িতে ছিলেন। কয়েক মাস থেকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের কাজে বোম্বাই চলে আসেন।মুজফফর আহমদের সম্পাদনায় ১৯২৭ সালের গোড়ায় আবার ‘গণবাণী’ প্রকাশ শুরু হয়।১৯২৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় ভারত সভা হলে শ্রমিক কৃষক দলের দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯২৭ সালের ৩১ মে বোম্বাইয়ে কমিউনিস্টদের এক সম্মেলনে কমিউনিস্ট পার্টির নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। পার্টির কর্মসূচি ও গঠনতন্ত্র গৃহীত হয়।
সঙ্গে একটি ইশতেহারও প্রকাশিত হয়। মুজফফর আহমদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি কার্যকরী কমিটির সদস্য এবং ঘাটে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন।
১৯২৭-২৮ সালে ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলন, বিশেষত শ্রমিক আন্দোলন এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত হয়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনও তীব্রতর হয়ে ওঠে। ১৯২৭সালের মার্চ মাসে কানপুরে এ আই টি ইউ সির অধিবেশনে এবং নভেম্বর মাসে দিল্লি অধিবেশনে কমরেড মুজফফর আহমদ যোগ দেন এবং সংগঠনের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন
ক্রমবর্ধমান শ্রমিক সংগ্রাম ও তাতে কমিউনিস্টদের প্রভাব বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ শাসকদের আতঙ্ক বেড়ে যায়। আক্রমণের মাত্রা বাড়তে থাকে।’গণবাণী’ অফিস তল্লাশি করে সমস্ত মার্কসবাদী পত্রপুস্তিকা ও বই বাজেয়াপ্ত করে।১৯২৭ খড়গপুরে রেলকর্মীদের ধর্মঘট, বৃহৎ শিল্প কারখানায় ধর্মঘট,চটকল শ্রমিকদের ও বন্দর শ্রমিকদের ধর্মঘটে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন মুজফফর আহমদ। ১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাসে মাদ্রাজে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি ও অন্যান্য কমিউনিস্টরা নেতারা যোগ দেন।এখানে শ্রমিক কৃষক দলের পক্ষ থেকে গণপরিষদ বা কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি সম্পর্কে একটি ইশতেহার প্রচারিত হয়। এখানে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন সম্পর্কে কমিউনিস্টদের এক গোপন বৈঠকে তিনি যোগ দেন। উল্লেখ্য যে কমরেড মুজফফর আহমদ ১৯২১-১৯৪৪ সাল পর্যন্ত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ছিলেন, আবার এআইসিসির সদস্যও ছিলেন তিনি।
১৯২৮ সালে কলকাতা,বাংলা ও দেশব্যাপী অসংখ্য আন্দোলন-ধর্মঘট হয়। সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও সেই সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রত্যেকটি সংগ্রামে তিনি সক্রিয় অংশ নেন। বেতন বৃদ্ধির জন্য কলকাতা কর্পোরেশনের ধাঙ্গড়,মেথর ও ঝাড়ুদারদের ধর্মঘটের নেতৃত্ব দেবার জন্য তিনি গ্রেফতার হন।
শ্রমিক কৃষক দল কয়টি প্রদেশ গঠিত হয়েছিল ইতিপূর্বেই। ১৯২৮ সালের ৩১ মার্চ ২৪ পরগনার ভাটপাড়ায় এই দলের তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এখানে সর্বভারতীয় শ্রমিক কৃষক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। বাংলায় এই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মুজাফফর আহমদ।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তখন ফ্যাসিজমের উদ্ভব হচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী তখন দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ আর্থিক মন্দা ও সংকট।১৯২৮ সালের ১৫ ই জুলাই থেকে ১লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মস্কোতে চলে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ষষ্ঠ কংগ্রেসের অধিবেশন। এখানে আন্তর্জাতিকের কর্মসূচি,গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলী গৃহীত হয়।ঔপনিবেশীক দেশসমূহে বিপ্লবী মুক্তি আন্দোলন, বিশ্ববিপ্লব ইত্যাদি নিয়ে কর্মসূচি গৃহীত হয়।
পরাধীন দেশে বিপ্লবের দিকনির্দেশক পৃথক দলিলও গৃহীত হয়। লেনিন আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে যে মতাদর্শগত সংগ্রাম শুরু করেন এই অধিবেশন তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়।
