Site icon CPI(M)

সাক্ষী ইতিহাস, পেরু জাগছে – শান্তনু দে

৯ জুন ২০২১ (বুধবার)


এক ঐতিহাসিক মুহূর্তর সাক্ষী পেরু।

নিও লিবারেল মিডিয়ার তুমুল কুৎসা প্রচারকে পরাস্ত করে পেরুর ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু করতে চলেছেন হতদরিদ্র নিরক্ষর কৃষক পরিবারের সন্তান পেদ্রো ক্যাসিলো।

ভারতীয় সময় বিকেল ৫ টা ৩৫ মিনিট। গণনার সর্বশেষ তথ্য দিয়ে পেরুর নির্বাচন কমিশন জানাচ্ছে ৯৯.৭৯ শতাংশ ভোট গণনার শেষে ফ্রি পেরু’র প্রার্থী ক্যাসিলোর ভোটের হার ৫০.২০ শতাংশ। প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণপন্থী প্রার্থী কেইকো ফুজিমোরি কেইকোর ৪৯.৭৯ শতাংশ। সংখ্যার হিসেবে ৭১,৭৬৪ ভোটে এগিয়ে ক্যাসিলো। সরকারিভাবে এখনও ঘোষণা করা না হলেও নিশ্চিত জয়ের পথে বামপন্থী প্রার্থী।

পেরুর সংবাদপত্রগুলির ৮০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ যে মিডিয়া টাইকুনের হাতে— সেই ‘গ্রুপো এল কমার্সিও’ ছিল ক্যাসিলোর ঘোর বিরোধী। মাওবাদী ‘শাইনিং পথের’ সঙ্গে ক্যাসিলোর ‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’ প্রমানে দিনরাত ছিল ব্যস্ত। শাইনিং পথ মানে বর্বরতার চরম নিদর্শন। যা নিয়ে পেরুর নোবেল জয়ী সাহিত্যিক মারিও ভার্গাস ইয়োসা লিখেছেন সাড়া জাগানো বই ‘ডেথ ইন আন্দিজ’। যৌবনে ফিদেল ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা। ছিলেন মার্কেজের বন্ধু। পরে নয়া উদারবাদের কট্টর সমর্থক। ১৯৯০, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কেইকোর বাবা আলবার্তো ফুজিমোরির সঙ্গে যখন প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, তখন তিনি নয়া উদারবাদের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন। চান ‘আন্দিজে থ্যাচারবাদ’

শুধু পেরুতে নয়, এমনকি ব্রিটিশ দ্য টেলিগ্রাফে পর্যন্ত ক্যাসিলোকে নিয়ে শিরোনাম: ‘মার্কসবাদী শাইনিং পথ গেরিলার প্রত্যাবর্তন’ পেরুতে। যদিও নির্বাচনের প্রচারে ক্যাসিলো বারংবার অস্বীকার করেছেন শাইনিং পথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা। অন্যদিকে ভোটের মুখে রয়টার্সের শিরোনাম, ‘নয়া উদারবাদ না মার্কসবাদ?’ যে মারিও ভার্গাস বরাবর ছিলেন ফুজিমোরি-বিরোধী, সেই তিনি নিজের তিন-দশকের অবস্থান থেকে সরে এসে বলেন, ‘গণতন্ত্রকে বাঁচানোর একমাত্র পথ’ হলো কেইকোর জন্য ভোট দেওয়া। তাঁর ছেলে আলভারো ভার্গাস বলেন, ‘আজ আমরা গুরুতর হুমকির মুখে। কমিউনিজমের বিরুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে।’ গণনার শেষ দিকে দ্য ইকনমিস্টে অসহায় আর্তনাদ: পেরুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে একজন ‘কট্টর বামপন্থী’! পেরুর রাস্তার বিলবোর্ডে ছড়ানো হয়েছিল আতঙ্ক। ক্যাসিলোকে জিতিয়ে আপনারা কি ‘পেরুকে ভেনেজুয়েলা, কিউবা করতে চান!’ ‘কমিউনিজম মানে দারিদ্র!’

