Site icon CPI(M)

উড়ে গেল গানের পাখি – সোমনাথ ভট্টাচার্য…

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ (মঙ্গলবার)


সুরলোকে আঁধার নামিয়ে চলে গেলেন সংগীত সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকার। এখন থেকে লতাহীন হল সংগীত জগত। কিন্তু লতা মঙ্গেশকররা তো চলে যান না, তাঁরা থেকে যান অগুনতি মানুষের হৃদয়ে। তাঁর গানের মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মধ্যে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। লতা মঙ্গেশকর সম্পর্কে বিংশ শতাব্দীর তানসেন উস্তাদ বড়ে গুলাম আলিখান বলতেন, “ লতা আল্লার এক আশ্চর্য সৃষ্টি।” সংগীত পরিচালক অনিল বিশ্বাসের মতে, “সঙ্গীত পরিচালকদের কাছে লতা ঈশ্বরের দূত। ” ঈশ্বর আর আল্লা দুইজনকেই মিলিয়ে দিয়ে ছিল তার গান। এটাই লতা মঙ্গেশকর। ইলিয়ারাজা বলেছিলেন, “অতি ব্যবহারে সব কিছু জীর্ণ হয়, শুধু লতার গান ছাড়া।” লতা মঙ্গেশকর রইলেন না কিন্তু তাঁর গান রইল আমাদের কাছে। একের পর এক অসামান্য গান কোটিকোটি মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবে আরো বহু বহু কাল।


আনন্দে-বিষাদে, প্রেমে-বিরহে, ভজনে-সাধনে, দেশাত্মবোধে-সাম্যের আহবানে তাঁর গাওয়া সেই সব গান আমাদের কাছে বার বার তাঁকে জীবন্ত করে তুলবে। উপনিষদের সেই কথা, “মৃত্যোর্মা অমৃতংগময়”। অর্থাৎ মৃত্যুর পরেও তিনি অমর হয়ে বেঁচে থাকবেন মানুষের মনের মনি কোঠায়।


কাউকে ছোট না করেও বলা যায় অনেক সিনেমার নাম মানুষ ভুলে গেছেন, ভুলে গেছেন নায়ক-নায়িকার নাম কিন্তু লতার গাওয়া গানটি এখনো স্মৃতিতে উজ্জল। রাগ রাগিণীর ওপর অসামান্য দখল নিয়ে গেয়ে গেছেন একের পর এক ফিল্মের গান। দক্ষ সুরকারের সৃষ্টিতে সেই সব গানও প্রভাবিত করেছে ধ্রুপদী সংগীতের দিকপালদের। এইতো কিছু দিন আগে ভাইরাল হলো একটি ভিডিও। যেখানে উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ এবং ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ তাদের যুগল বন্দী থামিয়ে গলায় সুর ধরেছেন লতার গাওয়া “মোহে পনঘট পে নন্দলালা। মুঘল-ই-আজম ছবির গান। গারারাগে, নৌশাদেরসুর।
সি রামচন্দ্রের সুরে আনার কলির “ইয়ে জিন্দেগি উসিকি হ্যায়”, মদন মোহনের সুরে “লাগ যা গলে” কত দশক আগে গাওয়া কেউ ভাবে না, শুনলে মনে হয় গত কাল গাওয়া হয়েছে। শংকর জয়কিষণ থেকে লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলাল, শচীনদেব বর্মণ থেকে সলিল চৌধুরী, হেমন্ত কুমার থেকে আর ডি বর্মন, রবীন্দ্র জৈন থেকে হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের সুর নিজের গলায় ধারণ করে রেখে গেছেন অসামান্য সব গান।


গাইড-র “কাঁটো সে খিঁচকে ইয়ে আঁচল”, মধুমতি-র “আজারে” আশা-র “শিসা হো ইয়া দিলহো”, আঁধি-র “রয়না বীতি যায়”, রাম তেরি গঙ্গা মৈলি-র “এক রাধা এক মীরা” এ সব গান ভোলা অত্যন্ত কঠিন কাজ। মেহেবুবা-ররেকর্ডিংয়ের আগে কিশোর কুমার তো সুরকার রাহুলদেব বর্মনকে সাফ জানিয়ে দিলেন শিবরঞ্জনী রাগের সুরে “মেরে নয়না শাওন ভাদো” আগেল তাকে দিয়ে রেকর্ড করাও তার পর সেটা শুনে আমি রেকর্ড করবো।
বাংলাতেও লতার অসাধারণ সব গান রয়েছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সলিলচৌধুরীর সঙ্গেই সব চেয়ে বেশি কাজ। যদিও তাঁর প্রথম বাংলা বেসিক গান পবিত্র মিত্র-র কথা ও সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে “আকাশ প্রদীপ জ্বলে” ১৯৫৬তে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও ভূপেন হাজারিকা, সুধীন দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষ, অপরেশ লাহিড়ী প্রমুখের সুরেও তার বেশ কিছু কাজ আছে। বাংলা গানের কথা লিখেছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারেরা। সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে সৃষ্ট গানগুলো বাংলা সংগীত জগতে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। ১৯৫৯ সালে সলিল সৃষ্টিতে প্রথম গান “না যেও না” খাম্বাজ ও কলাবতী রাগে একমাইল স্টোন হয়ে রয়ে গেছে। এই রেকর্ডেরই অপর পিঠেছিল, “যারে উড়ে যারে পাখি”। এরপর সাত ভাই চম্পা, ও বাঁশি কেন হায় কি যে করি, আজ নয় গুন গুন, আজ তবে এই টুকু থাক একের পর এক প্রাণ ছুঁয়ে যাওয়া গান।


এই গানে ইতি নিহত ভাগ্য মানুষের জন্য প্রশ্ন তুলেছেন,
“কার ঘরে প্রদীপ জ্বলেনি
কার বাছার অন্ন মেলেনি
কার নেই আশ্রয় এবর্ষায় ?”
তাঁর এই গানের মধ্য দিয়েই আহ্বান জানিয়েছেন আপনার আমার উদ্দেশ্যে,
“কাঁধে আজ তার ভার তুলে নাও।”
তিনি প্রাণ উজাড় করে গাইলেন,
“এবার আমি আমার থেকে
নিজেকে বাদ দিয়ে ……
ভুবনটারে আপন করে নিলাম।”
হে সুরের সম্রাজ্ঞি, একদিন আপনি গেয়েছিলেন,
“কি যে করি দূরে যেতে হয় তাই।”
আজ আমরা আপনার সেই গানেরই রেশ ধরে বলি, “সুরে সুরে কাছে পেতে চাই।”
আপনি গেয়েছিলেন,
“যারে উড়ে যারেপাখি।” আর আজ আপনিই গানের পাখি, সংগীতের নাইটিঙ্গেল আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আপনি চলে গেলেন কিন্তু থেকে গেল আপনার গান। যা আমাদের সম্পদ। আমাদের প্রাণের ধন। আমাদের অহংকার।


আপনার গানের কথাতেই আপনাকে প্রণতি জানিয়ে বলি,
“ওগো আর কিছুতো নাই
বিদায় নেবার আগে তাই,
তোমারই নয়নে পাওয়া,
তোমারই সুরে গাওয়া
এগান খানি রেখে যাই।।

শেয়ার করুন