১৯২৮ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। কলকাতায় ২৭ থেকে ২৯ ডিসেম্বর শ্রমিক কৃষক দলের সর্বভারতীয় সম্মেলনে সর্বভারতীয় শ্রমিক-কৃষক দল গঠিত হয়।কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে কমিউনিস্টদের মধ্যে এখানে আলোচনা হয় এবং তা নিষ্ঠার সঙ্গে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়।এখানে ঠিক হয় শ্রমিক-কৃষকের পার্টির বদলে শ্রমিকশ্রেণীর পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করতে হবে। ১৯২৯ সালের জানুয়ারিতে কলকাতায় কমিউনিস্টদের আরেক গোপন সভায় নতুন করে গোপন ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ পুনর্গঠিত হয়। এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নেন কমরেড মুজফফর আহমদ। কিন্তু পুনর্গঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আগেই বিভিন্ন প্রদেশে সরকার দমননীতি শুরু করে। সর্বত্র ট্রেড ইউনিয়ন অফিস, কৃষক সমিতির অফিস, শ্রমিক-কৃষকের অফিসের ওপর আক্রমণ নেমে আসে। ৩২ জন নেতা-কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করে ।তার মধ্যে সবাই কমিউনিস্ট ছিলেন না, কমরেড মুজফফর আহমদ ও অন্যান্য কমরেডরা গ্রেপ্তার হন শ্রমিক-কৃষক দলের অফিস থেকে।ধৃত নেতাদের বিরুদ্ধে ভারত সম্রাটকে ভারত থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। তাদের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ১২১ এ ধারায় ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। এটা মিরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা নামেবিশ্ববিখ্যাত। প্রায় চার বছর ধরে এই মামলা চলে। মিরাট আদালতে কমিউনিস্ট বন্দীরা যে দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছিলেন তা এক গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিস্ট দলিল হিসাবে চিরস্মরণীয়।যুক্ত বিবৃতি ছাড়াও প্রত্যেকে পৃথক পৃথক বিবৃতি দিয়েছিলেন।কমরেড মুজফফর আহমদ বলিষ্ঠভাবে কমিউনিস্ট মতবাদ ও ভারতে কমিউনিস্টদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে কমিউনিজম প্রচারের এই প্রচেষ্টা প্রভূত সফল হয়েছিল।কমিউনিস্টদের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আরো বেড়ে যায়। ব্রিটিশ সরকারের বিচারক মুজাফফর আহমদকেই ভারতে কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্রের মুখ্য আসামি বলে মন্তব্য করে তাঁর যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন। অন্যদের হয়েছিল ৩ থেকে ১২ বছর কঠোর কারাদণ্ড। পরে আপিলে এলাহাবাদ হাইকোর্টের আদেশে তাঁর দণ্ডাদেশ কমিয়ে তিন বছর করা হয়
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার পর প্রচন্ড দমন-পীড়নে শ্রমিক আন্দোলন সাময়িককালের জন্য পিছু হটে। কিন্তু আবার বিরাট বিরাট আন্দোলন ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে নতুন বিপ্লবী শক্তির সমাবেশ হয়।১৯৩১সালে চিকিৎসার জন্য জামিনে মুক্ত হয়ে মুজফফর আহমদ কিছুদিনের জন্য কলকাতায় আসেন এবং ৪১ নম্বর জাকারিয়া স্ট্রিটে ‘গণশক্তি’ কার্যালয়ে অবস্থান করেন। আব্দুল হালিম, সোমনাথ লাহিড়ী,সরোজ মুখার্জী প্রমুখ ‘গণশক্তি’ অফিস থেকে প্রথমে ‘মার্কসবাদী’ ও পরে ‘গণশক্তি’ পত্রিকা বের করতেন।মুজফফর আহমদ কমিউনিস্ট কর্মীদের পার্টি গঠনের কাজে মূল্যবান পরামর্শ দিতেন। জেল থেকেও নানাভাবে তিনি পরামর্শ পাঠিয়ে সাহায্য করতেন।
তখন বিভিন্ন প্রদেশের পার্টি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৯৩৩ সালের শেষ দিকে আবার নতুন করে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। একটি কেন্দ্রীয় কমিটিও গঠিত হয়। ১৯৩৪ সালের২৭ জুলাই যাবতীয় কমিটি,শাখা ও গণসংগঠনসহ কমিউনিস্ট পার্টিকে সরকার বেআইনি ঘোষণা করে। অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হলেন। কিন্তু কমিউনিস্টরা গোপনে পার্টি গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
কারাদণ্ডের পর কানপুর জেল থেকে তাঁকে ও অন্যান্যদের পাঠানো হয় নৈনি সেন্ট্রাল জেলে।পরে তাঁকে বাংলার বিভিন্ন জেলে আটকে রাখা হয়। কারাদণ্ড শেষ হলে ফরিদপুর জেল থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন। মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে বঙ্গীয় ফৌজদারি আইনে গ্রেফতার করে জন্মভূমি সন্দ্বীপে অন্তরীণ রাখা হয়।কয়েক মাস পর মেদিনীপুরের সুতাহাটা থানায় তাঁকে অন্তরীণ রাখা হয়।১৯৩৭ সালের প্রথম দিকে তিনি মুক্তিলাভ করেন।সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কাজ সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেন।সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী বন্দীদের মুক্তি ও আন্দামানে নির্বাসিত বন্দীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দাবিতে আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশ নেন।১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বাংলায় পার্টির প্রাদেশিক কমিটিতে তিনি নেতৃত্ব দেন। অন্যান্য প্রদেশে, নেপাল ও বার্মায়ও কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে তিনি প্রত্যক্ষ সহায়তা করেন। এই সময়েও গোয়েন্দা পুলিশ তার গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখতো।