গত তিনবছরে পেরু দেখেছে চার-চারজন রাষ্ট্রপতি। দুর্নীতি, উৎকোচ নেওয়ার দায়ে একের পর এক পদত্যাগ।

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মার্তেগুইপন্থী দলের সদস্য, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক, জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ক্যাসিলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান ২০১৭’র শিক্ষক ধর্মঘট থেকে। তাঁর মুখ্য স্লোগান: ‘ধনী দেশে থাকবে না একজনও গরির মানুষ।’ চিলির মতোই নতুন সংবিধান লিখতে গঠন করা হবে নির্বাচিত গণপরিষদ। ক্যাসিলো বলেছেন, সংসদ যদি একান্তই গণপরিষদ না করে, তবে তিনি তা ভেঙে দেবেন।

ক্যাসিলোর দল ফ্রি পেরু ইউএসএইড-কে বহিষ্কারের ডাক দিয়েছে। একইসঙ্গে মার্কিন সেনাঘাঁটির ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেছে। ওয়াশিংটনের মদতপুষ্ট অর্গনাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটসের পালটা সেলাক, ইউনাসুরকে শক্তিশালী করার কথা বলেছে। সেইসঙ্গেই বলেছে স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রের জাতীয়করণের কথা।



২০২০, পেরুর জিডিপি পড়েছে ১১.১ শতাংশ। শেষ ৩০-বছরে সবচেয়ে শোচনীয় মন্দার মুখে দেশ। একরত্তি দেশে কাজ হারান ২০ লক্ষ মানুষ। বেকারত্বের হার দ্বিগুণ বেড়ে ১৪.৫ শতাংশ। যদিও, এটি শুধুই সংগঠিত ক্ষেত্রের হিসেব, যে দেশে শ্রমশক্তির ৭০ শতাংশই চুক্তির বাইরে। দারিদ্রের হার ২০১৯ থেকে ৬ শতাংশ বেড়ে ২৭.৫ শতাংশ।
ক্যাসিলোর ফ্রি পেরু চায় মোরালেসের বলিভিয়া, রাফায়েল কোরিয়ার ইকুয়েদরের মতোই প্রাকৃতিক সম্পদের জাতীয়করণ।



যাবতীয় কুৎসা প্রচারকে পরাস্ত করে শেষে জয়ের পথে ক্যাসিলো। গণনাকে ঘিরে টানটান উত্তেজনা। শুরুতে এগিয়ে ছিলেন কেইকো। কিন্তু শহর শেষে গ্রামে গণনা শুরু হতেই অন্য ছবি। রবিবার মধ্যরাতে, যখন ৪২ শতাংশ গণনা হয়েছে, তখনও ৬ শতাংশ ভোটে এগিয়ে ছিলেন কেইকো। তারপরেই কমতে থাকে ক্যাসিলোর সঙ্গে ব্যবধান। একসময় সমান-সমান। রূদ্বশ্বাস উত্তেজনার মধ্যে শেষে ফুজিমোরিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যান ক্যাসিলো। রাজধানী লিমা-সহ বেশকিছু শহরে এগিয়ে ছিলেন কেইকো। যেমন লিমায় ভোট পান ৬৫.৬ শতাংশ। অভিজাত প্রধান সান ইসিদ্রো জেলায় ৮৮ শতাংশ। ভোট গণনা শহর ছেড়ে গ্রামে, আন্দিজের প্রত্যন্ত প্রান্তে শুরু হতেই বদলে যায় সেই ছবি। গরির প্রান্তিক মানুষের বিপুল ভোট পেতে শুরু করেন হতদরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান, গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ক্যাসিলো। কোনও কোনও অঞ্চলে তিনি পান ৮০ শতাংশের বেশি ভোট। যেমন দেশের হতদরিদ্র উচুরাক্কে জেলায় পান ৮৭ শতাংশ ভোট। বামপন্থী প্রার্থীর জন্য যা স্বাভাবিক।

কেইকো যথারীতি নির্বাচনে ‘অনিয়ম’, ‘জালিয়াতির’ অভিযোগ তুলেছেন। স্বাভাবিক। ২০১৬-তে, ৪০ হাজার ভোটে হেরে গিয়ে একই অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। কোনও প্রমান ছাড়া সেবারও দাবি করেছিলেন নির্বাচনে ‘জালিয়াতি’ হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা আগের মতো এবারেও কেইকোর দাবি খারিজ করে দিয়েছেন।



জবাবে ক্যাসিলো ‘জনাদেশকে রক্ষার’ ডাক দিয়ে বলেন, ‘নাগরিকদের নজরদারিই রক্ষা করতে পারে গণতন্ত্রকে। একমাত্র মানুষই পারে মানুষকে রক্ষা করতে।’

মেক্সিকোর বামপন্থী দৈনিক লা জর্নাদা’র উত্তর-সম্পাদকীয় পাতায় এদিনের নিবন্ধ: ‘পেরু জেগে উঠছে, মৃতপ্রায় ভার্গাস ইয়োসা।’

Spread the word