কৃষকদের মধ্যেও নবজাগরণ দেখা যায় এই সময়ে। জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদী সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকরা বিভিন্ন জায়গায় সংগ্রাম করছেন- সারা ভারত কিষান সভা গঠনেও তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করেন। তিনি এর সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৩৯ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হলে এদিকে ভারতে ব্রিটিশ সরকারও স্বাধীনতা আন্দোলন ও শ্রমিকশ্রেণীর ওপর দমননীতি প্রয়োগ করে। কমিউনিস্ট নেতাদের নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করে। ভারত রক্ষা আইনে পুলিশ ১৯৪০ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাথে থেকে মুজফফর আহমদকে বহিষ্কারের আদেশ দেয়। তা অমান্য করলে তিনি গ্রেপ্তার হন। একমাস পর ছাড়া পেলে তাঁর ওপর আবার বহিষ্কারের আদেশ জারি হয়। কিছুদিনের জন্য নবদ্বীপ থেকে তিনি আত্মগোপনে যান। যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থার মধ্যে পুলিশের দৃষ্টি এড়িয়ে সমস্ত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে তিনি পার্টির কাজ করে যান। গোপনে কাজ করার সময় তিনি “কাকাবাবু” নামে পরিচিত ছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান ভারতের দিকে যখন অগ্রসর হচ্ছিল, তখন হাজার হাজার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দেশপ্রেমিক বন্দী জেলে আটক ছিলেন। যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের যোগদানের ফলে যুদ্ধের প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়।১৯৪২ সালের জুনে কমিউনিস্ট নেতারা মুক্তি পেতে শুরু করেন, কমিউনিস্ট পার্টির ওপর নিষেধাজ্ঞা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়।১৯৪৩ সালেবোম্বাইয়ে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস হয়। তিনি তাতে যোগ দেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও হন। ১৯৪৫ সালে সারা ভারত কিষান সভার নেত্রকোনা সম্মেলনেও তিনি যোগ দেন এবং সংগঠনের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। চল্লিশের দশকে দমননীতির বিরুদ্ধে, দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকের বিরাট বিরাট আন্দোলনে, বন্দি মুক্তির আন্দোলনে কাকাবাবু বিরাট ভূমিকা নেন।
১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট দেশকে দ্বিখন্ডিত করে ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করে।১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়। কয়েকদিনের মধ্যে কংগ্রেস সরকার সারা ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে, পার্টি বেআইনি ঘোষিত হয়।শত শত নেতা ও কর্মী গ্রেপ্তার হন, পুলিশের গুলিতেও অনেকের মৃত্যু হয়। কাকাবাবুও গ্রেফতার হয়ে ছয়মাস জেলে কাটান। মুক্তির দুইমাস পর আবার গ্রেফতার হন।দমদম জেলে কমিউনিস্ট বন্দিরা সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে দীর্ঘকাল অনশন-ধর্মঘট করেন এই বয়সেও অসুস্থ কাকাবাবু তাতে অংশ নেন।১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি নিবর্তনমূলক আইনে আটক ছিলেন। প্রচণ্ড অত্যাচারে পার্টি খানিকটা দুর্বল হয়। তাছাড়া ভুলভ্রান্তি ও শিথিল আন্তঃপার্টি সংগ্রাম পার্টির দুর্বলতার আরেকটি কারণ। কিন্তু এই সময়ে তা সত্ত্বেও বিরাট বিরাট বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম হয়েছে, যেমন তারমধ্যে তেভাগা আন্দোলন, তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য। দুর্বলতা কাটিয়ে ১৯৫১ সালের সম্মেলনে পার্টি নতুন রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ করে।এই সম্মেলনে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিতে ও পলিট ব্যুরোতে নির্বাচিত হন।
১৯৫২ সালে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করেন। জেল থেকে তাঁর মুক্তির কিছু আগে ‘স্বাধীনতা’ পুনঃপ্রকাশিত হয়। ‘স্বাধীনতা’র নিজস্ব মেশিন ও ‘গণশক্তি’ প্রেস গঠনের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। ১৯৫১- ৫২ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৩ ও ১৯৫৬ সালে পার্টির মাদুরাই ও পালঘাট কংগ্রেস কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি যোগদান করেন। ১৯৫৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির অমৃতসর বিশেষ অধিবেশনে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬০ সালে নব পর্যায়ে আট পৃষ্টার ‘স্বাধীনতা’ প্রকাশের জন্য তিনি প্রাণান্ত পরিশ্রম করেন। ১৯৫৭ ও ১৯৬২ সালের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি পার্টির কাজ খুঁটিনাটি দেখতেন। ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন পরিচালনায়ও তিনি নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন।
১৯ ৬১ সালে বিজওয়াদা কংগ্রেসে, ১৯৬৮ সালে কোচিন কংগ্রেসে তিনি যোগ দেন। ১৯৭২ সালে মাদুরাইতে নবম কংগ্রেসে তিনি যোগদান করতে পারেননি।
১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধের সময় তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৬৩ সালে দমদম জেল থেকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অপারেশনের জন্য তিনি স্থানান্তরিত হন। হাসপাতাল থেকে তাঁকে মুক্তি দেবার আদেশ আসে। ১৯৬৪ সালের প্রথমে পার্টির জাতীয় পরিষদ থেকে ৩১ জনের সঙ্গে তিনিও বেরিয়ে আসেন এবং সংশোধনবাদীদের বর্জন করার জন্য পার্টি সভ্যদের কাছে আবেদন করেন।
১৯৬৪ সালে পার্টি কংগ্রেসের প্রাক্কালে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন। জেলে থাকার সময় অসুস্থতা ও নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে তিনি ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ বইটি রচনা করেন এবং দমদম জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় সেটি প্রকাশিত হয়। ১৯৬৬ সালে তিনি মুক্তি পান।
অসুস্থতার কারণে দৈনন্দিন সাংগঠনিক কাজে নিয়মিত সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব ছিল না। তিনি লেখার মধ্যেই নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে তাঁর ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রকাশিত হয়। এর ইংরাজি অনুবাদও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯৬৮ সালে সিপিআই(এম) -র বর্ধমান প্লেনাম ও বড়শুলে কৃষক সম্মেলনে অংশ নেন।
১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠার সময় ব্রিগেডের জনসমাবেশেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার কাজী নজরুল ইসলামকে রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গনে যে বিরাট সংবর্ধনা দেন, মুজফফর আহমদ সেখানেও উপস্থিত ছিলেন।
‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’-র দ্বিতীয় খণ্ডের জন্য লেখা তিনি শুরু করেন। কিন্তু স্বাস্থ্যের কারণে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। লেকপ্লেসে থাকার সময় একতলায় তাঁর ঘরের ওপর বোমা ছোঁড়ে কংগ্রেস ও নকশালপন্থীরা । ১৯৭১ সালে তিনি বাংলাদেশে যান। ঢাকায় তাঁর মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। আগেই তাঁর স্ত্রী মারা যান। সেখানে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা জানান।
তাঁর শরীর দ্রুত ভেঙে পড়তে থাকে। ১৯৭৩ সালের ১৮ ই ডিসেম্বর কিম্বার নার্সিং হোমে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
১৯১৯-২০ সালে সাহিত্য ও রাজনীতি মিলিয়ে তিনি সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যে জীবন শুরু করেছেন, একটানা ৫৩ বছর রাজনৈতিক জীবনে তা আত্মত্যাগ ও অবদানে ক্রমভাস্বর হয়ে ওঠে। প্রচন্ড আর্থিক অনটন, অর্ধাহার, অনাহারের মধ্যে এবং মতাদর্শগত সংগ্রামে মার্কসবাদ – লেনিনবাদের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা , মানুষ ও কর্মীদের প্রতি গভীর মমত্ববোধ , দেশের প্রতি ও আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রতি গভীর ভালবাসা , সুলেখক ও সংগঠক হিসেবে তাঁর অবদান তাঁকে ইতিহাসের পাতায় করে তুলেছে মহান। কমরেড মুজফফর আহমদের মৃত্যু নেই। তাঁর আত্মত্যাগ ও অবদান ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।